ঢাকা, রবিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

ভাষার জগত

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩০০ ঘণ্টা, মে ২১, ২০১৭
ভাষার জগত ফ্রেডরিক বডমার ও তার বই

বিশ্বের বহুবিচিত্র মানবসমাজের মতোই বিচিত্র ভাষার জগত। বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত ভাষার জগত নিয়ে ভাষাবিজ্ঞানীদের ভাবনার অন্ত নেই। বহু আগে থেকেই চিন্তাটি চলছে। আজ অব্দি মানুষ আর তাদের ভাষা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা, পরীক্ষা-নিরীক্ষার শেষ নেই।

ভাষা নিয়ে জীবনভর কাজ করেছেন, তেমনই একজন ফ্রেডরিক বডমার। জন্ম সুইজারল্যান্ডে ১৮৯৪ সালে।

ভাষার প্রতি তাঁর অপার কৌতুহল অল্প বয়স থেকেই। যৌবনেই তিনি অনেক ভাষা শিখে বহুভাষাবিদ বা ‘পলিগ্লাট’ হয়ে ওঠেন। ভাষাতত্ত্বে জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯২৪ সালে অর্জন করেন পিএইচডি উপাধি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঠিক আগে দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষাতত্ত্বে অধ্যাপনার চাকরি নিয়ে চলে যান। সেখানেই পরিচয় পরবর্তী কালের বন্ধু ও সহযোগী ল্যান্সলট হুগবেনের সঙ্গে।

বন্ধু হুগবেন মূলত প্রাণিবিজ্ঞানী ও পরিসংখ্যানবিদ। পাশাপাশি চর্চা করছেন ভাষা নিয়েও। এই সময়েই বডমার লেখেন তাঁর বিখ্যাত ‘দ্য লুম অব ল্যাঙ্গুয়েজ’ গ্রন্থটি। লেখার আগে বইয়ের খসড়া দেখালেন বন্ধু হুগবেনকে। হুগবেন ততদিনে রীতিমত বিখ্যাত। একটা সময়ে বডমার বলেছিলেন ‘দ্য লুম অব ল্যাঙ্গুয়েজ’ তাঁর একার লেখা নয়। ওতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে হুগবেনেরও। আসলে প্রকাশের আগে বডমারের অনুরোধে হুগবেন ‘দ্য লুম অব ল্যাঙ্গুয়েজ’ বইটির খসড়া দেখে কিছু পরিমার্জনা করেছিলেন। বডমার আরও চেয়েছিলেন, বইটি প্রকাশিত হোক তাঁদের দুজনেরই নামে। হুগবেন যুগ্ম রচয়িতার কৃতিত্ব নিয়ে ভাগ বসাতে রাজি হন নি। ভূমিকায় হুগবেন লিখেছেন, তিনি অতি কষ্টে বডমারকে নিরস্ত করেছেন যুগ্ম লেখকের প্রসঙ্গে। বাধ্য হয়েই বডমার একক নামে বইটি প্রকাশ করেন।

এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে, হুগবেন তো মূলত প্রাণিবিজ্ঞানী। তাহলে বডমারের বইটিতে তাঁর আগ্রহ বা দায় কীসের? উত্তর মিলবে হুগবেনের জীবন ও কর্মে। এ কথা ঠিক যে হুগবেন পেশায় মূলত প্রাণিবিজ্ঞানী। পরে তিনি হয়েছিলেন প্রশাসক। ১৯৬৩ সালে গাইয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর। তাঁর পেশাজীবন জুড়েই তীব্র ছিল একটি বিশেষ উদ্যোগ। তা হলো, বিজ্ঞান ও ভাষা বিষয়ক গ্রন্থাদির প্রচার ও পৃষ্ঠপোষকতা। তদুপরি ১৯৪৩ সালে হুগবেন ‘ইন্টারগ্লোসা’ নামে একটি কৃত্রিম ভাষা উদ্ভাবন করেছিলেন।

