ঢাকা, বুধবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

কৃষি

করসলের পাতা নিতে অনেকেই ছুটছেন আলী আশরাফের বাড়িতে

শেখ তানজির আহমেদ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৫৬ ঘণ্টা, জুলাই ৬, ২০২৩
করসলের পাতা নিতে অনেকেই ছুটছেন আলী আশরাফের বাড়িতে

সাতক্ষীরা: ‘ক্যানসার নিরাময়ে করসলের কার্যকারিতা নিয়ে যা বললেন গাজী আলী আশরাফ’ এই শিরোনামে গত ৪ জুন বাংলানিউজটুয়েন্টিফোর.কমে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছিল। এর পর করসলের পাতা সংগ্রহ করতে আলী আশরাফের বাড়িতে পড়েছে শত মানুষের ভিড়।

সেই সঙ্গে তার বাড়িতে লাইন পড়ছে সংবাদকর্মীদেরও।

প্রথমে আগতদের সাধ্যমতো করসল পাতা দিয়ে উপকার করতে পারলেও এখন অনেকটা নিরুপায় হয়ে পড়েছেন আলী আশরাফ। কারণ তার গাছগুলো থেকে পাতা ছিঁড়তে ছিঁড়তে এখন এক প্রকার ‘ন্যাড়া’ হয়ে গেছে। এছাড়া এতো মানুষকে পরামর্শ দেওয়া ও সংবাদকর্মীদের সময় দিতে গিয়ে বিশ্রামহীন হয়ে পড়েছেন তিনি।

করসলের পাতার বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকটা ঝড় উঠেছে। আলোচনা-সমালোচনায় সাতক্ষীরায় অনেকটা টক অব দ্য টাউনে পরিণত হয়েছে ‘করসল’।

চুয়াডাঙ্গা থেকে আলী আশরাফের বাড়িতে আসেন হাসানুর রহমান নামে এক ব্যক্তি। তিনি বলেন, গণমাধ্যমে সংবাদ দেখে করসলের পাতা নিতে এসেছি। আলী আশরাফের সঙ্গে কথা হয়েছে। তিনি পরামর্শ দিয়েছেন। আমার বাবা ক্যান্সারে আক্রান্ত, দেখি করসলের পাতার রসে কোনো উপকার পাই কি না।

গাজী আলী আশরাফ বলেন, খবরটি ছড়িয়ে পড়ায় মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন। অনেকে ফেসবুকে তর্ক-বিতর্ক করছেন। কেউ কেউ অন্যান্য গাছ-গাছড়ার সঙ্গে তুলনা করছেন। কিন্তু আমি প্রথমেই যখন বাংলানিউজের সঙ্গে কথা বলেছিলাম, তখনই করসল গাছ নিয়ে আমার এক্সপেরিমেন্ট এবং অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে এটা নিয়ে বৃহৎ আকারে গবেষণার কথা বলেছিলাম। আমার দাবি ছিল একটা নিয়মতান্ত্রিক গবেষণায় যদি এর উপকারিতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে, তবে করসলের আবাদ বৃদ্ধির মাধ্যমে বাংলাদেশের হাজারো ক্যান্সার রোগীকে বাঁচানো সম্ভব। কিন্তু সেদিকে না গিয়ে মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়ছে, সংবাদকর্মীদের লাইন পড়ছে। আমার সব গাছের পাতা শেষ।

এদিকে, গাজী আলী আশরাফের বাড়িতে করসলের পাতা নিতে মানুষের ভিড় ও উদ্ভূত পরিস্থিতিতে জনসাধারণের উদ্দেশে সতর্কতামূলক বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে সাতক্ষীরা স্বাস্থ্য বিভাগ।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ‘সম্প্রতি সাতক্ষীরা জেলায় করসল গাছের পাতা, ফল বা অন্যান্য অংশ ক্যান্সারের ওষুধ হিসাবে ব্যবহারে জনগণের মধ্যে কৌতূহল সৃষ্টি হচ্ছে। যার সঙ্গে চিকিৎসা বিজ্ঞানের কোনো সম্পর্ক নেই। ক্যান্সারসহ যে কোনো রোগে রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যতীত ওষুধ সেবন বা ভেষজের ব্যবহার রোগের জটিলতা বৃদ্ধি করতে পারে। এ বিষয়ে সচেতন থাকা এবং যে কোনো রোগের চিকিৎসার জন্য রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়ার জন্য অনুরোধ করা হলো।

