ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

দালানের গায়ে দালানের দীর্ঘ ছায়া | এনামুল রেজা

গল্প ~ শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭২৭ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৯, ২০১৭
দালানের গায়ে দালানের দীর্ঘ ছায়া | এনামুল রেজা দালানের গায়ে দালানের দীর্ঘ ছায়া | এনামুল রেজা

“থ্র্যাসিমেকাস বললেন, হ্যাঁ, নিশ্চয়।
কানের ব্যাপারেও আমরা একই কথা বলতে পারি। আমাদের শ্রবণেন্দ্রিয় যখন তার শ্রবণশক্তি হারায়, তখন সে আপন লক্ষ্য সাধনে ব্যর্থ হয়। নয়কি?

হ্যাঁ, একথা সত্য।
এ কথা অপরাপর বস্তু সম্পর্কেও সত্য।

কী বলো থ্র্যাসিমেকাস?
আমি তোমার সঙ্গে একমত, সক্রেটিস। ” — প্লেটোর রিপাবলিক, সরদার ফজলুল করিম    
 

রোজ একই গল্প কেন বলো দাদি?
নুরুন্নাহার তার সদ্য কৈশোরে পা রাখা নাতনির প্রশ্নে বিরক্ত হন। গায়ে-পায়ে যা বেড়েছে মেয়েটা, বুদ্ধিসুদ্ধি হয়নি। ওর জন্মের পর সবাইকে বলেছিলেন জেবুন্নেসা রাখতে নাম, রাখা হলো রুবিনা। রুবিনা থেকে এখন সবাই ডাকে রুবি। ছোট নামের মেয়েদের ছোট বুদ্ধি, মাথা নেড়ে নেড়ে যেনো কাউকে বিড়বিড় করে এ কথাগুলো বলেন, খানিকটা সময় চুপচাপ হয়তো কিছু শুনতেও চেষ্টা করেন। জানালার ওপাশে বিকেলের রোদ ম্রিয়মান, দালানের গায়ে দালানের দীর্ঘ ছায়া। মূল সড়ক থেকে কিছুক্ষণ পর পর বাস কিংবা ট্রাকের হর্ন শোনা যাচ্ছে। তিনি রট আয়রনের খাট ছেড়ে টয়লেটের দিকে যেতে যেতে আবার বিড়বিড় করেন, শহরের সব প্রান্ত একই রকম—এক জানালা থেকে অন্য জানালা আলাদা করা যায় না।  
ও দাদি, রাগ করলে?
টয়লেটের দরজা খুলতে খুলতে নুরুন্নাহার শোনেন—রুবি আবার একটা অর্থহীন প্রশ্ন করেছে। ভিতরে ঢুকে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখেন মুখে এতো এতো বলিরেখা, মুখ আর হৃদয় কি একই রকম, দাগে ভরপুর? আয়নায় তার লম্বাটে সাদা মুখে যে পাতলা লালচে ঠোঁট, ওগুলো ভেদ করে উত্তর আসে না। তবে নিশ্চয় অমন হবে, মুখ আর মন আদতে সমবস্তু—একটা সবাই দেখে, অন্যটাও সবাই দেখে?
প্রস্রাবের বেগ নিয়ে ঢুকেছিলেন, সেসব ভুলে নুরুন্নাহার আয়নার সুমুখে দণ্ডে রন। ওই অবস্থাতেই তার শরীর পাকস্থলীর নিম্নচাপ থেকে মুক্ত হয়, কুঞ্চিত উরু বেয়ে বেয়ে শাড়ি ভিজিয়ে মেঝের স্পর্শ পায় হলদেটে তরলের ধারা। দাঁড়িয়ে থেকে তবু তিনি অপেক্ষা করেন, নিশ্চয় আয়নার ছায়া জবাব দেবে—প্রশ্নটা আবার করেছেন, মন আর চেহারা তো একই রকম তাই না?
দাদি ও দাদি, দরজা খোলো।  
উহ মেয়েটা বড্ড জ্বালাতে শিখেছে তো। পেশাব-পায়খানাও করতে দেবে না? এসমস্ত ভাবতে ভাবতে টের পান কাপড় নষ্ট করে ফেলেছেন অজান্তেই। এখন কী হবে? দরজা খুলে দেখেন চিন্তিত মুখে দাঁড়িয়ে আছে রুবি।  
এইভাবে কেউ টয়লেটে গিয়ে নিখোঁজ হয়? তুমি পারোও। এখন থেকে আর দরজা লাগাবে না তো!
কফ জড়ানো কণ্ঠে তিনি বলেন, দরজা লাগাবো না মানে? তোরা উঁকি মেরে মেরে দেখবি ভিতরে কী করি আমি?
বাসায় কেউ নেই, আর তুমি আমায় জ্বালাচ্ছ। ওমা, শাড়ি ভিজল কীভাবে পায়ের দিকে?
তোকে জানতে হবে না।
মানে কী?
গোসল করব। আমার আলমারি থেকে শাড়ি-ব্লাউজ আর একটা পেটিকোট এনে দে।
এই অসময়ে গোসল করলে ঠাণ্ডা কি আমার লাগবে? নুরুন্নাহার ভালো মতো শুনতে পান না, কীসব গজগজ করতে করতে রুবি তাদের রুমটায় ঢুকে যায়—কিছুক্ষণ বাদে দু’হাতে পাঁজা করে নিয়ে আসে তার কাপড়-চোপড়।
নাও। চুলে কি শ্যাম্পু করবে?
নুরুন্নাহার বিরক্ত হয়ে জবাব দেন- এই বললি অবেলায় গোসল করা ভালো না, এখন আবার শ্যাম্পু করব কিনা জানতে চাইছিস?
 

