ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

কিলোমাঞ্জারোর তুষার | আর্নেস্ট হেমিংওয়ে (পর্ব-৫)

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০৪৯ ঘণ্টা, জুলাই ২১, ২০১৬
কিলোমাঞ্জারোর তুষার | আর্নেস্ট হেমিংওয়ে (পর্ব-৫)

[১৯৫৪ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারজয়ী আর্নেস্ট হেমিংওয়ে তার বিখ্যাত ‘কিলোমাঞ্জারোর তুষার’ গল্পটি লিখেছিলেন ১৯৩৮ সালে। এটিকে বিশ্বের সর্বেকালের সেরা গল্পের তালিকায় বেশ ওপরের দিকেই ঠাঁই দেন সাহিত্যবোদ্ধারা।

গল্পটিতে ১৯৩০-এর দশকে হেমিংওয়ের লেখক-জীবন ও ব্যক্তিগত জীবন প্রতিফলিত হয়েছে।
এতে তিনি মন্তব্য করেছেন, রাজনীতি, নারী, সুরা, অর্থ ও উচ্চাকাঙ্ক্ষা আমেরিকার লেখকদের নষ্ট করে দিচ্ছে। ধনী লোকজনরে সঙ্গে মাখামাখি তার লেখকসত্তার ক্ষতি করছে। এই বোধ স্পষ্টতই ফুটে উঠেছে গল্পটিতে। ব্যাপকার্থে, গল্পটিকে একজন লেখকের হারানো প্রজন্মের স্মৃতিচারণের উদাহরণ হিসেবে নেওয়াই সঙ্গত। যাদের ছিলো বিশ্বযুদ্ধ ও স্পেনের যুদ্ধ-অভিজ্ঞতা, যেসব যুদ্ধ তাদের মনে নৈতিকতা ও দর্শন নিয়ে প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। একের পর এক স্মৃতিচারণে গল্পের নায়ক স্মরণ করতে থাকে বুলগেরিয়া ও কনস্টান্টিনোপলের পর্ববতমালা এবং একই সঙ্গে প্যারিসের একাকিত্বের দুঃসহ অনুভূতি আর ভেতরটা হঠাৎ করেই শূন্য হয়ে ওঠা।
খাটে শুয়ে শুয়ে গল্পের নায়ক সর্তক হয়ে ওঠে, যখন তার অস্থায়ী তাঁবুর চারপাশে শকুন হাঁটতে দেখে। ছায়ার ভেতর একটি হায়নোর আনাগোনা টের পায়। জেগে ওঠার আগেই মরে যাবো এটা জেনেই সে ঘুমাতে যায় এবং স্বপ্ন দেখে- একটি উদ্ধার বিমান তাকে তুষারাবৃত কিলোমাঞ্জারোর চূড়ায় নিয়ে গেছে। গোটা আফ্রিকায় যেটি সবচেয়ে উঁচু পর্বত। তার স্ত্রীরও স্বপ্নদেখা ঘুম ভেঙে যায় হায়েনার বিদঘুটে শব্দে। তাঁবুর বাইরে হায়েনাটা কেঁদে ওঠে অদ্ভূতভাবে। সে কান্নাটা মানুষের মতো।
]

