জেমস মাঝেসাঝে আমাদের জন্য বিচিত্র ধরনের উপহার নিয়ে এসে আমাকে রীতিমতো সংকটে ফেলে। যেমন, কিছুদিন আগে আমাদের মেয়ে কাজরি যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফ্রিটাউনে বেড়াতে এলে জেমস বলিউডের আমির খানের অভিনয় করা কয়েকটি ডিভিডি নিয়ে তাকে দেখতে আসে।
রিজেক্টেড হয়ে গাড়িতে বসে থাকা জেমস মোহাম্মদকে নিয়ে চুপচাপ তার মহল্লার দিকে ড্রাইভ করতে অস্বস্তি হয়। তাই, তার পরিবারের কে কোথায় কী হালতে আছেন তা নিয়ে টুকটাক প্রশ্ন করি। কিছু নতুন তথ্য পাওয়া যায়। তার ছোটবোনও ইবোলায় মারা গেছে। সংক্রমণের দিনগুলোতে তার স্ত্রী গ্রামে বাপের বাড়িতে ছিলো, তার কোলে মাস দু’য়েক আগে এসেছে একটি শিশু। কথা বলতে বলতে এসে পড়ি তার পল্লীতে। গ্রামটি ফ্রিটাউন থেকে বাইরে, সামান্য দূরে, হাইওয়ের লাগোয়া। স্লো করে সড়কের পাশে গাড়ি সাইড করতে হয়। গ্রামের অল্পবয়সী মেয়েরা ঈদের জোশে ছোটখাট একটি মিছিল বের করেছে। তারা হাল্কাচালে ড্যান্স করতে করতে মারাক্কাস বাজিয়ে গাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায়। হাসিমুখে এক যুবতী জানালায় হাত বাড়িয়ে দিলে- আমি দরাজ দিলে তাকে বকশিস দেই। সংক্রমণের ভয়ে গেলো বছর এ ধরনের সামাজিক মেলামেশা, জটলা ও আড্ডা ইত্যাদি রাষ্ট্রীয়ভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিলো। আজকে সড়কে মেয়েদের উচ্ছ্বাস দেখে ভাবি, ইবোলার জীবাণু যদি ফিরে না আসে, তাহলে মাস ছয়েকের মাঝে দেশটির তাবৎ কিছু নরমাল হয়ে আসবে।
জেমস মোহাম্মদের পারিবারিক বসতবাড়ির ঘরটি অনেক বছরের পুরনো। জং-ধরা টিনের চাল ও কাঠের দেয়াল দারুণভাবে ঝুরঝুরে হয়ে আছে। এক কামরার ঘরটিতে বসা, শোয়া ও খাওয়ার ব্যবস্থা। আমি চেয়ার টেনে ডাইনিং টেবিলে বসি। জেমসের জননী পিরিচে করে আমার দিকে বাড়িয়ে দেন কাজু বাদাম ও কয়েকটি লজেন্স। ফিশ-পাইয়ের প্যাকেটটি তার হাতে তুলে দিলে তিনি তা বুকে ঠেকিয়ে জোড় হাতে ‘উনা থ্যাংকি বসম্যান’, বলে ধন্যবাদ জানান। আমি ঘরের দেয়ালে ক্রুশবিদ্ধ যিশুখৃষ্ট ও শিশুকোলে জননী মরিওমের ছবি দেখে কৌতূহলি হয়ে প্রশ্ন করি। কিছু বিষয় জানতে পেরে ভারী তাজ্জব লাগে। মহিলার প্রয়াত স্বামী সিলভাসটার ওরায়লি ছিলেন নিষ্টাবান খৃষ্টান। তার পূর্বপুরুষ কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাস মি. ওরায়লি আইনিভাবে ফ্রি হয়ে ১৭৪৭ সালে কানাডার নবস্কোসিয়া থেকে জাহাজে করে ফ্রিটাউনে এসে সেটেলড্ হন। তিনি পেশায় ছিলেন কাঠমিস্ত্রি। জেমসের জননী মিসেস ওরায়লি তিমনি গোত্রের মুসলমান নারী। ১৯৬১ সালে তারা বিবাহিত হন, এবং সংসারে দু’জনে তাদের পৈত্রিক ধর্মমত বজায় রাখেন। মিসেস ওরায়লি কথা বলতে বলতে তার ইবোলায় প্রয়াত কন্যার ফটোগ্রাফ দেখান। আমি আন্তরিকভাবে