ঢাকা, বুধবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

কৃষি

বাংলার আপেলে ভাগ্যের চাকা ঘুরেছে বুলবুলের

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১৫৬ ঘণ্টা, অক্টোবর ২০, ২০১৭
বাংলার আপেলে ভাগ্যের চাকা ঘুরেছে বুলবুলের পেয়ারা গাছের পরিচর্যা করছেন বুলবুল। ছবি: বাংলানিউজ

গোদাগাড়ীর (রাজশাহী) বালিয়াডাইং থেকে ফিরে: ‘এসএসসি পাস করার পর অর্থাভাবে আর লেখাপড়া হয়নি। কিছু কৃষি জমি ছিল একমাত্র সম্বল। কিন্তু হাতে টাকা না থাকায় জমিতে চাষাবাদও করতে পারিনি। পরে ব্যাংক থেকে মাত্র ৪০ হাজার টাকা ঋণ নেই।

থাই বারী-৩ জাতের চারা সংগ্রহ করে পেয়ারা চাষ শুরু করি। এখন আমার ১৫ বিঘা জমির পেয়ারার বাগান রয়েছে।

যেখান থেকে বছরে ১০ লাখ টাকার ওপরে ব্যবসা হয়। এই পেয়ারা আমার ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়ে দিয়েছে। বেকারত্ব ঘুচিয়ে শক্ত হয়ে দাঁড়ানোর সুযোগ করে দিয়েছে’।

এই ছিল শূন্য থেকে লাখপতি হওয়া সফল পেয়ারা চাষি বুলবুলের নিজের কথা। তবে কেবল বুলবুলই নন, অনেক বেকার যুবকের ভাগ্যের বন্ধ তালা খুলছে ‘থাই পেয়ারা’। বরেন্দ্রের পোড়া মাটিতে যেন সোনা ফলতে শুরু করেছে। কম সময়ে বেশি ফলন হওয়ায় পেয়ারা চাষে ঝুঁকছেন বেকার যুবকরা। এই অঞ্চলের জমি অন্যান্য স্থানের চেয়ে উঁচু। তাই অপেক্ষাকৃত উঁচু জমিতে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে দুবছর থেকে থাই বারী-৩ ও বারী-৫ জাতের পেয়ারার চাষ বেড়েছে।

সাফল্যগাঁথার কথা জানাতে গিয়ে বুলবুল জানান, বরেন্দ্র অঞ্চলের মিষ্টি স্বাদের পেয়ারার চাহিদা এখন দেশ জুড়েই। তবে এই পেয়ারার জন্য এখন তিনি ঢাকায় বেশ পরিচিত। তার চাষ করা পেয়ারা ঢাকার কারওয়ান বাজার ও যাত্রাবাড়ীতে সরাসারি পাঠানো হয়। এছাড়াও বিভিন্ন স্থান থেকে পাইকাররা আসেন তার কাছে। পেয়ারা ভাঙার পর বাগান থেকেই দর-দাম করে কভার্ডভ্যানে করে নিয়ে চলে যান। এছাড়া রাজশাহীর বাজারেও পেয়ারা সরবরাহ করেন তিনি।    

ছবি: বাংলানিউজএকটা সময় ছিল যখন নির্দিষ্ট মৌসুম ছাড়া পেয়ারা পাওয়া যেতনা। কিন্তু থাই পেয়ারা নতুন এই জাত উদ্ভাবনের পর এখন সারা বছরই পেয়ারা পাওয়া যায়। চাষও হয় বছর জুড়ে। তবে মৌসুমের চেয়ে অসময়ের পেয়ারার দাম বেশি। এ জন্য পেয়ারা চাষিদের লাভও বেশি হয়। সাধারণত আষাঢ়-শ্রাবণ এই দুই মাস পেয়ারার ভরা মৌসুম। ওই সময় পেয়ারার দাম কেজি প্রতি ২০ থেকে ৩০ টাকায় নেমে আসে। তবে এর আগে ও পরে ৮০ থেকে ৯০ টাকা পর্যন্ত ওঠে।

