ঢাকা, রবিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

অনন্ত নক্ষত্র বীথির পথে

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৩৬ ঘণ্টা, জুলাই ১৬, ২০১৭
অনন্ত নক্ষত্র বীথির পথে হুমায়ূন আহমেদের অপার্থিব শবানুগমন

নন্দিত সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ দূর-পরবাসে লোকান্তরিত হয়েছিলেন ১৯ জুলাই। ৫ম মৃত্যুবার্ষিকীতে জনপ্রিয় লেখকের বেদনার্ত শেষ দিনগুলো ফিরে দেখেছেন বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম-এর কন্ট্রিবিউটিং এডিটর ড. মাহফুজ পারভেজ।

হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যু সংবাদ পেয়েছিলাম খুবই অদ্ভ‍ূত পরিস্থিতিতে।  ২০১২ সালের ১৯ জুলাই বৃহস্পতিবার রাত ১১ টা ৪৫ মিনিটে মোবাইল ফোনে কবি ও আবৃত্তিশিল্পী  ভিখারুন্নেসা রেইনির এসএমএস পেলাম- ‘নিউ ইর্য়কে হুমায়ূন আহমেদ মারা গেছেন’।

 

আমি তখন ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ফেনী-কুমিল্লার কাছাকাছি কোনো একটি এলাকায় ‘সিয়াম পরিবহন’ নামের নাইট কোচে চট্টগ্রাম থেকে কিশোরগঞ্জের পথে। বাসটি কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ভৈরব, কিশোরগঞ্জ হয়ে ময়মনসিংহের নান্দাইল চৌরাস্তার উপর দিয়ে যাবে তাড়াইল উপজেলা সদর পর্যন্ত।  

নান্দাইল চৌরাস্তা থেকে বাসটি যখন ডানে মোড় নেবে, তখন বাম পাশে রেখে যাবে ময়মনসিংহ-কিশোরগঞ্জ-নেত্রকোনার সীমান্ত সংলগ্ন হুমায়ূন আহমেদের জন্মস্থান কেন্দুয়া উপজেলার কুতুবপুর গ্রাম। সারা রাস্তায় আমি নিউইর্য়ক থেকে নেত্রকোনার কুতুবপুরের কথা ভাবতে ভাবতে হুমায়ূন আহমেদে মগ্ন হয়ে থাকি।  

গল্প-উপন্যাস, নাটক কিংবা চলচ্চিত্র নির্মাণ যেখানেই হাত দিয়েছেন সেখানেই সোনা ফলিয়েছেন ড. হুমায়ূন ২০ জুলাই (শুক্রবার) কিশোরগঞ্জে অস্থির সময় কাটে। ইলেক্ট্রনিক্স মিডিয়া জুড়ে হুমায়ূন আহমেদ। শুক্রবারের সকল পত্রিকায় তার মৃত্যুর সংবাদ পূর্ণভাবে আসতে পারেনি। সামান্য কিছু দৈনিকে আবছাভাবে হুমায়ূনের মায়াবী প্রস্থান সম্পর্কে নিউজ ধরাতে পারলো।  

অধিকাংশ রইল সংক্ষিপ্ত সংবাদের গন্ডিতে। ঢাকা, চট্টগ্রাম ও কানাডার কয়েকটি মিডিয়া থেকে আমাকেও লেখার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হলো।  পাঁচবছর আগের সেদিনের লেখাগুলোর কথা ভেবে ভেতরটা আর্দ্র হয়ে আসে। সত্যিই, তাঁর মৃত্যু ছিল বেদনার; চিরপ্রস্থান ছিল দুঃখজাগানিয়া।  

আসলেই তো, মহাকালের ‘অনন্ত নক্ষত্র বীথি’র পথে চিরদিনের জন্যে  চলে গেছেন নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ। ভাটিবাংলার জলমগ্ন হাওরের ‘লিলুয়া’ বাতাসে ভেসে তিনি চলে গেলেন। তিনি চলে গেছেন অপরূপ জোছনার স্মৃতিতে ভিজে ভিজে ‘শ্রাবণ মেঘের দিনের’ অন্বেষায় ।  

হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যু এমনই এক চলে যাওয়া, যার অন্য নাম ‘মায়াবী প্রস্থান’। বাংলাদেশের মানুষ আর প্রকৃতির যাবতীয় সত্ত্বা স্পর্শী সেই চিরযাত্রাপথ। ক্ষণিকের এ প্রস্থান কখনই বিদায় নয়। পঞ্চান্ন হাজার বর্গমাইলের ক্যানভাস জুড়ে তিনি আছেন তার অজর লেখনির মাধ্যমে; তবু তিনি নেই।
 
গোড়ার দিকে নগন্য সংখ্যক অতি-আঁতেল ধরনের তথাকথিত বুদ্ধিজীবী ছিলেন তার সমালোচক। সমঝদার ছিলেন বৃহত্তর পাঠক শ্রেণী। তিনি পাঠ-বিপ্লবের প্লাবনে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন তুচ্ছ বিরোধিতা। পরিণত হয়েছিলেন অখণ্ড বাংলার কথা সাহিত্যের এক ও অনন্য আইকনে।  

‘জীবন্ত কিংবদন্তি’ বলতে সত্যি সত্যিই যদি কাউকে চিহ্নিত করা হয়, তাহলে তিনি অবধারিতভাবে হুমায়ূন আহমেদ। ঈর্ষণীয় পাঠকপ্রিয়তার জাদুকরী ছোঁয়ায় তিনি বাংলা সাহিত্যের মরা গাঙে প্রাণের বন্যা জাগিয়েছেন।

জন্মে ছিলেন হাওর জনপদের উত্তর-পশ্চিম তীরের বৃহত্তর ময়মনসিংহের নেত্রকোনায়। বেড়ে ওঠেছিলেন হাওরের পূর্ব পার্শ্বস্থ সিলেটের মীরাবাজারে। তারপর বৃহত্তর বরিশালের শ্যামল পিরোজপুরে এবং বাংলাদেশের আরও কিছু চমৎকার স্থানে।  

পড়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও উত্তর আমেরিকার নর্থ ডেকোটায়। কর্মসূত্রে ময়মনসিংহে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বল্পকালীন শিক্ষকতার পর বহু বছর ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। লেখালেখি ও চলচ্চিত্র নির্মাণে পূর্ণকালীন আত্মনিয়োগের প্রয়োজনে এক সময় ছেড়ে দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনা। তার জন্য নিরাপদ পেশা ছেড়ে সাহিত্যাঙ্গনে চলে আসার প্রয়োজন ছিল।  

পুত্রের সঙ্গে বাবা হুমায়ূনকেননা প্রবল পাঠক প্রত্যাশার কারণে তাকে অবিরাম লিখতে হয়েছে। একুশের মেলায় তার বই বের হলে একাধিক সংস্করণ হয়েছে। একেকটি সংস্করণ ২০-২৫ হাজারের কম হয়নি। লাখ লাখ কপি বিক্রি হয়েছে হুমায়ূনের একেকটি বই। অটোগ্রাফের ভিড় সামলাতে তার আশে-পাশে নিয়োজিত করা হতো নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের। তুঙ্গস্পর্শী, বিরল ও অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তার কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন তিনি তার সমকালে।

গল্প-উপন্যাস লেখা, নাটক রচনা, চলচ্চিত্র নির্মাণ যেখানেই হাত দিয়েছেন সোনা ফলিয়েছেন তিনি। ‘শঙ্খনীল কারাগার’, ‘নন্দিত নরকে’ দিয়ে শুরু। তারপর স্রোতধারার মতো তার সোনালি কলম ছুটে চলেছে। মুক্তিযুদ্ধে পটভূমিতে ‘৭১’, ‘জোসনা ও জননী’। প্রেমের, বিরহের, বেদনার শত শত গল্প-উপন্যাস হুমায়ূন আহমেদের হাত দিয়ে পাঠক চিত্তে স্থায়ী আসন করে রেখেছে।  