কিলোমাঞ্জারোর তুষার
মূল: আর্নেস্ট হেমিংওয়ে
ভাষান্তর: মনজুর শামস

পর্ব-৫
‘কেমন লাগছে তোমার?’ নারী জানতে চাইলো। গোসল করে সে এখন তাঁবু থেকে বেরিয়ে এসেছে।
‘একদম ঠিক আছি। ’
‘তুমি কি এখন খেতে পারবে?’ হ্যারি দেখতে পেলো, তার প্রেমিকার পেছনে ফোল্ডিং টেবিল নিয়ে মোলো এবং অন্য ভৃত্য-বালকটি খাবার থালা-বাসন নিয়ে তৈরি।
‘আমি লিখতে চাই। ’  হ্যারি বলল।
‘চাঙ্গা হয়ে নেওয়ার জন্য তোমার একটু সুরুয়া খেয়ে নেয়া উচিৎ। ’
‘আজ রাতে আমি মরতে চলেছি, আমার আর চাঙ্গা হয়ে নেওয়ার দরকার নেই। ’ হ্যারি জবাবে বললো।
‘নাটুকেপনা করো না তো হ্যারি! প্লিজ। ’ প্রেমিকা অনেকটা ধমকের সুরেই বললো।
‘নাকটা একটু ব্যবহার করছ না কেন? ঊরুর অর্ধেকটা পর্যন্ত আমি পচে গেছি। তো কোন জাহান্নামের বোকা হতে যাবো যে সুরুয়া খেতে হবে? মোলো, হইস্কি-সোডা নিয়ে আয়। ’
‘প্লিজ, সুরুয়াটা নাও। ’  প্রেমিকা তাকে এবার খুব তোয়াজের সঙ্গে বলল।
‘আচ্ছা, ঠিক হ্যায়। ’
সুরুয়া ছিলো খুব বেশি গরম। হ্যারিকে তা কাপে নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ ধরে রাখতে হচ্ছিলো যথেষ্ট ঠাণ্ডা হওয়ার জন্য। তারপর কোনো ওয়াক না তুলেই তা সে গিলে ফেলছিলো।
‘তুমি বড্ড চমৎকার এক মেয়ে গো। ’ হ্যারি ফস করে বলে ফেললো। ‘এই, আমার দিকে অত মনোযোগ দিও না। ’
নারীটি তার সেই পরিচিত, লাবণ্য ছোঁয়ানো ভালোবাসাময় মুখ নিয়ে তার দিকে তাকালো। এটি সেই পার্বত্য এলাকার, শহরের, গ্রামের পরিচিত, ভালবাসার মুখ। ড্রিঙ্ক করার কারণে যা একটুখানি ম্লান হয়েছে মাত্র, বিছানার জন্য একটু মান খুইয়েছে ঠিকই, কিন্তু শহর ও গাঁয়ে কখনও এত চমৎকার স্তন এবং এতটা যুৎসই ঊরু আর কোমেরের নিচের দিকটায় আঙুল বুলানো এত চমৎকার হাত খুঁজে পাওয়া যাবে না। হ্যারি তাকালো। তাকিয়েই তার সেই অতিপরিচিত সুখের ঘোর লাগানো হাসিটা দেখতে পেলো। তখন আবারও সে অনুভব করলো মৃত্যু ঘনিয়ে আসছে। এবার অবশ্য কোনো তাড়াহুড়ো ছিলো না। ছিলো একটি দমক, সেই দমকা বাতাসের মতো যা মোমবাতির শিখাকে দপ করে বাড়িয়ে দেয়। আর শিখাটি লম্বা হয়ে যায়।
