রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বর্ণাঢ্য জীবন নায়িকা-বহুল; প্রেমময়। চিন্তা ও কর্মে প্রেমের বহুমাত্রিক দ্যোতনায় উজ্জ্বল তাঁর গান, কবিতা।
তিনটি বিষয়বস্তু বারবার তার রচনায় ফিরে ফিরে এসেছে, সেগুলো হলো পূজা, প্রেম আর প্রকৃতি। কিন্তু আধ্যাত্মিকতার কথা মনে রাখলে লক্ষ্য করা যায় যে, বয়স যতো বেড়েছে, ততোই তিনি আনুষ্ঠানিক ধর্ম থেকে সরে গিয়ে মানুষের ধর্মে বিশ্বাস স্থাপন করেছেন। গানে তিনি বার বার নৈর্ব্যক্তিক ঈশ্বরের কাছে আশ্রয় এবং সান্তনা খুঁজেছেন। তা সত্ত্বেও তাঁকে যদি কোনো বিশেষ ধরনের কবি অথবা শিল্পী বলে চিহ্নিত করতেই হয়, তাহলে সম্ভবত প্রেমের কবি অথবা প্রেমের শিল্পী বলেই নাম দিতে হয়। কারণ প্রেম কেবল তার শত শত প্রেমের গান আর কবিতায় প্রকাশ পায়নি, তার প্রকৃতি এবং পূজাও প্রেমের সঙ্গে একাকার হয়ে গেছে। এই ভিন্ন ধরনের বিষয়বস্তুকে বিশ্লেষণ করে আলাদা করা যায় না। প্রেমে দেহের তুলনায় মানসিক এবং আধ্যাত্মিক যোগাযোগ ছিলো অনেক বেশি।
তিনি বড়ো হয়েছিলেন ভিক্টোরিয়ান রুচির মধ্যে, তার সঙ্গে আবার মিশেছিলো ব্রাহ্মরুচি ও আধুনিকতা। একেবারে প্রথম যৌবনে লেখা 'শেষ চুম্বন', 'চুম্বন' এবং 'স্তনে'র মতো কবিতায় নারীদেহের প্রতি তাঁর আকর্ষণ বলিষ্ঠ এবং স্পষ্টভাবেই প্রকাশ পায়। কিন্তু আরেকটু বেশি বয়সে লেখা 'বিজয়িনী'র মতো কবিতায় দৈহিক সৌন্দর্য কাটিয়ে তাকেও তিনি নৈর্ব্যক্তিক করে দেখেছেন। সৌন্দর্যের কাছে দেহের পরাজয় ঘটান তিনি।
যে বালিকার সঙ্গে তিনি প্রথমে প্রেমে পড়েন, তিনি তাঁর অন্যতম বড়ো ভাই জ্যোতিরিন্দ্রনাথের স্ত্রী, কাদম্বরী দেবী। যেমন, ‘ভগ্নহৃদয় কাব্য’ তিনি উৎসর্গ করেছিলেন বউদি কাদম্বরী দেবীকে একটি কবিতার মাধ্যমে ‘তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা’। ১৮৮০ সালের কার্তিক সংখ্যা ‘ভারতী’তে এটি ছাপা হয় কবিতা হিসেবে। কিন্তু তার তিন মাস পরে এটি প্রথম গাওয়া হয় মাঘোৎসবের সময়ে, ব্রহ্মসঙ্গীত হিসেবে। দু-এক পঙক্তির কেবল পরিবর্তন করতে হয়েছিল মূল কবিতার।
কাদম্বরী ছাড়া, তিনি আরো অনেক নারীর সান্নিধ্যে এসেছেন জীবনের নানা পর্বে ও পর্যায়ে। যেমন, ইংরেজি ভাষা, বিশেষ করে ইংরেজদের সংস্কৃতি এবং তাদের রীতিনীতি শেখার জন্য রবীন্দ্রনাথ সাত-আট সপ্তাহ থাকলেন বোম্বাইয়ের এই পরিবারে। আত্মারাম পান্ডুরঙের তিনটি মেয়ে ছিলেন, তিনজনই কেবল বিলেত ভ্রমণ করেননি, সেখানে লেখাপড়াও শিখেছেন। তাদের