ঢাকা, বুধবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

কৃষি

‘আমের শহরে’ মুগ্ধতা ছড়াচ্ছে টিউলিপ

শরীফ সুমন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৪০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৭, ২০২২
‘আমের শহরে’ মুগ্ধতা ছড়াচ্ছে টিউলিপ নজরকাড়া টিউলিপের বাহার। ছবি: বাংলানিউজ

রাজশাহী: টিউলিপ একটি ভিনদেশি ফুল। শুভ্র, সুশোভিত ও রক্তরাঙা এই রঙিন ফুলের আছে হরেক রকম রূপ।

টিউলিপের বাড়ি নেদারল্যান্ডসে। কিন্তু অপার সৌন্দর্যের কারণে এই ফুল গোটা বিশ্বেই সুপরিচিত। মূলত শীতপ্রধান দেশের ফুল টিউলিপ। দেখা মেলে আগুন ঝরা ফাগুনে।

হালে দেশের শীতপ্রবণ উত্তরাঞ্চলে পরীক্ষামূলকভাবে এর চাষ শুরু হয়েছে। আর প্রথম প্রচেষ্টাতেই বাজিমাত করেছেন টিউলিপের কয়েকজন স্বপ্নদ্যোক্তা। এরই মধ্যে রাজশাহীর খরা প্রবণ বরেন্দ্রের লাল মাটিতে আমের সাথী ফসল হিসেবে একই বাগানে পত্রপল্লব মেলেছে সুশোভিত ও সুমোহিত ফুল টিউলিপ। এ মুলুকে ফুলপ্রেমী মানুষের অখণ্ড অবসর বিনোদনের মধ্যমণি হয়ে উঠেছে টিউলিপ এখনই। তাই রঙিন টিউলিপ আশা জাগানিয়া হয়ে উঠেছে স্বপ্নচারী তরুণ কৃষি উদ্যোক্তাদের কাছে। কৃষি পর্যটনে দিন বদলের স্বপ্ন দেখাচ্ছে ভিনদেশি টিউলিপ। রঙিন টিউলিপে এরই মধ্যে বিশাল অর্থনৈতিক সম্ভাবনারও হাতছানি দেখছেন তারা। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় বাণিজ্যিকভাবে টিউলিপের চাষ শুরু হলে খুলে যেতে পারে অনেক তরুণ কৃষি উদ্যোক্তার ভাগ্য!সবার হয়ে সেই স্বপ্নের বীজ বুনেছেন হাসান আল সাদী পলাশ। তিনি একজন অগ্রগামী তরুণ উদ্যোক্তা। তার গ্রামের বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার পৌর সদরের পুরাতন বাজার এলাকায়। দীর্ঘদিন থেকেই আমচাষ এবং ব্যবসায় যুক্ত রয়েছেন। রাজশাহী শহর থেকে নয় কিলোমিটার দূরে দামকুড়ার পলাশবাড়িতে পুকুরসহ ১৩ বিঘা জমির ওপর বিশাল আমবাগান রয়েছে তাদের। ওই বাগানে ভেতরই সাথী ফসল হিসেবে পরীক্ষামূলকভাবে রাজসিক ফুল টিউলিপের চাষ করেছেন।

আম বাগানের ভেতরে তিনি প্রাথমিকভাবে এক হাজার বাল্বের টিউলিপ বাগান গড়ে তুলেছেন। এর মধ্যেই রাজশাহী অঞ্চলের প্রধান অর্থকরী ফসল আমের সঙ্গে কৃষি পর্যটনের অংশ হিসেবে ফুলকেও যুক্ত করার সম্ভাবনা দেখছেন তিনি। এতে একদিকে যেমন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়বে। অন্যদিকে তেমনি কর্মসংস্থানের দুয়ারও খুলবে। আর ভ্রমণ ও বিনোদনপিপাসুদের জন্যও আম এবং টিউলিপ বাগান পরিণত হবে অনন্য এক আনন্দ উদযাপনের কেন্দ্রবিন্দু। পরীক্ষামূলক হলেও এরই মধ্যে রাজশাহীর মানুষের মধ্যে সাড়া ফেলেছে এই সারি সারি আমগাছ বেষ্টিত ক্ষুদ্র টিউলিপ বাগান। নয়নাভিরাম ও দৃষ্টিনন্দন এই টিউলিপ ফুলের টানে প্রতিদিনই মানুষজন বাগান দেখতে আসছেন।  এখন পলাশের সেই আমের বাগান হয়ে উঠেছে ফুলের স্বর্গরাজ্য। ভরা বসন্ত না আসতেই ফুলে ফুলে ভরে উঠেছে আম্রকানন। আম বাগানের চারপাশ ম-ম করছে নানান ফুলের সৌরভ। ফুলের মিষ্টি সুবাসে এক ফুল থেকে আরেক ফুলে বসছে মৌমাছির দল।

