আবহমান বাংলার শিশুতোষ ক্রীড়া কৌতুকের মধ্যে কানামাছি ভোঁ ভোঁ, গোল্লাছুট এবং পলাপলি বা পালাপালি খেলা যেমন জনপ্রিয় তেমনি বাঙালির আদি ও আসলরূপে বেড়ে ওঠার জন্য এই তিনটি খেলা অতীব জরুরি এবং গুরুত্বপূর্ণ। যারা এসব ক্রীড়া কৌতুকে শৈশব থেকেই দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা লাভ করতে পারে তারা পরবর্তীকালে সমাজের তাপ-চাপ, কুটচাল এবং প্রতিযোগিতার দৌড়ে টিকে থাকতে পারে।
আমার শৈশবে আমি কোনো খেলাতেই পারদর্শী ছিলাম না। ফলে কোনো খেলায় অংশগ্রহণ করার চেয়ে খেলা দেখতেই আমার ভালো লাগত। মাঝেমধ্যে ফুটবল খেলায় খেলোয়াড়ের অভাব হলে আমাকে জোর করে কয়েকবার মাঠে নামানো হয়েছিল এবং গোলকিপারের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল কিন্তু ফুটবল দেখলে আমার এত ভয় হতো যে প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়রা বল নিয়ে গোলপোস্টের কাছে এলেই আমার বুক ধড়ফড় করত এবং আমি ভয়ে জড়োসড় হয়ে পড়তাম। আমার দলের খেলোয়াড়রা দল বেঁধে এসে আমাকে উদ্ধার করতেন। কানামাছি ভোঁ ভোঁ খেলার ক্ষেত্রে আমি প্রায়ই একটি কর্ম করতাম। যার চোখ বেঁধে বউ বানানো হতো তার জন্য আমার খুব মায়া হতো। সবাই এসে তাকে খোঁচা দিত আর সে অসহায়ের মতো চোখ বাঁধা অবস্থায় তাদের ধরতে চাইত। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ব্যর্থ হতো। এ অবস্থায় তাকে জিতিয়ে দেওয়ার জন্য আমি স্বেচ্ছায় ধরা দিতাম এবং পরিণতিতে আমার চোখ বেঁধে দুষ্টরা দলবেঁধে আমাকে খোঁচাত।
অন্যকে জিতিয়ে দিয়ে নিজে হেরে যাওয়ার খেলায় আমি যে পারদর্শিতা অর্জন করেছি, তা এখনো অব্যাহত। কানামাছির মতো পলাপলি, গোল্লাছুট ইত্যাদি খেলায় আমার বেহাল সম্ভবত আমার বংশগত ঐতিহ্য, আমার আব্বার দশাও একই রকম ছিল। আমার সাতটি ভাই মাশাল্লাহ জীবনের অনেক ক্ষেত্রে সফল হলেও আমার মতোই শিশুতোষ খেলায় ভীষণ আনাড়ি ছিল। আমার এক ভাই শৈশবে অনুরোধে ফুটবল খেলতে নেমে কী যে কাণ্ড করল যা স্মরণ করলে আজও হতভম্ব হয়ে যাই। সে খুব ভাব নিয়ে অন্য সব পাকা খেলোয়াড়ের মতো হেড করতে গেল। কিন্তু দুষ্ট বল তার মাথায় না পড়ে ডাইরেক্ট চোখের ওপর এসে পড়ল। ভাইটি আমার চিৎকার দিয়ে চিৎপটাং হলো। চোখ ফুলে ঢোল হয়ে গেল। পরে ঢাকায় এনে বহু দিন চিকিৎসা করে চোখের জ্যোতি ফিরিয়ে আনা হলো।
আমার পূর্বেকার বংশধরদের চেয়ে আমার পরবর্তী বংশধররা খেলাধুলায় বাবা, চাচা, দাদার অদক্ষতাকে এক নতুন মাত্রা দিয়েছে। আমার বেগম সাহেবা এবং তার বংশের লোকজনের ইতিহাস অবশ্য আমার পরিবারের ইতিহাসের ঠিক উল্টো। ফলে তিনি চাইতেন, আমাদের ছেলেমেয়েরা স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় পুরস্কার লাভ করুক। কিন্তু প্রতিযোগিতা-তা সে দৌড় কিংবা মোরগযুদ্ধ যা-ই হোক না কেন সে ক্ষেত্রে আমার ছেলেমেয়ে প্রথম ধাক্কায় কুপোকাত। ছেলেমেয়েরা যতই বলত, তাদের কী দোষ! পেছন থেকে দুষ্ট ছেলেমেয়ে এসে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলে তারা কী করতে পারত। ছেলেমেয়েদের কথায় বেগম সাহেবার মেজাজ সর্বোচ্চ পর্যায় পৌঁছাত এবং ভাবিদের সামনে বীর পুত্র-কন্যার ক্রীড়া নৈপুণ্যের বেহালের জন্য আমার বংশীয় ঐতিহ্যের নিকুচি করে মনের ঝাল মেটাত।