কৃত্রিম ভাষা হলো সহযোগী বা অক্সিলারি ল্যাঙ্গুয়েজ। কাজেই বডমারের বইয়ে তাঁর ভূমিকা ও মতামত থাকা স্বাভাবিক। বডমারের মৃত্যুর (১৯৫৫) পর যেহেতু তিনি বেঁচেছিলেন আরও কুড়ি বছর (১৯৭৫), তাই পরে একাধিক বার বইটির পরিমার্জনা, পুনর্মুদ্রণ ইত্যাদি করতে পেরেছিলেন বিষয়গত যোগ্যতা ও অধিকারের কারণেই। কিন্তু কখনোই সহ-লেখকের মর্যাদা দাবি করেন নি। কেউ দিতে চাইলেও গ্রহণ করেন নি। বিষয়ের প্রতি ভালোবাসায় এমনই আত্মনিবেদিত ও নির্লোভ চরিত্রে অধিকারী ছিলেন হুগবেন।

যা হোক, বডমার কেপটাউনের চাকরি ছেড়ে যোগদান করেছিলেন আমেরিকার বিশ্বখ্যাত ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি বা এমআইটি-এর ভাষাবিজ্ঞান বিভাগে। আমৃত্যু তিনি সেখানেই অধ্যাপনা করেন। ১৯৫৫ সালে তাঁর মৃত্যু হলে সেই বিভাগের সেই পদেই যোগ দেন নোয়াম চমস্কি, যিনি তাঁর সমকালের একজন শ্রেষ্ঠ ভাষাবিজ্ঞানী। বডমারের বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় বিখ্যাত সংস্থা জর্জ অ্যালেন অ্যান্ড আনউইন থেকে। তখন একে বলা হয়েছিল বিদেশি ভাষা শিক্ষার গাইড। ১৯৮০ দশক পর্যন্ত বারো-তেরোবার সংস্করণ ও পুনর্মুদ্রিত হওয়ার পর ১৯৮৫ সালে এ বই চলে যায় একটি মার্কিন প্রকাশনা ডব্লু. ডব্লু নর্টন অ্যান্ড কোম্পানির হাতে।

বডমারের বইটিতে আছে চারটি পর্ব। প্রথম পর্বে বর্ণমালা ও লিপির ইতিহাস, অন্বয়, ভাষার শ্রেণিবিভাজন ইত্যাদি। দ্বিতীয় পর্বে লাতিন ও টিউটোনিক ভাষাগোষ্ঠীর যৌথ উত্তরাধিকার নিয়ে ইংরেজি ভাষার গড়ে ওঠার আখ্যান, লাতিনের উত্তরাধিকার এবং লাতিন থেকে উদ্ভুত ভাষাসমূহের কথা। তৃতীয় পর্বে ভাষা পরিকল্পনা এবং চতুর্থ পর্বে লাতিন, টিউটোনিক, ইন্ডিক প্রভৃতি ভাষাগোষ্ঠীর ভাষাগুলোর মধ্যে যোগসূত্র, শব্দসাদৃশ্য ইত্যাদির আলোচনা এবং সেই সঙ্গে ল্যাঙ্গুয়েজ মিউজিয়াম নামে একটি পরিশিষ্টে ছয়-সাতটি ভাষার নির্বাচিত শব্দপঞ্জি ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ।

বডমার সিনট্যাক্সকে বলেছেন, ‘ট্র্যাফিক রুল অব ল্যাঙ্গুয়েজ’। বহুকাল সিনট্যাক্স বা অন্বয় বলতে বাক্যের পদক্রমকেই বোঝানো হত। এখনকার ভাষাবিজ্ঞান সে ধারণা বদলে দিয়েছে। সিনট্যাক্স নিছক পদক্রম নয়, সিনট্যাক্স হল বাক্যে ব্যবহৃত পদগুলোর সংস্থান ও পারস্পরিক সম্পর্ক। ভাষায় ভাষায় পদক্রমের নিয়মের পার্থক্য ঘটে যায়। বডমার পাশাপাশি শব্দ সাজিয়ে দেখিয়েছেন যে, ইংরেজি, জার্মান, ফরাসি, লাতিন প্রভৃতি ভাষার পদক্রমের নিয়ম কেমন। তিনি দেখিয়েছেন যে, সব কটি রোমান্স ভাষায় আর জার্মানিক গোষ্ঠীর ভাষায় কেবল কর্তা বা সাবজেক্ট আর ক্রিয়ার অবস্থান বদলে দিলেই নির্দেশক সদর্থক বাক্য প্রশ্নবাচক বাক্যে পরিণত হয়ে যায়। এভাবেই বডমার ভাষা পরিকল্পনা করার কথা বলেছেন। ভাষা ও চিন্তার সেতুবন্ধর রচনায় প্রয়াসী হয়েছেন। তিনি ভাষাবিজ্ঞানের মূল সূত্র ধরে একাদিক্রমে নানা ভাষায় পারদর্শি হওয়ার কথাও বলেছেন। আশা জাগিয়ে ছিলেন যেন পৃথিবীর সব মানুষ পৃথিবীর সব ভাষায় কথা বলতে পারে।

