গ্রাম্যবধূ যেমন সুনিপুণ যত্ন-দক্ষতায় অধীর আগ্রহ ও ধৈর্যে অমলিন কাপড়ে সুঁইয়ের ফোঁড়ে-ফোঁড়ে স্বপ্নের মণিকোঠায় গেঁথে তোলে নকশি কাঁথা, তেমনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা সাহিত্যের প্রতিটি শাখা-উপশাখায় সযতনে আপন মহিমা আর প্রতিভায় বিচরণ করে গেছেন। রবীন্দ্রপূর্ব বাংলা সাহিত্য কেবল স্বভাষী জনগোষ্ঠীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো।
বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে মহৎ সাহিত্যিক হিসেবে প্রায় সব গুণই ধারণ করতেন রবীন্দ্রনাথ। তার উদার ও সুদূরপ্রসারী দৃষ্টিভঙ্গি যেকোনো পাঠককে দেশ-কালের সীমানা পেরিয়ে এক বিস্তৃত ও ধ্রুপদী উপলব্ধির জগতে নিয়ে যায়। তাই দ্বিধাহীনভাবেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে বলা যায়, বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। তার ভেতর বাঙালির শৈল্পিক সৌন্দর্যবোধ ও মননশীলতার উপাদানসমূহের সর্বোচ্চ প্রকাশ ঘটেছে। রবীন্দ্রনাথ নিজেই আকাশের রবির মতো উজ্জ্বল।
বাংলাসাহিত্যে প্রথম সার্থক উপন্যাস রচনার কৃতিত্ব যেমন বঙ্কিমচন্দ্রের, অনুরূপভাবে বাংলা ছোটগল্পের সার্থক সূচনা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাতে। এই সার্থকতা এতোটাই উচ্চমানের যে, কোনো কোনো সাহিত্য বিশ্লেষক মনে করেন, শুধু ছোটগল্প সৃষ্টির জন্য রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যিক হিসেবে বিশ্বজনীন খ্যাতি ও স্বীকৃতি লাভের যোগ্যতা রাখেন। মানবজাতির অভিন্ন অনুভূতি ও প্রত্যাশার কথা মাথায় রেখেও স্বীকার করতে হবে, আমাদের জীবনাচার ও প্রকাশভঙ্গির সঙ্গে পাশ্চাত্যের ভাবনার রয়েছে যোজনব্যাপী দূরত্ব। তাই বালজাক, চেখভ অথবা মোপাসাঁর ছোটগল্পের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথরচিত ছোটগল্পের তুলনা করতে গিয়ে অনেককে হিমশিম খেতে দেখা যায়। রবীন্দ্রনাথ তার ছোটগল্পের অন্দরে-বাহিরে অবাক করা এক ভূবন তৈরি করে গেছেন যা কেবল বাংলা সাহিত্যকেই সমৃদ্ধ করেছে তা নয়, সেই সঙ্গে বিশ্বসাহিত্যের অমিতাভ বিভারূপে বিরাজমান। কবিতা, গান, উপন্যাসসহ নাটকের যে দখল, তার ছোটগল্প সেগুলোকেও ছাড়িয়ে গেছে। সময় আর সভ্যতার প্রয়োজনে নয় বরং রবীন্দ্রনাথ নিছক প্রকৃতি আর প্রেমের বাস্তবিক রূপ প্রকাশের তাগিদ থেকেই সৃষ্টি করেছেন তার প্রতিটি গল্প এবং যা পরবর্তীতে এক বিশাল মহীরূহরূপে বিরাজমান আমাদের সাহিত্য আসরে। রবীন্দ্রনাথের ছিন্নপত্রাবলীর অনেক চিঠিই এ মন্তব্যের স্বপক্ষ সমর্থন করে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ গল্পের প্রসঙ্গে ছিন্নপত্রাবলীর ১৪৯ নম্বর পত্রে লিখেছিলেন- ‘পুরোনো ইতিহাস ছিল তার হাড়গুলো বের করে; তার মাথার খুলিটা আছে, মুকুট নেই। তার উপরে খোলস মুখোশ পরিয়ে একটা পুরোপুরি মূর্তি মনের জাদুঘরে সাজিয়ে তুলতে পেরেছি তা বললে বেশি বলা হবে। ঢালচত্তির খাড়া করে একটা খসড়া মনের সামনে দাঁড় করিয়েছিলুম, সেটা আমারই খেয়ালেরই খেলনা’।