ছোটটির নাম আনা তরখড়। তাঁরই ওপর দায়িত্ব পড়লো রবীন্দ্রনাথকে খানিকটা ইংরেজ করে তোলার। আনা ছিলেন রবীন্দ্রনাথের দু'বছরের বড়ো। কিন্তু অমন সুদর্শন কবি আর গায়কের প্রেমে পড়তে তার দেরি হয়নি মোটেই। রবীন্দ্রনাথও ইংরেজি শেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠলেন না। বরং কবিতা লিখে, গান রচনা করে, আনাকে 'নলিনী' নাম দিয়ে তাকে মুগ্ধ করতেই বেশি আগ্রহ দেখালেন। মুগ্ধ করলেন এবং নিজের মনেও হয়তো রঙ লাগলো।
এরপর রবীন্দ্রনাথ লন্ডন হয়ে যান ব্রাইটনে। তিনি মোটেই ভালো লাগাতে পারেননি নিয়ম আর পাঠক্রম অনুযায়ী আনুষ্ঠানিক লেখাপড়া শেখার পদ্ধতিকে। ভালো লাগতো কেবল ইংরেজির অধ্যাপক হেনরি মর্লির সাহিত্যের পাঠ। ভর্তি হয়ে তিনি ঘর ভাড়া নিয়েছিলেন কলেজের সামনের দিকের রাস্তায়, রিজেন্টস স্ট্রিটে। কিন্তু অল্পদিনের মধ্যে অতিথি হিসেবে বাস করতে আরম্ভ করলেন ডাক্তার জন স্কটের বাড়িতে। তিনি ‘ইউরোপ-প্রবাসীর পত্রে’ এ পরিবারের পরিচয় দিয়েছেন। সে বাড়িতে সার্জন জন স্কট ছাড়া আরও ছিলেন তার স্ত্রী, মেরী, তাদের তিরিশোর্ধ্ব কন্যা, সাতাশ বছর বয়সী মেয়ে ফ্যানি, আর পঁচিশ বছরের কন্যা লুসি। গৃহভৃত্য ছিলো দু'জন। স্কট পরিবারে একটি পুত্রও ছিলো রবীন্দ্রনাথের চেয়ে তিন বছরের বড়ো। তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয়েছিলো পরিবারের ছোট দুই মেয়ে ফ্যানি আর লুসির। রবীন্দ্রনাথকে অমন সুদর্শন দেখে তার প্রেমে পড়তেও তাদের দেরি হলো না। বিশেষ করে লুসির। রবীন্দ্রনাথেরও একটু পক্ষপাত ছিলো তাঁর চেয়ে ছয় বছরের বড়ো এই মেয়েটির প্রতি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর দেখা হয় ১৯২৪ সালে। কবি যাচ্ছেন পেরুর স্বাধীনতা সংগ্রামের শতবার্ষিকী অনুষ্ঠানে অতিথি হয়ে। সঙ্গী লিওনার্ড এলমহার্স্টকে নিয়ে জাহাজে চড়েছেন। সমুদ্রপথে দীর্ঘযাত্রার ধকল সহ্য হলো না ৬৩ বছর বয়সী ওই শরীরে। অসুস্থ হয়ে পথিমধ্যে আর্জেন্টিনায় যাত্রাবিরতি নিতে বাধ্য হন বৃদ্ধ কবি। পরের গল্পটা সবার জানা। বুয়েন্স আয়ার্সের প্লাজা হোটেলে কবিকে দেখতে এলেন তার গুণমুগ্ধ পাঠিকা, যিনি কিনা নিজেও ছিলেন একজন সাড়া জাগানো লেখিকা; নারীবাদী, পত্রিকার সম্পাদক। কবির শারীরিক দুরবস্থা দেখে কাঠখোট্টা সে হোটেল থেকে তাকে রাজি করিয়ে নিয়ে গেলেন নিজের বাড়িতে। স্যান ইসিদ্রোর মিরালরিও থেকে ভিলা ওকাম্পো’তে নিজের তত্ত্বাবধানে রেখে দেখভাল করেছেন কবির। দুই মাস তার