ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

কৃষি

পানির অভাবে বোরো চাষ ব্যাহত, বিপাকে কৃষকেরা

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬০৭ ঘণ্টা, মার্চ ১৩, ২০২৩
পানির অভাবে বোরো চাষ ব্যাহত, বিপাকে কৃষকেরা

ফেনী: ফেনীর সোনাগাজীতে পানির অভাবে বোরো আবাধ চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ফসলের মাঠের মত কৃষকদের স্বপ্নও যেন ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে।

পানির সংকটে হাজার হাজার কৃষক উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। কৃষি বিভাগের আশ্বাসে লাখ লাখ টাকা খরচ করে বোরো ধানের চারা রোপন করেন কৃষকেরা। এখন খালে পানি না থাকায় ধান নিয়ে বিপাকে পড়েছেন তারা।

বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুহুরী সেচ প্রকল্পও কৃষকদের কোনো কাজে আসছেনা। উপজেলার নয়টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা জুড়ে ৫০টিরও বেশি খাল রয়েছে। মুহুরী নদীতে মিঠা পানি, বড় ও ছোট ফেনী নদীতে নোনা পানি থাকলেও রহস্যজনক কারণে খালগুলোতে পানি যাচ্ছেনা। নদীগুলোর মোহনায় খালে পানি ধরে রাখার জন্য রয়েছে বেশ কয়েকটি রেগুলেটর (গতি নিয়ন্ত্রক)।  

গত কয়েক বছর ধরে শত শত কোটি টাকার সরকারি খরচে খালগুলো সংস্কার করেও খালগুলোতে পানি থাকছেনা। পানি পাওয়া জন্য উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ও পানি উন্নয়ন বোর্ডে লিখিত আবেদন করেও কোনো প্রতিকার পাচ্ছেন না কৃষকেরা।

ইতোমধ্যে কৃষকদের পক্ষ থেকে সরকারি সংশ্লিষ্ট দপ্তরে একাধিক লিখিত অভিযোগ করা হয়েছে। সব দপ্তরের কর্মকর্তারা খালে পানি সরবরাহ করার আশ্বাস দিলেও খালগুলোতে এখনও পানি সরবরাহ করতে পারেননি। অধিকাংশ এলাকায় গ্রামের পুকুরগুলো থেকে পানি কিনে জমিতে সেচ দিয়েছেন কৃষকেরা।  

তবে শুকনো মৌসুম হওয়ায় অনেক পুকুরের পানি শুকিয়ে গেছে। ফলে, কৃষকদের স্বপ্নের ধান নিয়ে উদ্বিগ্নতা আরও বেড়েছে। কেউ কেউ স্বর্ণ বন্ধক রেখে কিংবা ব্যাংক-এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে এক বুক আশা নিয়ে বোরো আবাদ করেছেন।  

এদিকে, এমন অবস্থায় সব চেয়ে বেশি আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হবেন বর্গা চাষিরা। সব হারিয়ে এখন নিঃস্ব হওয়ার আশঙ্কায় তারা।  

সরকারি হিসাব মতে সোনাগাজী উপজেলায় বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল এক হাজার ৩০০ হেক্টর। সে ক্ষেত্রে চাষ হয়েছে এক হাজার ৮০০ হেক্টর। এর মধ্যে উচ্চফলনশীল (উফশী) এক হাজার ৫০০হেক্টর ও হাইব্রিড চাষ হয়েছে ৩০০ হেক্টর।  

বেসরকারি হিসাব মতে সোনাগাজীতে বোরো আবাদ হয়েছে প্রায় তিন হাজার হেক্টর। চাষকৃত ধাগুলোর মধ্যে রয়েছে বিআর-১৬, ব্রিধান-২৮, ২৯, ৬৭, ৬৮,৭৪, ৮৮, ৮৯, ৯২, বিনা-১০, ২৪, হাইব্রিড ব্র্যাক-১১, রূপালী, দোয়েল, সম্পদ, হীরা-২, ময়না, টিয়া। এ উপজেলায় রয়েছে বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট। বিজ্ঞানীরা ধানের নতুন নতুন জাতও উদ্ভাবন করে যাচ্ছেন।  

পৌর এলাকার চরগণেশ গ্রামের কৃষক সিরাজুল ইসলাম বলেন, পানি না দিলে আমাদেরকে গুলি করে মেরে ফেলা হোক। নিজের ক্ষেতে বিআর-২৯ ধানের চারা লাগিয়েছেন। খালে পানি না থাকায় দূরের একটি পুকুর থেকে পানি কিনে এনে মাঠে দিয়েছেন। কিন্তু সেই পানিও শুকিয়ে গেছে। আমাদের কান্না দেখার কেউ নাই।