বুলবুলের বাগান ঘুরে দেখা যায়, সারি করে লাগানো মাঝারি আকৃতির পেয়ারা গাছগুলোর প্রতিটিতেই ফল ধরেছে। ফ্রুট ব্যাগিং পদ্ধতিতে এখানে থাই বারী-৩ জাতের পেয়ারা চাষ করা হচ্ছে। ফুল থেকে পেয়ারার রূপ নেওয়ার ছোট অবস্থাতেই ব্যাগিং করা হয়েছে। এর মাধ্যমে রোগ-বালাই, পোকামাকড়, পাখি, বাদুড়, কাঠবিড়ালি এসব থেকে খুব সহজেই পেয়ারাকে রক্ষা করা যাচ্ছে। আর ব্যাগিং করার ফলে পেয়ারা অপেক্ষাকৃত বড় আকারের এবং আকর্ষণীয় সবুজ রঙ ধারণ করছে। ছোট ছিদ্রযুক্ত পলিথিন দিয়ে ব্যাগিং করা হয়েছে বাগানের প্রতিটি পেয়ারা। ব্যাগিং করায় সূর্যের আল্ট্রাভায়োলেট রশ্মি থেকে প্রতিহত হচ্ছে বলে কোষ বিভাজনও বেশি হচ্ছে। মূলত এতেই আকারে বাড়ছে থাই পেয়ারা।

জানতে চাইলে পেয়ারা চাষি বুলবুল জানান, তার গ্রামের বাড়ি পুঠিয়া উপজেলার বিড়লদহে। কিন্তু উঁচু জমিতে পেয়ারার ফলন ভালো হওয়ায় তিনি গোদাগাড়ীর এই লাল মাটির এই অঞ্চলকে বেছে নিয়েছেন। প্রতিদিন সকালে আসেন। আর বিকেলে বাড়ি ফেরেন। জমিতে ভালো ফলনের জন্য তাকে পরিচর্যা করতে হয়। এজন্য শ্রমিকদের সঙ্গে নিজেও কাজ করেন। নিয়ম করে কীটনাশক স্প্রে করতে হয়, সার দিতে হয়, সেচ দিতে হয়। এখানে ১২ বিঘা জমির ওপর তার ১৮শ’ পেয়ারা গাছ রয়েছে। বালিয়াডায়িং ছাড়াও তার তিন বিঘার আরও একটি পেয়ারার বাগান রয়েছে পুঠিয়ায়।

তবে এখানকার ফলন বেশি হয়। একেকটি পেয়ারা ৭শ’ থেকে ৯শ’ গ্রাম পর্যন্ত ওজন হয়। একবার গাছ লাগালে পর পর তিন বছর ফলন পাওয়া যায়। এর পর আবার নতুন জমি খুঁজতে হয়। কারণ থাই পেয়ারা এক জমিতে একবারই হয়। প্রতি সপ্তাহে ৭০ থেকে ৮০ কার্টন করে পেয়ারা ভাঙা হয়। বর্তমানে ৫০ থেকে ৬০ টাকা (পাইকারি) কেজি দরে পেয়ারা বিক্রি করা হচ্ছে। পৌষ এবং মাঘ মাসে ৯০ থেকে ১শ’ টাকা দরে পেয়ারা বিক্রি হবে। উচ্চ ফলনশীল হওয়ায় তার দেখাদেখি আশপাশের গ্রামের বেকার যুবকরাও এখন থাই পেয়ারা চাষে ঝুঁকেছেন বলে জানান বুলবুল।

পেয়ারা বাগান।  ছবি: বাংলানিউজজানতে চাইলে গোদাগাড়ী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা তৌফিকুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, গোদাগাড়ীর বরেন্দ্র অঞ্চল খরা প্রবণ। এখানে পানির স্তর অনেক নীচে। আর জমি অনেক ওপরে। ধান ও অন্যান্য ফসল ফলানো এখানকার কৃষকদের জন্য খুবই কষ্টকর। এজন্য স্থানীয় কৃষকদের পেয়ারা ও মালটার মত ফলের আবাদ করার জন্য উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে।

তৌফিকুর রহমান জানান, নীরক্ষীয় ফল বলে ভিটামিন ‘সি’ সমৃদ্ধ পেয়ারা হচ্ছে বাংলার আপেল। তিনি দু’বছর হলো এখানে বদলি হয়ে এসেছেন। আসার পর থেকে অন্তত: তিন হাজার স্থানীয় কৃষককে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। আর প্রত্যেককেই বলেছেন, যদি সম্ভব হয় তাহলে পেয়ারা চাষ করুন। কারণ উঁচ্চ ফলনশীল হওয়া বাণিজ্যিকভাবে পেয়ারা খুবই লাভজনক। এছাড়া বরেন্দ্র অঞ্চলের মাটি পেয়ারা চাষের জন্য খুবই উপযোগী। ধীরে ধীরে কৃষকরাও বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। এজন্য গোদাগাড়ীতে পেয়ারা চাষে নিরব বিপ্লব ঘটেছে বলেও উল্লেখ করেন গোদাগাড়ী উপজেলার এই কৃষি কর্মকর্তা।

বাংলাদেশ সময়: ০৭৪৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৯, ২০১৭
এসএস/জেডএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।