ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

ধারাবাহিক গল্প/শেষপর্ব

কিলোমাঞ্জারোর তুষার | আর্নেস্ট হেমিংওয়ে

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৪৮ ঘণ্টা, জুলাই ২৯, ২০১৬
কিলোমাঞ্জারোর তুষার | আর্নেস্ট হেমিংওয়ে

[১৯৫৪ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারজয়ী আর্নেস্ট হেমিংওয়ে তার বিখ্যাত ‘কিলোমাঞ্জারোর তুষার’ গল্পটি লিখেছিলেন ১৯৩৮ সালে। এটিকে বিশ্বের সর্বেকালের সেরা গল্পের তালিকায় বেশ ওপরের দিকেই ঠাঁই দেন সাহিত্যবোদ্ধারা।

গল্পটিতে ১৯৩০-এর দশকে হেমিংওয়ের লেখক-জীবন ও ব্যক্তিগত জীবন প্রতিফলিত হয়েছে।
এতে তিনি মন্তব্য করেছেন, রাজনীতি, নারী, সুরা, অর্থ ও উচ্চাকাঙ্ক্ষা আমেরিকার লেখকদের নষ্ট করে দিচ্ছে। ধনী লোকজনরে সঙ্গে মাখামাখি তার লেখকসত্তার ক্ষতি করছে। এই বোধ স্পষ্টতই ফুটে উঠেছে গল্পটিতে। ব্যাপকার্থে, গল্পটিকে একজন লেখকের হারানো প্রজন্মের স্মৃতিচারণের উদাহরণ হিসেবে নেওয়াই সঙ্গত। যাদের ছিলো বিশ্বযুদ্ধ ও স্পেনের যুদ্ধ-অভিজ্ঞতা, যেসব যুদ্ধ তাদের মনে নৈতিকতা ও দর্শন নিয়ে প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। একের পর এক স্মৃতিচারণে গল্পের নায়ক স্মরণ করতে থাকে বুলগেরিয়া ও কনস্টান্টিনোপলের পর্ববতমালা এবং একই সঙ্গে প্যারিসের একাকিত্বের দুঃসহ অনুভূতি আর ভেতরটা হঠাৎ করেই শূন্য হয়ে ওঠা।  
খাটে শুয়ে শুয়ে গল্পের নায়ক সর্তক হয়ে ওঠে, যখন তার অস্থায়ী তাঁবুর চারপাশে শকুন হাঁটতে দেখে। ছায়ার ভেতর একটি হায়নোর আনাগোনা টের পায়। জেগে ওঠার আগেই মরে যাবো এটা জেনেই সে ঘুমাতে যায় এবং স্বপ্ন দেখে- একটি উদ্ধার বিমান তাকে তুষারাবৃত কিলোমাঞ্জারোর চূড়ায় নিয়ে গেছে। গোটা আফ্রিকায় যেটি সবচেয়ে উঁচু পর্বত। তার স্ত্রীরও স্বপ্নদেখা ঘুম ভেঙে যায় হায়েনার বিদঘুটে শব্দে। তাঁবুর বাইরে হায়েনাটা কেঁদে ওঠে অদ্ভূতভাবে। সে কান্নাটা মানুষের মতো। ]

কিলোমাঞ্জারোর তুষার
মূল: আর্নেস্ট হেমিংওয়ে
ভাষান্তর: মনজুর শামস

শেষপর্ব

এটি এখন তার দিকে এগিয়ে আসতে শুরু করলো। কিন্তু এটির তখন আর কোনো আকার নেই। ¯্রফে জায়গা দখল করে।
‘এটিকে চলে যেতে বলো। ’
এটি কিন্তু চলে গেলো না, বরং আরেকটু কাছে এগিয়ে গেলো।
‘তুই একটা নরকের নিশ্বাস পেয়েছিস শালা’, সে এটিকে বললো। ‘বিটকেলে বদগন্ধ বেজন্মা একটা তুই। ’
ততক্ষণে এটি তার খুব কাছে চলে এলো এবং সে আর এখন এটির সঙ্গে কথা বলতে পারলো না। এটি যখন দেখতে পেলো সে কথা বলতে পারছে না। তখন আরও একটু কাছে চলে এলো। হ্যারি এখন কথা না বলেই এটিকে দূরে সরিয়ে দিতে চেষ্টা করলো। কিন্তু এটি তার ওপরে উঠে পড়েছে বলে এটির পুরো ওজন এখন তার বুকের ওপরে। যখন তার বুকের ওপর গুটিসুটি মেরে উঠে পড়েছে এবং সে নড়াচড়া করতে বা কথা বলতে পারছে না। তখনই সে শুনতে পেলেঅ নারী বলছে, ‘বুয়ানা এখন ঘুমাচ্ছে। খুব সাবধানে আলতো করে ধরে তার খাটটা তাঁবুর ভেতরে নিয়ে এসো। ’