(পত্র-১৪৯; ছিন্নপত্রাবলী। )
রবীন্দ্রনাথ আমাদের সাহিত্যিক আশ্রয়। আমাদের জাতিসত্তার শেকড়ে প্রোথিত যে মূল মর্মবাণী তার পুরোটাজুড়েই কেবল রবীন্দ্রনাথ। তার কবিতা, গান আমাদের বাঙালি চেতনাকে সুশোভিত করে, সৌকর্যমণ্ডিত করে, তার ছোটগল্প দিয়ে যায় অপরূপ এক মনোভূমি। বাংলা ছোটগল্পের সর্বপ্রথম সার্থক স্রষ্টা, বাংলা ছোটগল্পের জনক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তার ছোটগল্পে বিষয় বৈচিত্র্য, সমাজ বাস্তবতা, জীবন ঘনিষ্ঠতা, চরিত্র চিত্রণ ও মনুষ্যত্ব বিশ্লেষণে যতোটা সার্থকতার পরিচয় দিয়েছেন, অন্য কোনো লেখক অতীতে ততোটা সার্থক হতে পারেননি।
গল্পকার রবীন্দ্রনাথ তার ছোটগল্প সম্পর্কে সোনার তরী কাব্যের ‘বর্ষা যাপন’ কবিতায় বলেছেন- ‘ছোটো প্রাণ, ছোটো ব্যথা/ ছোটো ছোটো দুঃখ কথা
নিতান্তই সহজ সরল/ সহস্র বিস্মৃতি রাশি, প্রত্যাহ যেতেছে ভাসি/ তারই দু’-চারটি অশ্রুজল’।
বাস্তবিক অর্থে তিনি জীবনের বহুবিধ রূপ বর্ণনার সার্থক শিল্পী, মানব মনোবিশ্লেষণের ক্ষেত্রে তার ছোটগল্পে সঠিক ধারার রূপায়ন ঘটিয়েছেন। সাধারণ বাস্তবতা ও ব্যক্তি মানুষের অন্তবেদনার এক মনোরম বহিঃপ্রকাশ তার ছোটগল্পে। একজন সার্থক শিল্পীর মতো জীবনের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষের অনুভূতির সূক্ষ্ণ বিষয়গুলোকে অত্যন্ত নিখুঁতভাবে শিল্পিত করেছেন। বিশেষ করে নারীর চাওয়া-পাওয়া ভালোলাগা, মন্দলাগা, তথা মনোবিশ্লেষণে তিনি একজন দক্ষ শিল্পী। তার ছোটগল্পের নারী চরিত্রগুলো আমাদের সদাজাগ্রত চিরচেনা জগতের বাসিন্দা, আমাদের একান্ত কাছের আপনজন। বাঙালি নারী সমাজের নিপীড়নের নানা চিত্র শিল্পিত রূপে প্রকাশ করেছেন।
বাংলা সাহিত্যের বহু বিশেষণে বিশেষিত বাংলা ছোটগল্পের রূপকার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মূল বিষয় বাস্তব জীবন ও সমাজ সংসারের আলেখ্য। পল্লী গ্রামবাংলায় বেড়ে ওঠা অতি সাধারণভাবে যেসব জনমানুষের চিত্র আঁকা হয়েছে, তাদের সবাইকে আমাদের প্রতিবেশী হিসেবে পাঠক অবলীলায় মেনে নেয়। বিশেষ করে নারী জীবন, বাস্তবতার স্পর্শে মহিমান্বিত রূপে আত্মপ্রকাশ করেছে। গ্রাম্য বিধবা, গৃহবধূ, কুমারী, বাল্যবধূ, তরুণী প্রভৃতির সমাবেশ গল্পগুলো অবিসংবেদীরূপে প্রত্যক্ষধর্মী হয়ে উঠেছে। ‘দেনাপাওনা’র নিরূপমা, ‘মানভঞ্জন’র গিরিবালা, ‘মহামায়া’ গল্পের মহামায়া; ‘মাল্যদান’ গল্পের কুড়ানি; ‘সুভা’ গল্পের সুভা আমাদের সবার অতি পরিচিত নারী চরিত্র। রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পে প্রত্যেকটি নারী চরিত্রই স্বমহিমায় ভাস্বর।