আতিথ্যে ছিলেন কবি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভিক্টোরিয়ার নাম দিয়েছিলেন বিজয়া। ওই সময় প্রায় ৩০টি কবিতা লেখেন রবীন্দ্রনাথ। পাশাপাশি তার চিত্রকর হয়ে ওঠার পেছনেও ভূমিকা রয়েছে ভিক্টোরিয়ার। এমনকি ১৯৩০ সালে প্যারিসে রবীন্দ্রনাথের প্রথম চিত্রকর্ম প্রদর্শনীর আয়োজনে অন্যতম উদ্যোগীর ভূমিকা পালন করেন ভিক্টোরিয়া। বলা হয়, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে প্লেটোনিক প্রেমে জড়িয়ে যান অসম বয়েসী বিদেশিনী।
যারা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অন্তরঙ্গ জীবনের খোঁজ রাখেন কিংবা নিদেন পক্ষে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘রানু ও ভানু’ উপন্যাসটি পড়েছেন, তারা রানু সম্পর্কে অবহিত। রানু মানে প্রিন্সেস রানু মুখার্জি। রবীন্দ্রজীবনের একজন গুরুত্বপূর্ণ অংশ তিনি। কে ছিলেন তিনি ? কি ছিলেন তিনি রবীন্দ্রনাথের? পঁচিশে বৈশাখে, রবীন্দ্রনাথের জন্মজয়ন্তীতে প্রেমময় সে কাহিনীর আলোচনা প্রাসঙ্গিক হবে। বলে রাখা ভালো, রবীন্দ্র জীবন নায়িকাবহুল। ব্যক্তিগত জীবনে এবং সাহিত্যের আবহে রবীন্দ্রনাথের নায়িকাগণের দৃপ্ত আনাগোনা অলক্ষ্যণীয় নয়। রানু এদের মধ্যে ব্যতিক্রম ও বিশিষ্ট, যিনি লেডি রানু নামেও সমধিক পরিচিত ছিলেন।
রানু মুখার্জির বাবা কাশীতে দর্শনের অধ্যাপক ছিলেন; মা মানুষ হয়েছিলেন পাঞ্জাবে। ছোটবেলাতেই তিনি তাঁর মাকে রবীন্দ্রনাথের কবিতা আবৃত্তি করতে শুনতেন। মায়ের গলা ছিল ভারী মিষ্টি। গান গাইতে পারতেন। ছবির মতো সুন্দর ছিল তাঁদের কাশীর বাড়িটি। অন্দর আর বৈঠকখানা নিয়ে দুই মহলা বাড়ি। একপাশে গোয়ালঘর। একজন কাজের লোক সব সময় দা দিয়ে তামাক কাটতো বাবার গড়গড়ার জন্য। উঠানের আরেকদিকে বাড়ির মধ্যেই রাম-সীতার মন্দির ছিল। বাড়ির ছাদের ওপর বাবা মাঝে মাঝে এস্রাজ বাজাতেন। তাঁর বাবা ছিলেন গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ। একটা বিরাট দূরত্ব ছিল তাঁর বাবার সঙ্গে। রবীন্দ্রনাথ ‘ভানুসিংহের পত্রাবলী’তে কাশীর এই বাড়িটির উল্লেখ করেছেন। বিশিষ্ট বাঙালি হিন্দু বাড়ির উৎকৃষ্ট উপমা ছিল বাড়িটি। এই বাড়ির কর্তা রানুর বাবা পরে দিল্লির হিন্দু কলেজের প্রিন্সিপাল হয়েছিলেন। একদিন হঠাৎ রানুর ঠাকুরদাদা খবর পাঠান তিনি ‘দণ্ডী সাধু’ হয়েছেন। এ রকম একটি ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক আবহে রানুর জন্ম ও বেড়ে ওঠা।