তাকে সে কিছু একটা করে এটিকে তাড়িয়ে দিতে বলতে পারলো না। এটি আরো ভারী হয়ে তার ওপর চেপে বসল। আর তাই সে নিশ্বাস নিতে পারলো না। তখন, যখন তারা তার খাটটিকে উঁচু করে তুলে ধরেছে, হঠাৎ করেই সবকিছু আবার স্বাভাবিক হয়ে গেল এবং তার বুকের ওপর থেকে ভার নেমে গেলো।

তখন সকাল। কিছুক্ষণ আগে থেকেই ভোরের আলো ফুটছিলো। এ সময় সে বিমানের শব্দ শুনতে পেলো। প্রথমে এটিকে খুব ছোট দেখাচ্ছিলো আর তারপরই এটি বড় একটি চক্কর কাটতে শুরু করলো। ছেলেরা দৌড়ে বাইরে চলে এলো। কেরোসিন ছিটিয়ে আগুন জ্বেলে দিলো। আর তার ওপরে স্তূপ করে ঘাস জড়ো করলো। এতে সমতলভূমির দুই প্রান্তেই বড় দুটি অগ্নিকুণ্ডের সৃষ্টি হলো। ভোরের বাতাস সেই অগ্নিকুণ্ডের ধোঁয়া আর আঁচ বয়ে আনতে থাকলো তাঁবুটার দিকে। বিমানটি আরো দুটি চক্কর মারলো। এবার আরও নিচ দিয়ে। এরপর নিম্নমুখী হয়ে নিচে নেমে এলো। ভূমির সমান্তরাল হয়ে নির্ঝঞ্ঝাটে অবতরণ করলো। ঢিলা ট্রাউজার্স পরা বুড়ো কম্পটন ছোট্ট বিমানটি থেকে নেমে তার দিকে হেঁটে আসতে থাকলো। তার গায়ে ছিলো মিশেল রঙের নরম মোটা পশমি কাপড়ের জ্যাকেট আর মাথায় ছিল বাদামি রঙের ফেল্ট হ্যাট।
‘কী খবর বুড়ো মোরগ?’ কম্পটন তাকে বললো।
‘পায়ের অবস্থা খুব কাহিল’, জবাবে সে তাকে বললো। ‘নাশতা করবে তো তুমি?’
‘ধন্যবাদ। আমি এক কাপ চা খাবো। তুমি তো জানো, এটি একটি তিন সিটের ছোট্ট পাস মথ বিমান। মেমসাহেবকে নিতে পারবো না। একটা সিটই কেবল খালি রয়েছে। তোমার লরিটা আসছে। ’
হেলেন কম্পটনকে একপাশে সরিয়ে নিলো। তার সঙ্গে কথা বলতে শুরু করলো। কম্পটন এবার অন্য যে কোনো বারের চেয়ে খোশ মেজাজে ফিরে এসেছে।
‘আমরা তোমাকে ভেতরে তুলে নেবো। ’ সে বললো। ‘মেমসাহেবকে নিতে আমি আবার ফিরে আসবো। আমার এখন ভয় হচ্ছে তেল ভরার জন্য বোধ হয় আমাকে অ্যারুশায় থামতে হবে। আমাদের বরং এগিয়ে যাওয়াই ভালো। ’
‘চায়ের কী হবে?’
‘তুমি জানো আসলেই আমি এর কোনো পরোয়া করি না। ’
ছেলেরা খাটটি কাঁধে তুলে নিলো। সবুজ তাঁবুটা পেরিয়ে পাথুরে ঢালু পথে নেমে খোলা সমতল জায়গাটায় চলে এলো। আগুনের কুণ্ড দুটি এখন আরো দপদপিয়ে উজ্জ্বল হয়ে জ্বলছিলো। এরই ভেতরে সব ঘাস গিলে নিয়েছে আগুন। বাতাস সেই আগুনের আঁচ বয়ে নিয়ে যাচ্ছিলো ছোট বিমানটার দিকে। তাকে বিমানের ভেতরে ঢোকানোটা খুব কষ্টকর হয়েছিলো, কিন্তু একবার ভেতরে ঢোকানোর পরে সে যখন চামড়ার সিটটায় শুয়ে পড়লো, তখন সে তার পাটা সিটের একদিকে লম্বা করে দিলো। যেখানটায় কম্পটন বসে ছিলো। কম্পটন মোটর চালু করে দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়লো। সে হাত নেড়ে হেলেনকে এবং ভৃত্য-বালকদের বিদায় জানালো। ইঞ্জিনের ঢনঢন শব্দ সেই পরিচিত পুরনো