উল্লিখিত বংশমর্যাদা নিয়ে যখন রাজনীতিতে এলাম তখন প্রাথমিক সফলতা যে কীভাবে এলো, তা টেরই পেলাম না। কিন্তু সফলতাকে কাজে লাগান এবং উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধির জন্য যে দম লাগে, কৌশল লাগে এবং চালাকির প্রয়োজন হয় তা আমার রক্তে না থাকার জন্য মানসম্মান থাকতেই আমি রাজনীতির খেলোয়াড় না হয়ে দর্শক হওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি সেই ২০১৪ সাল থেকে। মাঝে অবশ্য দুইবার অর্থাৎ একবার ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচন এবং ২০১৮ সালের রাতের ভোটের নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলাম অনুরোধে ঢেঁকি গেলার সূত্রের কবলে পড়ে এবং উভয় ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক শিক্ষা পাওয়ার পর আমি আবার দর্শকের সারিতে বসে রাজনীতির শিশুতোষ ক্রীড়া কৌতুক উপভোগ করে যাচ্ছি।
চলমান রাজনীতিতে যা কিছু হচ্ছে, তা বর্ণনা করার জন্য উল্লিখিত লম্বা ভূমিকা টানলাম এ কারণে যে সম্মানিত পাঠক যেন বুঝতে পারেন যে আমি সত্যিকার অর্থেই একজন বোদ্ধা দর্শক যার কি না, খেলার মাঠের বাস্তব রূপ হৃদয়-মন শরীর দিয়ে উপভোগ করার সুযোগ হয়েছে এবং বংশগত অপারগতার কারণে রাজনীতির ক্রীড়া কৌতুকের ব্যাপারে দর্শক হিসেবেই নিজেকে যোগ্য মনে হয়েছে। ২০০১ সাল থেকে জাতীয় রাজনীতির মাঠে রয়েছি। তার আগে দলীয় রাজনীতি এবং ছাত্ররাজনীতির প্রতিটি পর্বে পদপদবির জন্য ছুটিনি। কারণ ওখানে সফল হতে হলে কানামাছি, পলাপলি বা গোল্লাছুট খেলায় সফলতার কৌশল-দৌড়াদৌড়ি করার দম এবং অন্যকে খোঁচা দিয়ে দ্রুত সরে পড়া অথবা চোখ বাঁধা অবস্থায় কাউকে পাকড়াও করার যে দুর্বার শক্তির প্রয়োজন হয়, তা আমার ক্ষেত্র বিশেষে যেমন ছিল না। আবার ক্ষেত্রবিশেষে আমার প্রতিদ্বন্দ্বীদের অসহায়ত্ব, বিজয়ী হওয়ার লোভ এবং প্রতিযোগিতা করার অযোগ্যতা দেখে করুণা হয়েছে। ফলে অনেক ক্ষেত্রে অনেককে বিজয়ী করে স্বেচ্ছায় পরাজয়ের মালা গলায় ধারণ করে দর্শক সারিতে বসে মনের আনন্দে তালি বাজিয়েছি।
২০২৪ সালের আগস্ট মাসের ৫ তারিখ পর্যন্ত কানামাছি, পলাপলি এবং গোল্লাছুটের রাজনীতি দেখে চমকিত হয়েছি। তিন তিনটি কানামাছির নির্বাচন পলাপলির ভোটের ফল এবং দুই নম্বরি ক্ষমতার গোল্লাছুটের দাপাদাপি দমনপীড়ন এবং দম্ভ দেখে হতভম্ব হয়েছি। মজলুমের আর্তচিৎকার এবং জালিমের হুঙ্কারের মধ্যে প্রকৃতির বিচারের আশায় বারবার আকুল নেত্রে আকাশের পানে তাকিয়েছি- ধর্মালয় দেবালয় তীর্থস্থানের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা বাড়িয়েছি। রাজনীতির ইতিহাস পাঠ করেছি এবং ছলচাতুরী, লোক ঠকানো মোনাফেকি অথবা প্রতারণার রাজনীতির হাজার বছরের নির্মম পরিণতি জেনেছি এবং পরম আশায় বুক বেঁধে প্রহর গুনেছি একটি সুন্দর সকালের। ফলে ২০২৪ সালের আগস্ট মাসের ৫ তারিখের দুপুরবেলার ঘটনা দেখে যে উল্লাস অনুভব করেছি তা আমার জীবনে অতীতে কখনো ঘটেনি।
সাবেক সরকারের পতনের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে যখন হুঁশ ফিরে পেয়েছি এবং রাজনীতির দর্শক হিসেবে অতীতের অভিজ্ঞতার আলোকে পরিস্থিতি মূল্যায়নের চেষ্টা করেছি তখন আতঙ্কে যেভাবে দিশাহারা হয়েছি তা জ্যামেতিক হারে গত ১১ মাসে বেড়েই চলেছে। শেখ হাসিনার হেলিকপ্টারে প্রকাশ্য দিবালোকে ভারত গমন কী পলায়ন নাকি পশ্চাৎপসরণ তা নিয়ে যেভাবে ক্রমাগত বিতর্ক হচ্ছে তদ্রুপ জুলাই-আগস্ট ঘটনাপুঞ্জি কি বিপ্লব নাকি গণ অভ্যুত্থান তা নিয়ে আমরা এখনো সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি। তারপর যে বিতর্কগুলো আমাদের আতঙ্কের মধ্যে ফেলেছে সেগুলো হলো শেখ হাসিনার পদত্যাগ-পদত্যাগপত্র, ইউনূস সরকারের শপথ, বৈধতার ভিত্তি এবং সরকারের শ্রেণি চরিত্র, মেয়াদ ইত্যাদি।