রানুর বাবা এক পর্যায়ে ক্ষিতিমোহন সেনকে দার্শনিক গবেষণায় সাহায্য করতে শান্তিনিকেতনে বসবাস করেন। থাকতেন ‘উত্তরায়ণ’-এর পাশের একটি বাবড়িতে। রানু মুখার্জি নিজেই জানিয়েছেন ( দেশ, ১৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৮৯):
“রবীন্দ্রনাথের প্রভাব আমার জীবনে খুব। অত্যন্ত বেশি পড়েছিল। ছোটবেলা থেকে খুব কাছে তাঁকে পেয়েছি। রবীন্দ্রনাথের অভ্যাস ছিল ভোরে ওঠার। আমরাও ভোরে ওঠতাম। শরৎকাল, আঁচল ভরে শিউলি তুলেছি। উনি তখন স্তব্ধ গাছতলায় বসে সূর্যোদয় দেখছেন। তখনও চারিদিকে আবছা। আমার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছেন। আস্তে আস্তে বললেন, কে রানু? আমি আঁচলের সব ফুল তখন ওঁর পায়ে উজাড় করে দিয়েছি। রবীন্দ্রনাথের কথা ফুরাবার নয়। ওঁর ছবি তখন কি বুঝতাম? পরে, বিয়ের পরে যখন একটু পরিণত হয় বোধ। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নাটকে অভিনয় করেছি। বিসর্জনে। ”
রানু মুখার্জির শিল্পদৃষ্টিরও সূচনা ঘটে রবীন্দ্রনাথের সাহচর্যে। শান্তিনিকেতনে বসবাসের সময় রবীন্দ্রনাথ রানুকে সুরেন করের কাছে ছবি আঁকা শেখাতে পাঠান। রানুর গানের গলা তেমন ভালো ছিল না। তাই রবীন্দ্রনাথ চাইতেন রানু ছবি আঁকা শিখুক। সে সময়ে শান্তিনিকেতনে নেভেস্কোপস্কি নামে এক শিল্পী এসেছিলেন। তিনি ছিলেন চেকস্লোভাকিয়ার আর্টিস্ট। রবীন্দ্রনাথের আগ্রহে ভদ্রলোক রানুর প্রতিকৃতি আঁকেন। বিদেশী শিল্পী বেচারারা রানুকে কিঞ্চিত শ্যামলা রঙে এঁকেছিলেন। তা দেখে রবীন্দ্রভক্ত সুনীতি চট্টোপাধ্যায় চটে গিয়েছিলেন। সুনীতি বাবু রানুকে বললেন: “দেখেছেন, আপনাকে কেমন কালো করেছেন। ” নেভেস্কোপস্কি মন থেকে রানুর একটি ন্যুড এঁকেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত আরও অনেক শিল্পী তাকে ঘিরে ছিলেন-গগনেন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথ, সমরেন্দ্রনাথ। ওঁদের সঙ্গে ব্রেকফাস্ট খেতেন রানু মুখার্জি।
রানু মুখার্জি পরবর্তীকালেও শিল্পকলার সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন। কারণ রবীন্দ্রনাথের পৃষ্ঠাপোষকতা ছাড়াও তিনি তাঁর পারিপার্শ্ব থেকে শিল্পের প্রণোদনা লাভ করেছিলেন। তাঁর পিত্রালয়ে ছবির সংগ্রহ ছিল। শ্বশুর ও স্বামী শিল্পীদের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। ছবি কিনতেন। রবীন্দ্র সান্নিধ্য এবং ঠাকুরবাড়ির আঙিনা তো তাঁর ছিলই। বহু ছবির জন্য নিজে সিটিং দিয়েছেন। সিটিং দিয়ে আনন্দ পেয়েছেন অতুল বাবুর কাছে। এ রকম সিটিং দেওয়া তখন কলকাতার সোস্যাল ইভেন্ট ছিল। রানু মুখার্জি জানিয়েছেন:
