গত বছরের জেফ ও মাইকেল জিম্বালিস্টের 'পেলে: দ্য বার্থ অব আ লেজেন্ড' চলচ্চিত্রটি ব্রাজিলের কিংবদন্তী ফুটবলার পেলের উপর নির্মিত হলেও তা ব্রাজিলীয় চলচ্চিত্র নয়, সেটি হলিউডের। তবে 'সিটি অব গড' এদিক দিয়ে আলাদা, এটি ব্রাজিলীয় সিনেমা।
পর্তুগিজ ভাষার এই সিনেমাটিতে উঠে এসেছে ব্রাজিলের রাজধানী রিও ডি জেনেরিওর একটি বস্তির শিশু-কিশোরদের জীবনকথা। মূলত ষাটের দশক থেকে আশির দশক পর্যন্ত সময়কালে ফ্যাভেলা বা ব্রাজিলীয় শহুরে এসব বস্তির অপরাধ জগৎ চলচ্চিত্রটিতে ফুটে উঠেছে। সে সময়ের পরিস্থিতি বোঝাতে শুধু একটি চরিত্রই যথেষ্ট। স্টিক অ্যান্ড ফাইজ নামে একটা বাচ্চা ছেলে অন্যপক্ষ এক অপরাধ চক্রের কাছে গেলে তাকে জিজ্ঞাসা করা হয় কেনো সে এসবের সঙ্গে আছে। সঙ্গে সঙ্গে স্টিক অ্যান্ড ফ্রাইজ উত্তর দেয়, ''আমি ধুমপান করি, আমি মানুষ হত্যা করেছি এবং লুটপাটও করেছি”। যখন সে বোঝে এতেও কাজ হচ্ছে না, সে বলে, "আমি একজন শক্তসমর্থ পুরুষ”। এটা বলে সে জানান দেয় তাকে বাচ্চা মনে করলেও সে আসলে বাচ্চা নয়, অতোটুকু বয়েসেই অপরাধ জগতের নাড়ি-নক্ষত্র তার জানা।
রিও থেকে বিচ্ছিন্ন এই সংকটপূর্ণ এলাকার নামই দেওয়া হয় 'সিডাড ডি ডয়েস' বা 'সিটি অব গড'। দারিদ্র্যতা, মাদক ও অপরাধের রাজধানীতে পরিণত হয় এলাকাটি। এখানকারই দু’টি ছেলের জীবনের উপর ভিত্তি করে চলচ্চিত্রের গল্পটি এগিয়ে গেছে। একদিকে রকেটের ফটোগ্রাফার হবার স্বপ্ন, অন্যদিকে লিল ডাইসের অপরাধ জগতে রাজত্বের গল্প সমান্তরালে এগিয়ে গেছে। সিনেমাটিকে তিন ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। দশকের হিসাব ধরে এই হিসাব টানা যায়।
চলচ্চিত্রটি শুরু হয়েছে আশির দশকের 'সিটি অব গড'র একটি অসাধারণ রূপক দৃশ্য দিয়ে। একটি অসহায় মুরগি, যাকে একটু পরেই রান্না করে খাওয়ার জন্য আনা হয়েছে, সেই মুরগিটি পালিয়ে যায়। কিন্তু এই মুরগিকেও ছাড় দেয় না লিল জি (লিল ডাইস)। লিল জি তার পিচ্চি বাহিনী নিয়ে মুরগিটির পিছনে ছুটতে থাকে। তারপর একসময় সিনেমাটির এক চিত্তাকর্ষক মুহূর্তে ফ্লাশব্যাকে ষাটের দশকে চলে যায় কাহিনী।
ষাটের দশকে চলচ্চিত্রটির গুরুত্বপূর্ণ দুই চরিত্রের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। একদিকে সহজ-সরল রকেট, অন্যদিকে কূটবুদ্ধির রাজা লিল জি। এছাড়া তখনকার বেনি চরিত্রটি পরবর্তীতে বেশ প্রভাব বিস্তার লাভ করে। টেনডার ব্রাদারস শ্যাগি, গুজ, ক্লিপারের আধিপত্য ও পতন এখানে দেখানো হয়েছে। একরোখা শ্যাগির হৃদয় বিদারক চিরবিদায় দর্শকদের আবেগী করে তুলতে পারে। অপরাধ চক্রের গল্পের মাঝেও প্রেমের আগমন ও হৃদয় বিদারক সমাপ্তি চলচ্চিত্রটিতে দুইবার এসেছে। একদিকে শ্যাগির মৃত্যু অন্যদিকে ব্লাকির বেনি হত্যা।
