ঢাকা, বুধবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

কৃষি

নাটোরে জোরেসোরে চলছে বোরোর চারা রোপণ

মো. মামুনুর রশীদ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৫২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২১, ২০২৩
নাটোরে জোরেসোরে চলছে বোরোর চারা রোপণ

নাটোর: বন্যার পানি নেমে গেছে অনেক আগেই। এরই মধ্যে সরিষা ফসল ঘরে তুলে বোরো ধান আবাদে মাঠে নেমেছেন দেশের বৃহত্তম খাদ্য উৎপাদনকারী অঞ্চল চলনবিল ও হালতিবিল অধ্যুষিত নাটোরের কৃষকরা।

চলতি মৌসুমে ২ লাখ ৭৬ হাজার ৫২৭ মেট্রিক টন ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে বোরো ধানের চারা রোপণ চলছে জোরেসোরে। ঘন কুয়াশা আর কনকনে শীতকে উপেক্ষা করে বোরো ধানের চারা রোপন করছেন শ্রমিকরা।

তবে এবার পারিশ্রমিক বেশি এবং শ্রমিক সংকট নিয়ে খানিকটা বেকায়দায় আছেন কৃষকরা। সেই সঙ্গে সার ও জ্বালানির মূল্য বাড়ায় এবার বোরো চাষাবাদে উৎপাদন খরচ বেশি পড়বে। বিকল্প ফসল চাষাবাদের কোনো সুযোগ না থাকায় সংকট ও সমস্যা থাকলেও বোরো চাষই হচ্ছে এখানকার কৃষকদের একমাত্র ভরসা।

এখন কৃষি উপকরণের সহজলভ্যতা প্রাপ্তি নিশ্চিত হলে এবং  চাষাবাদের পরিবেশ ও আবহাওয়া অনুকুলে থাকলে বিগত বছরের ন্যায় এবারও বোরোতে বাম্পার ফলন হবে বলে আশা প্রকাশ করছেন কৃষি সংশ্লিষ্টরা।

কৃষি বিভাগ  জানিয়েছেন, প্রণোদনা কর্মসূচির আওতায় চলতি মৌসুমে জেলায় দুই কোটি ৪৫ লাখ ৪১ হাজার টাকায় ৪৪ হাজার ২০০ জন ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক বিনামূল্যে উফশী ও হাইব্রিড জাতের বোরো বীজসহ রাসায়নিক সার পেয়েছেন। যা থেকে প্রায় ১ হাজার ৪০০ মেট্রিক টন ধান উৎপাদন হবে।

নাটোর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, চলতি ২০২২-২৩ রবি মৌসুমে জেলার সাতটি উপজেলায় ৫৮ হাজার ৭১০ হেক্টর জমিতে বোরো ধান চাষাবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে হাইব্রিড জাত  ৪ হাজার ৭০০ হেক্টর ও উফশী জাত ৫৪ হাজার ১০ হেক্টর।   ইতোমধ্যে  প্রায় ৪০ হাজার হেক্টর জমিতে বোরোর চারা রোপণ সম্পন্ন হয়েছে। এবার মোট ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ২ লাখ ৭৬ হাজার ৫২৭ মেট্রিক টন। এর মধ্যে হাইব্রিড জাত ২৫ হাজার ৩৮০ মে. টন এবং উফশী জাতের ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ২ লাখ ৫১ হাজার ১৪৭ মে. টন।  

সূত্র জানায়, গত মৌসুমে ৫৮ হাজার ২০০ হেক্টর জমিতে বোরো চাষের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে চাষাবাদ হয়েছিল ৬০ হাজার ৭৫০ সেক্টর জমিতে।   প্রতি হেক্টরে গড়ে ৪ দশমিক ৬৮ মে. টন হারে ফলন হিসেবে মোট ধান উৎপাদন হয়েছিল ২ লাখ ৮৪ হাজার ২৫৬ মে. টন। এরমধ্যে হাইব্রিড জাতের ধান উৎপাদন হয়েছিল ২৮ হাজার ১২৮ মে. টন এবং উফশী জাত ২ লাখ ৫৬ হাজার ৫৬ মে. টন ও স্থানীয় জাতের ধান ৭২ মে. টন।

কৃষি বিভাগ আরও জানায়, এবার সদর উপজেলায় বোরো ধান চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ২ হাজার ৩০০ হেক্টরে, নলডাঙ্গায় ৮ হাজার ৮০০ হেক্টরে, সিংড়ায় ৩৬ হাজার ১০০ হেক্টরে, গুরুদাসপুর উপজেলায় ৫ হাজার ১০০ হেক্টরে, বড়াইগ্রাম উপজেলায় ৪ হাজার ৯ হেক্টরে, লালপুরে ১ হাজার ১১০ হেক্টরে ও বাগাতিপাড়া উপজেলায় ৮০০ হেক্টরে। এরমধ্যে হাইব্রিড, উফশী ও স্থানীয় জাত রয়েছে।

