ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

প্যারিসে ঘুরে বেড়ানো/পর্ব-শেষ পর্ব

ছাগল ও বাঁধাকপির ঠেক

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১২২ ঘণ্টা, মার্চ ৩০, ২০১৭
ছাগল ও বাঁধাকপির ঠেক প্যারিসে ঘুরে বেড়ানো

ছাগল ও বাঁধাকপির ঠেক
প্যারিসে ঘুরে বেড়ানো/শেষ পর্ব

লা প্লাত প্রিন্সিপাল বা মেনকোর্স হিসাবে ম্যানুয়েলের জন্য আসে স্টেক তারতারে বলে এক ধরনের খাবার। এতে রো বিফের গাব্দা গাব্দা টুকরা মেরিনেটেড্ করা হয়েছে কড়া ধাঁচের অ্যালকোহলিক সসে।

সাইড ডিশ হিসাবে সে সিদ্ধ পটেটোতে হানি-মাস্টার্ড মাখিয়ে মুখে তোলে। আমার জন্য পরিবেশিত হয়েছে হেলেবেথ মাছের এক টুকরা ফ্যালে। জিরা বাখর মিশিয়ে রান্না করা এ খাবারে ছড়ানো আছে ধনে পাতা ও চাকতি চাকতি লেবু। আগাথা তার গ্রিল করা গলদা চিংড়ি থেকে ফর্ক দিয়ে ফালি ফালি করে কেটে দেওয়া ভাজা নারকেলের টুকরা সরিয়ে লিকার-কার্ট ঠেলে হেঁটে যাওয়া ওয়েটারকে ওয়াইন সার্ভ করতে ইশারা করে। বেশ মনযোগ দিয়ে পরিবেশিত পদের সঙ্গে ম্যাচ করে সে সিলেক্ট করে প্রত্যেকের জন্য ভিন্ন ভিন্ন স্বাদের ওয়াইন।
  
আমি হেলেবেথ মাছের স্বাদ উপভোগ করতে করতে ম্যানুয়েলের দিকে তাকাই। কী যেনো ভাবতে ভাবতে তার চোখের মণি ঘষা কাচের মতো ঘোলাটে হয়ে উঠছে। বুঝতে পারি, সে মনে মনে আগাথাকে কীভাবে সঙ্গ দেবে তার পরিকল্পনা করে নিচ্ছে। তার চোয়ালের রেখা প্রচণ্ড ইচ্ছাশক্তিতে শক্ত হয়ে ওঠে। আগাথা ওয়াইন গ্লাস তুলে হাত বাড়িয়ে তা আমার গ্লাসে ঠেকায়। আমি তার সুগোল বাহুমূলের দিকে তাকাই। মনে হয় গ্রিস দেশের এ নারী আলিঙ্গনে হবে আশ্চর্য রকমের আন্তরিক। ম্যানুয়েল প্রচুর পরিমাণে ওয়াইন সিপ করে আমার দিকে চোখের ইশারায় একটি বার্তা পাঠায়। আমি নীরবে তার মেসেজ ইন্টারপ্রেট করি। বাস্তিল ডে’র মহড়া দেখতে আসার পথে ম্যানুয়েল এ বিষয়টি নিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে আমার সঙ্গে আলাপ করেছে। আমি অবগত যে, তার গ্ল্যাডস্টোন ব্যাগে রয়েছে একটি হাতকড়া ও ফ্লানেলের কাপড়ে মোড়া শংকর মাছের লেজের একটি ছোট্ট চাবুক। আমার কল্পনা করতে কষ্ট হয়, আজ সন্ধ্যায় এ চার্মিং গ্রিক নারীর বাহুযুগলের চলৎশক্তি রহিত হবে হাতকড়ার বন্ধনে। আর তার শরীর নিগৃহীতও হতে পারে বিশেষ রকমে তৈরি চাবুকে। ভাবতেই দারুণ অস্বস্তি হয়। আমি সচেতন যে, দিস ইজ নান অব মাই বিজনেস, কিন্তু মনকে এ প্রসঙ্গ থেকে সরাতেও পারি না। দৈহিক সম্পর্কের অন্তরঙ্গ মুহূর্তে এ ধরনের আচরণ অ্যাবিউজ কিনা এ নিয়ে ম্যানুয়েলের সঙ্গে আমার আলাপও হয়েছে। তার বক্তব্য সোজাসাপ্টা...অ্যান্ড ভেরি মাচ্ বিজনেস লাইক। সে বলেছে, ‘আমি পয়সার বিনিময়ে এ ধরনের সার্ভিস প্রভাইড করি। কোনো নারী আমার সঙ্গে সময় কাটতে চাইলে আমি আগেভাগে কীভাবে কী করতে চাই তা অনেকটা স্টোরিবোর্ডের স্ক্রিপ্টের মতো লিখিতভাবে বর্ণনা করে তার কাছে অ্যাটাচমেন্ট হিসাবে পাঠাই। উদ্দিষ্ট নারীর সম্মতি ছাড়া আমার হাতে কোনো কিছুই ঘটে না’। আমি সেক্সুয়াল অ্যাবিউজের প্রসঙ্গ আবার তুললে সে বিরক্ত হয়ে বলে, ‘দিস ইজ হোয়াট আগাথা ওয়ান্টেড, সে যদি শেষ মুহূর্তে মত পাল্টায়, আমি অন্য কোনোভাবে তাকে সঙ্গ দেবো। দ্যাটস্ ইট। দিস ইজ টোটালি লিগ্যাল। প্যারিসীয় পরিবেশে নারী-পুরুষের সম্মতিক্রমে সহজাত আনন্দে নেই কোনো সামাজিক বা আইনি প্রতিবন্ধকতা’। সে আমার কাঁধে চাটি মেরে, ‘ম্যান, দিস ইজ প্যারিস, আমরা সবাই এখানে জড়ো হয়েছি ফরাসি মুহূর্ত উপভোগ করতে, প্লিজ লার্ন হাউ টু বিহেভ হিয়ার’, বলে সমাপ্ত করেছিল তার বক্তব্য।
  
