আজ রাতে রাক্ষস বধ করবে রাখাল যুবক আইজান। রাজা তাকে বর্ম পরে নিতে বললেন।
‘অন্তত তুমি একটা তরবারি নাও। ’ রাজা অনুরোধ করেন।
‘নাহ, বলছি তো আমি ওকে শারীরিক শক্তি দিয়ে মোকাবিলা করবো না। আমি আমার সততা, আত্মবিশ্বাস, পবিত্রতার আলো দিয়ে ওকে মারবো। ’
রাজা তো জানেন। রাখাল যুবক আইজান কোনো সাধারণ বালক নয়। নিশ্চয় তার নিজস্ব কোনো অলৌকিক শক্তি রয়েছে। সে তার মতো করেই রাক্ষসটাকে মারুক। রাক্ষসের বিনাশ হলেই তো হলো।
সেদিন সারা রাত আইজান জেগে থেকে রাক্ষসের অপেক্ষা করতে লাগলো। রাজা বীরেন সিং তরবারি হাতে তার পাশে পাশেই থাকলেন। সমস্ত রাজ্যে প্রহরীরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে, রাক্ষসের কোনো খবর পেলেই তারা ছুটে এসে রাজা ও আইজানকে জানাবে। কিন্তু কোথাও থেকে কোনো খবর এলো না।
এভাবে সাত সাতটি দিন কেটে গেলো। রাক্ষসের কোনো খবর নেই। রাজা-প্রজা, উজির-নাজির সবাই ভাবলো, রাক্ষস হয়তো আইজানের খবর শুনে ভেগেছে। এদিকে, আইজানের সঙ্গে রাত জেগে জেগে রাজা ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। আইজান বললো, ‘রাজা সাহেব আপনি বিশ্রাম নেন। আপনাকে আর রাত জেগে আমার সঙ্গে থাকতে হবে না। আমি জেগে থাকবো। আপনি কোনো চিন্তা করবেন না। ’ যদিও রাজা রাক্ষস বধের পুরো সম্মানটা আইজানকে দিতে চান না। কিন্তু শারীরিক অবস্থার কথা ভেবে আইজানের কথা মেনে নিলেন।
অষ্টম রাতে আইজান একাই শহর পাহারা দিতে লাগলো। ঠিক মাঝ রাতে তার চোখজোড়া ঘুমে ভারী হয়ে এসেছিলো। হঠাৎ বুপ বুপ একটা আওয়াজ শুনলো। ডাহুক পাখি আতঙ্কিত হলে এমনি আওয়াজ করে। প্যাঁচাগুলো ফড়ফড় পাখা ঝেড়ে উড়ে পালালো। নিশ্চয়ই মন্দ কিছু একটা ঘটেছে। সামান্য দূরের বাঁশঝাড়টাকে অস্বাভাবিকভাবে নড়ে-চড়ে উঠতে দেখলো আইজান। সে ওদিকে এগিয়ে গেলো। বাঁশঝাড় থেকে একঝাঁক সাদা বক উড়ে গেলো আকাশে। কিন্তু হঠাৎই একটা বিশাল হাত বাঁশঝাড়ের আড়াল থেকে উড়ন্ত বকগুলোকে ধরে ফেললো। আইজান দৌঁড়ে গেলো সেদিকে। ওহ! কী ভয়ানক দৃশ্য। বকগুলোকে গপাগপ মুখে পুরে চিবিয়ে খাচ্ছে এক বিশাল রাক্ষস। আইজানকে দেখে তেড়ে এলো রাক্ষসটি। আইজান পিছিয়ে গেলো।
রাক্ষসটি সাদা ফেনার মতো থুথু ছিটালো আইজানকে লক্ষ্য করে। আইজান সরে গেলো। যেসব স্থানে থুথু পড়লো সেখানে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠছে।