ভঙ্গিমায় গর্জে উঠলো। পাখাগুলো চারপাশে ঘুরতে শুরু করলো। সেই সঙ্গে কম্পি বুনো শুয়োরের গর্ত খুঁজতে থাকলো। ইঞ্জিনটা গর্জন করতে থাকলো আর প্রবল ঝাঁকুনি খেতে থাকলো। দুই পাশের অগ্নিকুণ্ডের মাঝের জায়গা দিয়ে ধেয়ে যেতে যেতে আর শেষ ঝাঁকুনি দিয়েই এটি উঠে গেলো আকাশে। সে দেখতে পেল তারা নিচে দাঁড়িয়ে রয়েছে। হাত নাড়ছে এবং পাহাড়ের পাশে তাঁবুটাকে এখন চ্যাপ্টা দেখাচ্ছে। সমতলভূমি ছড়িয়ে যাচ্ছে। দেখতে পেলো গুচ্ছ গুচ্ছ গাছ এবং চ্যাপ্টা হয়ে যাওয়া ঝোপ-জঙ্গল। বুনো প্রাণীদের চলার পথ দৌড়ে চলেছে শুকনো পানির খাদে। নতুন এক পানি দেখতে পেলো, যার কথা সে আগে কখনও জানতো না। ছোট গোল পাছার জেব্রা, অন্যান্য বুনো জন্তুদের মনে হচ্ছে বড় মাথার একেকটা বিন্দু। পুরো সমতল জুড়ে লম্বা আঙুলের মতো পথে এখন তাদের ওপরে ছায়া এসে পড়লো। একেবারের ক্ষুদ্র দেখাচ্ছে এখন এগুলোকে। তাদের মধ্যে এখন ছুটে চলার ত্রস্ততা নেই। সমতলে যত দূরে চোখ যায় এখন কেবল ধূসর হলুদ, সামনে বুড়ো কম্পির মোটা পশমি কাপড়ের জ্যাকেটের পেছনের অংশ এবং বাদামি ফেল্ট হ্যাট। এরপর তারা উঠে এলো প্রথম পাহাড়টার ওপরে এবং বুনো জন্তুগুলো তাদের দিকে ধেয়ে আসতে থাকলো। তার পরেই তারা উঠে এলো পর্বতমালার ওপরে। হঠাৎ করেই বন আর বাঁশঝাড়ের ঢালে সবুজ আরো গাঢ় হয়ে উঠলো। তারপরেই আবার পর্বতের চূড়ায় চূড়ায়, ফাঁকা জায়গায় গভীর বনের ভাস্কর্য নির্মাণ চলতেই থাকলো। যতক্ষণ না তারা এগুলো পেরিয়ে এলো, ঢালু হয়ে নেমে যেতে থাকলো পাহাড়গুলো, তারপরেই আবার সমতল। এখন গরম, আর উৎকট বাদামি, ঝাঁকুনির সঙ্গে গরম। কম্পি এবার পেছনে তাকিয়ে দেখল সে কীভাবে উপরে উঠে যাচ্ছে। এরপর সামনে পড়ল গাঢ় কালো পর্বতমালা।
আর এর পরে অ্যারুশায় যাওয়ার বদলে তারা বাঁয়ে মোড় নিলো। সে স্পষ্টতই বুঝতে পারলো যে তাদের গ্যাস রয়েছে। নিচে তাকিয়ে সে গোলাপি হতে থাকা একখানা মেঘ দেখতে পেলো। মাটির ওপর দিয়ে ভেসে আসছে। বাতাসের ভেতর দিয়ে প্রবল বেগে তা ধেয়ে আসছে প্রথম তুষারপাতের মতো। যেন বায়ু ফুঁড়ে বেরিয়ে এসেছে। সে জানে দক্ষিণ থেকে পঙ্গপাল আসছে। এরপর তারা ওপরে উঠে যেতে থাকলো। মনে হলো, তারা পুবদিকে যাচ্ছে। তার পরেই অন্ধকার নেমে এলো। তারা ঝড়ের মধ্যে পড়লো। বৃষ্টি এতটাই ঘন ছিলো। যে মনে হচ্ছিলো, তারা জলপ্রপাতের ভেতর দিয়ে চলেছে। এরপর তারা বেরিয়ে এলো এবং কম্পি তার মাথা ঘোরালো এবং দাঁত কেলিয়ে হাসলো। সামনের দিকে আঙুল দিয়ে দেখালো। সে যা কিছু দেখতে পাচ্ছিলো তা বিশ্বের মতোই প্রশস্ত। বিশাল, উঁচু, এবং রোদের মাঝে অবিশ্বাস্য রকমের সাদা কিলিমাঞ্জারোর চৌকো চূড়ো। তখন সে জেনে গেলো এখানেই রয়েছে সেই জায়গাটা, যেখানে সে যাচ্ছে।

