পার্ক থেকে বেরিয়ে আমরা পা দিই পথচারীদের চলাচলে ভাইব্রেন্ট একটি স্ট্রিটে। প্রশস্ত এ রাজপথে গাড়িঘোড়া কিছু নেই।
মনে হয় আগাথা এ এলাকার পথঘাট ভালো চেনে। সে আমাদের নিয়ে ঢুকে পড়ে সম্পূর্ণ নির্জন একটি সড়কে। পথের দু’পাশে বিশাল সব আবাসিক ইমারতে লাগানো কাঠের শাটার দেওয়া মস্ত মস্ত ফ্রেঞ্চ উইন্ডো। প্রতিটি জানালার নকশা ও রঙ সম্পূর্ণ আলাদা। প্রতিটি বাড়ির সামনে টবে টবে প্রচুর ফুল। মনে হয় জানালার বর্ণের সাথে ম্যাচ করে রঙ করা হয়েছে টবগুলো। সড়কের ঠিক মাঝ বরাবর দাঁড়িয়ে অলস ভঙ্গিতে লেজ নাড়ছে দু’টি ছানাপোনাসহ একটি লোমশ বিড়ালি। কিছু কিছু বাড়ির দেয়ালে নানা রকমের ছবি আঁকা। একটি ছবিতে তিন তিনটি উটপাখি দেখে আমি দাঁড়িয়ে পড়ি। একটি উটপাখিতে সওয়ার হওয়া একটি মানুষ চিত্রটিকে রূপান্তরিত করেছে রূপকথার ফ্যানটাসিতে। সিয়েরা লেওনে আমার আপাত নিঃসঙ্গ জীবনে আমি মাঝে মাঝে লেবানিজ এক নারীর সাথে ক্যাফে কিংবা পানশালায় বসতে ভালোবাসি। নানাদেশের বিচিত্র সব স্ট্রিট আর্ট সংগ্রহ করতে সে পছন্দ করে। আমি তার কথা ভাবতে ভাবতে আমার মোবাইল ডিভাইসে তুলে নিই উটপাখিতে চড়া মানুষটির ছবির ফটোগ্রাফ।
ছবি তুলতে গিয়ে আমি একটু পিছিয়ে পড়েছিলাম। দ্রুত হেঁটে এসে যোগ দিই আগাথা ও ম্যানুয়েলের সাথে। একত্রে আমরা সড়কের মোড় ফিরতেই দেখি পুরনো একটি রঙ উঠে যাওয়া দালানের পিলারের কাছে গাঁথা বিবিধ বর্ণে বর্ণিল একটি বিশাল মুখোশ। তার তলায় জড়ো হয়েছে গোটা সাতেক পথচারী। একজন নারী ফিকে সোনালি রঙের অত্যন্ত ফ্যাশনেবল ড্রেস্ পরে প্রকাণ্ড মুখোশটির তলায় মডেলকন্যার মতো পোজ্ দিচ্ছে। মেয়েটির বাম বাহু সম্পূর্ণ নিরাবরণ। সে শ্রাগ করার ভঙ্গিতে বাম কাঁধ উঁচু করলে অনাবৃত হয় একটি স্তন। ঠিক তখনই তার সামনে এসে আড়াল করে দাঁড়ায় যমদূতের মতো দেখতে মুখোশ পরা এক কৃষ্ণাঙ্গ। আমরা অবাক হয়ে দেখি, মানুষটি পরে আছে দালানে গাঁথা মুখোশের অবিকল রেপ্লিকা। মেয়েটি এবার ঘুরে স্কার্ট ঊর্দ্ধে তুলে দেয়ালের বর্ণাঢ্য মুখোশটিকে বাও করলে প্রকাশিত হয় তার নিতম্বের বেশ খানিকটা। সিল্কের সুচারু অর্ন্তবাসে আঁকা হার্ট শেইপ দেখতে পেয়ে পুরুষ পথচারীরা উল্লসিত হয়ে হাততালি দেয়। একজন পথচারী এক্সাইটেড হয়ে দৃশ্যটির ছবি তুলতে ক্যামেরা হাতে নিতেই, মুখোশপরা যমদূতটি তার দিকে তাক করে টয়-রিভলবার। অতঃপর সে মুখোশ খুলে তা সবার সামনে ধরলে তাদের স্ট্রিট পারফরম্যান্সে খুশি হয়ে তাতে আমরা ফেলি ইউরোর একটি বা দু’টি কয়েন।
