ঢাকা, রবিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

মনের ঘূর্ণি থেকে-১

আপাত জন্মের পংক্তি | তানিয়া চক্রবর্তী

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯৫০ ঘণ্টা, আগস্ট ৬, ২০১৭
আপাত জন্মের পংক্তি | তানিয়া চক্রবর্তী আপাত জন্মের পংক্তি | তানিয়া চক্রবর্তী

‘আপাত’ আর ‘আপেক্ষিক’ এ হলো সবচেয়ে খেলুড়ে শব্দ। একটু অন্যভাবে ভাবলে বোঝা যায়, সত্য আর মিথ্যে কিন্তু কোথাও এদের হেরফের বদলাচ্ছে। যতোক্ষণ এই আমি বা আপনি সত্য ততোক্ষণ সবটা সত্য, ধরলাম এরপরও কিছু জিনিস সত্য। কিন্তু যে সত্যের আমি সাক্ষ্যই পাচ্ছি না সে সত্য কিম্বা মিথ্যে কী যায় আসে! আর ওই যে বললাম, একটু অন্যভাবে ভাবুন, আমরা মানে আমি আপনি তো গোটা মিথ্যের আখড়া, গলে পড়ে দেহরা ক্ষণিকের স্থিতি নিয়ে গর্ভপুষ্প থেকে মাটিতে। তাহলে আমরা এই বিরাট মিথ্যের মধ্যে এসেছি ক্ষণিকের সত্যকে জেতানোর আশা নিয়ে! বিজ্ঞান আমাদের জন্ম, আমাদের পৃথিবীর জন্ম সব গল্প বলে দিয়েছে। তবে জীবনকে যদি আস্বাদন করা যায় তাদের কাছে জন্মই তো শুরুর গুহা। অথচ জন্মক্ষণ ও জন্মপরবর্তীতে বেশ কিছুটা সময় আমাদের একটা অসাড় অবস্থার মতো আমাদের ঘোরে লুকিয়ে রাখে। জন্ম-জীবন, যৌবন আর বাড়ন্ত বয়স নিয়ে তথাকথিত বহুমন্তব্য আছে যেমন বার্নার্ড শ’ বলেছেন, ‘youth is a wonderful thing. What a crime to waste it on children’.

এলিয়ট বলেছেন, ‘The years between 50 & 70 are the hardest. you are  always asked to do things  you are not decrepit enough to turn down’.

অস্কার ওয়াইল্ড বলেছেন, ‘The old believe everything, the middle-aged suspect everything, the young know everything’.

মার্ক টোয়েন বলেছেন, ‘life would be infinitely happier if we could only be born at the age of 80 and gradually approach 18’.

এটা সত্যি জন্মকে চরম স্বীকৃতি দেয় আসলে যৌবন। বৃদ্ধবয়স জন্মের সমীচীন সম্পর্কে অতি ইতিবাচক নয়! গর্ভ থেকে ক্রমশ বেড়ে ওঠার মধ্য দিয়ে গর্ভের বাইরে আসা, তারপর ভূ-গর্ভের ওপরে নিজের ব্যক্তিমুহূর্তকে প্রতিষ্ঠা করা।

