ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

কৃষি

ভুট্টার ব্র্যান্ডিংয়েও থেমে নেই তামাক চাষ 

খোরশেদ আলম সাগর, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯৪০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১২, ২০২৩
ভুট্টার ব্র্যান্ডিংয়েও থেমে নেই তামাক চাষ 

লালমনিরহাট: ‘ভুট্টায় ভরবে সবার ঘর, লালমনিরহাট হবে স্বনির্ভর’ - এ স্লোগানে ভুট্টাকে ব্র্যান্ডিং ফসল করা হলেও লালমনিরহাটে থেমে নেই ‘বিষবৃক্ষ’ তামাকের চাষ।  

জানা গেছে, দেশের প্রতিটি জেলায় একটি করে পণ্য বা ফসলকে জেলা ব্র্যান্ডিং হিসেবে ঘোষণা করেছে সরকার।

এ ক্ষেত্রে জেলাটির ঐতিহ্যকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়। তিস্তা ধরলা আর সানিয়াজান নদী বেষ্টিত জেলা লালমনিরহাটে ভুট্টাকে ব্র্যান্ডিং ফসল ঘোষণা করা হয় বেশ কয়েক বছর আগে। ভুট্টাকে ব্র্যান্ডিং ফসল ঘোষণা করা হলেও এর চাষাবাদ আশানুরূপ বাড়েনি এ অঞ্চলে। জেলার হাতীবান্ধা ও পাটগ্রাম উপজেলায় এর চাষবাদ হলেও বাকি তিনটি উপজেলায় এখনও তামাকের চাষ হচ্ছে ব্যাপকহারে। সদর, আদিতমারী ও কালীগঞ্জ উপজেলার বিস্তীর্ণ জমিতে চাষাবাদ হচ্ছে তামাক। নীলকর মহাজনদের মতোই এ তিন উপজেলায় বড় বড় তামাক ক্রয় কেন্দ্র গড়ে তুলেছে তামাক কোম্পানিগুলো। সরকারিভাবে তামাক চাষে কৃষকদের নিরুৎসাহিত করার কথা বলা হলেও মাঠ পর্যায়ে ঘটছে তার উল্টো।  

চাষিরা জানান, তামাক কোম্পানিগুলো বিনামূল্যে বীজ দেয়। সেই সঙ্গে সার, কীটনাশক ও উৎপাদন খরচ ঋণ হিসেবে দেয় সহজ শর্তে। এতেই শেষ নয় তামাক কোম্পানিগুলো তাদের মাঠকর্মীদের দিয়ে নিয়মিত ক্ষেত পরিদর্শন করায়, চাষিদের সমায়নুযায়ী পরামর্শ দেয়। তামাক বিক্রিতেও তেমন কোনো ঝামেলা নেই চাষিদের। কোম্পানি নির্ধারিত চাষিদের মাধ্যমে তামাক চাষ করেন এবং উৎপাদিত তামাক কোম্পানির ক্রয় কেন্দ্রে গিয়ে পাস বইয়ের মাধ্যমে বিক্রি করে ব্যাংকের মাধ্যমে অর্থ পেয়ে থাকেন। ঋণগ্রহণকারী চাষিরাও তামাক বিক্রির সময় ঋণ পরিশোধের সুযোগ পাচ্ছেন।  

অপরদিকে সরকারিভাবে তামাক চাষ নিরুৎসাহিত করতে বলা হলেও বাস্তবে ঘটছে তার উল্টো। সরকারিভাবে বিভিন্ন ফসল চাষাবাদের জন্য কৃষকদের মধ্যে প্রণোদনা হিসেবে বিনামূল্যে বীজ ও সার বিতরণ করছে। কিন্তু তার বেশিরভাগই অকৃষকদের হাতে চলে যাচ্ছে। যা পরে কালো বাজারে বিক্রি করা হচ্ছে। এতে প্রকৃত কৃষকরা বঞ্চিত হয়ে তামাক কোম্পানির দিকে ঝুঁকছেন। আবার অনেক ক্ষেত্রে তামাক চাষিরাই সরকারি প্রণোদনার সার নিয়ে তামাক ক্ষেতে ব্যবহার করছেন। বরেন্দ্র সেচ প্রকল্পের ভর্তুকি মূল্যের সেচও ব্যবহার হচ্ছে তামাক ক্ষেতে।

