ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

ভ্রমণামৃত-৬

ইউজিন শহর।। দরজায় অচেনা আগন্তুক

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০১১ ঘণ্টা, জুন ১৭, ২০১৬
ইউজিন শহর।। দরজায় অচেনা আগন্তুক

ইউজিন শহর একা একা এক্সপ্লোর করতে মন চাইলো। বৃষ্টিমুখর দুপুরে একা বেরিয়ে গেলাম দক্ষিণ ইউজিনের স্পেন্সার ভিউ থেকে।

একা একা বেরিয়ে হারিয়ে যাওয়া কিংবা নগর আবিষ্কার আমার পুরনো অভ্যেস। শহর-নগরের জীবনযাত্রার সঙ্গে মিশে এর প্রাণসূত্রটি আবিষ্কারের জন্য জনযানে চড়ার বিকল্প নেই। এতে ভ্রমণ-অভিজ্ঞতার ঝুলিতেও বলার মতো কাহিনি জমা হয়।   নব্বুই সালে কলকাতা গিয়ে প্রথম হারিয়ে যাই। ভরবিকেল থেকে পথঘাট খুঁজে শেষাবধি রাত বারোটায় খুঁজে পাই জাকারিয়া স্ট্রিটের হোটেল। এরপর যতো ভ্রমণ করেছি, কোনো না কোনোভাবে হারিয়েছি ইচ্ছে অনিচ্ছেয় । আজ এ শহরে হারিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে হলো বড়।

গুগলিং করে শহরের পথঘাট সম্পর্কে একটা আইডিয়া নিয়েছিলাম। নদী-খাল বিধৌত, গুচ্ছ পাহাড়বেষ্টিত প্রশান্ত মহাসাগর উপকূলের এক চমৎকার প্রকৃতিময় শহর ইউজিন। শহরের স্লোগান ‘সিটি অব আর্টস অ্যান্ড আউটডোরস’। তাই আজ ঘর নয়, আউটডোরকে আরাধ্য মানলাম। রাস্তায় বের হয়ে বুঝলাম, শহরের জীবনযাত্রা সম্পর্কে ধারণা নিতে জনযানবাহনে ভ্রমণের যে থামরুল নিজে তৈরি করে নিয়েছি, ইউজিনের ক্ষেত্রে তা খাটবে না। শহরের জনযানবাহনের ব্যাপারটি পুরো ভিন্ন। নব্বুইভাগ মানুষ নিজস্ব গাড়িতে হুসহাস চলে ঢাউস রাস্তায়। আমার মতো ক্যাজুয়াল ভ্রামণিক, স্বল্পখরচে চলা শিক্ষার্থী আর গাড়ি কেনার সামর্থ্য নেই এমন স্থানীয়রা কেবল জনযাননির্ভর। গাড়িবিহীনদের জন্য আছে পর্যাপ্ত বাস, ট্যাক্সিসহ নানা যানবাহন। বৃহত্তর জনগোষ্ঠি এর বাইরে বলে জীবনযাত্রার প্রাণসূত্রও জনযান থেকে পাওয়া দুরূহ। বাসা থেকে বেরিয়ে এলটিডি-বা লেন কাউন্টি ট্রান্সপোর্ট সিস্টেমস’ পরিচালিত বাস ছাউনিতে গিয়ে দাঁড়ালাম। এ ছাউনিটি হিলিয়ার্ড স্ট্রিটের ২২ নম্বর এভিনিউয়ে। এ শহরের এভিনিউ ও স্ট্রিটগুলো একমুখি বলে হিলিয়ার্ড স্ট্রিট হয়ে সব গাড়িই যায় ইউজিন স্টেশনে। ইউজিন স্টেশন মূলত বাসস্ট্যান্ড। বিভিন্ন নম্বরের বাসগুলো এখান থেকে যাত্রীদের শহরের নানাপ্রান্তে নিয়ে যায়।


হিলিয়ার্ডে দেখি আমার মতো আরেকজন মাত্র যাত্রী। সে চীনা, আমি বাঙালি। ২৭, ২৮ ও ৭৩ নম্বর বাস এখানে থামে। বাসের টিকেট চালকের কাছে পাওয়া যায়। দিনমানের টিকেটের দাম তিন ডলার ৭৫ সেন্ট। একমুখি যাত্রার টিকেট এক ডলার ৭৫ সেন্ট। আমাদের দেশের মতো কন্ডাক্টর সিস্টেমস এখানে নেই। বাসে উঠে চালককে আগে থেকে কাটা পাস বা টিকেট দেখাতে হয়। সমপরিমাণ টাকা দিয়ে চালকের কাছ থেকে টিকেটও কাটা যায়। বেশিরভাগ চালকই মধ্যবয়স্কা নারী। আমি দিনমানের টিকেট বা ‘ডে-পাস’ই কাটতে চাইলাম। এতে আনলিমিটেড ভ্রমণের সুযোগ আছে। বাসে উঠে দশডলারের নোট দিয়ে চালকের কাছে ডে-পাস চাইলাম।   মহিলা চালক মুখে হাসি ধরে রেখে বললো-
সরি, আই ডোন্ট হ্যাভ অ্যানি চেঞ্জ।
ভাবলাম, বেটি বলে কী! তাহলে যাবো কি করে!
বললাম-‘হাউ ক্যান আই গো টু মাই ডেস্টিনেশন?’।
চালক বুঝলো আমি এ শহরে নুতন অভ্যাগত।
বললো, ‘আই উইল টেক ইউ অ্যাট ইউজিন স্টেশন উইদাউট চার্জ, দেন ইউ ক্যান কালেক্ট ইওর ডিজায়ার্ড টিকেট ফ্রম কাস্টমার সার্ভিস। ’