স্ট্রিট পারফরম্যান্স দেখতে দাঁড়িয়ে পড়াতে ম্যানুয়েল আবার অধৈর্য হয়। সে মুখে আঙুল দিয়ে শিস বাজিয়ে আমাদের আগ বাড়তে ইশারা দেয়। আগাথা মৃদু হেসে তাকে বলে, ‘ম্যান, হোয়াই আর ইউ গেটিং অল ইমপেশেন্ট, গোট অ্যান্ড ক্যাবেজ রেস্টুরেন্ট ইজ রাইট হিয়ার’। কথা বলতে বলতে আমরা এসে পড়ি স্ট্রিটের মোড়ের গোলাকার চত্বরে। ওখানে সড়কের লাগোয়া ‘ছাগল ও বাঁধাকপির ঠেক’ নামে রেস্তোরাঁর সাইনবোর্ড। তার দোরগোড়ায় চেন দিয়ে বাঁধা সত্যিকারের একটি ধবধবে সাদা ছাগল, সে নিরাসক্তভাবে তাকিয়ে আছে তাকে খেতে দেওয়া তাজা বাঁধাকপির পাতার দিকে। আগাথা তার লোম ছুঁয়ে দেওয়ার ভঙ্গি করলে প্রাণীটি চ্যঁ ব্যাঁ করে জানান দেয় তার আপত্তি। ম্যানুয়েল বাঁধাকপির একটি পাতা তুলে তার মুখে দিতে গেলে ছাগীটি ঘাড় বাঁকিয়ে কটমট করে তার দিকে তাকায়। আগাথা তার হাত ধরে বলে, ‘দিস ইজ আ ভেরি সিরিয়াস নো ননসেন্স টাইপ গোউট। ডোন্ট বাগ হার, তোমাকে গুঁতিয়ে দিতে সে পিছপা হবে না’। ম্যানুয়েল তার কথায় হো হো করে হেসে বলে, ‘আগাথা, কাম অ্যান্ড ডু আ গোউট ডান্স উইথ মি’। সে চটুল ভঙ্গিতে জবাব দেয়, ‘ নো ডিয়ার, ইউ ডু দ্য ডান্স, আমি তোমার নৃত্যে সঙ্গত করছি একটি চমৎকার ছাগল বিষয়ক গান’। খোলা ফুটপাতে দাঁড়িয়ে ম্যানুয়েল সত্যি সত্যিই নেচে ওঠে। তার নাচের ভঙ্গি কেমন যেনো রোবটের মতো। আগাথা আমাকে অবাক করে দিয়ে গায়, ‘আই অ্যাম আ সিম্পল গোউট, আই লিভ অন দ্য ব্যাক অব আ পিকআপ ট্রাক। দি ওল্ডম্যান টাইড মি হিয়ার উইথ আ থ্রি ফুট রোপ..’। গাইতে গাইতে হাত ধরাধরি করে তারা ঢুকে পড়ে রেস্তোরাঁয়। এনট্রেনসে এক আলজেরীয় অভিবাসী আমাদের ফরাসি কেতায় সম্ভাষণ জানান। চেয়ার টেনে বসতে গিয়ে দেয়ালে আফ্রিকান মাগরেবের ডেকোরগুলোর দিকে তাকিয়ে মনে হয় আমরা এসে পড়েছি একটি ভারী আপস্কেইল রেস্তোরাঁয়।