রঙিন ফুলের বিমোহিত সৌন্দর্যে পুরো প্রকৃতিই যেন মাতোয়ারা হয়ে উঠেছে। প্রকৃতির হিমশীতলতায় সুশোভিত হয়ে গাছে গাছে ফুটে আছে লাল, গোলাপি, কমলা, লাল-কমলা, গোলাপি-লাল ও সাদা সফেদ রঙের টিউলিপ। এর সঙ্গে পুরো আম বাগানজুড়ে আরও আছে চন্দ্রমল্লিকা, গাঁদা, গ্লাডিওলাস, পিটুনিয়া, সেলোসিয়াসহ ১৬ প্রজাতির ফুল। তবে, এত ফুলের বাহার থাকলেও এই বাগান থেকে কোনো ফুল বিক্রি করা হবে না এখনই। নিতান্ত শখের বসেই করা হয়েছে এই বাগান। ফুলে ফুলে সাজানো এই বাগানের নাম রাখা হয়েছে ‘ড্রিমার্স গার্ডেন’। আর ১৩ বিঘার বাগানটিতে বিভিন্ন জাতের সাড়ে ৩শ আমগাছ রয়েছে।

টিউলিপ শীতপ্রধান দেশের ফুল হলেও সার বছরই পাওয়া যায় বলে জানান হাসান আল সাদী পলাশ। পলাশ বলেন, আম ফলে নির্দিষ্ট মৌসুমে। আম গাছে মুকুল আসা থেকে শুরু করে মোটামুটি বছরের ছয় মাস ফল থাকে। এরপর বাকি সময়টা বাগানের জমি প্রায় পড়েই থাকে। এই সময়টা কীভাবে কাজে লাগানো যায়, সেই চিন্তা থেকেই এই ফুলের বাগান। শুরুর দিকে আমের বাগানের মধ্যে ফুল বাগান করার বিষয়টি সবাই বাধা দিয়েছে। কিন্তু তারপরও কেবল মনের জোরেই নতুন এই চ্যালেঞ্জ নিই।

পলাশ আরও বলেন, প্রথম দিকে গোলাপ, গাঁদা, পিটুনিয়া ও সেলোসিয়াসহ পরিচিত কিছু ফুল নিয়ে কাজ শুরু করি। একপর্যায়ে জানতে পারি যে, দেশে টিউলিপ ফুল চাষ হচ্ছে। এরপর নেদারল্যান্ডস থেকে বীজ এনে পরীক্ষামূলকভাবে টিউলিপের সেড তৈরি করি। গত বছরের ১৮ ডিসেম্বর পেঁয়াজের মতই টিউলিপের এক হাজার বীজ বপন করা হয়েছিল। গত জানুয়ারির মাঝামাঝি থেকে প্রায় সব গাছেই ফুল আসছে। এখনও সেই ফুল আছে। মূলত টিউলিপ বছরজুড়েই ফোটে। এটি ধরে রেখে বাণিজ্যিকভাবে আম বাগানের মধ্যেই চাষ করা সম্ভব। এতে একাধারে কর্মসংস্থান, ব্যবসা ও কৃষিনির্ভর পর্যটনে অপার সম্ভাবনার দুয়ার খুলে যেতে পারে। এই ড্রিমার্স গার্ডেনে টিউলিপ ফুল দেখতে প্রতিদিনই ফুলপ্রেমীরা আসছেন। যে কেউ ৫০ টাকা প্রবেশমূল্য দিয়েই টিউলিপসহ অন্য ফুলের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারছেন। বেড়াতে পারছেন। ছবি তুলতে পারছেন। আগামী এক বছরের মধ্যে এই ফুল বাগানের পরিসর বাড়ানোর পরিকল্পনার কথা জানান ওই উদ্যোক্তা।