তার ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে অধুনালুপ্ত ‘পাক্ষিক শৈলী’ একটি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করে। সেখানে আমাকে একটি মূল্যায়নধর্মী প্রবন্ধ দিতে হয়। আমার সেই প্রবন্ধে হুমায়ূন আহমেদের ‘মেঘ বলেছে যাব যাব’ উপন্যাস থেকে মেঘমন্দ্রিত হিমালয়ের আবহ থেকে কিছুটা উল্লেখ করার পর আমি টের পেলাম, কখন যেন আমার নিজের চোখ দু’টি ভিজে গেছে। আনন্দ ও বেদনার এমনই এক শিহরণের নাম হুমায়ূন আহমেদ।

শেষ দিকে তিনি ‘কবি’, সম্রাট হুমায়ূনের জীবনালেখ্যের ভিত্তিতে ‘বাদশাহ নামদার’, ঊনসত্তুরের প্রেক্ষাপটে ‘উতাল হাওয়া’ ইত্যাদি ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহে মানবীয় দূঃখ-বেদনা-সঙ্কটের অপূর্ব বিন্যাস নির্মাণ করেছেন।  

আনিস, শাহানা, বাকের ভাই, নীরা, পরী, বিনু, হিমু, মিসির আলীর মতো শত শত চরিত্র তিনি তৈরি করেছেন, যাদের নিত্য দেখা যায়, কখনও চারপাশের জগতে, কখনও আমাদেরই সমান্তরালে; একই পাড়ায় কিংবা পাশের বাড়িতে।
    
চলচ্চিত্রে অদ্ভূত জাগরণ এনেছিলেন তিনি। মনে পড়ে ‘আগুনের পরশমনি’ দেখতে প্রফেসর শেখ জহির আহমেদের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল অধ্যাপক সপরিবারে বন্দরনগরীর আলমাস সিনেমা হলে গিয়েছিলাম।  

বহু বছর পর প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে ছবিটি দেখে তৃপ্তি ও আনন্দের অভিভূত হয়েছিলাম সকলেই। আরও মনে পড়ে ২০০১ সালের দিকে এক নিঝুম অপরাহ্ণে ঢাকার শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটে  ‘উত্থানপর্ব’ অফিসে আহমদ ছফা ভাইয়ের সঙ্গে গল্প করছি।  

অকস্মাৎ সেখানে পশ্চিমবঙ্গের কবি জয় গোস্বামীর আগমন; সঙ্গে ছত্রধারি হিসেবে আমাদের প্রয়াত বন্ধু কবি ত্রিদিব দস্তিদার। জয়কে রোদ থেকে বাঁচাতে ত্রিদিব আক্ষরিক অর্থেই ছাতা নিয়ে ঘুরছিলেন।  

জয় গোস্বামী আমাদের সঙ্গে বইয়ের দোকানগুলোতে ঘুরতে ঘুরতে বাংলাদেশের তিনজন লেখকের বই যা পাচ্ছিলেন, সবগুলোই কিনে নিচ্ছিলেন। জয়ের সংগ্রহ তালিকাভভুক্ত বাংলাদেশের এই তিনজন লেখক ছিলেন আহমদ ছফা, ফরহাদ মজহার এবং হুমায়ূন আহমেদ।  

এ তথ্যের সঙ্গে সঙ্গে এটাও জানানো দরকার যে, অতি রক্ষণশীল ও গোঁড়া আনন্দবাজার পত্রিকা গোষ্ঠীর ‘দেশ’ ম্যাগাজিন তাদের ঢাউস সাইজের পূজা সংখ্যার জন্যে হুমায়ূন আহমেদের লেখা প্রার্থনা করতো কখনও পেত, কখনও পেত না।  

বাংলাদেশের অন্য কোনো লেখকের লেখার জন্যে তাদের বিচলিত হতে দেখা যায়নি। অথচ হুমায়ূন আহমেদ কখনও কলকাতা নিয়ে বিশেষ আগ্রহ প্রকাশ করেছেন বলে তার কোনো লেখা বা বক্তব্য থেকে জানা যায় না।  

