ঠিক এমনই কোনো আশ্চর্য মুখ দেখলেই বুঝি শরীরের অলিগলি ছুঁয়ে যায় মাখনের মতো এক ভীষণ মখমলি অনুভূতি কিংবা এক গ্লাস কাতর শূন্যতায় ছুঁয়ে যায় চুনিরঙা উষ্ণ ওয়াইন। এগারো ডিগ্রি সেলসিয়াসের এই শহরে উজ্জ্বল চুনিরঙা ঠোঁট কিংবা ঠোঁট থেকে নেমে আসা দেশের নামটাই হয়তো এক গড়পড়তা ক্যাশিয়ারের ফ্ল্যাশব্যাকে জুড়ে দেয় ওয়াইনের উষ্ণতা।
আর তারপর মেয়ের জীবনের সবথেকে স্মরণীয় এক কাপ ক্যাপিচুনো তৈরির চেষ্টা করতে করতে শওকত আলম প্রশ্ন করেছিল—কোত্থেকে এসেছো মেয়ে? শুষ্ক চুনিরঙা ঠোঁট থেকে নেমে আসা স্প্যানিশ উচ্চারণে দেশের নাম প্রথমে ভীষণ অচেনা মনে হয়—চিলে। চিলে! এ কি মহাবিশ্ব ছাড়িয়ে কোনো অমরাবতীর ঠিকানা, কোনো পরাবাস্তবতা!
অনুভূতিকে শব্দে এতটা উত্থাল অথচ সংযত করতে পেরেছিল বলেই অরুণ মহসিন ছিল কবি, তা না হলে ছেলেটা প্রেমিক হতো। তাই কবি হতে না পারার আক্ষেপে নয় বরং জয়শ্রী রাণী দাসের এই না পাওয়াটুকু ভেবেই কখনো কখনো কষ্ট পেয়েছে সে, পেয়েছে সান্ত্বনাও। সেই কবি-বিদ্বেষী আজ এই তেত্রিশ ডিগ্রি সেলসিয়াসের শহরে নিজস্ব গোপন অনুভূতিতে আকুল হতে হতে এক কবির গভীরে নিজেকে একাকার করে, তোলপাড় করে, ভাঙচুর করে—“in which there is no I or you, so intimate that your hand upon my chest is my hand, so intimate that when I fall asleep your eyes close.”
আয়নার মুখোমুখি হয়ে ভীষণ সময় নিয়ে দুল থেকে শুরু করে পায়ের নখ অবধি একটাই স্বৈরচারী রঙ—এরকম খুঁটিয়ে মিলিয়ে মিলিয়ে পড়ার মতো মানুষই নয় মেয়েটি তবু ওর সব কেমন মিলে একাকার হয়ে গেছে—চুনিরঙা হ্যাট, চুনিরঙা পিঠের ব্যাগ, কালো স্কার্ট, সাদা টপ, কালো বুট, শীত ছুঁয়ে যাওয়া ঠোঁট, বিউটি পার্লার এড়ানো নখ, ঝকঝকে চোখ—সব মিলিয়ে বড় এক উচ্ছ্বল স্বাধীন পাখি যাকে দেখেই ভাঙচুরে-ভাঙচুরে, তোলপাড়ে-তোলপাড়ে আরো একবার থমকে যায় পৃথিবী, গোপনে উচ্চারিত হয়—‘আমি আকাশে পাতিয়া কান শুনেছি শুনেছি তোমারই গান, আমি তোমারে স্বপেছি প্রাণ!’ যাকে দেখলে ভীষণ জানতে ইচ্ছে হয়—কোত্থেকে এসেছো বিদেশিনী?
খাবারের দোকানের এক গড়পড়তা ক্যাশিয়ার শওকত আলম তাই অনেকটা সাহস নিয়ে অনভ্যস্ত ইংরেজিতে প্রশ্নটা করেই ফেলে—কোত্থেকে এসেছো? তা না হলে কতটুকু সময়ই বা দাঁড়াত মেয়েটি শওকত আলমের পৃথিবী থমকে দিতে? শুধু তো মেয়ে চেয়েছিল এক কাপ ক্যাপুচিনো কফি। কফির ওপর হুইপড ক্রিম দেবে কি না জানতে চাইলে মেয়ে ভাঙ্গা ইংরেজিতে নিদ্বির্ধায় উত্তর দিয়েছিল—হুইপড ক্রিম কী সেটাই তো জানি না। ভনিতাহীন না জানার এই সরলতাটুকুই হয়তো ছুঁয়ে গিয়েছিল শওকত আলমকে, ফ্রিজ থেকে বের করে ক্যানে ক্রিমের ছবি দেখালে মেয়েটির মুখে ফুটেছিল যে উজ্জ্বল হাসি, শওকত আলমের গভীর ছুঁয়ে নিয়েছিল সে হাসির রেখা। আর তারপর মেয়ের জীবনের সবথেকে স্মরণীয় এক কাপ ক্যাপিচুনো তৈরির চেষ্টা করতে করতে শওকত আলম প্রশ্ন করেছিল—কোত্থেকে এসেছো মেয়ে?
