ঢাকা, শনিবার, ১৮ শ্রাবণ ১৪৩২, ০২ আগস্ট ২০২৫, ০৭ সফর ১৪৪৭

অন্যান্য

একাত্তরে শ্রেণিমুক্তির মীমাংসা ঘটেনি

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮:৪২, আগস্ট ২, ২০২৫
একাত্তরে শ্রেণিমুক্তির মীমাংসা ঘটেনি সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী 

যুবকরা তো যুদ্ধে গেছেই। উনসত্তরে গেছে, গেছে একাত্তরে।

কিন্তু তারপরে? যুদ্ধটা কী শেষ হয়ে গেছে? যুদ্ধটা তো আসলে ছিল শ্রেণিবৈষম্য ও শ্রেণিশোষণ বিলুপ্ত করার জন্যই। জাতীয় মুক্তি আবশ্যক ছিল সব শ্রেণির মানুষের মুক্তির প্রয়োজনেই। একাত্তরে তো সেই যুদ্ধের, অর্থাৎ শ্রেণিমুক্তির যুদ্ধের, মীমাংসা ঘটেনি। বরং উল্টোটাই দেখা গেল। দেখা গেল শ্রেণিবৈষম্য বৃদ্ধি পেয়েছে। তার অসংখ্য নজিরের মধ্যে একটি পাওয়া যাবে শিক্ষাক্ষেত্রেই। শিক্ষাক্ষেত্রে অনেক ‘সংস্কার’ ঘটেছে, কিন্তু সমাজবিপ্লবের আকাক্সক্ষার ভিতর যে প্রতিশ্রুতির উজ্জ্বল উপস্থিতি ছিল, সেটা হলো মাতৃভাষার মাধ্যমে অভিন্ন ধারার শিক্ষার প্রবর্তন। সেটা ঘটেনি। বরং শিক্ষার ক্ষেত্রে যে তিন ধারার বিভাজন- সাধারণ, ইংরেজি মাধ্যম ও মাদরাসা পাকিস্তান আমলে কিছুটা দুর্বল ও সীমিত আকারে ছিল, বাংলাদেশ আমলে সেই বিভাজনই আরও গভীর ও বিস্তৃত হলো। তিন ধারার ভিত্তি ছিল শ্রেণিবিভাজন; ওই তিন ধারা যে নতুনভাবে শক্তিশালী হয়ে উঠল, তাতে বোঝা গেল বিপ্লব ঘটেনি; বরং উল্টোটাই ঘটে গেছে। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা তরুণরা কেন এগিয়ে এলো না প্রতিবিপ্লবকে প্রতিহত করে সমাজতন্ত্র-অভিমুখী একটি সামাজিক বিপ্লবকে সম্ভব করে তুলতে? বিপ্লবী চেতনার উন্মেষ এবং তার দ্রুত অন্তর্ধানের একটি ছোট্ট কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ দৃষ্টান্ত মুক্তিযুদ্ধের সূচনাতে চট্টগ্রামে প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের নামকরণের ক্ষেত্রে পাওয়া গেছে। শুরুতে নাম ছিল স্বাধীন বাংলা ‘বিপ্লবী’ বেতার কেন্দ্র, কিন্তু সে নাম টেকেনি, নাম থেকে ‘বিপ্লবী’ অভিধাকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। বিপ্লবী আন্দোলনের স্বপ্ন ও বাস্তবতার ব্যবধানটা এভাবেই ঘটেছিল। সেটা যুদ্ধের সময়ে যে অনুপস্থিত ছিল তা নয়, যুদ্ধের পরে প্রকট হয়ে প্রকাশ পেয়েছে।

স্বপ্ন সফল না হওয়ার প্রধান কারণটা কিন্তু নিহিত ছিল একাত্তরের বিজয়ের মধ্যেই। বিজয়ের অর্থটা দাঁড়িয়েছিল হানাদার পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণ। তাদের আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে অর্জিত ওই বিজয়ের পর বিজয়ীদের জন্য কাজ হতে পারত দুটি। একটি হচ্ছে পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদীরা যেমনটা করেছে, যেভাবে লুণ্ঠন ও জবরদখল চালিয়েছে সেই পথেই চলা। অন্যটি হতে পারত সম্পূর্ণ বিপরীত পথে এগোনো, ‘বিজয়’কে আরও সামনের দিকে অর্থাৎ রাষ্ট্র ও সমাজকে সমাজতান্ত্রিক রূপদানের অভিমুখে এগিয়ে নিতে সচেষ্ট থাকা।

প্রথম কাজটি তেমন কঠিন ছিল না, দ্বিতীয় কাজটি ছিল অত্যন্ত দুরূহ। তরুণদের যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন তাদের অনেকের মধ্যেই প্রথম পথে অগ্রসর হওয়ার প্রবণতাটাই প্রধান হয়ে দেখা দিয়েছিল। ফলে তাদের অনুসারীরাও লুণ্ঠন ও জবরদখলে উৎসাহী হয়েছেন। জাতীয়তাবাদীরা মনে করলেন তাঁরাই জিতেছেন, তাই রাষ্ট্রকে তাঁরা নিজেদের সুবিধার্থে যদৃচ্ছা ব্যবহার করবেন। এবং সেটাই তাঁরা করতে থাকলেন।