রাতের বেলা ঠিক তখনই হায়েনাটা কান্না থামালো। অদ্ভুত এক শব্দ জুড়ে দিলো। প্রায় মানুষের কান্নার শব্দের মতো। মহিলাটি শব্দটা শুনতে পেলো এবং অস্বস্তির সঙ্গে নড়েচড়ে উঠলো। ঘুম পথকে সে জেগে উঠলো না। সে তার স্বপ্নে তখন লং আইল্যান্ডের বাড়িটিতে ছিলো এবং এটি ছিলো তার মেয়ের প্রকাশ্যে মঞ্চে প্রথম উপস্থিতির আগের রাত। কোনো না কোনো কারণে তার বাবা সেখানে ছিলো এবং সে খুব রুক্ষ আচরণ করেছিলো। ঠিক তখন হায়েনাটা এত্ত জোরে শব্দ করে উঠলো যে তার ঘুম ভেঙে গেলো। এক মুহূর্তের জন্য সে বুঝতে পারলো না কোথায় রয়েছে। সে ভীষণ ভয় পেয়ে গেলো। তখন সে ফ্লাশলাইটটা হাতে তুলে নিলো। অন্য খাটটার ওপর আলো ফেললো। হ্যারি ঘুমিয়ে পড়ার পর তারা যে খাটটি ভেতরে নিয়ে এসেছিলো। সে দেখতে পেলো হ্যারির শরীরের প্রায় পুরোটাই মশারির ভেতরে থাকলেও কোনো কারণে তার পাটা বাইরে। খাটের পাশে ঝুলছে। পায়ের ক্ষতের ড্রেসিং পুরোটাই খুলে পড়েছে এবং সে আর ওদিকে তাকাতে পারলো না।
‘মোলো’,  সে চিৎকার করে ডাকলো। ‘মোলো! মোলো!’
তারপর সে বলে উঠলো, ‘হ্যারি, হ্যারি!’ এরপর তার গলার স্বর অনেক চড়ে গেল, ‘হ্যারি! প্লিজ। ওহ, হ্যারি!’

কোনো জবাব নেই এবং সে হ্যারির নিশ্বাসের শব্দ শুনতে পেলো না।  
তাঁবুর বাইরে হায়েনাটা আবারো সেই অদ্ভুত শব্দটা করে উঠলো। যে শব্দটা তার ঘুম ভাঙিয়ে দিয়েছিলো। কিন্তু তার নিজের হৃদস্পন্দনের শব্দ এতটাই বেড়ে গিয়েছিলো যে সে আর হায়েনাটার কোনো শব্দ শুনতেই পেলো না।

বাংলাদেশ সময়: ১৬৪২ ঘণ্টা, জুলাই ২৯, ২০১৬
এসএমএন
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।