পেশাসূত্রেই রাজপথের রাজনীতিরও রাজদর্শক তিনি। ক্যামেরার চোখে চোখ রেখে তিনি বাংলাদেশের ধারাবাহিক রাজনীতিনাট্য দেখেছেন; সে সূত্রে তিনি দশকের পর দশক ধরে চলা দৃশ্যের পর দৃশ্যের অদৃশ্য দ্রষ্টা, আমাদের দীর্ঘ আত্মঘাতী বিধ্বংসী বিভেদ-বিচ্ছেদ ভাঙ্গনপ্রক্রিয়ার অত্যন্ত মনোযোগী বোদ্ধা দর্শকও তিনি।
ফটোসাংবাদিক হিসেবে আবু তাহের খোকনের নাম বাংলাদেশের সাংবাদিকতার ইতিহাসে এক উজ্জ্বল নাম। রাজপথের উত্তাল রাজনীতি থেকে শুরু করে মানুষের হাসি-কান্না, প্রকৃতির সৌন্দর্য আর জীবনের বহুমাত্রিক ছবি তিনি তুলে ধরেছেন ক্যামেরার লেন্সে। সেই ছবিশিকারী মানুষটি এবার ধরা দিলেন শব্দের জগতে—কবিরূপে। তার প্রথম কবিতার বই “মনের কথা” যেন এক অনন্য ভুবন, যেখানে ফটোসাংবাদিকের চোখে দেখা বাস্তবতা আর অন্তরের গভীর অনুভূতি মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে।
“মনের কথা” মোট পঞ্চান্নটি কবিতার সংকলন। এখানে কবি কখনো লিখেছেন প্রেম-ভালোবাসার কথা, কখনো রাগ-ক্ষোভ, দুঃখ-অভিমান, আবার কখনো সমাজ-বাস্তবতা, বৈষম্য আর অনাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। তাঁর কবিতা জটিল কোনো দার্শনিক ঘোরে আচ্ছন্ন নয়, বরং সরল শব্দে নিরাভরণ সত্যকে প্রকাশ করেছে। এ কারণেই পাঠকের কাছে তার কবিতা হয়ে উঠেছে সহজবোধ্য, আপন, আর অন্তরঙ্গ।
বইয়ের কবিতাগুলো পড়তে পড়তে মনে হয়, এগুলো শুধু আবু তাহের খোকনের নিজের “মনের কথা” নয়, বরং আমাদের সবার হৃদয়ের প্রতিধ্বনি। সমাজ ও দেশের প্রতি দায়বদ্ধতা, মানুষ ও মাটির প্রতি মমত্ববোধ, এবং ভাঙন-বিক্ষোভে ক্ষতবিক্ষত এক জাতির যন্ত্রণা তাঁর কবিতায় স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
আবু তাহের খোকনের জীবনও যেন তাঁর কবিতার মতোই সংগ্রামী। ফটোসাংবাদিকতার দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তিনি বহুবার আহত হয়েছেন, বাবা-মায়ের মৃত্যুর সময়ও পাশে থাকতে পারেননি। অথচ সেই ত্যাগ-তিতিক্ষাই তাঁকে আরও দৃঢ় করেছে, আরও গভীর করেছে তাঁর দৃষ্টিকে। ছবির মতোই শব্দেও তিনি খুঁজে পেয়েছেন সত্যকে, খুঁজে পেয়েছেন মানবিকতার আলো।
মনের কথার বিশেষত্ব হলো—এখানে কোনো কৃত্রিমতা নেই। সহজ ভাষা, সরল বাক্য, অথচ ভেতরে ভেতরে এক অগাধ আবেগ। পাঠকের মনে হবে, কবি যেন তাঁর নিজের কথাই বলছেন। আর সেখানেই “মনের কথা” হয়ে ওঠে সত্যিকারের সবার মনের কথা।
কবিতাপ্রেমী কিংবা সমাজ-বাস্তবতায় আগ্রহী যে কেউ এই বই থেকে খুঁজে পাবে নিজের প্রতিচ্ছবি। বলা যায়, আবু তাহের খোকনের “মনের কথা” আজ আমাদের সবারই মনের কথা।
তাঁর “এমন একটা দেশের কথা ভাবি”–র মতো কবিতাগুলো শুধু ব্যক্তিগত অনুভূতি নয়, বরং জাতির দীর্ঘ রাজনৈতিক বিভাজন ও সামাজিক বৈষম্যের প্রতি প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়। একসময় যে মানুষ ক্যামেরায় সময়কে ধরে রেখেছেন, এখন তিনি শব্দে ধরে রাখছেন অনুভূতির ইতিহাস।
কবি নিজেই লিখেছেন, মনের কথা আমার একান্ত নিজস্ব ভাষাভঙ্গিতে ভালোলাগা, ভালোবাসা, রাগ-ক্ষোভ-দুঃখ-অভিমান, প্রতিরোধ-প্রতিবাদের প্রকাশ। এর কোনো একটা লেখার একটা লাইনও যদি কারও ভালো লাগে, একজন পাঠকেরও মনের কথার সঙ্গে মিলে যায়, সেটুকুই আমার পাওয়া।
তাঁর এই সাদামাটা চাওয়া অপূর্ণ থাকেনি । ছবিশিকারী খোকন যখন শব্দশিকারী কবি হিসেবে হাজির হন, 'মনের কথা' সবার 'মনের কথা' বলেই মনে হয় তখন।
মনের কথার প্রারম্ভ বা সূচনা-কবিতার শিরোনাম, ‘এমন একটা দেশের কথা ভাবি’। পড়ে পাঠকের মনে হবে যেমন একটা দেশের কথা আমরা চেতনে অবচেতনে সবাই ভাবি। এসব কবিতা শুধু সাদামাটার শব্দে কোনো গতানুগতিক কবির অনুভূতি নয়, বরং এক দীর্ঘ প্রত্যক্ষদর্শী জীবনের তীব্র আর্তনাদ বলে মনে হয়।
“মনের কথা” কেবল একটি কবিতার বই নয়, বরং এক জীবনকাব্য—যেখানে একজন ফটোসাংবাদিকের চোখে দেখা ইতিহাস, লড়াই, দুঃখ, ভালোবাসা আর স্বপ্ন মিশে গেছে কবির কলমে। বইটি পাঠকের মনে একদিকে গভীর চিন্তার খোরাক জাগাবে, অন্যদিকে এনে দেবে মানবিকতার আলো।
তাঁর সমাপনী কবিতার শিরোনাম “কবর প্রাসাদ”। এই কবিতায় তিনি নির্মম প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন—
“কবরে প্রাসাদ পাবে, পালঙ্কে ঘুমাবে,
তেমন কিছু তুমি করে যাচ্ছ কি?”