শুষ্ক চুনিরঙা ঠোঁট থেকে নেমে আসা স্প্যানিশ উচ্চারণে দেশের নাম প্রথমে ভীষণ অচেনা মনে হয়—চিলে। চিলে! এ কি মহাবিশ্ব ছাড়িয়ে কোনো অমরাবতীর ঠিকানা, কোনো পরাবাস্তবতা! কফির কাপে ফোম ছড়াতে ছড়াতে হঠাৎ আবিষ্কার করে নিজের গভীরে চিলে, চিলি, আহা, সবুজ উপত্যকার দেশ, চুনিরঙা আঙুরের দেশ, পাবলো নেরুদার দেশ। শওকত আলমের হঠাৎ মনে পড়ে অতীতের এক গোধূলি, রূপেশ্বরীর জলে আলোড়িত ত্রিভূজ—অরুণ মহসিন, শওকত আলম এবং দলিত সম্প্রদায়ের আলোড়ন জয়শ্রী রাণী দাস।
সেদিন শওকত আলম ছিল ত্রিভূজের সব থেকে দুর্বল বাহু, নৌকো চালাতে জানা এক নিতান্ত মাঝি আর যুবরাজের মতো মুঠোতে তাবৎ জয় নিয়ে কবি অরুণ মহসিন চিনিয়েছিল পাবলো নেরুদা—“Then love knew it was called love. And when I lifted my eyes to your name, suddenly your heart showed me my way.” আজও যেন নেমে এলো সেই গোধূলির আলো, কল্পনার রূপেশ্বরীতে যুবরাজ যেন সেই তালব্য-শ আর অতি দূর সমুদ্রের’ পর হালভাঙা নাবিকের পাশে দখিনা হাওয়ার মতো এক চিলতে চিলের ফুল...
কুড়ি মিনিটের ব্যাপ্তি এতটা দিঘল হতে পারে ভেবেছিল কি এয়ারপোর্টে খাবারের দোকানের এক গড়পড়তা ক্যাশিয়ার শওকত আলম! ভিড় ছিল না বলেই হয়তো কিংবা ভিড়ের গভীরেও আঁকড়ে নিয়েছে চুনিরঙা ঠোঁটের মেয়েটির সাথে কুড়ি মিনিটের জীবন—দেখেছে টেবিলে বসা মেয়েটির কফি খাওয়া, বিস্ময়ে ভেবেছে কফি ছুঁয়ে গেলে বুঝি এতটা আদুরে হয় ঠোঁট! নাহ, কামনা দিয়ে তাকে সাজায়নি, শুধু ভালোলাগা দিয়ে।
এটুকুতেই হয়তো শেষ হতে পারত কিন্তু মেয়েটি পুনরায় শওকত আলমের কাছে আসে—ম্যানু দেখে বেছে নেয় স্যান্ডউইচ। শওকত আলমের মতো এতটা যত্ন করে কেউ হয়তো কোনোদিন গরম করেনি স্যান্ডউইচ। প্রচণ্ড ক্ষিধেয় মেয়েটি বিল মেটাতে মেটাতেই মুখে তোলে স্যান্ডউইচ, কথা হয় টুকটাক। শওকত আলম জেনে নেয় আরো কিছুটা ফুলের জীবন। গত এক বছর চুনিরঙা চিলের ফুল ছিল বাবার সাথে আমেরিকায়। আমেরিকা কেমন লাগল এ প্রশ্নের উওরে মেয়ে বলেছিল—‘এই এক বছরে ভীষণ মিস করেছি চিলেকে। দেখো, আমার কাছে বিদেশটা ঘুরতে যাওয়ার জন্যই ভালো, ঘুরলাম-ফিরলাম, ব্যাস। প্রবাস আমার পথ, নিয়তি নয়। তাই এবার বাড়ি ফিরছি’। আহা, শেকড়ের টানে ফিরে যাওয়া এক চিলের পাখি নেমে আসে তারও গভীরে। শওকতেরও কি ফিরে যেতে ইচ্ছে করে না সেই রূপেশ্বরীর কাছে, নিজের উত্থাল শেকড়ে? কিন্তু মেয়ের মতো সবাই কি ফিরতে পারে?