আমি ইউজিন স্টেশনেই যেতে চাচ্ছিলাম। কারণ সেখান থেকে কোন বাস শহরের কোন দিকে যাচ্ছে, তা জেনে বুঝে ডে-পাসে কিনে ভ্রমণ শুরু করা যাবে। ইউজিন নেমে দেখলাম, ৬৬ নম্বর বাসে চড়লে শহরের ভ্যালি রিভার সেন্টারসহ ওক এলাকার গ্রোসারি শপ ‘মার্কেট অব চয়েসে’ যাওয়া যায়। যাওয়ার আসার পথে ভিলামেট রিভার ও কবুর্জ গুচ্ছ পাহাড়সহ নানা দৃষ্টিনন্দন দৃশ্য আছে। সে মতে, ডে-পাস কিনে ৬৬ নম্বর বাসে উঠে বসলাম। শহরের আঁকাবাঁকা পথ পেরিয়ে আরামদায়ক বাস হেলেদুলে চলতে শুরু করলো। বাসে বাইকারদের সাইকেল নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা, হুইলচেয়ার ওঠানোর ব্যবস্থাসহ নানা এন্তেজাম আছে। এগুলো দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম ভিলামেট নদীপারের ওক স্টপেজে। পাশেই ‘মার্কেট অব চয়েস’। সদাইপাতিতে মন দিলাম। মার্কেট অব চয়েসে নানা জিনিস দেখে কিনতে আগ্রহ হলো, তবে চয়েস করতে একটু দেরিই হয়ে গেল। ফিরতি পথে ঘটলো অনিচ্ছেয় হারিয়ে যাওয়া আর  বৃষ্টিবিড়ম্বনার দুর্ভোগ।

ওক থেকে প্রথম ফিরতে হবে ইউজিন স্টেশনে। তারপর বাস বদলে স্পেন্সারভিউমুখো প্যাটার্সন স্ট্রিট কিংবা হিলিয়ার্ড স্ট্রিটের ২২ নম্বর এভিনিউয়ে আসতে হবে। এখানকার বাসগুলো মিনিট মেপে চলে। দেখলাম,ইউজিন স্টেশনে পৌঁছার পর আমার বাস ট্রান্সফারটা খুব মিলছে না। হয় বহুক্ষণ বসে থাকতে হবে না হয় হিলিয়ার্ড-প্যাটার্সনে আমাদের ২২ নম্বর এভিনিউয়ের আশপাশ দিয়ে চলে এমন বাসে উঠে পড়তে হবে। এমন একটি বাসের নম্বর ৭৬। এই বাস ইউনিভার্সিটি অব অরেগন ও ওয়ারেন পাহাড়ি এলাকার মধ্যে চলাচল করে ইউজিন স্টেশনের পাশ দিয়ে। ১১ নম্বর এভিনিউ অলিভ স্টপেজ থেকে এই বাস উঠে পড়লাম। এটা হিলিয়ার্ড স্ট্রিট ছুঁয়ে যাবে। ওই বাস ঢাউস রাস্তা,পার্ক, সবুজবেস্টিত পথ পেরিয়ে ওয়ারেন-উইলশায়ারের পাহাড়ি রাস্তায় গিয়ে উঠলো। বুঝতে বাকি রইলো না আমি ফিরতি বাসে না উঠে এর আপ রুট বা ওয়ারেনমুখো বাসে  চড়েছি। শেষ স্টেশনেও নামছি না দেখে ফাঁকা বাসে মহিলা চালক লুকিং গ্লাসে বার বার তাকাতে লাগলো। তার মনে জিজ্ঞাসা বুঝতে পের  আমিই মুখ খুললাম।  