যদিও বাংলাদেশের অনেক কবি বা গল্পকার মনে করেন, বাইরের কল্কে পেলে তারা ‘অমর’ হয়ে যাবেন। হুমায়ূন আহমেদ মানুষকে বিশ্বাস করতেন; পাঠককে সম্মান করতেন; কোনো পৃষ্ঠপোষক-মোড়লকে গ্রাহ্য করতেন না। বাংলাদেশের হৃদয় থেকে লিখতেন। মানুষের হৃদয়ের কাছাকাছি অবস্থান করতেন। বাংলাদেশ ও বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে থাকা বাংলাভাষী মানুষের হৃদস্পন্দনের সঙ্গে ছিল তার সংযোগ। মানব মনস্তত্ত্বের অদেখা ভুবনের উন্মোচনে তিনি ছিলেন এক বিস্ময়কর ও কুশলী কারিগর। আশা ও আশাভঙ্গের মেরুকরণে ব্যক্তিক আর্তি আনন্দ-বেদনায় প্রাণ পেয়েছে তার অলৌকিক কলমে।

জীবনকে নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের লোভনীয় চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। সেন্ট মার্টিনে ‘সমুদ্রবিলাস’ বানিয়েছেন। ভাওয়ালের উপান্তে তৈরি করেছেন নান্দনিক ‘নূহাশ পল্লী’। শুটিংস্পটে পরিচালক হুমায়ূন আহমেদ

‘কুমির মার্কা প্রতীকে’র প্রার্থী কবি নির্মলেন্দু গুণের পক্ষে নির্বাচনের জন্যে চলে গেছেন বারহাট্টা-নেত্রকোনায়। কেউ যখন এগিয়ে আসেনি তখন মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে দারা-পুত্র-পরিবার-পরিজন নিয়ে প্রবল ঝুঁকির মধ্যেও বসে গেছেন সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফটকে।  

ব্যক্তিগত জীবনের দুঃখ-বেদনার হলাহল পান করে নীলকণ্ঠের মতো তিনি অপেক্ষা করেছেন প্রিয় কন্যা, প্রিয় পুত্রের জন্যে।  

ভালোবাসার সন্ধানে কাটিয়েছেন তিনি তার আস্ত একটি জীবন। লেখক বা ব্যক্তি-মানুষ হিসেবে তিনি একজন আটপৌরে কেউ ছিলেন না। সর্বার্থেই তিনি ছিলেন বিশিষ্ট; অন্য সকলের চেয়ে ভীষণভাবে আলাদা। এ রকম বড় মাপের এবং বৈচিত্র্যপূর্ণ একজন মানুষ, শিল্পী, লেখক বহু বহু বছর পর পর আসেন। এসেই স্বকীয়তায় বিজয়ী হন; পরিণত হন ইতিহাসের অংশে।
 
২০১২ সালের একটি বৃহস্পতিবারের মধ্যরাতে (১৯ জুলাই) জন্মভূমির সুদূরের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি হাসপাতালে হুমায়ূন আহমেদ যখন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করছেন, তখন বাংলাদেশের মানুষ রমজান মাসের নতুন চাঁদের অপেক্ষায় আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলেন।  

আজ কিংবা কাল সে চাঁদ ওঠবে। চাঁদের হাত ধরে আসবে প্রিয় জোছনা। তখন আবশ্যিকভাবেই জ্বলজ্বল করে ওঠবে একটি অমোঘ নাম হুমায়ূন আহমেদ; অনন্ত নক্ষত্র বীথির পথে চলে যাওয়া এক জ্যোর্তিময় নক্ষত্র।

পরবর্তী কিস্তি: সাহিত্যের অমর প্রতিভা

বাংলাদেশ সময়: ১৬৩৩ ঘণ্টা, জুলাই ১৬, ২০১৭
এমএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।