“আমি সেজেগুজে এমারেল্ডের গয়না পরে দোতলার বারান্দায় বসতাম। একুশটা সিটিং দিই। অতুলবাবুর আঁকা দেখতে কলকাতার বিশিষ্ট ব্যক্তিরা ভিড় করে আসতেন। খানসামা তাঁদের জন্য চা, কফি, স্ন্যাকসের ব্যবস্থা রাখত। দুপুরে আমার স্বামী ফিরলে অতুলবাবু লাঞ্চ খেতেন আমাদের সঙ্গে। প্রথম দিনটার কথা মনে পড়ে। বড় উঁচু ইজেলে ক্যানভাস রেখে ক্রেয়ন নিয়ে চেয়ারে উঠে আঁকতে শুরু করলেন। প্রথম বিরতির সময় আমি উঠে দেখি ক্রেয়নে পোর্ট্রেট মিলিয়ে দিয়েছেন। শুরু করার সময় এই দেখলাম ওপর থেকে ধরলেন। দ্রুত টান দিচ্ছেন। এই রকম নিচে নেমে আসছে হাত। আমার পোর্ট্রেট অতুলবাবু ইউরোপে প্রদর্শন করার জন্য নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। আমার স্বামী বললেন, ‘দেবো না। ’ অতুলবাবু খুব রেগে গিয়েছিলেন: ‘দেবেন না মানে ? কেস করব। ’ শেষ পর্যন্ত আমি ওঁর বাড়িতে যাই। অনেক কষ্টে বুঝিয়ে শান্ত করি।
রবীন্দ্রস্মৃতি ছাড়াও লেডি রানু মুখার্জি কয়েক যুগ ধরে কলকাতার শিল্পকলারও সাক্ষীস্বরূপ। এক পর্যায়ে তিনি অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসের প্রেসিডেন্টও হয়েছিলেন। মহারাজ প্রদ্যেতকুমার ঠাকুর ছিলেন অ্যাকাডেমির প্রথম প্রেসিডেন্ট। এটি প্রতিষ্ঠার সময় অতুলবাবুর (শিল্পী অতুল বসু) বড় রকমের ভূমিকা ছিল। প্রতিষ্ঠার বছর ১৯৩৩ সাল। তখন অফিস ছিল ইন্ডিয়া মিউজিয়ামে। রানু মুখার্জি যখন অ্যাকাডেমির খুব কাছাকাছি আসেন, তখন সংস্থাটির প্রেসিডেন্ট স্যার আবদুল হালিম গজনাভি। সেক্রেটারি ডি. সি. ঘোষ। স্যার আবদুল হালিম যখন লন্ডনে তখন রানু মুখার্জিকে প্রথমে ভাইস প্রেসিডেন্ট করা হয়। তার কিছুদিন পরে একদিন রাতে ডি. সি. ঘোষ হার্টফেল করে মারা গেলেন। অ্যাকাডেমির আর্থিক অবস্থাও তখন খুবই খারাপ। ভীষণ দৈন্যদশা চলছিল। ব্যাঙ্কে প্রতিষ্ঠানের নামে কোনওই টাকা ছিল না। সবাই এসে লেডি রানুকে ধরলেন এবং এবং তিনি অ্যাকাডেমির প্রেসিডেন্ট হলেন। তাঁর স্বামী প্রতিষ্ঠানের জন্য ব্যাঙ্ক একাউন্ট খুলিয়ে দিলেন; কাজ চালাবার জন্য নিজের অফিস থেকে অ্যাকাউনটেন্ট, স্টেনো-টাইপিস্ট দিলেন। তিনি প্রয়োজনে স্বামীর কাছ থেকে সব রকমের সাহায্য-সহযোগিতা-পরামর্শ পেয়েছেন। তাঁর কাজে স্বামী কখনও কোন রকম হস্তক্ষেপ করেন নি। তিনি স্বাধীনভাবে নিজের মতো করে কাজ করেছেন। বিলেত থেকে ফিরে স্যার আবদুল হালিমও তাঁকে মেনে নিলেন।