প্লেটো তার আত্মা সম্পর্কিত সংলাপে জন্মকে মৃত্যুর বিপরীত অবস্থা বলে জন্মের কারণ হিসেবে অতীতে আত্মার মাধ্যমে অস্তিমান থাকার কথা বলেছেন। জন্ম তো অবশ্যই একটি চূড়ান্ত আগমনী গঠন, যার জন্য অদ্ভুত ইন্দ্রিয় ও চেতনা পেয়ে যায় একটি বাদামের মতো ভ্রূণ, তার চলাচল শুরু হয় জৈবিক! আর একটা জন্মই শতশত জন্মের উৎসকে সূচিত করে। জীবনধারণের প্রত্যেকটি মুহূ্র্তে সঙ্গে শক্তি সম্পর্কিত। ‘কসমিক প্রেগনেন্সি’ বলে একটি শব্দবন্ধ আছে যার মূলতত্ত্বে জন্মের আগে থেকে তথা মায়ের গর্ভ থেকে ভ্রূণপর্ব থেকে মায়ের সঙ্গে শিশুর আত্মীয়তা তথা অনুভূতি মাধ্যমে ভাবের আদান-প্রদানে শিশুকে গঠন করা কে জন্মের মহৎ উপায় বলে মানা হয়েছে। এর বিজ্ঞানসম্মত সততা সম্পর্কে ত্রুটিমুক্ত তথ্য দেওয়া মুশকিল! আসলে জন্ম এমন একটা পর্ব, যে পর্ব এতো দীর্ঘ যে তার মৃত্যু অবধি সীমানা কিন্তু মৃত্যুর শুরুটুকু আমরা জানি কিন্তু তার পরবর্তী পর্ব আমরা জানি না! হতেই পারে জন্ম একটি ফ্ল্যাশব্যাক, হতেই পারে জন্ম ক্ষতিপূরণের পর্ব, হতে পারে জন্ম মৃত্যুকালীন প্রক্রিয়া কিম্বা জন্ম শুধুই জন্ম। মিজৌরি-কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের মতে, ‘আমরা যে ভাবি, শিশু পুরো একটা শূন্য মস্তিষ্ক আর শুধু উত্তেজনাপর্বের সমারোহ নিয়ে আসে তা কিন্তু নয়, তারা যা নিয়ে আসে তাকে বলে ‘INTUITIVE PHYSICS’— একধরনের সহজাত স্বতঃস্ফূর্ত জ্ঞান! যা ক্রমোন্নতির মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গের ব্যবহারের মতো হয়ে ওঠে। ‘চোখের গতির পরিবর্তন করে তারা বস্তুকে খোঁজে’।  

‘মানুষ যখন মৃত্যুর দিকে এগোতে থাকে সে ব্যাকুল হয়ে পেছনে তাকায়। আমার মনে হয় তাই হয়েছে। সারাক্ষণই শৈশবের কথা মনে পড়ে। কী অপূর্ব সময়ই না কাটিয়েছি’।
(হুমায়ুন আহমেদ)
 
‘THE VOYAGE OF LIFE’ এটি একটি আর্ট। যা ১৮৪২ খ্রিস্টাব্দে সৃষ্টি করেছিলেন থমাস কোলে। তিনি মানবজীবনের জন্ম ও মৃত্যু মধ্যবর্তী স্তরকে চারটি অংশে দেখিয়েছেন:
১) শৈশব ২) যৌবন ৩)পূর্ণাঙ্গ ৪) বৃদ্ধ 
আপাত জন্মের পংক্তি | তানিয়া চক্রবর্তী
 এই সেই অপূর্ব ছবির (প্রথম ছবি) এখানে শৈশব তথা জন্মের আগমন পর্ব দেখানো হয়েছে, যেখানে শুভ আত্মা তাকে যত্নের আচ্ছাদনে এগিয়ে নিয়ে চলেছে। সেখানে পরিবেশ মনোরম, জলাশয় শান্ত, সিক্ত, নরম। বোঝানো হচ্ছে জন্ম কী স্থির, নির্মল, যেনো এই ঘেরাটোপ তার আশ্রয়!আপাত জন্মের পংক্তি | তানিয়া চক্রবর্তী
এই হলো দ্বিতীয় ছবি যা যৌবনের। এখানে নৌকার অগ্রভাগ সূচালো যেনো উদ্যমী, পেছনে শুভশক্তির প্রতীক তাকে সাক্ষী রেখে সে রহস্যের দিকে ধাবমান, আবছা এক দূর্গের দিকে সে এগোচ্ছে, পথ খুব মসৃণ নয় আর কিছুদূরে তার পাহাড়, নদীর আঁকাবাঁকা পথ। এই সেই রোমাঞ্চকর বয়স যখন মন বাস্তবকে বোঝার জন্য ধাবমান!
আপাত জন্মের পংক্তি | তানিয়া চক্রবর্তী
তিন নং ছবিতে ব্যক্তি পূর্ণ প্রবীণ ও অভিজ্ঞ মানুষ! জীবনের অভিমুখের সঙ্গে সে লড়তে উদ্যত। তার নৌকা আর ততো বলিষ্ঠ নয়। ঈশ্বর তাকে দেখছেন কিন্তু সে ঈশ্বরকে দেখতে পায় না শুধু এক তীব্র জৈবিক ও আত্মিক বিশ্বাস নিয়ে সে খাড়া পর্বতরাজি ও খরস্রোতা নদীর সম্মুখীন হতে এগোচ্ছে, এখানে প্রতিমুহূর্তে বিপদের ছায়া। এই তীব্র কাণ্ড ভরপুর গাছ এখানে বিপদের সংকেত।
আপাত জন্মের পংক্তি | তানিয়া চক্রবর্তী
এটি শেষ ও চতুর্থ ছবি, মৃত্যুসন্নিকটস্থ জীবন, এখানে নদী, প্রকৃতি শান্ত— ঈশ্বর তার জন্য যেনো অপেক্ষমান।