প্রসঙ্গত, করসল গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলের একটি ফল। স্থান বিশেষ টক আতা, লক্ষ্মণ ফল, সায়ারসপ, গ্রাভিওলা বা গায়াবানো নামেও পরিচিত। কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ না থাকলেও করসল বা টক আতা গাছের ফল ও পাতা ক্যান্সার প্রতিরোধে খুবই কার্যকরী বা ক্যান্সারের বিকল্প চিকিৎসা বলে প্রচার রয়েছে।

করসল ফলের গা ঘন সবুজ এবং কাঁটাযুক্ত। ডিম্বাকৃতির এই ফল ১২ ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা হতে পারে এবং একটি মাঝারি দৃঢ় গঠনবিন্যাস রয়েছে। এগুলির মাংস রসালো, অ্যাসিডিক, সাদাটে এবং সুগন্ধযুক্ত। ফলটিতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ভিটামিন সি, ভিটামিন বি ১ এবং ভিটামিন বি ২ রয়েছে।

এই করসল বা টক আতা গাছ নিয়ে দীর্ঘ ১০ বছর যাবত পরীক্ষা নিরীক্ষা করছেন সাতক্ষীরা শহরের মুনজিতপুরের গাজী আলী আশরাফ।

২০১২ সালে থাইল্যান্ড থেকে বীজ সংগ্রহ করে নিজ বাড়িতে সাতটি চারা তৈরি করেছিলেন গাজী আলী আশরাফ। এর মধ্যে ছয়টি ফলবান করসল গাছ এখনও বেঁচে আছে। নিজের লাগানো করসল বা টক আতা গাছ থেকে দীর্ঘ সাত বছর পর প্রথমবার ফল পান তিনি। যার একটির ওজন হয়েছিল এক কেজি ২৭ গ্রাম। গায়ে কাঁটাযুক্ত করসল ফলের ভেতরটা অনেকটা আতার মতোই। স্বাদও অনন্য।

ক্যান্সার প্রতিরোধে করসলের ফল ও পাতা বেশ উপকারী বলে দাবি করেছেন গাজী আলী আশরাফ।

তিনি জানান, ২০২০ সালে তার ক্যান্সার ধরা পড়ে। বয়স বিবেচনায় তাকে কেমো দিতে চাননি চিকিৎসকরা। ক্যান্সারের চিকিৎসা চলাকালীন সুস্থ হওয়ার পরিবর্তে দিন দিন দুর্বল হয়ে পড়ছিলেন তিনি। এক পর্যায়ে পরিবারের সদস্যদের উপেক্ষা করে নিজেই সিদ্ধান্ত নেন আর ক্যান্সারের চিকিৎসা নেবেন না। পরে বিকল্প হিসেবে তিনি নিয়ম করে করসল পাতার রস খাওয়া শুরু করেন।

তিনি আরও বলেন, করসল ফল তো আমাদের দেশে দুষ্প্রাপ্য। তাই করসলের পাতার রস খেতে শুরু করি। প্রতিদিন তিন বেলা করসল পাতা পানি দিয়ে জ্বালিয়ে চায়ের মতো করে খেতাম। তিন বেলা খেলে সহ্য হতো না। এর পর কমিয়ে দুই বেলা, তারপর আস্তে আস্তে আরও কমিয়ে দেই। এক পর্যায়ে সুস্থ হয়ে উঠি এবং এখনও আল্লাহর রহমতে ভালো আছি। এখন মাঝে মধ্যে খাই। শুধু আমি না, আমার কাছ থেকে সাতজন ক্যান্সার রোগী পাতা নিয়ে যান। তারাও উপকার পাচ্ছেন, ভালো আছেন। করসলের ফল ও পাতা- খুবই উপকারী। তবে, তা অবশ্যই  পরিমিত পরিমাণে খেতে হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

