ঢাকা, বুধবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

ভাষা আন্দোলনের বই অপ্রতুল

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯৩০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২১, ২০২৩
ভাষা আন্দোলনের বই অপ্রতুল ভাষা আন্দোলনের চেতনা ধারণ করে প্রতিবছর আয়োজন হয় অমর একুশে বইমেলা। ছবি: শাকিল আহমেদ

ঢাকা: ভাষা আন্দোলন আমাদের গৌরবের ইতিহাস। অন্যদিকে শোকেরও।

এ আন্দোলন নানা দিক থেকে দেখার ও তুলে ধরার দাবি রাখে। কিন্তু কাজটি খুব সহজ নয় বলে ভাষা আন্দোলনবিষয়ক বই প্রকাশ হয় খুব কম। তবে আশার কথা, প্রতি বছরই বইমেলায় ভাষা আন্দোলন ও এ-বিষয়ক কিছু বই প্রকাশ হচ্ছে। অনেকেই ভাষা আন্দোলনের নানা শাখা-প্রশাখা ধরে নতুন কিছু প্রকাশের চেষ্টা করছেন।

ভাষা আন্দোলনের চেতনা ধারণ করে প্রতিবছর আয়োজন হয় অমর একুশে বইমেলা। প্রতিবছরই নতুন, পুরোনো মিলিয়ে অনেক লেখকের কয়েক হাজার বই প্রকাশিত হয়। তবে এসব গল্প, কবিতা, উপন্যাস, প্রবন্ধ ও গবেষণামূলক বইয়ে ভাষা আন্দোলন বা তার চেতনা কতটুকু স্থান পাচ্ছে, তা প্রশ্নসাপেক্ষ। বাস্তবতা হলো, মেলা চষে বেড়িয়ে ভাষা আন্দোলন নিয়ে ২০টি বইয়েরও খোঁজ মেলেনি। যে কয়েকটি বই চোখে পড়ে, তার বেশিরভাগ পুরোনো লেখকদের। অর্থাৎ ভাষা আন্দোলন নিয়ে নতুন লেখকদের আগ্রহ কম।

প্রকাশকরা বলছেন, ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস ও পূর্বাপর নিয়ে যথাযথ পাণ্ডুলিপি ও গবেষণার অভাবে তারা বই প্রকাশ করতে পারছেন না। আবার ভাষা আন্দোলন নিয়ে বইয়ের কাটতিও কম। তাই অনেক প্রকাশক এ বিষয়ে বই প্রকাশে আগ্রহ দেখান না।

মেলার প্রথম ২০ দিনে ২ হাজার ২৮১টি নতুন বইয়ের নাম গেছে বাংলা একাডেমির তথ্যকেন্দ্রে, যার অধিকাংশই কবিতা, গল্পগ্রন্থ ও উপন্যাস। এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধ, অনুবাদ, প্রবন্ধগ্রন্থের পাশাপাশি রয়েছে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা নানা গ্রন্থও। তবে ভাষা আন্দোলন নিয়ে খুব সামান্যসংখ্যক গ্রন্থই চোখে পড়ে।

বাংলা একাডেমির তথ্যকেন্দ্রের তালিকা এবং বিভিন্ন প্রকাশনীর তথ্য অনুযায়ী, এবার মেলায় আসা ভাষা আন্দোলন নিয়ে বইয়ের সংখ্যা নেহায়েত কম। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- আহমদ রফিকের 'একুশ থেকে একাত্তর' (অনিন্দ্য) ও 'ফিরে দেখা অমর একুশ ও অন্যান্য ভাবনা' (সময়), গোলাম কুদ্দুছের 'ভাষার লড়াই ও রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন' (নালন্দা) ও 'বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলন' (অন্যপ্রকাশ), রফিকুর রশীদের 'ছড়িয়ে গেলো ভাষার লড়াই' (আগামী), 'ভাষার লড়াই ছড়ায় ছড়ায়' (য়ারোরা বুক কর্নার), এম আবদুল আলীমের 'রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে রফিকুল ইসলাম' (আগামী প্রকাশনী), 'ভাষা-আন্দোলনে তাজউদ্দীন আহমদ' (ঝুমঝুমি প্রকাশনী), 'ভাষা আন্দোলনের জানা-অজানা ইতিহাস' (ইত্যাদি গ্রন্থপ্রকাশ), 'রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলন জেলাভিত্তিক ইতিহাস' (আগামী), আহমেদ রশিদের 'ভাষাশহিদদের কথা' (ইত্যাদি গ্রন্থপ্রকাশ), শাহনেওয়াজ চৌধুরীর 'বঙ্গবন্ধু, একুশ ও মুক্তিযুদ্ধের গল্প' (শোভা প্রকাশ), আখতার হোসেন মল্লিকের 'ভাষা সংগ্রাম ও বইমেলা' (জলছবি), শেলী সেনগুপ্তার 'নারীর ভাষা আন্দোলন' (গ্রন্থ কুটির), মোস্তফা দুলালের 'জ্যোতির্ময় একুশ' (প্রিয় বাংলা)।