অত্যন্ত লো ভলিয়্যুমের মিউজিকে আচ্ছন্ন পরিবেশে আমরা মার্টিনি সিপ করতে করতে মেনুতে উনে এনত্রে বা স্টার্টার সিলেক্ট করতে যাই। আলজেরিয়ান অভিবাসী নিয়ে আসেন ব্রোঞ্জের খুঞ্চা। তাতে হরেক রকমের কাবাবের স্যাম্পল। ম্যানুয়েল তুলে নেয় শিকে গাঁথা খাসির ঝলসানো এক টুকরা মাংশ। আগাথা মিক্সড্ স্যালাডের অর্ডার করে ম্যানুয়েলের হাত তার মুঠোয় নিয়ে একটু ঝুঁকে আমাকে বলে, ‘থ্যাংক ইউ সো মাচ ফর কামিং হিয়ার অ্যান্ড গিভিং মি সাম টাইম’। আমি জবাবে বলি, ‘মিউজিক হিয়ার ইজ ওয়ান্ডারফুল আগাথা, গ্রিক ভাষায় তোমরা কীভাবে থ্যাংক ইউ বলো?’ আমার প্রশ্নের সরাসরি জবাব না দিয়ে সে বলে, ‘অল দিজ মিউজিকস্ ইন দিস রেস্টুরেন্ট আর ফ্রম সাহারা ডেজার্ট। আই লাভ দিস উইন্ডি মিলাংকুলিক সাউন্ড’। আমি এবার জানতে চাই, ‘সো, ইউ হ্যাভ আ ব্যাকগ্রাউন্ড ইন মিউজিক আগাথা, অ্যাম আই রাইট?’ সে ম্লান হেসে শরীর একটু অ্যাডজাস্ট করে ম্যানুয়েলের হাত তার পায়ে রাখার সুযোগ করে দিয়ে বলে, ‘তুমি যে রকম ভাবছো, ও রকম কিছু না। গ্রিসের একটি গ্রামে আমি বড় হই। ওখানে কালেভদ্রে স্বজনহীন কারও মৃত্যু হলে আমি চার্চের বারোয়ারি অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় পিয়ানো বাজিয়ে একটু আধটু গাইতাম। দ্যাটস্ অল অ্যাবাউট মাই মিউজিক। নাথিং গ্লোরিয়াস অর ফেন্সি’।
স্টার্টার হিসাবে ম্যানুয়েল ওনিওন স্যুপ চামচে তুলতে তুলতে খানিকটা অন্যমনস্ক হয়ে আছে। আমি চিজের প্রলেপ মাখানো সেসমি সিড দেওয়া এক টুকরা রুটি খেতে খেতে তাদের দিকে তাকাই। আগাথা খুব আদুরে ভঙ্গিতে ফিসফিসিয়ে ফরাসি ভাষায় ম্যানুয়েলকে কিছু বলছে। আর রিয়্যাকশন দেখার জন্য গ্রীবা বাঁকিয়ে তার দিকে তাকচ্ছে। সি-থ্রু টপে ভাসমান মেঘে বার বার আড়ালে চলে যাওয়া চাঁদের মতো লুকোচুরি করছে তার স্তনযুগল। ম্যানুয়েল চঞ্চল হয়ে তার গ্ল্যাডস্টোন ব্যাগ থেকে বের করে একটি পলিথিনের প্যাকেট। তা থেকে এক চিমটা শুকনা গোলাপের পাপড়ি তুলে নিয়ে সে তা ছিটিয়ে দেয় আগাথার লো-কাট নেকলাইনে। গ্রিক নারীটি তাতে উদ্বেল হয়ে তার প্রার্থিত পুরুষের বা’হাত টেনে এনে করতলে ঘষে তার চিবুক। একটি শুখা পাপড়ি মৃত প্রজাপতির ভাঙা ডানার মতো লেগে থাকে তার বিভাজিকায়।
বাংলাদেশ সময়: ১৪৫৭ ঘণ্টা, মার্চ ২৭, ২০১৭
এসএনএস