রবীন্দ্রনাথ ছোটগল্প লেখা শুরু করেন ১২৯৮ বাংলা সনে। তখন থেকে ১৩১০ সনের মধ্যে তার বেশিরভাগ গল্প রচিত। তার একটি বিখ্যাত গল্প ‘পোস্টমাস্টার’ ১২৯৮ সালে লেখা। এর কিছুদিন আগে থেকে তিনি জমিদারি দেখাশোনার ভার নিয়েছেন। তার দিন কাটছে পদ্মার ওপরে নৌকায় ভেসে ভেসে শাহজাদপুর ও শিলাইদহে। আনন্দময় বৈচিত্র্যে ভরপুর এ সময়ের জীবনযাত্রা। তিনি পদ্মাবোটে চড়ে পাড়ি জমিয়েছেন আত্রাই, বড়াল, নাগর, করতোয়া, পদ্মা আর যমুনায়। বাংলাদেশের একটি নির্জন প্রান্ত; তার নদী তীর, উন্মুক্ত আকাশ, বালুচর, অবারিত মাঠ, ছায়া সুনিবিড় গ্রামে সহজ অনাড়ম্বর পল্লীজীবন, অভাবক্লিষ্ট অথচ শান্তসহিষ্ণু গ্রামবাসী- কবি বিমুগ্ধ বিস্ময়ে, পুলকে, শ্রদ্ধায় ও বিশ্বাসে এসবের অপরিসীম সৌন্দর্য আকণ্ঠ পান করেছেন। ধীরে ধীরে বাংলাদেশের পল্লীজীবনের সুখ-দুঃখের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ পরিচয় শুরু হয়। পল্লীজীবনের নানা বেদনা আর আনন্দ যখন তার মনকে অধিকার করে বসলো, তখন তার ভাব ও কল্পনার মধ্যে আপনাআপনি বিভিন্ন গল্প রূপ পেতে শুরু করলো। ১৮৯৪ সালের ২৭ জুন শিলাইদহ থেকে একটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘আজকাল মনে হচ্ছে, যদি আমি আর কিছুই না করে ছোট ছোট গল্প লিখতে বসি তাহলে কতকটা মনের সুখে থাকি এবং কৃতকার্য হতে পারলে পাঁচজন পাঠকেরও মনের সুখের কারণ হওয়া যায়। গল্প লিখবার একটা সুখ এই, যাদের কথা লিখব তারা আমার দিনরাত্রির অবসর একেবারে ভরে রেখে দেবে, আবার একলা মনের সঙ্গী হবে, বর্ষার সময় আমার বদ্ধঘরের সঙ্কীর্ণতা দূর করবে এবং রৌদ্রের সময় পদ্মা তীরের উজ্জ্বল দৃশ্যের মধ্যে আমার চোখের পরে বেড়িয়ে বেড়াবে’।
রবীন্দ্রনাথ বুঝতে পেরেছিলেন সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা, দিনাতিপাত ও সাধারণের জীবনদর্শনকে কাজে লাগিয়ে তুলে ধরা যাবে পুরো সমাজচিত্র এবং এর মাধ্যমেই সমৃদ্ধ হবে গোটা বাংলা সাহিত্য। যদিও পদ্মা বোটে, পাবনার শাহজাদপুর ও নওগাঁর পতিসরে জমিদারি তদারকির সুবাদেই রবীন্দ্রনাথের গল্পে উঠে এসেছে তৎকালীন সমাজের উঁচু স্তর থেকে পুরোপুরি নিচুস্তরের মানুষের কথা, আচার-ব্যবহার-সংস্কৃতি আর নির্বিকার শুদ্ধ জীবনাচার। রবীন্দ্রনাথের পুরো সাহিত্য জীবনকে বিশ্লেষণ করলে ছোটগল্পের সময়টুকু খুব বড় তা নয় বরং ব্যাপক বর্ণাঢ্য ও সুগভীর দৃষ্টিভঙ্গিমার সার্থক উপমা। তার গল্পের অধিকাংশ ঘটনা ও চরিত্র বাস্তব এবং কেবলমাত্র ভালোবাসার চাদরে মোড়ানো এসব চরিত্রের প্রকাশ। এ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের মন্তব্যটিও প্রণিধান আবশ্যক, ‘এগুলি নেহাত বাস্তব জিনিস। যা দেখেছি, তাই বলেছি। ভেবে বা কল্পনা করে আর কিছু বলা যেত, কিন্তু তাতো করিনি আমি’।