‘ওরা পরে আমার মশারিটা বাইরে নিয়ে আসতে পারবে। ঐ গাছটি থেকে ঝুলিয়ে দিতে পারবে আর একটি অগ্নিকুণ্ড তৈরি করতে পারবে। আজ রাতে আমি আর তাঁবুর ভেতরে যাচ্ছি না। ভেতরে গিয়ে কোনো লাভ নেই। আজকের রাতটা খুব স্বচ্ছ আর পরিষ্কার। কোনো বৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা নেই। ’
সুতরাং এটি হচ্ছে সেই দশা- যেভাবে আপনি মরে গিয়েছিলেন। একটি ফিসফিসানি যা আপনি শুনতে পাননি। তো বেশ, আর কোনো ঝগড়া হবে না। সে তা শপথ করে বলতে পারে। যে অভিজ্ঞতাটি তার কখনও হয়নি, সে এখন তা বরবাদ করতে যাচ্ছে না। সম্ভবত সে মরেই যাবে। কিন্তু হয়তো সে মরবে না।
‘তুমি তো শুনে শুনে লিখতে পারো না, পারো কি?’
‘আমি কখনও শিখিনি। ’  তার প্রেমিকা তাকে বললো।
‘বিলকুল ঠিক আছে, ওতেই চলবে। ’
অবশ্যই আর সময় ছিলো না। যদিও মনে হচ্ছিলো অক্ষরগুলো সব আণুবীক্ষণিক হলেই ভালো হয়। যাতে মাত্র একটি পরিচ্ছেদেই সবকিছু লিখে ফেলা যায়।
হ্রদের ধারে পাহাড়ের ওপরে কাঠের একটি লম্বা বাড়ি। সাদা চুনকাম করা। লোকজনকে খেতে ডাকার জন্য একটি খুঁটির ওপরে ঘণ্টি বাঁধা। বাড়িটির পেছনে বেশ কয়েকটা মাঠ। মাঠগুলোর পেছনেই বনের বৃক্ষসারি। পাহাড়ের নিচে বাড়িটিতে ওঠার জন্য তৈরি বেদিটা পর্যন্ত এক সারি লম্বার্ডি পপলার গাছ। দৃশ্যমান জায়গাজুড়ে অন্যান্য জাতের পপলার গাছ। বনের ধার থেকে একটি পথ চলে গেছে পাহাড়ের ওপর। আর সেই পথ ধরে যেতে যেতেই সে কিছু ব্ল্যাকবেরি তুললো। তখনকাঠের বাড়িটা পুড়ে গেলো। খোলাখুলি গুলি ছোড়ার জায়গটায় ডিয়ার ফুট ৠাকে রাখা সব বন্দুকও পুড়ে গেলো। এরপর এগুলোর নল, সিসা গলানো ম্যাগাজিন ও কাঠের কুঁদাও পুড়ে গেলো। পড়ে রইলো এক গাদা ছাই, যেগুলো ঢালাই লোহার কেটলি করার জন্য ব্যবহৃত লাই তৈরিতে ব্যবহার করা হবে। আপনি যদি খেলার জন্য আপনার দাদুর কাছে এগুলো চান তো তিনি আপনাকে সোজা ‘না’ বলে দেবেন। আপনি দেখতে পাবেন সেগুলো যেনো তখনো তার বন্দুক-রাইফেলই রয়ে গেছে। কখনো ওগুলো কেনা হয়নি। তিনি আর কখনো আঘাতও করেননি। এখন সেই একই জায়গায় তক্তা দিয়ে সেই বাড়িটি আবার তৈরি করা হয়েছে। রঙ করা হয়েছে সেই সাদাই এবং এর বারান্দায় দাঁড়িয়ে আপনি পপলার গাছগুলো এবং তার পেছনে হ্রদটা দেখতে পাবেন। কিন্তু কখনো আর বন্দুক দেখতে পাবেন না। দেয়ালের সেই ডিয়ার ফিট ৠাকে থাকা বন্দুকের নলগুলো এখনও সেই ছাইয়ের গাদায় পড়ে রয়েছে। সেগুলো আর কেউ ছুঁয়ে দেখেনি।