আমাদের মেন কোর্স শেষ হয়েছে একটু আগে। চিজ কোর্স স্কিপ করে আমি ও আগাথা ডেজার্ট হিসাবে ক্রিম ক্যারামেল নিই। ম্যানুয়েল মিষ্টান্নের মেনুটি খুঁটিয়ে দেখে, তবে সহজে সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। তখনই তার আইফোনে জরুরি মেসেজ আসে। সে ‘এক্সকিউজ আমওয়া’ বলে উঠে চলে যায় রেস্তোরাঁর এন্ট্রেনসের দিকে। আগাথা তার জন্য মস্ত বড় একটি পাফপেস্ট্রির অর্ডার করে। তাতে স্তরে স্তরে ছড়ানো হুইপ ক্রিম, চকোলেট সস ও চাকতি চাকতি করে কাটা কিউই ফল। ডেজার্ট শেষ করে এসপ্রেসোতে চুমুক দিয়ে আগাথা ম্যানুয়েলকে ইঙ্গিত করে মন্তব্য করে, ‘এরা প্রফেশন্যাল, শরীরের ব্যাপারে অত্যন্ত দক্ষ হলেও মাত্র ঘণ্টাখানেকের জন্যও তুমি এদের সম্পূর্ণ মনযোগ পাবে না। তোমার পাশাপাশি বসে তোমাকে উষ্ণ সঙ্গ দিতে দিতে তারা অ্যাপোয়েন্টমেন্ট করবে অন্য নারীর সাথে’। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে কফিতে আরেকবার চুমুক দিলে আমি খেয়াল করি, তার চোখের দৃষ্টি অস্থির হয়ে ঘুরছে বোধ করি অন্য কোনো দৃশ্যপটে। দেখতে দেখতে তার বনানী-সবুজ চোখের তারায় জমে গাঢ় মেঘ।
  
আমি হাত বাড়িয়ে তার কব্জিতে চাপ দিয়ে জানতে চাই, ‘ম্যানুয়েল তোমাকে ইগনোর করে উঠে চলে যাওয়াতে কি তৈরি হচ্ছে স্ট্রেস?’ ম্লান হেসে আগাথা জবাব দেয়, ‘ম্যানুয়েল কথা দিয়েছে, আমার স্ট্রেস্ লাঘবে সে সাহায্য করবে। আই ট্রাস্ট হিজ প্রফেশনালিজম। এজন্য আজ আমি তার সঙ্গ ক্রয় করেছি। আমার স্ট্রেসের উৎস আমার নিজের সংসারে’। শুনে প্রতিক্রিয়ায় আমি বলি, ‘আই অ্যাম বিকামিং সো কিউরিয়াস ইন ইয়োর লাইফ’। এবার সে রহস্যময়ভাবে হেসে বলে, ‘আমার বিষয়টা বিস্তারিত জানতে পারলে তুমি এতে খুঁজে পাবে উপন্যাস লেখার উপাদান। আমার সেকেন্ড হাজব্যান্ড বয়সে অনেক বড় হলেও তার বিত্ত অনেক। একটি পুরনো বজরা গোছের ইয়টে ভেসে বেড়ানো, ও তার চেয়ে পুরনো জং-ধরা ছোট্ট বিমানে উড়তে সে পছন্দ করে। এগুলো বদলিয়ে নতুন মডেলের প্রাইভেট প্লেন বা ছোটখাট ঝকঝকে একটি ইয়ট ক্রয় করা তার জন্য তেমন কিছু না। কিন্তু সে পুরনো জিনিসগুলো বদলাতে চায় না একেবারে। এমনকি নতুন কোনো জামা-কাপড়, স্যুট বা জুতা পর্যন্ত কিনতে চায় না। তো তার বজরা গোছের ইয়টটি বিকল হয়ে পড়ে আছে মন্টিকার্লোর বালুচরে। এখন সারাই করাতে লাগবে তিন কিংবা চার দিন’।  