কনডোলেন্স জানাতে গিয়ে তার মুখের অভিব্যক্তির পরিবর্তন দেখি। মনে হয়, গ্রামের এ মহিলা কোনো রেলওয়ে জংশনের ভিড়ভাট্টায় পথ হারিয়েছিলেন, এবার সঠিক ট্রেনটি কোন প্ল্যাটফর্ম থেকে ছাড়বে এ তথ্য পেয়ে তার মনে ফিরে এসেছে স্থিরতা। তিনি দু’টি প্লেটে জেমস ও আমাকে টমেটো সসে জারিত জালোফ রাইসের সঙ্গে পাম অয়েলে মুড়মুড়ে করে ভাঁজা আস্ত সামুদ্রিক মাছ সার্ভ করেন। তখনই লাজুকমুখে দু’টি ছোট্ট পাঁচ-সাত বছর বয়সের মেয়ে ঘরে ফিরে আমাকে বলে, ‘গুড আফটারনুন স্যার’। এরা কে জানতে চাইলে মিসেস ওরায়লি নিরাসক্ত মুখে জানান, ‘এরা আমার ভাইঝি, মা-বাবা ইবোলায় মারা গেলে আমি এদের এখানে নিয়ে এসেছি’।
খোলা দরোজা দিয়ে দেখি, ভেতর দিকে উঠানে পামপাতায় ছাওয়া কিচেন-শেডের বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছোট্ট শিশুকে দুধ খাওয়াচ্ছে এক যুবতী। বুঝতে পারি, মেয়েটি জেমসের স্ত্রী। একটু পর বাচ্চাকে মিসেস ওরায়লির ভাইঝির হাতে দিয়ে তরুণীটি আমাদের জন্য নিয়ে আসে ডাবের জল। টেবিলে গ্লাস রেখে আমার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘আ গ্লাডি ফো মিট ইউ বসম্যান, বা আপনার সঙ্গে দেখা হওয়াতে খুশি হয়েছি স্যার’। ময়লা স্কার্ফে উথলানো যৌবন সামলাতে সামলাতে মেয়েটি দু’হাত জোড় করে বলে, ‘আমার ছোট্ট ছেলে, লিটিল ববোকে আপনি কাইন্ডলি কী একটু কোলে নেবেন?’ আমি রাজি হতেই ছোট্টমেয়েটি বাচ্চাকে আমার হাতে তুলে দেয়। সিয়েরা লিওনের সংস্কৃতিতে ছোট্ট বাচ্চাদের সুন্দর বলার রেওয়াজ নেই, কারণ এতে প্রেতের কুনজর পড়তে পারে। তাই মায়ের দিকে তাকিয়ে বলি, ‘লিটিল ববো, উনা ওয়োওয়ো ববো, বা বাচ্চাটি দারুণ কুৎসিত তো’। আমার ক্রিয় উচ্চারণে মজা পেয়ে জেমসের বউ এবার ফিক করে হেসে বলে, ‘বসম্যান, আপনি কী কাইন্ডলি আমার লিটিল ববোর গডফাদার হবেন?’ আমি তার দিকে তাকাই, আর মনে হয়, মেয়েটির অসামান্য রূপ যেকোনো লেখককে প্ররোচিত করবে রূপকথার মতো গল্প রচনায়। আমি রাজি হতেই সে আবদার করে বলে, ‘বসম্যান, আমার লিটিল ববোকে একটি সুন্দর নাম দিতে হবে কিন্তু’। আমি প্রস্তাব করি, ‘হাউ আবাউট শরীফ মোহাম্মদ ওরায়লি?’ তরুণীটি, ‘লাভলি, উনা নাইস নেম, আই লাইক দিস নেম’, বলে শিশুটির বুকে ক্রুশ চিহ্ন আঁকলে আন্দাজ করি, জেমসের বউ ধর্মে খ্রিষ্টান।
খাওয়া দাওয়ার পাঠ চুকলে জেমস কাজের কথা তুলে, ‘বসম্যান, বাচ্চার নামকরণের একটা ছোট্ট অনুষ্ঠান করতে হয় যে স্যার’। ইশারাটি আমি বুঝতে পেরে বলি, ‘খাবার-দাবারের খরচ বাবদ যা লাগে আমাকে জানাবে, আই উড বি গ্ল্যাড টু হেল্প ইউ’। জেমসের স্ত্রী জোড়হাতে, ‘উনা থ্যাংকি বসম্যান,’ বলে ধন্যবাদ জানালে আমি ‘আ ডে গো মামা বা গুডবাই মা-জননী’, বলে মিসেস ওরায়লির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে আসি। টুকটাক কথা বলতে বলতে আমার সঙ্গে হাঁটে জেমস মোহাম্মদ।
