আচ্ছা নন্দিনী, যদি তোমার ইচ্ছাতেই সম্পর্কের ইতি হবে তবে তুমি ভালো নেই কেন? ভালো না থাকা তোমাকে লেখা আমার চিঠিটা নয়নের কাছে দিয়ে যাচ্ছি। আমি জানি, এ চিঠির উত্তর তুমি দেবে না।
তপু
চিঠিটা পড়ে শেষ করলো সোমা। একটু পরেই সুব্রত চলে আসবে। সুব্রত সোমার স্বামী। একটা অ্যাড ফার্মে কাজ করতে গিয়ে দুজনের পরিচয়। সুব্রত হিন্দু হওয়ায় পুরো পরিবার অমতে ছিলো কিন্তু সোমার মায়ের জন্যেই বিয়েটা হয়েছে শেষপর্যন্ত।
মাকে না বলেই চুরি করে মায়ের ডায়েরিটা নিয়ে এসেছে সোমা। পুরো ডায়েরিটাই সাদা। শুধু এই একটা চিঠিই ছিলো ডায়েরির ভাঁজে! সোমা ভাবছে, মা তো শায়লা খান কিন্তু চিঠিতে নন্দিনী কে? আর তপু? তপু নামে এক আঙ্কেল তো সুব্রতর বাবার বন্ধু। নিউইয়র্ক থেকেই এসেছিল সোমার বিয়ের দিন। বিয়ের পরে সোমার শ্বশুর বাড়ি থেকে দাওয়াতে শায়লা খান আসেননি। তার শরীরটা নাকি ভালো ছিলো না। সোমা ভাবছে, মায়ের শরীরটা কি বেশিই খারাপ? ভাবতে ভাবতেই সোমার মোবাইল ফোনটা বেজে উঠলো। ফোন করেছে সোমার বাবা আদনান আহমেদ।
: হ্যালো, বাবা কেমন আছো তুমি?
: ভালো আছি মা, তুই?
: আমি ভালো আছি বাবা, আচ্ছা বাবা একটা প্রশ্ন করি? তুমি নাকি ছোটবেলায় আমার নাম নন্দিনী রাখতে চেয়েছিলে আর তা শুনে মা খুব আপত্তি করেছিল তাই আমার নাম তুমি আর নন্দিনী রাখনি। কেন?
: মা, আমি জানি তোর মায়ের সাদা ডায়েরিটা তোর কাছে কিন্তু তোর মা জানে না। তোর মা জানে, অনেক বছর আগে বাসা বদলের সময় ওটা হারিয়ে গেছে। তোর মা জানে না আমি চিঠির কথাটা জানি। সে এও জানে না, তোর শ্বশুরের বন্ধু তপু চক্রবর্তীই তোর মায়ের আঠারো বছর বয়সের প্রেম, সে কথাটা আমি জানি। সোমা মা, একটা কথা রাখবি? মাকে কখনও জানতে দিবি না আমি এ কথাটা জানি। তোর মা বড্ড লাজুক, আমি জেনে গেছি জানলে কষ্ট পাবে।
: আচ্ছা বাবা, কিন্তু তোমার কখনও কষ্ট হয়নি এই ভেবে যে, মা তোমাকে ভালোবাসেনি?
: পাগলি মেয়ে! তোর মা আমাকে ভালো না বাসলে তুই হলি কি করে? আমি জানি তপু তার প্রেম ছিলো কৈশোরের, আর আমাকে সে ভালবাসে। যাই হোক আজ রাখি মা, তোর কিছু চাই কি? জানাস।
ওপাশ থেকে লাইনটা কেটে দিলো আদনান আহমেদ। বাইরে ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। সোমার আজ বৃষ্টিটা অসাধারণ লাগছে আর মনে মনে ভাবছে, বাবা তার কাছে জানতে চেয়েছে তার কিছু চাই কিনা!
সোমা বলছে, সোমা চিৎকার করে বলছে- হ্যাঁ, বাবা আমি চাই, আমি চাই সুব্রত ঠিক তোমার মতো স্বামী হোক, তোমার মতো বন্ধু হোক!