তার কাহিনীতে তীব্রভাবে আগ্রহী হয়ে উঠে আমি বলি, ‘আগাথা আই আন্ডারস্ট্যান্ড, ব্রোকেন-ডাউন ইয়টের বিষয়টি তোমাকে কষ্ট দিচ্ছে’। ‘নট রিয়েলি’, বলে দ্রুত জবাব দিয়ে সে জানায়, ‘ইউ নো, দিস ইজ মাই সেকেন্ড ম্যারেজ, আমার প্রথম বিয়ের হাজব্যান্ডটি ছিলো খুবই সুদর্শন ও অ্যাথলেটিকগোছের পুরুষ, আমাকে সে ভালোও বাসতো মোর অর লেস্। কিন্তু খুবই ডমিনিয়ারিং চরিত্রের মানুষ সে। সারা বছরে মাত্র তিন বা চার দিন আমি পছন্দ করি অজানা পুরুষের সঙ্গ। সামান্য এ বিষয়টা সে সহ্য করতে পারতো না। খামোকা ঝামেলা করতো। তাই আমি তাকে ডিভোর্স দিয়ে এ বয়স্ক লোককে বিয়ে করেছি’।

আমি এবার জানতে চাই, ‘আগাথা, তবে কি তোমার বয়স্ক দ্বিতীয় স্বামী এবার গোল পাকাচ্ছে’? সে লাজুক হেসে জবাব দেয়, ‘হি ইজ আ ফাইন জেন্টলম্যান, ঝামেলা করা তার স্বভাব না। বাট মাই ফার্স্ট হাজব্যান্ড হ্যাজ ক্রিয়েটেড আ বিগ ট্রাবল ফর মাই ফ্যামিলি’। ‘সে কী তোমাকে ফিরে পেতে চাচ্ছে আগাথা?’ জানতে চাইলে কাঁধ ঝাঁকিয়ে সে জবাব দেয়, ‘ওয়ার্স্ট দেন দ্যাট। আমার সেকেন্ড হাজব্যান্ডের আগের তরফে আছে একটি কন্যা সন্তান। তার নাম কেইলি, মেয়েটির বয়স মাত্র একুশ। সে এথেন্সের একটি ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। আমার ফার্স্ট হাজব্যান্ড ওই ইউনিভার্সিটির জিম ইন্সট্রাকটার। তো ঘটনা হচ্ছে, সংক্ষেপে তোমাকে বলছি, আমার স্টেপ ডটার কেইলি তিন দিন আগে কোর্টে গিয়ে বিয়ে করেছে আমার ফার্স্ট হাজব্যান্ডকে’! কাহিনি শুনে আমি প্রতিক্রিয়ায় কী বলবো, কোনো প্রসঙ্গ খুঁজে পাই না। আগাথা আবার কথা বলে, ‘মাই সেকেন্ড হাজব্যান্ড ইজ ফিলিং ভেরি অ্যাংরি অ্যান্ড বিট্রেইড্। আমি যে আমার প্রথম হাজব্যান্ডের সঙ্গে কালেভদ্রে যৎসামান্য যোগাযোগ রাখছি, সে নিয়ে সে কখনও কোনো আপত্তি তোলেনি। যোগাযোগ না রেখে আমার অন্য কোনো উপায়ও ছিলো না। আমার প্রথম তরফে আছে আমাদের একটি উনিশ বছরের পুত্রসন্তান। কেইলিকে আমিই আমার প্রথম হাজবেন্ডের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই’।
  
ম্যানুয়েল ফিরে আসে তাজা একটি গোলাপ নিয়ে। বোধ করি রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে লা আমোর দ্য ফ্লোর থেকে তা কিনে এনেছে। সে আগাথার হাত ধরে টেনে তুলে চুমো খেয়ে বলে, ‘হানিসাকোল, লেটস্ গো। আই অ্যাম ফিলিং বোরড্ হিয়ার’। আগাথা দ্রুত ক্রেডিট কার্ডে পরিশোধ করে বিল। রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে ঠিক হয়, ওরা ট্যাক্সি ক্যাব নেবে। আমি মেট্রোর দিকে রওয়ানা হতে গেলে আগাথা হাত ধরে আন্তরিকভাবে আমাকে চুমো খায়। একটি সিগারিলো ধরালে ম্যানুয়েল অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে থাকে।

বাংলাদেশ সময়: ১৭১৮ ঘণ্টা, মার্চ ৩০, ২০১৭
এসএনএস
  

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।