শিল্পকলার ক্ষেত্রে রানু মুখার্জি বাণিজ্যিক ধারার বদলে ভারতীয় ঋপদী ধারাকে সব সময় সাহায্য করেছেন। ভারতীয় তথা কলকাতার শিল্পকলা পরিস্থিতি সম্পর্কে তাঁর অভিমতও খুবই প্রণিধা যোগ্য:
“অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টস এবং বিড়লা অ্যাকাডেমির যে কাজ, তার সঙ্গে কমার্শিয়াল বা বাণিজ্যিক আর্ট গ্যালারির তুলনা চলে না। অ্যাকাডেমি হলো বড় বাজারের বড় দোকান। একে কেন্দ্র করে ছোট ছোট দোকান হলো গ্যালারি। কখনও কখনও লাভের আশায় শিল্পীদের কাজের দাম অযথা বাড়াচ্ছেন গ্যালারির মালিক। যথেচ্ছভাবেই বাড়াচ্ছে। তাঁরা মিডলম্যান। কথাটা সত্য। আবার আরেক দল ভাবেন শিল্পীরা তো ভালো টাকা পাচ্ছেন। সব কিছুর ভালো এবং মন্দ-দুটি দিক থাকে।
সন্দীপ সরকার নামে একজন শিল্পী-সাংবাদিক সম্ভবত লেডি রানু মুখার্জির সর্বশেষ সাক্ষাতকার নিয়েছিলেন ১৯৯০ সালের দিকে। তাঁর মন্তব্য গুরুত্বপূর্ণ: “একটা অদ্ভুত নিষ্কাম তাঁর (রানু) মন। ” সেই ১৯৮৯-৯০ সালে পরিণত ও বয়স্ক অবস্থাতেও তিনি কলকাতার প্রবীণ বা তরুণ শিল্পীর প্রদশর্নীতে হাজির হয়েছেন। বলতে গেলে তৎকালের প্রতিটি প্রদশর্নীতে তাঁর উপস্থিতি ছিল স্বাভাবিক ঘটনা। এসে কেবল বসে থাকেন নি-ছবি বা মূর্তি খুঁটিয়ে দেখেন। শিল্পীর কুশল শুধান। দুদণ্ড গল্প করেন। তাঁর স্মৃতিকথা অনুলিখনের কথা উঠেছিল। কিন্তু সেটা আর সম্ভব হয়ে ওঠে নি। লেডি রানু মুখার্জির স্মৃতিকথা লিপিবদ্ধ থাকলে রবীন্দ্রজীবনের অনেক অজানা ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য যেমনি জানা যেতো, তেমনি জানা যেতো রবীন্দ্রোত্তর পশ্চিম বাংলার শিল্পকলার নানা ইতিকথা। নিজের জীবনের মধ্য দিয়ে তিনি বর্ণনা করতে পারতেন সমকালীন বাঙালি প্রতিভা, সাহিত্য, চিত্রকলা আর কলকাতাকেন্দ্রিক সমাজ-সংস্কৃতি-ধর্ম-দর্শনের নানা দিক। সেটা না হলেও রবীন্দ্রনাথের নায়িকার রহস্যময় লীলাময়তায় তিনি মিথ আর বাস্তবতার মাঝখানে মূর্ত-বিমূর্ত হয়ে থাকবেন ধরা-অধরা উপস্থিতিতে।
রবীন্দ্রনাথের মতোই দ্যুতিময় হয়ে আছেন তাঁর হিরণ্ময় নায়িকারা। বাংলা ভাষার অসীমান্তিক আকাশের মায়াবী মেঘ হয়ে প্রেমে, বিরহে, স্মরণে ছুঁয়ে আছেন শত-সহস্র পাঠকের অন্তর।
ড. মাহফুজ পারভেজ, কবি-রাষ্ট্রবিজ্ঞানী। অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। ই-মেইল: mahfuzparvez@gmail.com।
বাংলাদেশ সময়: ০৮০০ ঘণ্টা, মে ০৮, ২০১৭
জেডএম/