ফোনটা রেখে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো আদনান আহমেদ। বাইরে বৃষ্টি, সোমার বিয়ের দিন এভাবে বৃষ্টি হয়েছে, সোমার জন্মের দিনটাতেও বৃষ্টি ছিলো। শায়লা ক’দিন ধরে আবার আগের মতোই চুপচাপ হয়ে গেছে, যেমনটা বিয়ের পরপর ছিলো সে। বিয়ের পরে শায়লার বন্ধু হতে অনেকটা সময় লেগেছিল আদনানের। বিয়ের প্রায় এক বছরের মাথায় আমেরিকা ফেরত বন্ধু সাজ্জাদের কাছে জানতে পারে, সে আদনানের অফিসে আসার পথে শায়লাকে দেখেছে একটা কফি শপে। শায়লার সঙ্গে যে ছেলেটি ছিলো তাকে সাজ্জাদ চেনে, ছেলেটির নাম তপু চক্রবর্তী। আদনানের বন্ধু সাজ্জাদ আর তপু চক্রবর্তী নিউইয়র্কে একই সঙ্গে পড়েছে কিছুদিন। সাজ্জাদের জানা মতে তপু বেশ কিছুদিন আগে নিউইয়র্কে থাকা এক ভারতীয় মেয়েকে বিয়েও করেছে। সেদিন সাজ্জাদের কাছে কথাগুলো শুনে খুব তাড়াতাড়ি বাসায় চলে এসেছিল আদনান। এরপর শায়লার আলমারিতে ডায়েরিটা খুঁজে পায় আদনান। আদনান ঠিক করে রেখেছিল, সে রাতে শায়লাকে প্রশ্ন করবে ডায়েরিটার ব্যাপারে কিন্ত রাতে শায়লার ইচ্ছায় অনেক কিছুই ঘটেছিল আদনান আর শায়লার মধ্যে। বলা যায়, আদনান সেদিনই প্রথম বুঝেছিল, শায়লা নিজের ইচ্ছাতেই আদনানকে কাছে টেনে নিয়েছে। এও বোঝে, এর আগের রাতগুলোতে ঠিক শায়লার ইচ্ছাতে হয়নি। বেশ কদিন আদনানের মধ্যে সে রাতের সুখের রেশটা থেকে গিয়েছিল তাই তপু চক্রবর্তীর প্রসঙ্গটা তোলেনি আদনান। তারও প্রায় এক মাস পরেই এক সকালে জানা যায়, শায়লা মা হতে যাচ্ছে, আদনান ডায়েরিটা রেখে দেয় তার অফিসের ড্রয়ারে। সোমা পেটে থাকতেই একদিন ডায়েরিটার খোঁজ করেছিল শায়লা। আদনান জানিয়ে দেয়, কোনো ডায়েরি সে দেখেনি, হতে পারে বাসা বদলের সময় হারিয়ে গেছে।
সোমার বিয়ের কিছুদিন আগেই কিছু পুরনো বইয়ের সঙ্গে ডায়েরিটা অফিস থেকে নিয়ে আসে আদনান। বুঝতেই পারেনি সেটা সোমার কাছে চলে যাবে। সোমার স্বামী সুব্রত ছেলেটাকে বেশ ভালোই লেগেছে আদনান আহমেদের।
সোমা বলছিল, ‘বাবা, সুব্রতটা না তোমার মতো বোকা’। আদনান হাসতে হাসতে মেয়েকে বলেছে সেদিন, ‘মা, সংসারে বোকা হয়ে থাকাটাই ভালো, তাতে সংসারে সুখ থাকে’। সোমাও সেদিন হাসিমুখে পাল্টা প্রশ্ন করেছে, ‘কেন, তোমার এমন মনে হয় বাবা’?
আদনান সাহেব সেদিন মেয়েকে উত্তর দিতে পারেনি, জানাতে পারেনি যে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে বোকা হয়ে না থাকলে সংসারে মাঝরাতে সুখের রেশ মাখানো প্রেম আসে না, সোমারা আসে না।
যদিও সেই রাতে আদনান বুঝতে পেরেছিল, তাকে কাছে টানার যে তীব্র ইচ্ছা শায়লা খান সেদিন দেখিয়েছে, তাতে যে শুধু শায়লা খানের মাঝে আদনানকে নতুন করে ভালোবাসতে চাওয়ার চেষ্টা ছিলো, তা নয়, পাশাপাশি তপু চক্রবর্তীর বিয়ে করে ফেলার ঘটনাটা ভুলতে চাওয়ার চেষ্টাও ছিলো।
অনেক সন্ধ্যাতেই আদনান সাহেবের মনে প্রশ্ন আসতো তপু চক্রবর্তীকে নিয়ে, আদনানের মন চাইতো শায়লাকে প্রশ্ন করতে।
কিন্তু সে করেনি, কারণ, আদনান সাহেব নামের বোকা মানুষটা জানে, কিছু প্রশ্নের উত্তর না খোঁজাই ভালো, অনেক সময় উত্তর মিলে গেলে প্রশ্নকর্তাই বেশি কষ্ট পায়!
পাশের বাড়ির সিডি প্লেয়ারে আদনান সাহেবের খুব প্রিয় একটা কবিতা ছেড়েছে কেউ একজন।
জীবনানন্দ দাশের ‘কে হায় হৃদয় খুঁড়িয়া বেদনা জাগাতে ভালবাসে...’
বাংলাদেশ সময়: ১৬৪৬ ঘণ্টা, মার্চ ১০, ২০১৭
এসএনএস