গাজী আলী আশরাফ নিজেই করসলের পাতা ব্যবহার করে উপকার পেয়েছেন দাবি করে বলেন, আমার কিডনিতে টিউমার হলো। পরে অপারেশন করে টিউমারসহ একটি কিডনি ফেলে দেওয়া হলো। টিউমারটি পরীক্ষা করে দেখা গেল ক্যান্সারে রূপ নিয়েছে। তখন আমার ৭৪ বছর বয়স। চিকিৎসকরা আমার বয়স বিবেচনায় কেমোর বিকল্প হিসেবে রেডিয়েশন ট্যাবলেট খাওয়ার পরামর্শ দিলেন। এক মাস খাওয়ার পর দেখা গেল আমার অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছে। তখন আমি ওষুধ খাওয়া ছেড়ে দিয়ে করসলের পাতার রস খাওয়া শুরু করি। আমি এখন একটি কিডনি নিয়ে জীবনযাপন করলেও বেশ সুস্থ আছি।

তিনি বলেন, করসল নিয়ে বড় আকারের গবেষণা হওয়া দরকার এবং এর ক্যান্সার প্রতিরোধী ভূমিকা সবার মধ্যে তুলে ধরা দরকার। একই সঙ্গে করসল বা টক আতা গাছ বেশি করে লাগানোর ওপর গুরত্বারোপ করেন তিনি।

গাজী আলী আশরাফের দাবির সঙ্গে বিশ্ব মুক্তকোষ উইকিপিডিয়ায় দেওয়া তথ্যের যেমন কিছুটা সামঞ্জস্যতা আছে, তেমনি এর কিছু ক্ষতিকর দিকও তুলে ধরা হয়েছে সেখানে।

উইকিপিডিয়া বলছে, করসল বা টক আতার বীজ ও পাতাকে নিউরোটক্সিন হিসাবে শনাক্ত করা হয়েছে। যা ক্ষতিকর।

আবার, একথাও বলা হচ্ছে যে, মেমোরিয়াল স্লোয়ান-কেটরিং ক্যান্সার সেন্টার ক্যান্সার চিকিৎসায় লক্ষ্মণ ফলের অবদান আছে দাবি করে তালিকাভুক্ত করেছে। একই সঙ্গে ক্যান্সারের বিকল্প চিকিৎসা হিসেবে লক্ষ্মণ ফল ব্যবহারের বেশ প্রচারও আছে।

যদিও ক্যান্সার গবেষণা ইউকে এ সম্পর্কে একটি বিবৃতিও প্রকাশ করেছে, যাতে বলা হয়েছে- সামগ্রিকভাবে, গ্রাভিওলা ক্যান্সারের নিরাময়ের জন্য কাজ করে এমন কোনো প্রমাণ নেই। পরীক্ষাগার গবেষণায় গ্রাভিওলা সূত্রগুলো কিছু ধরনের লিভার এবং স্তন ক্যান্সারের কোষকে মেরে ফেলতে পারে যা নির্দিষ্ট কেমোথেরাপির ওষুধের বিরুদ্ধে প্রতিরোধী। তবে এর চেয়ে বড় কোনো চিহ্ন এখনও পাওয়া যায়নি এবং এ ব্যাপারে বড় কোনো স্ট্যাডিও নেই। তাই আমরা এখনও জানি না এটি ক্যান্সারের চিকিৎসা হিসেবে কাজ করতে পারে কিনা।

এ প্রসঙ্গে সাতক্ষীরার কামালনগরের সায়েম ফেরদৌস মিতুল নামে এক ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল। যিনি একজন ক্যান্সার রোগী এবং কেমো নিয়েছেন। একই সঙ্গে করসলের পাতার রসও খাচ্ছেন।

তার অভিজ্ঞতা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি একবার করসল ফল খেয়েছি। এর পাতার রস এখনও সপ্তাহে একবার খাই। করসলের পাতার রস অত্যন্ত এন্টি অক্সিডেন্টাল। এটি যেমন রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে, তেমনি টানা দুই-তিনদিন খেলে শরীর অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়ে, যেমনটি কেমো দিলে হয়।

বাংলাদেশ সময়: ১৪৫১ ঘণ্টা, জুলাই ০৬, ২০২৩
এফআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।