এবার আইজান তার কোমরের ভাঁজ থেকে বাঁশিটা বের করলো। বাঁশিতে এক অদ্ভুত সুর তুললো সে। সেই সুরের মূর্ছনায় রাক্ষসের সমস্ত শরীর থরথর করে কেঁপে উঠলো। রাক্ষস এক বীভৎস চিৎকার দিলো। চিৎকারে রাজার সব প্রজার ঘুম ভেঙে গেলো। মশাল হাতে ওরা সবাই বাইরে বেরিয়ে এলো। রাজকর্মচারী ও অমাত্যরা ছুটে এলো। তারা সবাই নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলো সেই রাক্ষসের ভয়ানক সব কাণ্ড-কীর্তি। রাক্ষসটি তার দু’কানে হাত দিয়ে ছটফট করছে আর চিৎকার করে চলেছে। কী ভয়ানক সে চিৎকার! গাছপালা দালান-কোঠা সব কেঁপে কেঁপে উঠছে। আইজান তার বাঁশির সুর তীব্র করে তুললো। রাক্ষসের ছটফটানি আরও বেড়ে গেলো। এভাবে কিছুক্ষণ চলার পর রাক্ষসটির চোখ-মুখ-কান দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়তে লাগলো। মাটিতে লুটিয়ে পড়লো সে। ধীরে ধীরে তার শরীরটা ফুটো বেলুনের মতো চুপসে যেতে থাকলো। রাক্ষসের বীভৎস চেহারাটাও পাল্টে মানবীয় রূপ পেতে থাকে। প্রজারা অবাক হয়ে নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতে লাগলো, এতো আমাদের রাজা মশাই, বীরেন সিং। এ কী দেখছি আমরা। রাজার নিঃসাড়-নিথর দেহটা প্রজাদের সামনে রক্ত-কাদায় মাখামাখি হয়ে পড়েছিলো। সবার অবাক দৃষ্টি সেদিকে। প্রজাদের মনে অনেক প্রশ্ন এসে জমা হয়েছে। কে দেবে সেসব প্রশ্নের উত্তর?
রাজার দরবারি, অমাত্যরা ভয়ে পাথর হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। এবার প্রজারা না ক্রুদ্ধ হয়ে তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে! কারণ তারাই তো ছিলো রাজার তোষামোদকারী- কাছের লোক- সব কাজের সঙ্গী। কিন্তু তেমন কিছু ঘটার আগেই সেখানে সেই দরবেশের অবির্ভাব ঘটলো। তিনি সবাইকে বুঝিয়ে বললেন, ‘তোমাদের রাজার উপর এক রাক্ষসের প্রেতাত্মা ভর করেছিলো। এসব তারই কুকীর্তি। তোমাদের রাজাও সেটা জানতো না। ’ সেই প্রেতাত্মার হাত থেকে তোমাদের বাঁচাতে হলে রাজার মৃত্যু ছাড়া আর কোনো পথ ছিলো না। কারণ, রাক্ষসের সেই প্রেতাত্মা একমাত্র মানুষের উপর ভর করলেই দৃশ্যমান হয়। ’
প্রজারা সবাই বলল, ‘তাহলে এবার আমাদের নতুন রাজা কে হবে? রাজা ছাড়া তো রাজ্য অচল। ’
প্রজাদের মধ্য থেকে কেউ কেউ বলে উঠলো, ‘রাখাল যুবক আইজান হবে আমাদের নতুন রাজা। সেই আমাদের রাক্ষসের হাত থেকে বাঁচিয়েছে। তাছাড়া তার মতো সৎ, আদর্শবান, নির্লোভ রাজা সারা ব্রহ্মাণ্ডে খুঁজলেও পাবো না। ’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, আইজানকে রাজা করাই হবে সঠিক সিদ্ধান্ত। ’- প্রজারা একসঙ্গে বলে উঠলো। রাজন্যরা প্রজাদের বোঝানোর চেষ্টা করেন, আইজান তো রাজ-পরিবার এমনকি রাজবংশের কেউ নয়। সে সামান্য রাখাল বালক।