গলির মোড়ে যেখানে গাড়ি পার্ক করেছি, ওখানে এসে দেখি পুরনো একটি পাঁকুড় গাছের তালায় ঢোল করতাল নিয়ে জমেছে নৃত্যগীতের জলসা। মাসকেৠাড বলে পরিচিত এ আসরে বিচিত্র পোশাকের সঙ্গে ভারি মুখোশ পরা এক চরিত্র গেয়ে গেয়ে কীর্ত্তণ করছে ঈদ-উৎসবের আনন্দ। এ ধরনের মুখোশ পরা শামান বা তুকতাকের ওঝাদের বলা হয় গংগুলি। সিয়েরা লিওনে গংগুলিরা সমাজের স্পিরিট বা আত্মা হিসাবে পরিচিত। প্রতিটি বিশেষ অনুষ্ঠানে তারা বাদ্যবাজনার সঙ্গে প্রতীকীভাবে প্রচার করে গুরুত্বপূর্ণ বাণী। গান-বাজনার আসরে সামাজিক যোগাযোগ ও স্পর্শের মাধ্যমে ইবোলা ছাড়াতে পারে- এ আশঙ্কায় গেলো বছর গংগুলিদের পারফরমেন্স নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। তারা আবার ছন্দ-সুর ও কৌতুক-রহস্যে আসর গুলজার করছে দেখে ভালো লাগে। মুখোশওয়ালা তার লোমশ গতর দুলিয়ে আমার দিকে ধেয়ে এসে নাকিসুরে- ‘ওয়েলকাম উনা জেন্টোলম্যান ফ্রম ফরেনল্যান্ড,’ বললে আমিও আসরে দাঁড়িয়ে পড়ি। পাঁকুড় গাছের ডালে চড়ে বসা কয়েকটি ছেলে কী কারণে জানি উলুধ্বনি করে ওঠে।
ঢুলিরা বেজায় জোশে বাজিয়ে ছড়ায় উৎসব মুখর উল্লাস। মহল্লার দু’টি তরুণী মা তাদের শিশু কোলে নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে জলসায়। মুখোশওয়ালা তাদের কাছে গিয়ে তার শরীর অষ্টবক্র করে শুভাশীষ জানিয়ে কী যেনো বলে। তার বক্তব্য আমি বুঝতে না পারলে জেমস ফিসফিসিয়ে আমার জন্য তা ইংরেজিতে তর্জমা করে, ‘ওয়ান্স দেওয়ার আর চিলড্রেন, দেয়ার আর হোপ’। দেখি- জেমসের স্ত্রীও তার লিটিল ববোকে কোলে নিয়ে অনাথ মেয়ে দু’টির সঙ্গে হেঁটে আসছে। তাদের দিকে তাকিয়ে আমার সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠি। ইবোলা রিকভারি ফান্ডের বিশাল সম্পদের সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকেও আমি জেমসের প্রকল্পকে সহায়তা দিতে পারছি না, কিন্তু তার দরিদ্র পরিবার সম্পদের অপ্রতুলতা সত্ত্বেও তাদের নিকট আত্মীয়ের অনাথ হওয়া মেয়ে দু’টি লালন-পালনের দ্বায়িত্ব নিয়েছে। বড় খিন্ন লাগে।
চারদিক মাতিয়ে ঢোল করতালের বাদ্যবাজনার ভেতর মুখোশ-নাচের জলসা জমে ওঠে। তমেশগীরা থেকে থেকে গানের ধুয়ার সঙ্গে সুর মিলিয়ে মাঝেসাজে উলুধ্বনি দিচ্ছে। আসরের এক কোণায় দাঁড়িয়ে আমিও সুরছন্দে মশগুল হতে হতে ভাবি- হাউ কুইকলি থিংগস্ হ্যাভ চেঞ্জ ইন ফ্রিটাউন। গেলো বছরের ঈদের দিনে এখানকার জনপদে মৃত্যুই ছিলো প্রধান খবর, আজ আবার মায়ের সঙ্গে শিশুরাও এসে যোগ দিচ্ছে সামাজিক উল্লাসে।
* ইবোলা প্রকোপের সময় লেখা।
বাংলাদেশ সময়: ০৯৫৬ ঘণ্টা, জুন ২৭, ২০১৭
এসএনএস
** সিয়েরা লেওনে ঈদ, ইবোলা সারভাইভার ও ছোট্ট শিশু (১ম পর্ব)