এখানে বাহুল্যকে যদি বর্জনও করি তাও বোঝা যায় জন্ম আসলে মুখদ্বার আর মৃত্যু নির্গমন দ্বার। এখানেও সেই দেখা যায় জন্মের গতি ও আধিপত্য কী ব্যাপক অথচ মৃত্যু এতো স্বল্প হয়েও জীবনকে গিলে খায়। জন্ম নিয়ে বহু কথা আছে। প্লেটো, সক্রেটিস, অ্যারিস্টটল তা রচনা করেছেন। গ্রিক মিথ, ভগবদগীতা সর্বত্র।
আসলে এই মুকুল— এক জন্ম, অর্কিডের ফুল– এক জন্ম, পাথরকুচির পাতা- এক জন্ম, হাঙরের সন্তান- এক জন্ম, গোরিলার বাচ্চা- এক জন্ম, উটপাখির ডিম- সেই জন্মই।

এভাবে সারা পৃথিবী ছেয়ে আছে জন্মে। এই অজস্র জন্মরা পৃথিবীর বৈচিত্র্য। এই জন্ম এক ব্যাপ্তির আশ্রয়। এই জন্মরা পৃথিবীর বৈচিত্র্য এরাই পৃথিবীকে বহাল রাখার চাবি। আর একে সক্রিয় করার হাতিয়ার হলো জীবনের থেকে তার মর্ম খুঁজে বার করা। না হলে জন্ম কেবল একটা ঘটনা। এটা আসলে পরিণতিতে যাওয়ার বোধ, জন্ম হলো ক্রমবর্ধমান ভৌত ও জৈব গতির সংকেত। গীতায় বলা আছে, ঈশ্বর হলো সেই চূড়ান্ত কবি যে অন্ধকারের বাইরে যেনো সূর্যের মতো উজ্জ্বল। জীবন সম্পর্কে এখানে বলা আছে, কেউ জীবনে আসেন ভোগের জন্য, কেউ জীবন বুঝতে, কেউ কাঙ্ক্ষিতকে অর্জন করতে, কিছু আসেন সেই নারী-পুরুষ যারা জ্ঞানের অধিকারী হতে— তারাই সর্বোত্তম।  

প্লেটো-ফিদোতেও জন্ম- মৃত্যুর তথ্য বণ্টিত হয়েছে বৈপরীত্যের সূত্র ধরে, যেমন ‘লম্বা/ বেটে, আলো/ আঁধার’ এই প্রত্যেক বিপরীত তাদের উৎসের মতো। অতএব জন্ম/ মৃত্যুতেও যদি তাই হয় তবে মৃত্যুর দিক থেকেই জন্মের আগমন— এভাবেই সমৃদ্ধ মাস্টারপিস প্লেটো-ফিদো রচিত।
 
মথের> শুঁয়োপোকা, মৌমাছির> গ্র্যাব, মাছির> ম্যাগট, ফিতাকৃমির> সিস্টিসারকাস, সাগরকুসুমের> প্লানুলা, ঝিনুকের> গ্লচিডিয়াম, তারামাছের> বাইপিনেরিয়া

আহা, এই নামে, ধর্মে, বৈচিত্র্যে সমস্ত এই সূচনার লার্ভা দশা তো এই জন্মের প্রতীক। জন্ম আসলে এই সমস্ত লেখনীর অ, আ— আলো তৈরির মহার্ঘ্য ফুলকি— জীবনের গুহামুখ— এই আপাত জন্মের পংক্তি ধরে বলি জন্মকালীন আমরা জন্মের কাছে ঋণী— সে মানুষ কিম্বা পাখি কিম্বা পশু বা কীটই হোক। পৃথিবীর আগমনীই তো এই জন্ম।  

বাংলাদেশ সময়: ১৫৪৩ ঘণ্টা, আগস্ট ০৬, ২০১৭
এসএনএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।