সমাজতন্ত্রের দিকে যাওয়ার পথটা ছিল কঠিন। রাষ্ট্রক্ষমতা তখন জাতীয়তাবাদীদের হাতে। তারা সমাজতন্ত্রের কথা বলতে ভোলেননি, কিন্তু শেখ মুজিব যে নিজেদের দেশীয় সমাজতন্ত্রের কথা বলেছিলেন, তাতেই তাদের আস্থা ছিল; প্রকৃত (অর্থাৎ বৈজ্ঞানিক) সমাজতন্ত্রে তাদের বিশ্বাস ছিল না। তাদের বড় একটা অংশ আসলে সমাজতন্ত্র-বিরোধীই ছিল। ফলে সমাজতন্ত্রীরা সুবিধা করতে পারেননি। তা ছাড়া সমাজতন্ত্রীরা তো ছিলেন বিভক্ত, কেউ কেউ আবার বিভ্রান্ত। তাঁদের মধ্যে যাঁরা হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছেন, তাঁদেরও কোনো সংগঠিত বাহিনী ছিল না, ছিল না অস্ত্রের সরবরাহ। তবে সমাজতন্ত্রীরাই কিন্তু দেশের ভিতরে থেকে অধিক পরিমাণে যুদ্ধ করেছেন। জাতীয়তাবাদীদের অধিকাংশই (নেতারা তো অবশ্যই) চলে গিয়েছিলেন সীমান্তের ওপারে। শুরুতে গেছেন শরণার্থী হিসেবে, পরে একাংশ যোগ দিয়েছে মুক্তিবাহিনীতে। নেতারা কিন্তু রয়ে গেছেন কলকাতা ও আগরতলাতেই। সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী তরুণদের মুক্তিবাহিনীতে অংশগ্রহণের ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা জারি ছিল; চীনপন্থিরা তো অবশ্যই, রুশপন্থিরাও অনুমতি পাননি অন্তর্ভুক্তির। চীনপন্থিদের সম্বন্ধে এমন মিথ্যা প্রচারণাও ছিল যে তারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেননি। এমনও বলা হয়েছে যে তাঁরা পাকিস্তানিদের সঙ্গে সহযোগিতা করেছেন। এ প্রচারণায় জাতীয়তাবাদীরাই ছিলেন অগ্রগামী, তাই বলে রুশপন্থিরা যে পিছিয়ে ছিল তা-ও নয়। শেখ মুজিব দেশীয় সমাজতন্ত্রের কথাই বলছিলেন; ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে যাঁরা সমাজতন্ত্রের পক্ষে ছিলেন তাঁদের নেতারাও ওই পর্যন্তই যাবার কথাই ভাবছিলেন, তার বেশি নয়। শ্রেণি-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠার বিষয়ে তাঁদের জ্ঞান এবং আগ্রহ দুটিতেই বিলক্ষণ ঘাটতি ছিল।

যুদ্ধের পরে আন্দোলনকামী ছাত্ররাও দেখা গেল উধাও হয়ে গেছেন। তার কারণ, যে জাতীয়তাবাদীরা রাষ্ট্রক্ষমতা পেয়েছিলেন তাঁরা ভেবেছেন যা পাওয়ার ছিল সেটা তো হাতে এসেই গেছে, এখন আর আন্দোলন কার বিরুদ্ধে? কীসের জন্য? ছাত্রদের পক্ষে এখন কাজটা হবে ক্ষমতাসীনদের সাহায্য করা, যাতে তারা দেশের উন্নতি ঘটাতে পারেন। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের অন্তর্গত আওয়ামীপন্থিদের পক্ষে তখন তাই নিষ্ক্রিয় হয়ে যাওয়াটাই ছিল স্বাভাবিক। তাদের একাংশ অবশ্য একেবারে নিষ্ক্রিয় ছিল না। নানা ধরনের দখলদারির কাজে তাদের ব্যস্ত থাকতে দেখা গেছে।