রবীন্দ্রনাথের গল্পে অবলীলায় উঠে এসেছে বাংলাদেশের মানুষ আর প্রকৃতি। তার জীবনে গ্রামবাংলার সাধারণ মানুষের জীবনাচার বিস্ময়ের সৃষ্টি করে। তার গল্পের চরিত্রগুলোও বিচিত্র- অধ্যাপক, উকিল, এজেন্ট, কবিরাজ, কাবুলিওয়ালা, কায়স্থ, কুলীন, খানসামা, খালাসি, কৈবর্ত, গণক, গোমস্তা, গোয়ালা, খাসিয়াড়া, চাষি, জেলে, তাঁতি, নাপিত, ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট, দারোগা, দালাল পণ্ডিতমশাই, নায়েব, ডাক্তার, মেথর, মেছুনি, মুটে, মুদি, মুন্সেফ, যোগী, রায়বাহাদুর, সিপাহী, বাউল, বেদে প্রমুখ। তার গল্পের পুরুষ চরিত্র ছাড়া নারী চরিত্র অধিকতর উজ্জ্বল।
বিভিন্ন গল্পের চরিত্রের প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ একসময় তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়কে লিখেছিলেন, ‘পোস্টমাস্টারটি আমার বজরায় এসে বসে থাকতো। ফটিককে দেখেছি পদ্মার ঘাটে। ছিদামদের দেখেছি আমাদের কাছারিতে’।
সত্যিকার অর্থেই রবীন্দ্রনাথ তার জীবনাচারের সামগ্রিক উপমার সবিশেষ ফলাফল পেয়েছিলেন নিজেকে জমিদারিতে নিযুক্ত করে। কেবল ছোটগল্প সৃষ্টিই নয় বরং তিনি তৎকালীন চিত্র তুলে ধরেছেন বিশ্ববাসী ও বিশ্বসাহিত্য কর্মীদের সামনে। আরও একটি বিষয় প্রাধান্য পেয়েছে তার গল্পে, সেটিকে ভাষাশৈলীর চরম উৎকর্ষতা বললে অত্যুক্তি হবে না- সেটি প্রকাশ ভঙ্গিমা। তার গল্পগুচ্ছের সর্বমোট ১১৯টি গল্পের প্রকাশ ভঙ্গিমা মারাত্মক পর্যায়ের ব্যতিক্রমধর্মী। বলা যায়, রবীন্দ্রনাথ যে কথা কবিতায়, গানে প্রকাশ করতে বাধাপ্রাপ্ত হয়েছিলেন এবং যে কথা তিনি সাধারণ, সাবলীল ভাষায় বলতে পারেননি তাইই ব্যক্ত করেছেন গল্পে। তারপরও জীবনাচার, ধর্মীয় অনুশাসনের বাইরে না গিয়ে তিনি সৃষ্টি করেছেন ছোটগল্পের মারাত্মক যুদ্ধক্ষেত্র যেখানে তিনি নিজেই সারথী ও নিজেই অর্জুন। কখনও কথক ভঙ্গিমায়, কখনওবা বৈঠকি ঢঙে আবার কখনওবা মারাত্মক পর্যায়ের গাম্ভীর্যের মাধ্যমে তার কাব্যভাষা পরিশীলিত রূপে রূপান্তরিত হয়েছে গদ্য ভাষায়। আবার তার গল্পের শুরু থেকে শেষ অবধি যে বাকময়তা এবং একটি ঘটনাকে সম্প্রসারিত করে কয়েকটি দীর্ঘ ঘটনার প্রকাশ আর যে চলমান ভঙ্গিমা, সত্যিকার অর্থেই সেটি বাংলা সাহিত্যের এক নতুন দরজা খুলে দিয়েছিলো। এ কারণে রবীন্দ্রনাথ গল্পের মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যকে চরম সার্থকতায় পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন।