জেলার মধ্যে চলনবিল অধ্যুষিত সিংড়া উপজেলা এবং হালতিবিল অধ্যুষিত নলডাঙ্গা উপজেলায় সবচেয়ে বেশি বোরোর চাষাবাদ হচ্ছে।
 
হালতিবিলের খোলাবাড়িয়া গ্রামের কৃষক মামুনুর রশিদ জানান, বঙ্গবন্ধু-১০০  এবং জিরাসাইল জাত মিলে দুই বিঘা জমিতে বোরোর চাষাবাদ করছেন। তবে এবার চাষাবাদ প্রক্রিয়ায় খরচ একটু বেশি পড়বে। কেননা সার, জ্বালানি এবং শ্রমিক ও  সেচ মূল্য বেশি  হওয়ায় বিঘা প্রতি চাষাবাদ খরচ বেশি হবে।

হালতিবিলের খাজুরা গ্রামের কৃষক মো. সাদেক আলী জানান, এবার তিনি ৫০ বিঘা জমিতে বোরোর আবাদ করেছেন। এরমধ্যে হাইব্রিড জাতের ধান বেশি করেছেন। তবে এবার কৃষি বিভাগের উদ্ভাবিত বঙ্গবন্ধু-১০০ জাতসহ সহ ব্রি -২৯ জাত ও জিরাশাইল জাতের ধান আবাদ করেছেন। শ্রমিক সংকট ও পারিশ্রমিক বেশি এবং কীটনাশকের দাম বেশি। তবে অন্যান্য কৃষি উপকরণের দাম স্বাভাবিক রয়েছে।  

খোলাবাড়িয়া গ্রামের কৃষক বেলাল কারিগর জানান, হালতিবিলে সমলয় প্রযুক্তিতে অন্তত ৫০ জন কৃষক ১৫০ বিঘা জমিতে জাতের ধান আাবাদ করছেন। কৃষি বিভাগ থেকে সব ধরনের পরামর্শ ও সহযোগিতা দেওয়া হচ্ছে।   তারা এ প্রযুক্তিতে আাশাবাদী।  

তবে চাষাবাদে এবার অন্যান্য বছরের তুলনায় খরচ একটু বেশি পড়ছে বলে দাবি করে তিনি বলেন, সারসহ অন্যান্য উপকরণ প্রাপ্তিতে কোনো সমস্যা নেই। একই কথা জানালেন অন্যান্য কৃষকরাও।

চলনবিলের শফিকুল ইসলাম, আব্দুস সামাদসহ অন্যান্য কৃষকরা বাংলানিউজকে জানান, এ বছর বন্যার পানি অনেক আগে নেমে যাওয়ায় বোরোর আগে বাড়তি ফসল হিসেবে সরিষার আবাদ করেছেন। বিঘা প্রতি ৫ থেকে ৬ মণ করে ফলন পাওয়া গেছে। নতুন সরিষার বর্তমান বাজার দর প্রতিমণ ৩৪০০ থেকে ৩৫০০ টাকা। ওই ফসল বিক্রি করে বোরো চাষাবাদে অনেকটা সহায়ক হবে। পাশাপাশি তারা সারা বছর ভোজ্য তেলের  চাহিদা মিটাতে পারবেন।

তারা বলেন, ইতোমধ্যে অনেক কৃষক বোরোর চারা রোপন শেষ করেছেন। আগামী সপ্তাহ খানেকের মধ্যে বোরোর চারা রোপন সম্পন্ন হবে। তবে এবার শ্রমিক সংকট ও মূল্য নিয়ে কিছুটা ভোগান্তিতে ছিলেন। স্থানীয় বর্গাচাষী আব্দুল গফুর জানান, এবার সেচ ও  রোপন খরচ বেশি হয়েছে।

সিংড়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. সেলিম রেজা বাংলানিউজকে জানান, চলনবিল অধ্যুষিত তার উপজেলায় ৩৬ হাজার ১০০ হেক্টর জমিতে বোরো ধান চাষাবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। ইতোমধ্যে প্রায় ২৫ হাজার হেক্টর জমিতে রোপন শেষ হয়েছে। সমলয় পদ্ধতিতে ১৫০ বিঘা জমিতে ব্রি-৮৯ জাত চাষ করা হচ্ছে। এছাড়া উচ্চ ফলনশীল বঙ্গবন্ধু-১০০, ব্রি ধান ৮১, ৯২ ও হাইব্রিড জাতের ধান বেশি চাষাবাদ করা হচ্ছে।

গুরুদাসপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা হারুনুর রশীদ বাংলানিউজকে জানান, ৫ হাজার ৯০০ হেক্টর জমিতে বোরোর লক্ষ্যমাত্রা ধরা হলেও চাষাবাদের পরিধি বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছ।  

কারণ হিসাবে তিনি উল্লেখ করেন, বোরো ধানের ভাল মূল্য প্রাপ্তিতে কৃষকরা এ ফসল চাষাবাদে আগ্রহী হচ্ছেন। ইতোমধ্যে শতকরা ৫ ভাগ বোরোর চারা রোপণ শেষ হয়েছে। কৃষকরা সরিষা ফসল তোলার পর সেখানে বোরো চাষাবাদ করছেন। ফলে বোরোর চারা রোপণে কিছুটা বিলম্ব হচ্ছে। তবে পুরোদমে বোরোর চাষাবাদ চলছে। একই কথা জানান বড়াইগ্রাম উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শারমিন শিখাও।

নলডাঙ্গা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ফৌজিয়া ফেরদৌস বাংলানিউজকে জানান, কৃষকদের নতুন নতুন জাত এবং চাষাবাদে আধুনিক প্রযুক্তি সম্পর্কে যে ধারনা ও সহযোগিতা দেওয়া হয়েছে তার যোথাযথ ব্যবহার হলে কৃষিতে বিপ্লব ঘটবে। বিগত বছরের ন্যয় এবারও বোরোতে বাম্পার ফলন হবে।

তিনি বলেন, চলতি মৌসুমে নলডাঙ্গা উপজেলায় ৮ হাজার ৮০০ হেক্টর জমিতে বোরো চাষাবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হলেও হালতিবিলেই সাড়ে ৫ হাজার হেক্টর জমিতে বোরোর চাষাবাদ হয়েছে এবং লক্ষ্যমাত্রা আরও ছাড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এবারও সমলয় প্রযুক্তিতে ৩০ জন কৃষক ১৫০ বিঘা জমিতে ব্রি-৮৯ জাতের বোরো ধান চাষাবাদ করছেন। আশা করা যাচ্ছে এবারও কৃষকরা তার সুফল পাবেন।

তিনি বলেন, নতুন নতুন উদ্ভাবিত জাতের ধান চাষাবাদে উৎসাহিত করতে কৃষকদের প্রশিক্ষ সহ বিভিন্ন প্রদর্শনী সহায়তা দেওয়া হয়েছে। ধান গবেষণা থেকে প্রাপ্ত  বঙ্গবন্ধু-১০০ জাতের বীজে হালতিবিলে ৫০ বিঘা জমিতে প্রদর্শনী দেওয়া হয়েছে।  

নাটোর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক (ডিডি) কৃষিবিদ আব্দুল ওয়াদুদ বাংলানিউজকে জানান,  উন্নত জাত ও নতুন উদ্ভাবিত ফসল চাষাবাদে উৎসাহিত করতে উফশী ও হাইব্রিড জাতের বোরো প্রণোদনা কর্মসূচির আওতায় চলতি মৌসুমে নাটোর জেলায় দুই কোটি ৪৫ লাখ ৪১ হাজার টাকায় ৪৪ হাজার ২০০ জন ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষককে বিনামূল্যে উফশী ও হাইব্রিড জাতের বোরো বীজসহ রাসায়নিক সার দেওয়া হয়েছে। এরমধ্যে ১৬ হাজার ২০০ জন কৃষককে উফশী জাতের বোরো বীজ ও ২৮ হাজার জন কৃষককে হাইব্রিড জাতের ধান বীজ দেওয়া হয়েছে। এতে এবার বোরো মৌসুমে সরকারের প্রণোদনা সহায়তায় জেলার সাতটি উপজেলায় প্রায় ১ হাজার ৪০০ মেট্রিক টন ধান উৎপাদন হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

তিনি বলেন, বৈশ্বিক অবস্থা বিবেচনা করে ফসলের নতুন নতুন জাত ও প্রযুক্তি উদ্ভাবন করে কৃষকদের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। যাতে কৃষকরা অতিরিক্ত ফসল উৎপাদনে উৎসাহিত হয়। পতিত জমিগুলোকে চাষাবাদের আওতায় আনতে কৃষকদের উৎসাহ দেওয়াসহ বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন ও কৃষি বিভাগ থেকে সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। আবহাওয়া ও পরিবেশ অনূকুলে থাকলে এবারও বোরোতে বাম্পার ফলন হবে।

বাংলাদেশ সময়: ১৪৫০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২১, ২০২৩
এমএমজেড

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।