একই জমিতে বার বার তামাক চাষের ফলে জমিগুলো উর্বরা শক্তি হারাচ্ছে। যেসব জমিতে তামাক চাষ হয়, সেসব জমিতে পরবর্তী মৌসুমে চাষ করা অন্য ফসলের ফলন অনেক কমে যায়। বিকল্প লাভজনক ফসল না পেয়ে আপাত লাভের আশায় তামাক চাষ করছেন চাষিরা। তামাক চাষে জমির ক্ষতিসহ স্বাস্থ্যের ক্ষতিকর বিষয়টি জেনেও মুনাফার আশায় ঝুঁকি নিচ্ছেন চাষিরা।  

ভুট্টা চাষাবাদ বাড়াতে দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নেই জেলা কৃষি বিভাগের। কাগজ কলমে তামাকের উৎপাদন কম দেখানো হলেও বাস্তবে তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি চাষ হচ্ছে এ জেলায়। এ জেলার হাতীবান্ধা ও পাটগ্রাম উপজেলায় ভুট্টার চাষাবাদ চোখে পড়ার মতো। চাষিদের ভুট্টা কিনতে ব্যবসায়ীরা বড় বড় ক্রয় কেন্দ্রও গড়ে তুলেছেন এ দুই উপজেলায়। এখানকার চাষিদের উৎপাদিত ভুট্টা কম দামে কিনে ব্যবসায়ীরা ভুট্টা প্রক্রিয়ার কারখানায় বেশি দামে বিক্রি করছেন। ফলে উৎপাদন ভালো হলেও মুনাফা তেমন পাচ্ছেন না কৃষকেরা।  

ভুট্টার ব্র্যান্ডিংয়ের জেলা লালমনিরহাটে ভুট্টা প্রক্রিয়াজাত করার কারখানা প্রতিষ্ঠার দাবি এ অঞ্চলের চাষিদের। সরকারের নীতি নির্ধারণী পর্যায়ের কর্মকর্তারা প্রায়ই চাষিদের আশ্বস্ত করলেও বাস্তবায়ন নেই। চাষিদের দাবি, কারখানা হলে চাষিরা তাদের উৎপাদিত ভুট্টা সরাসরি কারখানায় বিক্রির সুযোগ পাবেন। এতে মুনাফা যেমন বাড়বে, তেমনি ভুট্টা থেকে তৈরি করা পণ্যের দামও চাষিদের নাগালের মধ্যে থাকবে। এ জেলার ভুট্টা ঢাকায় গিয়ে আবার ভুট্টাজাত পণ্য হয়ে ফিরছে। এতে দুইবার পরিবহন খরচে পণ্যের দাম বাড়ছে। একইভাবে এখানে কারখানা হলে, কাঁচামাল সহজলভ্য হওয়ায় পণ্য উৎপাদনে কারখানা লাভবান হবে।

হাতীবান্ধার ভুট্টা চাষি আফজাল হোসেন বলেন, জমি ও স্বাস্থ্যের ক্ষতি, তাই তামাক ছেড়ে ভুট্টা চাষ করছি। ফলন ভালো হলেও আশানুরূপ মুনাফা পাচ্ছি না। ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট কম দামে কিনে কারখানায় বেশি দামে বিক্রি করছে। আমরা কষ্ট করেও মুনাফা পাচ্ছি না। তাই আমরা এ অঞ্চলে ভুট্টাজাত পণ্যের কারখানা প্রতিষ্ঠার দাবি করছি। নয় তো সরাসরি কারখানায় ভুট্টা বিক্রির সুযোগের দাবি জানাচ্ছি।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর জানায়, চলতি বছর জেলার পাঁচটি উপজেলায় ভুট্টা চাষাবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ৩১ হাজার ৯০০ হেক্টর জমিতে। চাষাবাদ হয়েছে ৩২ হাজার ২৫ হেক্টর জমিতে। যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও বেশি। অপরদিকে জেলার পাঁচটি উপজেলায় ছয় হাজার ৭৮৫ হেক্টর জমিতে তামাক চাষ হয়েছে। তবে কৃষি বিভাগের মনগড়া এ তথ্য মানতে নারাজ চাষিরা।  

লালমনিরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ হামিদুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, ব্র্যান্ডিং ফসল হিসেবে জেলায় ভুট্টার চাষাবাদ বাড়াতে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। বিগত বছরগুলোর তুলনায় চলতি বছর তামাক চাষ কমেছে এবং বেড়েছে ভুট্টার চাষাবাদ। ভুট্টাজাত কারখানা প্রতিষ্ঠার জন্য কোনো লগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান এগিয়ে এলে ব্যাংক ঋণের মাধ্যমে সহায়তা করা হবে।

বাংলাদেশ সময়: ১৯৩৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১২, ২০২৩
এসআই
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।