এদিকে শীতপ্রধান দেশের টিউলিপ প্রশ্নে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. শহিদুল আলম বলেন, এখন উদ্ভাবিত বিভিন্ন পদ্ধতিতে সব কিছুরই চাষ সম্ভব। তাই দেশে টিউলিপ ফুলের চাষও সম্ভব। কেননা স্ট্রবেরি শীতপ্রধান দেশের ফল হলেও আমাদের দেশে সফলভাবে চাষ করা যাচ্ছে। এজন্য পরীক্ষামূলকভাবে টিউলিপও দেশের অনেক এলাকায় চাষ হচ্ছে। ভালো যত্নের মাধ্যমে এটি আমাদের দেশেও চাষ করা সম্ভব।

আর সব অনুষ্ঠানেই এখন মানুষ ফুলকে স্বাগত উপহার হিসেবে ব্যবহার করছে। সেদিক থেকে এটির বাণিজ্য সম্ভাবনা প্রচুর। বেশি ফুল চাষের মাধ্যমে দেশ অর্থনৈতিকভাবেও এগিয়ে যাবে বলে মনে করেন উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের এই অধ্যাপক। আর টিউলিপ চাষ নিঃসন্দেহে একটি উদ্ভাবনী উদ্যোগ বলে মন্তব্য করেন একই বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. ইলিয়াস হোসাইন।  

তিনি বলেন, আম বাগানের পাশাপাশি উদ্যোক্তারা ফুল চাষ করছে। এতে বাগানের সম্পূর্ণ জায়গাই ব্যবহার করা যাচ্ছে। রাজশাহীতে আমবাগান বেশি। তাই সাথী ফসল হিসেবে নতুন এই ফুল চাষ পদ্ধতি বরেন্দ্র অঞ্চলের মানুষের অর্থনৈতিক সচ্ছলতা ফিরে আসতে পারে।

অধ্যাপক ড. মো. ইলিয়াস হোসাইন বলেন, আয় বাড়াতে অনেকেই আম বাগানে হলুদের চাষ করছেন। বড় পুকুরের ওপর রেস্তোরাঁ করছেন। তার নিচে আবার মাছও চাষ হচ্ছে। এ ধরনের গ্রামীণ কৃষকরাই আমাদের মেরুদণ্ড। পুরো উৎপাদন প্রক্রিয়ায় যারা জড়িত তাদের সঙ্গে অনেকেরই কর্মসংস্থান হচ্ছে, যা অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আনছে। এ ধরনের উদ্ভাবনী উদ্যোগগুলো আরও সামনে আনা দরকার বলেও মন্তব্য করেন রাবি অর্থনীতি বিভাগের এই অধ্যাপক।

রাজশাহীর বরেন্দ্র অঞ্চলে টিউলিপ চাষ এই প্রথম উল্লেখ করে রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোজদার হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, এখন দেশের মাটিতে টিউলিপ পরীক্ষামূলকভাবে চাষ করা হচ্ছে। এতে পরিপূর্ণভাবে সফলতা মিললে অবশ্যই অর্থনৈতিক সম্ভবনা রয়েছে। তবে, এজন্য আরেকটু সময় নিতে হবে। গভীরভাবে গবেষণা চালাতে হবে। কারণ নতুন এই ফুল চাষে সফলতা এলে তবেই কৃষক পর্যায়ে বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদ ফলপ্রসূ ও লাভজনক হবে।

বাংলাদেশ সময়: ১২৪০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৭, ২০২২
এসএস/এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।