ইতিহাসের অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, প্রতিবছর নিয়ম করে কিছু বই হয়তো ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট নিয়ে প্রকাশিত হয়। সেসব বইয়ে আগ্রহ থাকে ইতিহাস পাঠে উন্মুখ তরুণদের। কিন্তু গবেষণার মান নিয়ে বলতে ইচ্ছা করে না।

বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখক ও সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির বলেন, বইমেলায় ভাষা আন্দোলন বা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যে বইগুলো প্রকাশিত হয়, তাতে এক দল পাঠকের আগ্রহ থাকে ঠিক। কিন্তু এসব বইয়ের গবেষণার মান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। ভাষা আন্দোলন নিয়ে যে বইগুলো এর আগে আমি দেখেছি, মনে হলো বই বের করার জন্যই মেলা উপলক্ষে বই প্রকাশ করা। হাতেগোনা কয়েকজন গবেষক ছাড়া বাকিরা ক'জন ভাষাসংগ্রামীর সাক্ষাৎকার, ওই সময়ের পত্রপত্রিকার সংকলন বা আগে প্রকাশিত বই থেকে তথ্য নিয়ে নতুন করে বই প্রকাশ করছে। গবেষণাধর্মী তো বই এমন করে হয় না। লেখককে গবেষণায় আরও সময় দিতে হবে।

কথাসাহিত্যিক রফিকুর রশিদ বলেন, এ বিষয়ে আমরা বড্ড অবহেলা করছি। ভাষা আন্দোলন যেন পুরোনো হয়ে গেছে আমাদের কাছে। এ প্রসঙ্গে প্রবীণদের দায়িত্ব পালন করতে হবে নবীনদের ইতিহাস জানাতে। কিন্তু আমাদের গল্প, কবিতা, উপন্যাসে ভাষা আন্দোলন হারিয়ে যাচ্ছে। ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করেই আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছি, যুদ্ধে জয় লাভ করেছি। কিন্তু কেন জানি আমরা এ ইতিহাসকে স্মরণ করছি না। ২১ ফেব্রুয়ারি এলে একটি দিনের জন্য আমরা ভাষা আন্দোলনকে দিবস আকারে পালন করি। ভাষা আন্দোলনের যে লক্ষ্য ছিল, তা দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে। আমাদের রাজনীতিকদের রাজনীতির মাধ্যমে, সাহিত্যিকদের সাহিত্যের মাধ্যমে ভাষা আন্দোলনকে খুঁজে ফিরতে হবে। পূর্বপুরুষরা যে স্বাক্ষর রেখেছেন উত্তরপুরুষদের জন্য, আমাদেরও তা পালন করতে হবে।

অনন্যা প্রকাশনীর প্রকাশক মনিরুল হক বলেন, ভাষা আন্দোলন নিয়ে বই প্রকাশ করতে পাণ্ডুলিপির সবচেয়ে বড় অভাব। এর জন্য প্রচুর পড়াশোনা করতে হবে, জানতে হবে। আমাদের তরুণরা সাহিত্যের অন্য শাখা নিয়ে কাজ করলেও ভাষা আন্দোলন নিয়ে গবেষণা করে না। তারা এ বিষয়ে সময় নিয়ে লিখতেও চায় না। যে কয়টি বই আসে, তার মধ্যে ভাষাসংগ্রামী বা জ্যেষ্ঠ গবেষক লেখকরা দু-একটি লেখেন।

আগামী প্রকাশনীর প্রকাশক ওসমান গণি বলেন, পরিতাপের বিষয় ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের কাছ থেকে আমরা খুব বেশি লেখা পাইনি। ভাষা আন্দোলন নিয়ে গবেষক, লেখকের অভাব আমরাও অনুভব করি। রাষ্ট্রীয়ভাবে ভাষা আন্দোলন বিষয়ে গবেষণা করে বই প্রকাশ করা উচিত। মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট এ ক্ষেত্রে কাজ করতে পারত। কিন্তু আমরা তাদের কাছ থেকে এ বিষয়ে কিছুই পাইনি।

বাংলাদেশ সময়: ১৯২৯ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২১, ২০২৩
এইচএমএস/এসএ


 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।