প্রজারা প্রতিবাদ করে বলে, ‘তাতে কী? সংখ্যার শুরুটা তো শূন্য থেকেই হয়। আর রাজ পরিবারের প্রজাশাসনের ইতিহাস তো আমাদের সামনেই আছে। তারা কতটা নির্দয় আর প্রজাশোষক ছিলেন। আইজান আমাদের মুক্তির পথ দেখিয়েছে। আজ আমরা কোনো বাধাই মানবো না। আইজান হবে আমাদের রাজা। ’

ক্রুদ্ধ প্রজাদের বিরুদ্ধে রাজন্যরা আর দ্বিমত করার সাহস পেলেন না।
দরবেশ চুপচাপ সবার কথা শুনছেন আর মনে মনে হাসছেন।
রাখাল যুবক আইজান প্রজাদের বোঝায়, পাহাড় আর বনের সৌন্দর্যের মধ্যে বসাবাসেই তার আনন্দ। এসব পাথরের দালানে তার জীবন দুর্বিসহ হয়ে পড়বে। তাকে প্রসূন নগরে ফিরে যাবার অনুমতি দেওয়া হোক।
কিন্তু কে শোনে কার কথা? প্রজারা চিৎকার করে স্লোগান দিতে থাকে, আইজান, আইজান, আইজান।
বৃদ্ধ মন্ত্রী হারুন জানা এবার হাত তুলে সবাইকে চুপ করতে বলে, থামুন, আপনারা থামুন। আমি আইজানের সঙ্গে কথা বলছি। সে আইজানকে বলে, দেখো, প্রজারা যখন তোমাকে মানে আপনাকে চাইছে, তাদের মতামতকে আপনার সম্মান করা উচিত।
আইজান কী করবে বুঝে উঠতে পারে না। সে ভীষণ দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মধ্যে পড়ে যায়।
আইজান কিছুক্ষণ ভাবার পর বলে, ‘ঠিক আছে রাজ্যের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে না আসা পর্যন্ত আমি রাজ্যশাসন করবো। কিন্তু তারপর আমাকে ছেড়ে দিতে হবে। ’
প্রজারা আনন্দে নেচে ওঠে। সবাই আইজান, আইজান বলে স্লোগান দিতে থাকে। এক বিশেষ দিনে আইজানের রাজ্যাভিষেক ঘটে। প্রজারা পুষ্পাঞ্জলি দিয়ে, বার বার রাজা আইজানের নামে জয়ধ্বনি তুলে তাকে বরণ করে নিলো। রাজন্য, বণিক, প্রতিবেশী রাজ্যের রাজারা সোনা, রূপা, হীরা, জহরতসহ নানা মূল্যবান উপঢৌকন পাঠিয়ে নতুন রাজাকে সম্মান জানালেন।
এরপর দিন যায় রাত যায়, সপ্তাহ যায়, মাস যায়, বছর যায় রাজ্যের প্রজারা রাজা আইজানের শাসনে সুখেই দিন কাটতে থাকে। দেশ দিন দিন সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে চলে। রাজা আইজান তার প্রিয় প্রসূন নগরের কথা একসময় ভুলে যায়। এখন সে আর বাঁশিও বাজায় না। সে রাজ্য নিয়ে মহাব্যস্ত হয়ে পড়ে।
রাজা আইজান এখন আর বালক নয়, পূর্ণ যুবক। একদিন রাতে সে ঘুমিয়ে রয়েছে। হঠাৎ সেই রাক্ষসের আত্মাটা জানালা দিয়ে বাতাসের সঙ্গে রাজার শয়ন কক্ষে প্রবেশ করে। তারপর সে রাজা আইজানের শরীরের মধ্যে প্রবেশ করে। ঠিক যেভাবে রাজা বীরেন সিংয়ের ভেতরে প্রবেশ করতো।

বাংলাদেশ সময়: ১৭১৮ ঘণ্টা, মার্চ ২৭, ২০১৬
এসএস
** এক যে ছিলো রাখাল বালক | সোলায়মান সুমন