বাংলাকে কেন্দ্রে রেখে আমরা উপমহাদেশের অন্য ভাষাগুলোকে আয়ত্ব করতে পারি নি। ইউরোপে একজন ফরাসি বা ডাচ বা ইংরেজ অবশ্যই সেকেন্ড বা থার্ড ল্যাঙ্গুয়েজ হিসাবে দুটি-তিনটি ভাষা শিখবেনই। আমরা কি হিন্দি বা উর্দু নিয়ে এমন গর্ব করতে পারি? কজন আছেন আমাদের মধ্যে, যারা নেপালি বা ভূটানি কিংবা উড়িয়া বা অহমিয়া জানেন? ইংরেজি প্রতিক্ষণ কানের কাছে বাজছে বটে। কিন্তু এতে আমাদের পারঙ্গমতা কতটুকু? ফরাসি ভাষার মায়াময় জগতে পৌঁছা এখনও দূরঅস্ত। হিস্পানিক ভাষার একটি আস্ত মহাদেশ বলতে গেলে আমাদের কাছে অজানা। ভাষার জগতে না পৌঁছে ভাব বিনিময়, আশা জাগানো ও চিন্তার মেলবন্ধন কিভাবে সম্ভব? বিশ্বায়ন বা ডিজিটাল মহাসড়কে আমরা আর কতদিন অন্তজ্য হয়ে থাকবো বৈশ্বিক সংযোগের জন্য অতীব প্রয়োজনীয় ভাষাহীনতায়?

আশার কথা হলো, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা ইনস্টিটিউটে দক্ষিণ এশিয়ার, দূর ও মধ্যপ্রাচ্যের এবং ইউরোপীয় বিভিন্ন দেশের ভাষা শেখার ব্যবস্থা রয়েছে। আবার বিভিন্ন দেশ তাদের সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের মাধ্যমে ভাষা শেখানোর ব্যবস্থা নিয়েছে। সে শিক্ষা-ব্যবস্থা ক্রমেই প্রসারিত হচ্ছে। বন্ধুপ্রতীম দেশগুলো রাজনৈতিক সম্পর্কের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক সম্পর্ক বৃদ্ধির প্রয়াসে ভাষা-শিক্ষায় নানা রকম পৃষ্ঠপোষকতাও দিচ্ছে। কম্পিউটার, মোবাইলে নানা রকম প্যাকেজ ও অ্যাপস আছে বিদেশি ভাষা শিক্ষার জন্য। ইন্টারনেট তো এখন আর কেবল বিনোদন মাধ্যম মাত্র নয়, একটি চলমান বিদ্যালয়ও বটে। অতএব ইচ্ছা ও আগ্রহ থাকলে একটা-দুইটা ভাষা শেখা বর্তমান সময়ে  এখন আর কঠিন কোনো কাজ নয়। শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা এ দিকে মনোযোগী হলেই বাংলাদেশে বহুভাষাবিদ আন্তর্জাতিক মানবসম্পদ তৈরি হওয়া খুবই সম্ভব, যারা উচ্চশিক্ষা, চাকরি, ব্যবসার নানা সুযোগ গ্রহণ করে দেশ ও সমাজের প্রভূত উপকার করতে সক্ষম হবে। পৃথিবীর ভাষার জগতে প্রবেশে আর বিলম্ব নয়। এখনই তৈরি হওয়ার উপযুক্ত সময়।

ড.মাহফুজ পারভেজড. মাহফুজ পারভেজ, কবি ও লেখক, অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, mahfuzparvez@gmail.com

 

 

বাংলাদেশ সময়: ১৮৪০ ঘণ্টা, মে ২১, ২০১৭
জেডএম/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।