যুদ্ধের পরে আমরা ব্ল্যাক ফরেস্টে ট্রাউট মাছে ভরা একটি নদী ভাড়া নিয়েছিলাম এবং সেখানে হেঁটে যাওয়ার দুটি পথ ছিলো। একটি ছিলো উপত্যকার নিচে ট্রাইবার্গ থেকে উপত্যকার পথ ধরে, সাদা পথটিতে যেখানে বিছিয়ে রয়েছে গাছের ছায়া। এরপর পথটি অন্য একটি পথে গিয়ে মিশেছে। যেটি পাহাড়ের ওপর দিয়ে ছোট ছোট অনেক খামার পেরিয়ে গেছে। পেরিয়ে গেছে বিশাল সুয়ার্জওয়াল্ড বাড়িটিও। নদীটি পেরুনোর আগে রাস্তাটি ওভাবেই চলে গেছে। এখান থেকেই আমাদের মাছ ধরা শুরু হতো।

অন্য পথটি দিয়ে যেতে হলে ঢাল বেয়ে বনের ধার পর্যন্ত গিয়ে পাহাড়ের ওপরে চলে যেতে হয় পাইন বনের মাঝ দিয়ে। তারপর একটি তৃণভূমি ধরে এগিয়ে ব্রিজের গোড়ায় যেতে হয়। সেখানে নদীর পাড়ঘেঁষে বার্চ গাছের সারি। নদীটি বড় নয়, সরু। স্বচ্ছ টলটলে পানি এবং নদীটি খুব দ্রুত বয়ে যায়। বার্চ গাছের শেকড়ের নিচ দিয়ে বয়ে যেতে যেতে এটি বেশ গভীর জলাধার তৈরি করে। ট্রাইবার্গের হোটেল মালিকের এবারের মৌসুমটা বেশ ভালো গেছে। ব্যাপারটা খুবই আনন্দদায়ক এবং আমরা একে অপরের খুব বড় বন্ধু হয়ে উঠেছিলাম। পরের বছর মুদ্রাস্ফীতি দেখা দিলো। আগের বছর সে যে টাকা কামিয়েছিল, হোটেল খোলা রাখতে রসদ কেনার জন্য তা যথেষ্ট ছিলো না। আর তাই সে গলায় ফাঁসি দিয়ে আত্মহত্যা করলো। শ্রুতলিখনের জন্য আপনি তা বলতে পারেন। কিন্তু শ্রুতলিখনের জন্য আপনি প্লেস কনট্রেসকার্পকে ডিক্টেক্ট করতে পারবেন না। যেখানে ফুল বিক্রেতারা রাস্তায় তাদের ফুল শুকাচ্ছে এবং কংক্রিটের ওপর এগুলোর রঙ লেগে যাচ্ছে। যেখান থেকে অটোবাসগুলো যাত্রা শুরু করে এবং বুড়ো লোকেরা ও নারীরা যেখানে মদ পান করে। মাদী ঘোড়াগুলোও থাকে। আর থাকে নাক দিয়ে সর্দি ঝরা শিশুরা। নোংরা মিষ্টির গন্ধ, দারিদ্র্য, ক্যাফে দেস অ্যামেচিউর্সে মাতলামি এবং বাল মেসেত্তির বেশ্যারা। যে বিনোদিনী তার ছোট্ট ঘরটিতে গার্ড রিপাবলিক্যাইনের অশ্বারোহী সৈন্যকে মজা দেয়। সে তার ঘোড়ার চুল দিয়ে সাজানো শিরস্ত্রাণটিকে চেয়ারের ওপর রেখে নেয়। ভাড়াটিয়া হল পেরিয়ে গেলো। যার স্বামী ছিলো একজন বাইসাইকেল প্রতিযোগী। ছোট্ট দুগ্ধজাত খাবারের দোকানটিতে ঢুকে এল’অটো (ফ্রান্সের ক্রীড়া বিষয়ক জাতীয় দৈনিক) পত্রিকাটি চোখের সামনে মেলে ধরতেই তার আনন্দ যেনো বাঁধ মানছিলো না। ক্রীড়া দৈনিকটিতে সে দেখতে পেলো তার স্বামী প্যারিস-ট্যুরে তৃতীয় হয়েছে। জীবনে এই প্রথম বড় কোনো সাইকেল দৌড়ে অংশ নিয়েছিলো সে। আনন্দে তার মুখ রাঙা হয়ে উঠলো এবং বাঁধভাঙা হাসিতে দৌড়ে হলুদ পত্রিকাটি হাতে নিয়েই সে ওপরতলায় চলে গেলো। নারীটির স্বামী বেজমেন্টে একটি বাল-মুসেত্তি (বাল-মুসেত্তি হচ্ছে ফ্রান্সের এক ধরনের সঙ্গীত ও নাচ, যা শ্রমজীবীদের ভেতর দারুণ জনপ্রিয় ছিল) রেস্তঁরা চালাতো। দিনের প্রথম ভাগেই প্লেন ধরতে হবে বলে হ্যারি যখন ঘুমাচ্ছিলো, নারীটির স্বামী তখন একটি ট্যাক্সি চালিয়ে এসে তাকে জাগানোর জন্য দরজায় নক করলো। এরপর তারা দুজনে বারে গিয়ে সিসার প্রলেপ দেয়া মদ পরিবেশনের টেবিল থেকে এক গ্লাস করে সাদা মদ খেয়ে নিলো বেরুনোর আগে। ওই কোয়ার্টারে হ্যারি তার প্রতিবেশীদের তখন চিনতো। কারণ তারা ছিলো গরিব।