এমন এক জটিল স্থানের কাহিনী চলচ্চিত্রটিতে উপস্থাপনা করা হয়েছে, যেখানে বাচ্চা ছেলেদের হাতে হাতে পিস্তল-মাদক, যেখানে জীবনের কোনো দাম নেই, প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর শঙ্কা। এখানে প্রতিবাদী হওয়ারও সুযোগ নেই। সত্তরের দশকের কাহিনীতে সিটি অব গডে মাদক সাম্রাজ্য বিস্তার করে লিল জি, কিন্তু তার একমাত্র শত্রু ক্যারোটকে নিয়ে সে সর্বদা শঙ্কিত থাকে। সিনেমাটিতে নাটকীয়তার একপর্যায়ে নেড নামে নেহাত এক ভদ্র ছেলের গার্লফ্রেন্ডকে ধর্ষণ করে লিল জি, আবার নেডের ভাইকেও হত্যা করে। এর প্রতিশোধ নিতে তার কিছুই করার থাকে না, শেষপর্যন্ত ক্যারোটের বাহিনীতে যোগ দেয় নেড। বন্ধু বেনির মৃত্যু ও নেডের ঘটনাটি পরবর্তীতে লিল জি’র ভীত নাড়িয়ে দেয়।
আশির দশকের দিকে লিল জি ও ক্যারোটের ভিতর তীব্র যুদ্ধ শুরু হয়, সিটি অব গড দুইভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। পুলিশও অবস্থার নিয়ন্ত্রণ নিতে পারে না। নেবেই বা কীভাবে? পুলিশের ঘুষ খাওয়া প্রবৃত্তিই লিল জিকে প্রশ্রয় দেয়। সিনেমার গল্পকথক রকেট সিনেমাটির সর্বত্র নানানভাবে বিরাজমান। কখনও নীরব দর্শকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে, কখনও প্রেমিকরূপে অ্যাঞ্জেলিকাকে চেয়েছে, কখনও ফটোগ্রাফার হওয়ার আশায় মত্ত হয়েছে রকেট। শেষপর্যন্ত লিল জি ও ক্যারোটের দ্বন্দ্বের জের ধরেই তার ফটোগ্রাফার হওয়ার স্বপ্ন পূরণের পথ প্রশস্ত হয়। তবে সে পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় সেই মুরগি। একপাশে লিল জি, অন্যপাশে পুলিশ, মাঝখানে মুরগি আর রকেট। একটু পরে সেখানে উপস্থিত হয় ক্যারোট বাহিনী। এখন কী হবে?
যা হওয়ার তা সেখানে হয়েছিল। রকেটের স্বপ্ন প্রসারিত হয়েছিল। তবে সিটি অব গড পাল্টে যায়নি। খোলস বদলের মতো শুধু লিল জি আর ক্যারোটের বদলে অন্যদের দখলে গিয়েছিল সিটি অব গড, নতুন সশস্ত্র পিচ্চি বাহিনী হুঙ্কার ছেড়েছিল একদিনের লিল ডাইসের মতোই।
পাওলো লিন্সের উপন্যাস অবলম্বনে চলচ্চিত্রটির চিত্রনাট্য লিখেছেন ব্রাওলিয়ো ম্যান্তোভানি। এছাড়া অ্যান্তোনিও পিন্টো ও অ্যাড করতেজের মিউজিকে চলচ্চিত্রটি বিশেষায়িত হয়েছে।
একগুচ্ছ নতুন অভিনেতাদের নিয়ে ফার্নান্দো মাইরেলেস তার অভিযান শুরু করলেও তিনি সবার কাছ থেকে ভালো অভিনয় আদায় করে নিয়েছেন। রকেট চরিত্রে আলেকজান্ডার রড্রিগেজ, লিল জি চরিত্রে লিন্ড্রো ফিরমিনো দ্য হোরা দারুণ অভিনয় করেছেন। এছাড়া চলচ্চিত্রটিতে সব অভিনেতাই স্ব স্ব চরিত্রে ভালো অভিনয় করেছেন।
সিনেমাটির দেখতে গিয়ে আপনার বলিউডের অনুরাগ কাশ্যপের 'গ্যাংস অব ওয়াসেপুর' চলচ্চিত্রটির কথা মনে পড়ে যেতে পারে। কিন্তু সিনেমাটির গঠন ও টোন মার্টিন স্করসেজির 'গুডফেলাস' সিনেমাটির সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। আবার সাম্বার তাল 'সিটি অব গড'-কে অন্য মাত্রায় নিয়ে গেছে। এক কথায় ফার্নান্দো মাইরেলেস 'সিটি অব গড' চলচ্চিত্রের মাধ্যমে আমাদের এক অন্যরকম অভিজ্ঞতার সম্মুখীন করিয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ১১৫৬ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৮, ২০১৭
এসএনএস