এখানে স্মরণ করা আবশ্যক যে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ছিল একটি সর্বদলীয় ঐক্যজোট। ওই জোটে ছাত্রলীগকে যুক্ত করতে রীতিমতো সাধ্যসাধনা করতে হয়েছে। কারণ ছাত্রলীগ ছয় দফার বাইরে যেতে উৎসাহী ছিল না, এগারো দফার সাম্রাজ্যবাদ-পুঁজিবাদ বিরোধিতায় তাঁদের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন ছিল না। দ্বিতীয়ত ছাত্রলীগ বিশ্বাস করত একক নেতৃত্বে, জাতীয়তাবাদীরা যেটা করতে খুবই অভ্যস্ত; আর ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ প্রতিষ্ঠিত হয় যৌথ নেতৃত্বে, যেমনটি ঘটেছিল বায়ান্নর রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদে। সাতই মার্চের বক্তৃতাতে  শেখ মুজিব পাড়া-মহল্লায় যে সংগ্রাম পরিষদ গঠনের আহ্বান জানিয়েছিলেন, সেখানে নির্দেশ ছিল আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বে রাখার। মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি সর্বজনীন জনযুদ্ধ, সেই যুদ্ধে জাতীয় মুক্তির একটি ঐক্যবদ্ধ ফ্রন্ট গঠিত হওয়াটাই ছিল প্রয়োজনীয় এবং স্বাভাবিক। মওলানা ভাসানী এবং বামপন্থি সংগঠনগুলোর কোনো কোনোটি জাতীয় মুক্তির ঐক্যজোট গড়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তু সেটা ঘটেনি। নেতৃত্ব রয়ে গেছে অনুপস্থিত আওয়ামী লীগের নেতাদের হাতেই, যে নেতাদের নিজেদের ভিতরই ঐক্য ছিল না; যে অনৈক্যের প্রমাণ যুদ্ধের সময়ে তো পাওয়া গেছেই, সবচেয়ে মর্মান্তিক প্রকাশ দৃশ্যমান হয়েছে পনেরোই আগস্টে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে।

মুক্তিযুদ্ধ যখন চলছিল তখন মুজিবনগরের অস্থায়ী সরকারের পক্ষ থেকে মোট তিনটি রাষ্ট্রীয় লক্ষ্যের কথাই বলা হতো- গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। বাঙালি জাতীয়তাবাদের কারণেই এবং ভিত্তিতেই তো যুদ্ধটা চলছিল, তাই জাতীয়তাবাদের কথাটা তখন আলাদা করে বলার প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু যুদ্ধ শেষে বাংলাদেশ যখন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তখন দেখা গেল রাষ্ট্রীয় লক্ষ্য হিসেবে জাতীয়তাবাদও উচ্চারিত হচ্ছে। এরপরে সংবিধান রচনার সময়ে তো জাতীয়তাবাদ রাষ্ট্রীয় মূলনীতির চারটির মধ্যে একটি নয়, প্রথমটি হিসেবেই স্থান করে নিয়েছে। পাকিস্তানি রাষ্ট্রকাঠামোর ভিতরে বাঙালিদের পক্ষে জাতি প্রশ্নের মীমাংসা পাওয়াটা সম্ভবপর ছিল না, তবে যুদ্ধের ভিতর দিয়ে পাকিস্তানের শোষণ বেষ্টনী থেকে মুক্ত হয়ে বাঙালিরা জাতি হিসেবে নিজেদের রাষ্ট্রীয়ভাবেই যেহেতু প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছে, তাই প্রশ্ন উঠতে পারে আবার জাতীয়তাবাদ নিয়ে আসা কেন? কারণটা কী?

কারণ হয়তো তখন রাষ্ট্রের নতুন শাসকের এ স্বাভাবিক উপলব্ধি যে জাতিগত পরিচয়ের পতাকাটি ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে পারলে তার নিচে শ্রেণি পরিচয়ের অস্বস্তিকর বিষয়টি প্রধান হয়ে উঠবে না। বলা যাবে আমরা সবাই বাঙালি, সবাই সমান, এখানে অন্য কোনো পরিচয়ের প্রয়োজন নেই। কিন্তু ভিন্ন পরিচয় তো ছিল।

শ্রেণি পরিচয়টা তো মুছে যায়নি। যে ৩০ লাখ মানুষ প্রাণ দিয়েছে, যে ৩ লাখ নারী সম্ভ্রম হারিয়েছেন তাঁদের পরিবার-পরিজন কি ধনী ও সুবিধাপ্রাপ্তদের সমান হয়ে গেছেন? নাকি স্বাধীনতার পর দেখা গেছে যে তাঁদের এবং সাধারণভাবে সব মেহনতি মানুষের জন্যই বৈষম্য আরও বেড়েছে? বৈষম্য কমানো, মানুষের সঙ্গে মানুষের অধিকার ও সুযোগের সাম্য প্রতিষ্ঠা, ক্ষমতার গণতান্ত্রিক বিকেন্দ্রীকরণ- এসবের জন্যই তো মানুষ যুদ্ধে গেছে; এবং শ্রেণিসমস্যার সমাধানের জন্যই তো জাতিসমস্যার সমাধান করা। আর সেই সমস্যার সংরক্ষক ও পৃষ্ঠপোষক পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রীয় রাষ্ট্রকাঠামোটি ভেঙে ফেলা আবশ্যক হয়ে পড়েছিল।

লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সৌজন্যে: বাংলাদেশ প্রতিদিন

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।