গত ১১ মাসে সরকার যা করেছে সেগুলো আমরা জানি না কিন্তু যা করার চেষ্টা করছে তা আমাদের ঘুম হারাম করে দিয়েছে। সংস্কার কমিশন, ঐকমত্য কমিশন, নিরাপত্তা উপদেষ্টা নিয়োগ, চট্টগ্রাম বন্দর বিদেশিদের দিয়ে পরিচালনার প্রস্তাব, নারী-নীতি, জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের অফিস স্থাপন ইত্যাদি ঘটনা পুরো দেশকে ক্রমশ গরম করে তুলছে। প্রায় অর্ধশত কিংস পার্টি বা রাজকীয় অথবা রাজার দলের আবির্ভাব-কতিপয় রাজার দলের রাজকীয় চালচলন, সরকারের ছায়াসঙ্গীদের দাপট, অনেক ক্ষেত্রে দুর্নীতি, অনিয়ম, চাঁদাবাজির তাণ্ডব, রাজনৈতিক সংঘাত, খুন খারাবি, রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ বিরোধ এবং এক দলের সঙ্গে অন্য দলের যুদ্ধাবস্থার মধ্যে মার্চ টু গোপালগঞ্জের ঘটনা দেশের মানুষের মনে শঙ্কা ও উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।
মব সন্ত্রাস বিশ্ব রেকর্ড তৈরি করেছে। বিচারহীনতা, অবিচার-অনাচার এবং সাধারণ মানুষের জানমালের নিরাপত্তাহীনতার কারণে জনজীবনের সাধারণ কোলাহল থেমে গেছে। মানুষের কাজ করার ক্ষমতা, চিন্তার ক্ষমতা ও স্বপ্ন দেখার ক্ষমতা রসাতলে গেছে। শ্রমের বাজারে হাহাকার শুরু হয়েছে। বেকারত্ব চরমে। শিল্প কলকারখানার চাকা ক্রমাগত বন্ধ হচ্ছে। অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়েছে এবং কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগ উল্টো পথে চলছে। সরকারির রাজস্ব আদায় নেতিবাচক। রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন কর্ম বা পাবলিক ওয়ার্কস স্বাধীনতার পর সব নিম্নস্তরে নেমে গেছে। ফলে চলতি অর্থবছরে জিডিপির হার ৩ দশমিক ৫০ পার্সেন্টের নিচে নামার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
আমদানি হ্রাস পেয়েছে, ব্যবসাবাণিজ্য সংকুচিত হচ্ছে এবং দেশ থেকে ধনিক শ্রেণি এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণি বিলুপ্ত হতে চলেছে। রাস্তাঘাটে চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। গত বছর জুলাই-আগস্টে লুট হওয়া অনেক আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা যায়নি। ফলে মহলবিশেষ থেকে যখন যুদ্ধের হুমকি আসছে তখন মানুষের প্রাণ ওষ্ঠাগত হওয়ার উপক্রম হচ্ছে। সমাজ ও রাষ্ট্রে হররোজ এমন শব্দ হচ্ছে যা শ্রবণ করার চেয়ে বিষপানকে নিরাপদ মনে হচ্ছে। জনপদে এমন সব প্রাণীর পদচারণা এবং এমন সব প্রাণীর চেহারাসুরত দেখতে হচ্ছে যা মানুষের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে দিচ্ছে। রাজনীতির নামে যে ধোঁকাবাজি চলছে এবং ক্ষমতার লোভে কিছু প্রাণী যে উন্মত্ততা দেখাচ্ছে তার ফলে স্বৈরাচারী এরশাদ জমানায় লেখা কবি রফিকুল্লাহর ‘সব শালা কবি হতে চায়’ কবিতার নিম্নোক্ত কথাগুলো মনে পড়ে যায়-
‘সব শালা কবি হবে; পিঁপড়ে গো ধরেছে, উড়বেই;
বন থেকে দাঁতাল রাজাসনে বসবেই। ’
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক