শিল্পবিচার কিংবা আলোচনার ক্ষেত্রে ‘ব্যক্তির রুচি আর শিল্পের নৈর্ব্যক্তিকতা পরস্পরের কাছে দুরাত্মা নয়, দূরাত্মীয়’- এটা মনে রেখেই গিরীশ গৈরিকের ‘ক্ষুধার্ত ধানের নামতা’ গ্রন্থের আমি একজন সাধারণ পাঠক। আমার পাঠকে নিবিড়তম পাঠ হয়তো বলা যায় না, কিন্তু সর্বাংশে খণ্ডিতও নয়-আমার বিশ্বাস।
প্রথমেই স্বীকার করা ভালো, ‘ক্ষুধার্ত ধানের নামতা’র পাঠ-মন্তব্য এবং আমার অবস্থান কিছুতেই কাব্যবোদ্ধার গুরুত্ব বহন করে না। গ্রন্থের প্রথম ‘জনক’ হিসেবে অনেকেই হয়তো তাকে ‘নবিশী কবি’ বলতে পারেন। শোচনীয়ভাবে স্বীকার করছি, অগ্রজদের প্রবণতার নিরিখে এর চেয়ে বেশি কিছু আশা করাও দূরূহ। বিষয়টি তর্কাতীত তাই সে পথে যাচ্ছি না। গিরীশ গৈরিক যেহেতু বিশ্বাস করেন ‘মৌলিক বলে কিছু নেই’, তাই তার কবিতার মৌলিকত্ব খুঁজতে যাওয়া বৃথা হতে পারে। আমি সেদিকেও যাবো না। অনেকের কবিতা পাঠে বোধে এসেছে, কবিতার ভেতর কার্যসিদ্ধির একটা প্রচেষ্টা বা দায় যেনো থাকতেই হবে। থাকেও। যেমন ‘ধর্মের দায়, সমাজের দায়, জ্ঞানের দায়, প্রেমের দায়, পরিবর্তনের দায়-সর্বোপরি পাঠককে বোঝানোর দায়। ’ গিরীশের কবিতা কোন দায় মেটাবার স্বার্থে সৃজিত, সে পাঠ নেওয়া যেতে পারে তার রচনা থেকে :
‘সাদা কাকের কুহু কুহু রিংটোন ভাতের থালায় মেখে
কোকিলের প্রার্থনায় নত হলে-শকুনের আনাগোনা বাড়ে
কিংবা বিড়াল ও ইঁদুর এক খাঁচায় পোষ মানালে
শাকচুন্নি বাতাসে ডানা ভাঙা রোদ ফিসফিস করতেই পারে
এভাবে বেজিদের রক্তে কোবরা হত্যার এক প্রকার নেশা জন্মে
অথচ সাপ ও বেজির দ্বন্দ্ব এখন মানুষের রক্ত থেকে পবিত্র গ্রন্থে’
উদ্ধৃত কবিতাংশ ‘আমি অভিজিৎ রায় বলছি’র। কবিতাটিতে ‘সাদাকাকের কুহু-কুহু রিংটোন’, ‘শাকচুন্নি বাতাসে’ ইত্যাদি শব্দবন্ধনী গিরীশের স্বকীয়। কবিতায় তিনি সমাজের একটি বিশেষ ক্ষতের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশনের চেষ্টা করেছেন। সমাজ-রাষ্ট্রে মানুষে মানুষে, উঁচু-নিচু শ্রেণিতে, অর্থ ও ক্ষমতার নিমিত্তে চলে নানামুখি দ্বন্দ্ব। এ দ্বন্দ্ব যেনো মানুষের রক্তেই প্রোথিত! ধর্ম নিয়েও দ্বন্দ্ব-সংঘাত চলমান। গিরীশ গৈরিক, চিরাচরিত এ দ্বন্দ্বের কথায় যেন সামনে টেনে এনেছেন। তার উপস্থাপন ভঙ্গিমা উত্তরাধুনিক, সে বিষয়ে সন্দেহ পোষণের সুযোগ নেই। আবার দায়ের প্রসঙ্গটি এড়িয়ে যাওয়াও সঙ্গত নয়। তবে ‘অধুনান্তিক কালখণ্ডে কবিতার ভাষা হবে রাইজোম্যাটিক, অর্থাৎ তার বহু শিকড়, বহু জন্মবিন্দু, একেক ভাবে তাকে দেখা যায়-একেকভাবে তাকে ইন্টারপ্রেট করা যায়; একই পাঠ্যবস্তু বা টেক্সট থেকে বহু টেক্সট জন্ম নিতে পারে। একটা পর্যায়ে কবিতার টেক্সটও আর শুধুমাত্র কবিতার নিজস্ব সম্পত্তি হিসেবে থাকবে না। তার মধ্যে ঢুকে পড়বে গল্প প্রবন্ধ চিত্রকলা সিনেমা বিজ্ঞাপন-অর্থাৎ কবিতা হয়ে উঠবে ‘ওপেন অ্যাণ্ডেড’; মুক্তমুখী, তার কোনো সীমানা নেই, তার কোনো বাঁধা ছক নেই, তার কোনো নিয়ম নেই, তার কোনো একক অর্থ নেই” -সমীর রায়চৌধুরীর এ বক্তব্যের সূত্র ধরে গিরীশ গৈরিকের কবিতার পাঠ নিলে, উত্তরাধুনিক কবিতার তার পদার্পণ, প্রবণতা এবং সৌন্দর্যবোধের সন্ধান মিলতে পারে।