সেই জায়গাটায় দুই ধরনের মানুষ থাকতো। মদ্যপ ও ক্রীড়াবিদ। মদ্যপরা এভাবে মদ গিলে গিলেই তাদের অভাবকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতো।   আর ক্রীড়াবিদরা এটিকে অনুশীলনের অংশ হিসেবে নিতো। তারা হচ্ছে প্যারি কমিউনের বিপ্লবীদের উত্তরসূরি। তাদের রাজনীতিটা কী তা জানার জন্য তাদের কষ্ট করতে হয় না। তারা জানে প্যারি কমিউন শেষ হয়ে যাওয়ার পর ভের্সাই সেনারা যখন এলো। নগরীটা দখল করে নিলো তখন কে তাদের বাবাদের, আত্মীয়দের, ভাইদের এবং বন্ধুদের গুলি করে মেরেছে। হাতে কড়া পড়া কাউকে বা যে টুপি পরেছে বা যে এমন কোনো চিহ্ন বহন করছে  যা থেকে বোঝা যায় সে খেটে খায়। এমন কাউকে ধরতে পারলেই তারা ফাঁসিতে লটকেছে। সেই দারিদ্র্যের ভেতরে, বুচারি শেভেলাইনার ও একটি ওয়াইন কো-অপারেটিভের উল্টোপাশের রাস্তায় সেই কোয়ার্টারটিতে সে যা কিছু করতে চাইছিলো তার শুরুটা লিখে ফেলেছিলো। প্যারিসের অন্য কোনো অংশকেই সে কখনও এতটা ভালোবাসেনি। চারপাশে ডালপালা ছড়ানো গাছ, পুরনো ধাঁচের সাদা প্লাস্টারের নিচের দিকটা বাদামি রঙ করা দালান। সেই গোল চক্করের অটোবাসের লম্বা সবুজ, কংক্রিটের ওপর ফুলের রক্তলাল রঙ লেগে থাকা, রু কার্ডিনাল লেমোইনের পাহাড়টার হঠাৎ করেই নদীতে আছড়ে পড়া এবং অন্য রাস্তাটায় রু মাউফেটার্টের জনাকীর্ণ জগৎ। প্যানথেয়নের দিকে যাওয়ার রাস্তাটা ও অন্য সেই রাস্তাটা, যে রাস্তাটায় সে সব সময় বাইসাইকেলে যাতায়াত করে, পুরো এলাকায় যেটি একমাত্র অ্যাসফাল্টের রাস্তা‍ টায়ারের নিচে মসৃণ, দু’পাশে উঁচু সঙ্কীর্ণ বাড়ি এবং সস্তা উঁচু হোটেল, যেখানে পল লারলাইন মারা গেছেন। তারা যে অ্যাপার্টপমন্টে থাকতো, সেখানে মাত্র দু’টি করে কক্ষ এবং ঐ হোটেলের সবচেয়ে উঁচুতলার একটি কক্ষে সে থাকত। কক্ষটির জন্য তাকে মাসে ৬০ ফ্রাঙ্ক গুনতে হতো, যেখানে সে তার লেখাগুলো সেরেছিলো। এই কক্ষ থেকে সে ছাদগুলো, চিমনিগুলো এবং প্যারিসের সব পাহাড় দেখতে পেতো।