ছোটগল্প রচনা প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ নিজের সম্পর্কেই করে গেছেন সহজ ও সাবলীল স্বীকারোক্তি, “আমি প্রথমে কেবল কবিতাই লিখতুম, গল্পে-টল্পে বড় হাত দিই নাই, মাঝে একদিন বাবা ডেকে বললেন, ‘তোমাকে জমিদারির বিষয়কর্ম দেখতে হবে’। আমি তো অবাক; আমি কবি মানুষ, পদ্য-টদ্য লিখি, আমি এসবের কী বুঝি? কিন্তু বাবা বললেন, ‘তা হবে না, তোমাকে এ কাজ করতে হবে’। ‘কী করি? বাবার হুকুম, কাজেই বেরুতে হলো। এই জমিদারি দেখা উপলক্ষে নানা রকমের লোকের সঙ্গে মেশার সুযোগ হয় এবং এ থেকেই আমার গল্প লেখারও শুরু হয়”।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গল্পে মানব জীবনের দ্বিধা-বিরোধ, আনন্দ-হাসি আর স্বাভাবিক জীবনাচারের বিষয়গুলো মুখ্য হয়ে ওঠে। গল্পের ধারাবাহিকতায় উঠে আসে সমাজ আর শ্রেণি বৈষম্যের নানা গতি-প্রকৃতি। সাহিত্যিক জীবনের সূচনালগ্নে রবীন্দ্রনাথ ছোটগল্পে প্রবেশ করলেও তার স্বীয় বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল ছোটগল্পগুলোর সূত্রপাত ঘটে ১৮৯১ সালে। রবীন্দ্রনাথ মূলত কবি এবং তার অধিকাংশ কবিতাই লিরিকধর্মী। এই গীতিময়তা তার ছোটগল্পেও প্রবলভাবে উপস্থিত। প্রকৃতির সঙ্গে পরিপূর্ণ একাত্মবোধ, জীবনের আপাততুচ্ছ ব্যাপারকেও পরম রমণীয় ও অপূর্ব রহস্যময় হিসেবে অনুভব করা, এসবের প্রতি অসম্ভব শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস, নিজেকে একান্তভাবে নির্লিপ্ত করে দিয়ে একমনে জীবনকে প্রকৃতির সব অভিব্যক্তির মধ্যে উপভোগ করা- এসবই রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পগুলোতে অপূর্ব রসে অভিষিক্ত হয়ে উঠেছে। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বজনীনভাবে আমৃত্যু গভীরভাবে ধ্যান-জ্ঞান বিলিয়ে দেওয়ার সাধনায় নিমিত্ত থেকে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন। কখনও তিনি নিজেকে মেলে ধরেছেন কবিতায়, মানুষের জীবনের শোকগাথাকে তুলে ধরেছেন ছোটগল্প-উপন্যাসে, কখনও বিজয়মুকুটে আসীন হয়েছেন সঙ্গীতের মূর্ছনায়। মানবসত্তাকে বিশ্বপ্রকৃতির কাছে প্রকাশ করতে, বিশেষভাবে বাঙালিকে শেখাতে চেয়েছিলেন- বিশ্বজনীন হয়ে বিশ্বমানবতার পথে হাঁটতে। তাই রবীন্দ্রনাথ তার মহৎ সাহিত্যকর্মের জন্যই মানুষের কাছে বাঙালির পাঠকের কাছে চিরকাল বেঁচে থাকবেন। বাংলা, বাংলা সাহিত্য আর রবীন্দ্রনাথ একই সত্তা। একটাকে বাদ দিয়ে অন্যটার পরিপূর্ণতা অর্জন কখনই সম্ভব নয়।
বাংলাদেশ সময়: ১১১৬ ঘণ্টা, মে ০৮, ২০১৬
এসএনএস