‘আই টুক দ্য রং ওয়ান, সো আই হ্যাভ টু গো ব্যাক উইথ ইউ’।

বাসের ভেতর রাখা রাইডার বুকে চোখ রাখলাম। দেখলাম, এই বাসই ফিরে ইউজিন স্টেশন হয়ে হিলিয়ার্ড স্ট্রিট হয়ে যাবে অরেগন বিশ্ববিদ্যালয়ে। ইউজিন স্টেশনে নেমে আরেক বাসে হিলিয়ার্ড বা প্যাটার্সন স্ট্রিটে যেতে পারি, তবে সে বাস ছাড়ার সময় আরও দেরিতে। হিলিয়ার্ড স্ট্রিট নেমেই হেঁটে বাসায় যেতে পারবো ভেবে এই বাসেই গাঁট হয়ে বসলাম।   নিরিবিলি পাহাড়-টিলার রাস্তায় শুধু আমাকে নিয়েই মধ্যবয়স্কা বাসচালক ধীরে ধীরে চলতো লাগলো। আমি বাসে বসেই শহরে এ প্রান্তটি উপভোগ করতে লাগলাম।

ইউজিন স্টেশন হয়ে হিলিয়ার্ড স্ট্রিটে আমাকে নামিয়ে দিল বাসচালক। নামার পরই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি, কনকনে ঠান্ডা। নিজেকে আরেক ভুলের মধ্যে আবিষ্কার করলাম। হিলিয়ার্ড স্ট্রিটে নেমেছি বটে, তবে তা ১৩ এভিনিউ বরাবর, আমার বাসা ২২ নম্বর এভিনিউয়ে । ১৩ থেকে ২২ এই ১০ এভিনিউ পাড়ি দিতে মাইল দুয়েক পথ হাঁটতে হবে। ফাঁকা রাস্তায় ঝাঁপানো বৃষ্টির মধ্যে সে রাস্তায় হাঁটা বড় কষ্টকর। মাথায় রুমাল পেঁচালাম। হাতে কাগজের কেজি কয়েক বাজার। বৃষ্টিতে চোখের চশমার কাঁচ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। ভিজে রুমাল,কাপড় চোপড় দিয়ে মুছে পরিষ্কার করা যাচ্ছে না। গায়ে হুডির বদলে সাধারণ জ্যাকেট, পায়ে কাপড়ের জুতো। বাজার থেকে আনা কাগজের ব্যাগটা ইতোমধ্যে ভিজে জবজবে। যে কোনো সময়  জিনিসপত্র পড়ে যাওয়ার আশঙ্কায় বাঁ হাতের তালুতে রেখে ডানহাত ধরে রেখেছি। রাস্তায় জমা পানির মধ্যে জবজবে হয়ে হেঁটে চলেছি। এভিনিউয়ে হুসহাস ছুটে চলা গাড়ি এড়াতে বার বার দাঁড়িয়ে পড়তে হচ্ছে। গাড়িওলারা ছুটে চলার পথে এক নজর দেখে নিচ্ছে। অরেগন স্টেটের ইউজিন শহরের বৃষ্টিমুখর রাস্তায় নিজেকে এক হারিয়ে যাওয়া অদ্ভুত মানুষ হিসাবেই আবিষ্কার করে বেশ মজা পাচ্ছি। কনকনে ঠান্ডার কাঁপুনি সে মজা কেড়ে নিতে চাচ্ছে। দাঁতে দাঁতে চেপে ধরে এগিয়ে চলেছি রুমালপরা বৃষ্টিভেজা এক মানুষ।  

বাসা থেকে বেরুনোর পর চার-পাঁচঘন্টা কেটে গেছে। বলে গেছি আজ এ-শহরে হারিয়ে যাওয়ার জন্য বেরুচ্ছি। ঘন্টার পর ঘন্টা পরও যখন বাসায় ফিরছি না, তখন বাসার সবাই সে কথা সত্যজ্ঞান করতে শুরু করেছে। সৃষ্টি হয়েছে এক রুদ্ধশ্বাস পরিস্থিতির। গত কয়েক ঘন্টায় ঘন ঘন বারান্দা দিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়েও তারা ফল না পাওয়া হতোদ্যম হয়ে পড়েছে। এরই মধ্যে দরজায় বেল। কপাট খুলতেই সামনে দেখি কনিষ্ঠপুত্রধন তুসু মাহমুদ। পেছনে দাঁড়ানো অন্যসবাই। তারা চোখ ছানাবড় করে  দেখলো, মাথায় সাদা রুমাল পেঁচানো, দু’হাতে খয়েরি রঙের কাগজের ব্যাগ ধরা জবজবে ভেজা এক আগন্তুক দাঁড়িয়ে দরজায় ঠায় । তিনি এ শহরে হারিয়ে যাওয়া এক অচেনা, অদ্ভুত মানুষ।

**বুনো নির্জনতার আমাজনদিন

**আলোকচিত্রের জন্য মার্কিন মুলুকে
**আমেরিকায় বয়ে নেওয়া বাক্সভরা আবেগ
** চিকেন চাইতেই এলো সিগারেট!
** সাড়ে তিন ঘণ্টার উড়াল ও ম্যাদোনা

বাংলাদেশ সময়: ০০০৫ ঘণ্টা, জুন ১৮, ২০১৬
জেএম/

 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।