এই অ্যাপার্টমেন্ট থেকে আপনি কেবল কাঠ ও কয়লাওয়ালা লোকটির থাকার জায়গা দেখতে পাবেন। সে মদও বিক্রি করে, খারাপ মদ। বুচারি শেভালাইনের বাইরে সোনালি ঘোড়ার মাথাটি, যেখানে ঝুলতে থাকে জবাই করা পশুর হলদেটে সোনালি দেহগুলো। খোলা জানালাটা লাল রঙের, সবুজ রঙ করা কো-অপারেটিভ, যেখান থেকে তারা তাদের মদ কেনে। ভালো মদ, দামে সস্তা। বাদবাকি প্লাস্টার করা দেয়াল এবং প্রতিবেশীদের জানালা। যে প্রতিবেশীরা রাতে যখন কাউকে মাতাল হয়ে রাস্তায় শুয়ে থাকতে দেখে, তাদের গোঙানি ও বিলাপ করে প্রচলিত ফরাসি ভাষায় মাতলামি করতে শোনে। আপনাকে যে ব্যাপারে বলা হয়েছিলো যে এর কোনো অস্তিত্ব নেই। আপনি তা বিশ্বাস করেছিলেন, তারা তখন জানালা খুলবে এবং বিড়বিড় করে কথা বলতে থাকবে।
‘পুলিশটা গেলো কোথায়? আপনি যখন চাইবেন না, তখন এই হতচ্ছাড়ারা সব সময় ঠিকই এসে হাজির হবে। সে নিশ্চয়ই কোনো দারোয়ানের সঙ্গে ঘুমাচ্ছে! এজেন্টটাকে ডাকো। ’ যতক্ষণ না কেউ জানালা দিয়ে এক বালতি পানি ছুঁড়ে না মারছে ততক্ষণ মাতালটির গোঙানি চলতেই থাকতো। ‘আরে, ওটা কী? পানি। ওহ্, খুব বুদ্ধিমানের কাজ হয়েছে। ’ এরপর থেকে জানালাগুলো বন্ধ হতে থাকে। মারিয়া নামের যে পরিচারিকা তার ঘরদোর পরিষ্কার করে সে দিনে আট ঘণ্টা কর্মঘণ্টার প্রতিবাদ করে বলেছিলো, ‘একজন স্বামী যদি ছয়টা পর্যন্ত কাজ করে তবে সে বাড়ি ফেরার পথে ব্যস্তসমস্ত হয়ে মাত্র একটুখানি মদ গিলে আসতে পারে এবং খুব বেশি একটা অপচয় করে না। কিন্তু সে যদি কেবল পাঁচটা পর্যন্ত কাজ করে তা হলে সে প্রতিরাতে পাঁড়মাতাল হয়ে বাড়ি ফেরে এবং তার কাছে তখন কোনো টাকাই আর অবশিষ্ট থাকে না। এই কর্মঘণ্টা কমানোর খেসারত দিতে হয় ঐ শ্রমজীবী লোকটার বউকে। ’

বাংলাদেশ সময়: ২০৪৮ ঘণ্টা, জুলাই ২১, ২০১৬
এসএমএন

আরও পড়ুন...
** কিলোমাঞ্জারোর তুষার | আর্নেস্ট হেমিংওয়ে (পর্ব-১)
** কিলোমাঞ্জারোর তুষার | আর্নেস্ট হেমিংওয়ে (পর্ব-২)
** কিলোমাঞ্জারোর তুষার | আর্নেস্ট হেমিংওয়ে (পর্ব-৩)
** কিলোমাঞ্জারোর তুষার | আর্নেস্ট হেমিংওয়ে (পর্ব-৪)

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।