তার শ্লোক কবিতা থেকে পাঠ নেওয়া যাক :
‘এই অভিধানে গুড় জাতীয় কোনো শব্দ নেই
কেননা তার বাড়ির পাশে খুনি পিঁপড়েদের বসবাস
যৌনতাত কিংবা মহুয়াবসন্ত শব্দবীজ বুনতে পারে
কিন্তু কলসির তলা ফুটো হলে-কৌমার্য ঘুঙুর আর বাজে না
এ সকল বিষয় অধ্যয়ন করে বুঝেছি-জন্মদাগ ঘষে ওঠানো যায় না’
‘শ্লোক’ কবিতা পাঠে মস্তিষ্কে এক ধরনের প্রফুল্লতা পাখা মেলে। উদ্ধৃত অংশটুকু পর্যালোচনায় বুঝতে পারি ‘জন্মদাগ ঘষে ওঠানো যায় না’-এই আপাতসরল সত্যটিকে সামনে আনতে অনেকগুলো পঙ্ক্তির অবতারণা করা হয়েছে। যার কেন্দ্রে তিনি গেঁথে দিয়েছেন নির্বাচিত শব্দসুষমা। কবিতা ‘মানুষের সঙ্গে মানুষের শিল্পিত যোগাযোগ স্থাপন করে’, হোক না তা অর্থহীন, অবোধগম্য কিংবা জ্ঞান বিতরণ! কবিতার পঙ্ক্তিগুলো যদি পাঠক চেতনায় অন্তর্লীন চিন্তার রূপকার হিসেবে আবির্ভূত হয়, তাই বা কম কিসে? তবে পারিপার্শ্বিক নৈরাজ্য যেমন মানুষের পঞ্চভূতকে দুমড়ে-মুচড়ে নতুন অবয়ব দিতে চাইছে, তেমনি একই ধারা শিল্প-সাহিত্যেও বেগবান। এ প্রক্রিয়ার ইতিবাচক রূপ উত্তরাধুনিকতা। কবিতায় সুদূর দৃশ্যায়নের মেধা, শব্দবিন্যাস, বিষয়বস্তু কিংবা বস্তুহীনতা গিরীশের কবিতায় ক্রমেই প্রতাপশালী হয়ে উঠতে দেখা যায়।
গিরীশ গৈরিকের কবিতায় আঞ্চলিক শব্দের পাশাপাশি বিজ্ঞানবিষয়ক ও পৌরাণিক শব্দের দেখা মেলে। কবিতাগুলোতে তার অভিজ্ঞতার ঝুলি থেকে নিঃসৃত হয়েছে শিল্প-কলা-দর্শন, যার ব্যাপ্তি একই সঙ্গে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক। আবার, ব্যক্তিগত উপলব্ধির সঙ্গে শিল্প বৈপরীত্য দৃশ্যমান কি-না সে বিষয়টিও প্রাসঙ্গিক। দেখা যায়, কোনো কোনো কবিতায় তিনি নৈতিক উপদেশ স্থাপন করতে চেয়েছেন। এ প্রক্রিয়া কাব্যময়তায় ব্যাঘাত ঘটায় বলেই মনে হয়। দীক্ষিত পাঠক কিংবা সমালোচক হয়তো এগুলো শনাক্ত করতে পারবেন। আমি শুধু পাঠোপলব্ধিই তুলে ধরতে চাইছি। গিরীশ গৈরিক যখন বলেন-‘কষ্টা হরীতকী কিংবা আমলকী চিবানোর পরে / জলপানে একপ্রকার মিষ্টিস্বাদ পাওয়া যায় / যেমন করে পাগলাঘণ্টা বাজলে কয়েদি পায় মুক্তির স্বাদ। ’ এমন সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অনুভূতি যখন পাঠকের অনুভূতিতে টোকা দেয় তখন দীক্ষিত পাঠকের মতে হতেই পারে গিরীশ গৈরিকও অগ্রজ প্রভাবিত। ‘একটি উজ্জ্বল মাছ একবার উড়ে / দৃশ্যত সুনীল কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে স্বচ্ছ জলে / পুনরায় ডুবে গেলো- এই স্মিত দৃশ্য দেখে নিয়ে / বেদনার গাঢ় রসে আপক্ব রক্তিম হ’লো ফল। ’ তবে সেই অগ্রজ যখন বিনয় মজুমদার হন, তখন বিষয়টিকে বোধের বিনির্মাণই বলা যেতে পারে। আধুনিক কবিতা যে প্রকারান্তরে ‘বিনির্মাণ’, গিরীশ গৈরিক (মৌলিক বলে কিছু নেই) সেটিও নিশ্চয়ই স্বীকার করেন।
যা হোক, ‘ক্ষুধার্ত ধানের নামতা’ আমার প্রায় এক বছরের সঙ্গী। দীর্ঘ সময় ধরে, থেমে থেমে পাঠ করেছি-গ্রন্থভুক্ত কবিতাগুলো। নিজের রুচি আর স্বল্প কাব্য অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিলিয়ে নিতে চেষ্টা করেছি গিরীশের চিন্তার অতলান্তিক। এভাবে হঠাৎ করেই ‘ম্যাও’ কবিতাটিতে ডুবে যাই। এটি আগেও কয়েকবার পাঠ করেছি। কিন্তু তৃতীয়বার পাঠের বিস্ময়ে আমি অত্যন্ত অভিভূত। পুরো কবিতাটিই তুলে ধরছি :
‘আমার জন্মের আগেই স্তনক্যান্সারে-মা স্তন হারিয়েছেন
তাই বাড়ির পাশের ব্রোথেল থেকে বোতলে করে দুধ আসত
সেই দুধে প্রায়ই একটি বিড়াল ভাগ বসাত
আমার ঠাকুরদাদা মহাকবি হোমার
বেথেলহেম থেকে বিড়ালটি চুরি করে এনেছিলেন বলে
কখনো তার কপালে মুড়োঝাঁটা জোটেনি
এমনকি পুষ্পপ্রদীপ জ্বেলে মা যখন অনার্যগীত গাইতেন
তখন সে ম্যাও-ম্যাও করে তাল যোগাত
এবং আমার পিতার ব্যক্তিগত ক্যাসেটের ফিতায় জড়ানো রকসঙ্গীত
সে একবার চেটে-চুটে ঢুকিয়ে দিয়েছিল ম্যাও
আমার পড়ার টেবিলের হিব্রুকঙ্কালটির সাথে তার ভাব হয়েছিল
গত হরতালের দিনে আমি ও সে ঘুরতে ঘুরতে
চৌরাস্তার কোণে একটি ফুটবল পেয়েছিলাম
খেলার ছলে সে যখন ফুটবলটির আঁচড় দিয়েছিল
ঠিক তখন বিকট শব্দে তার শরীর ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়
অতঃপর আমি হবিষ্যাণœ খেয়ে কয়েকটি স্তনযুগ পার করেছি
পেয়েছি জোনাকযোনির দেখা কিংবা স্বয়ম্ভর কোনো ড্রোনস্পর্শ
এখন আমার স্ত্রী সন্তানের মুখে স্তন গুঁজে ঘুমপাড়ানি গান গাইলেই
আমি সেই বিড়ালটির ম্যাও-ম্যাও ধ্বনি শুনতে পাই’
কবিতাটি পাঠের পর বুঝতে পারা যায়, গিরীশ গৈরিক একই সঙ্গে নিজস্ব ধর্ম-দর্শন, ঐতিহ্য-সংস্কৃতি, যৌনতা-যাপনের সঙ্গে বিশ্ব সংস্কৃতি-ঐতিহ্যের মেলবন্ধন ঘটিয়ে যে ‘ম্যাও’ গল্পটি সাজিয়েছেন তা নিছক গল্প নয়, এ এক নিদারুণ বাস্তবতা। কবিতায় সূক্ষ্ম উপস্থিতি রয়েছে বক্রোক্তি অলঙ্কারের। শুধু ‘ম্যাও’ নয়, গ্রন্থের বেশিরভাগ কবিতায় বক্রোক্তি অলঙ্কারের সার্থক ব্যবহারে কবিতাগুলো যেমন রহস্যের আঁধারে পরিণত হয়েছে, তেমনি ভাবে কবিতাগুলোকে ভিন্নতর এক ব্যঞ্জনায় অভিষিক্ত করেছে বলেও মনে হয়।
সার্বিকভাবে আমার মনে হয়েছে, ‘ক্ষুধার্ত ধানের নামতা’ প্রথম কবিতাগ্রন্থ হলেও লেখকের দৃষ্টি জীবনের অনেক দূরে ও গভীরে নিবিষ্ট। কবিতাবিষয়ক ব্যাপক ধারণা ও যথেষ্ট প্রস্তুতি নিয়েই তিনি কাব্যজগতে এসেছেন বলে ধারণা জন্মে। গিরীশের কবিতার দ্বিধাচিত্ত পাঠ হলেও, এটুকু বলা দোষের নয়, তিনি প্রাকৃত-অতিপ্রাকৃতের সংমিশ্রণে কবিতার নান্দনিক ভাঙা-গড়ার যে খেলায় জড়িয়েছেন, লক্ষ্য স্থির থাকলে তার কাব্যভ্রমণে পাঠক ভবিষ্যতে নিরাশ হবেন না। পরিশেষে কবিতাগ্রন্থটির বহুল প্রচার প্রত্যাশা করছি।
কবিতাগ্রন্থ: ক্ষুধার্ত ধানের নামতা
প্রকাশনী: বেহুলাবাংলা
প্রচ্ছদ: মোস্তাফিজ কারিগর
মূল্য: ১৩৫
বাংলাদেশ সময়: ১৪২২ ঘণ্টা, এপ্রিল ৩০, ২০১৭
এসএনএস