সোনাগাজী সদর ইউনিয়নের চরখোয়াজ গ্রামের কৃষক রফিকুল ইসলাম বলেন, বড় আশা করে দেড় একর জমিতে বোরো আবাদ করেছি। এক একর নিজে আর বাকী আধা একর বর্গা চাষিকে দিয়ে চাষ করিয়েছি। পানি সংকটে আমি ও আমার বর্গা চাষির মাথায় হাত পড়েছে। আমি মনে করেছি কৃষক বাঁচলে, দেশ বাঁচবে, দেশ বাঁচলে মানুষ বাঁচবে, কিস্তু পানির এ সংকটে আমাদের সব স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে যাচ্ছে।  

চরচান্দিয়া ইউনিয়নের লন্ডনি পাড়ার কৃষক প্রতিনিধি মিজানুর রহমান বলেন, তিনি সহ অন্য কৃষকরা ব্যাংক, এনজিও, স্বর্ণ বন্ধক রেখে বুক ভরা আশা নিয়ে কয়েকশ একর জমিতে বোরো আবাদ করা হয়েছে। পানি সঙ্কটে ধানের সঙ্গে কৃষকরাও মারা যাওয়ার আশংকা দেখা দিয়েছে। পানি সরবরাহের জন্য সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত আবেদন জানিয়েও কোনো প্রতিকার পাইনি। ধানক্ষেত পানির অভাবে ফেটে চৌচির হয়ে গেছে।  

চরগণেশ গ্রামের জামাল উদ্দিন বলেন, পাউবো কর্তৃপক্ষ আমাদেরকে সেচ কার্ড দিয়েছেন। পানির জন্য টাকাও রিচার্জ করেছি। পানিও পাচ্ছিনা রিচার্জকৃত টাকাও ফেরত পাচ্ছিনা। চরদরবেশ ইউনিয়নের চরসাহাভিকারী গ্রামের ওসমান গণি বলেন, আমাদের সব স্বপ্ন ধুলিসাৎ হয়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশ মতে এক ইঞ্চি কৃষি জমিও খালি না রাখার জন্য, অথচ আমরা আজকে নিঃস্ব হয়ে পড়েছি।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সাজ্জাদ হোসেন মজুমদার বলেন, দ্রুত সময়ের মধ্যে খালে পানি সরবরাহ করতে না পারলে ধানের চরম ক্ষতি হবে। এতে কৃষকদের ব্যাপক আর্থিক ক্ষতি হবে। এর ফলে আমাদের বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ভেস্তে যাবে। আমরা পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করে যাচ্ছি। পানি সংকটের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা ক্ষতি পুষিয়ে আগামীতে বোরো সহ অন্য ফসল চাষেও আগ্রহ হারাবেন।  

সোনাগাজী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান জহির উদ্দিন মাহমুদ লিপটন বলেন, কৃষকদের পানি সমস্যার কথা আমরা জেনেছি। নিয়মিত পাউবো কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে যাচ্ছি। দ্রুত সময়ের মধ্যে পাউবো কর্তৃপক্ষ পানি সরবরাহের আশ্বাস দিয়েছেন।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কামরুল হাসান বলেন, পাউবোর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করেছি। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দ্রুত সময়ের মধ্যে কৃষকদের পানির সমস্যা সমাধান করার আশ্বাস দিয়েছেন।

উপজেলা আ.লীগের সাধারণ সম্পাদক, সোনাগাজী পৌরসভার মেয়র অ্যাড. রফিকুল ইসলাম খোকন বলেন, কৃষকদের দাবির প্রেক্ষিতে আমরা পাউবো কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে যাচ্ছি। সংশ্লিষ্টরা আশ্বাস দিয়েছেন দ্রুত সময়ে নিরবিচ্ছিন্নভাবে পানি সরবরাহ করবেন।

এ ব্যাপারে ফেনী পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী আরিফুর রহমান ভূঞা বলেন, বেশ কয়েকটি খালে মাটি ভরাট হয়ে গেছে। কৃষকদের দাবির প্রক্ষিতে পাউবোর প্রকল্প পরিচালক রাফিউজ সাজ্জাদ খালগুলো পরিদর্শণ করে গেছেন। মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পেশ করেছি। দীর্ঘ দিন বৃষ্টি না হওয়ায় নদীর পানির নাব্যতাও সংকট রয়েছে। দ্রুত সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে।

বাংলাদেশ সময়: ১৬০৮ ঘণ্টা, মার্চ ১৩, ২০২৩
এসএইচডি/এসএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।