গড়পড়তা শওকত আলমের পৌরাণিক আমলের মুঠোফোনে ছবি কিংবা সেলফি তোলার বিলাসিতা নেই, আর তাই একটা ছবি কাছে রাখতে চাওয়ার দুরন্ত ইচ্ছেকে সরল অনুরোধে ব্যক্ত করতে পারে না রূপেশ্বরী গ্রামের মৃত দৌলত হালদারের সাদামাটা বড় ছেলে শওকত আলম। গোপন ব্যথা জেগে উঠতে উঠতেই হঠাৎ মনে হয় অন্তত নামটা জানা যদি সম্ভব হয়, রুমমেট ইকরামের ফোনে কিংবা সাইবার ক্যাফেতে বসে ফেসবুকেও তো খুঁজে নিতে পারে চিলের ফুল, দূর থেকে চোখ দিয়ে ছুঁয়েও তো যেতে পারে আরো কিছু পরাবাস্তবতা কিংবা লিখে নিতে পারে এক যুবরাজের বড় আশ্চর্য নিয়তি। শওকত আলম বুঝে গেছে অনুরোধের প্রত্যুত্তরে হাজার প্রশ্ন চোখে সাজিয়ে জেরা কিংবা অবজ্ঞা করবে এমন নয় এ ফুল, এ ফুল সরল শীষের মতো দুলে ওঠে অনায়াসে বলতে পারে—‘আনিলাম অপরিচিতের নাম ধরণীতে’।
ঠিক তখনই শওকত আলমের পৌরাণিক মুঠোফোনে শিউলি ঝরে পড়া সুখেল মুহূর্তের মতো মিসকল আসে, যে মিসকলের মানে ‘ব্যস্ত বুঝি খুব কাজে? আপনাকে মনে পড়ছে’ নাকি এ মিসকল ভিড়ে টানাপোড়েনের মতো। শওকত আলমেরও মনে পড়ে ইয়াসমিনের মুখ—যাকে দেখতে আজকাল প্রায়ই যায় শওকত আলম, এ যাওয়া-আসা আম্মা অথবা আম্মার বান্ধবী ইয়াসমিনের খালার অনুরোধ নাকি একান্তই নিজের ইচ্ছের টানে ভালো বুঝতে পারে না সে। শুধু মনে হয় জ্বর গায়ে মেয়েটাকে দেখতে ভীষণ অন্যরকম লাগে। সেই অন্যরকম মায়াবতী দেখার ঘোরেই হয়তো শওকত আলম যায়, চুপ করে বসে থাকে, জ্বর দেখে, দেখে জ্বরে পড়া মেয়ে, মাঝে-মধ্যে টুকটাক কথা হয়, কখনো কখনো মনে হয় বালিশের পাশে রাখা হাতটা বুঝি একটু এগিয়ে আসলো শওকতের দিকে।
হঠাৎ একদিন যাওয়া না হলে কিংবা দেরি হয়ে গেলে মেয়েটা রাগ করে বিছানা থেকে দূরে বেতের সোফাটা ঠেলে রাখে, তারপর রাগ পড়ে এলে বলে—একটু এগিয়ে আসুন তো, কিছু শুনতে পাচ্ছি না। পিতৃ-মাতৃহীন এই মেয়েটার রাগ, অভিমান, বালিশের ধারে শুয়ে থাকা জ্বরমাখা হাত শওকতেরও কি ভীষণ ভালো লাগে না! শওকতও কি ভাবে না আজকাল, ঘুম আসার আগে কিংবা বাসের জানালার পাশে বসে, একদিন ছুঁয়ে ফেলবে এগিয়ে রাখা হাত কিংবা কপাল ছুঁয়ে টের পাবে জ্বর। অনেক তো হলো ভেসে থাকা...
এই সামান্য জীবনে বেশি কিছু তো চায়নি এই গড়পড়তা শওকত আলম। চেয়েছিল ভীষণ কাছের একজনের সুতোর কাজে চুপ সুখের মতো ছোট্ট এক তালেব্য-শ হয়ে থাকবে কিংবা কোনো দেয়াল অথবা গাছ অপরাজেয় ভালোবাসার মতো যোগ চিহ্নের পাশে রেখে দেবে এক অমোঘ তালব্য-শ। অবশ্য এতদিনে বুঝে গেছে শওকত আলম—কী এমন আছে তার যে কেউ এমন করে কাছে টানবে তাকে! নিয়মভাঙ্গা ফুল জয়শ্রী রাণী দাস কোনোদিন যত্ন করে ধরে রাখেনি একটা তালব্য-শ। কিন্তু আজকের টানপোড়েন কি অমোঘ সত্যি কিংবা বোঝাপড়ার সামনে দাঁড় করিয়ে দেবে এক নিতান্ত তালব্য-শকে? চিলের চুনিরঙা ফুল কি তার এই গড়পড়তা জীবনটাকে অন্যরকম করে দিতে আসবে! নাকি জ্বর গায়ে মেয়েটা ইঞ্চিখানেক দূরত্ব এড়িয়ে আজ নিজেই এগিয়ে দেবে হাত, ছুঁয়ে ফেলবে গড়পড়তা তালব্য-শয়ের যাবতীয় ইতস্তত জীবন, তারপর এক মেহেদী রাঙানো হাতে কোনো বান্ধবী যত্ন করে লিখে দেবে এক তালব্য-শ, নববধূ গোপনে চুমু খাবে সেই তালব্য-শ-এর ওপর...
কাগজের টুকরোটা হাতে নিয়ে খাবারের দোকানের গড়পড়তা ক্যাশিয়ার শওকত আলম এগিয়ে যায় নাকি থমকে যায় আমাদের আর চোখে পড়ে না। আমরা দেখি চিলের আশ্চর্য ফুল, চুনিরঙা ঠোঁটের মেয়ে এগিয়ে যাচ্ছে এয়ারপোর্টের সিকিউরিটির দিকে।
বাংলাদেশ সময়: ১৫৪০ ঘণ্টা, মার্চ ৩, ২০১৬
টিকে/