রুবি ধীরপায়ে নিজের রুমটায় ঢোকে।
আলমারির কপাট উন্মুক্ত—কিছুক্ষণ আগে দাদির কাপড় বের করেছিল, লাগাতে ভুলে গিয়েছে। তারা বাসায় একলা আজ, আম্মা নিঝুমকে নিয়ে কোথায় যেনো গেলো—কারও বিয়ের দাওয়াতে নাকি? তার পক্ষে বাসায় একলা থাকা নবতর কিছু নয়। এর আগেও কত দুপুর, বিকেল, সন্ধ্যা কাটিয়ে দিয়েছে এমন। বাসায় বসে থাকা ছাড়া তার কাজই-বা কী আছে আর? ইদানিং অখণ্ড অবসর। চাইলেই ঘুমানো যায় ইচ্ছেমতো। কিংবা সিনেমা দেখা চলে। দাদিকে নিয়ে সিনেমা দেখতে গেলে অবশ্য ঝামেলা হয়। একটু পর পর এটা কী হলো, ওটা কী বললো, দৃশ্যটা আরেকবার টেনে দে, বুঝতে পারিনি—এইসব করতে থাকে। তবু তার জীবনে ওই সত্তোরোর্ধ্ব বৃদ্ধাই সব। বাবা-মায়ের সঙ্গে তার দুরত্ব, বড় বোন নিঝুমের সঙ্গেও।
চারতলার জানালা থেকে সে পাশের দালানের ব্যালকনি দেখতে পায়। সেখানে মাঝবয়সি লোকটা ফোল্ডিং চেয়ারে বসে সিগারেট টানছে, তার পায়ের কাছে হুট করে একটা বাস্কেটবল ছুটে এলো, পিছু পিছু এলো হাসিখুশি মতন এক শিশু—সবে হাঁটতে শিখেছে, টলোমলো ভঙ্গি। এই পিতা-পুত্রকে বেশ লাগে রুবির। আড়চোখে পিতাটি তার দিকে তাকায় তবু চোখ ফিরিয়ে নেয় না রুবি। খানিক বাদে দেয়ালে ঝুলন্ত অনেক আগে তোলা একটা ছবির দিকে দৃষ্টি জমে তার। ওই বছরটায় রাঙামাটিতে গিয়েছিল বন্ধুদের সঙ্গে। একটা বড় ইঞ্জিনবোটে জনা বিশেক বালিকার মাঝে ওই যে তাকেও দেখা যাচ্ছে, নীল একটা ফ্রক পরা, মাথায় ফুলতোলা সাদা হেয়ারব্যান্ড। দাদি আর কতো গল্প জানে? ছোট থেকে সে বড়ই হয়েছে ওসব শুনে শুনে অথচ তার তো অনেক গল্প।
এ ছবিটার পিছনেও কতো কাহিনী জমে আছে!
ফাইনাল পরীক্ষা শেষে তাদের পুরো স্কুল কয়েকটা বিশাল বিশাল বাস ভাড়া করে শুরু করেছিল যাত্রা। বাসগুলো যখন চিটাগাং থেমেছে, তাদের হেডস্যার কী কিনতে যেনো নেমেছিলেন। নামলেন তো নামলেন, ফিরবার নাম নেই। ঘণ্টাখানেক পার হলে সবার টনক নড়ল, ঠিক হলো যে পুলিশের সাহায্য নেওয়া হবে। তখন দেখা গেলো সঙ্গে রোগা পাতলা মতন এক বৃদ্ধকে নিয়ে হেঁটে আসছেন তিনি। বৃদ্ধের পরনে ছেঁড়া একটা ফুলহাতা শার্ট আর ময়লা পাজামা—হাসিতে গাল চওড়া হয়ে আছে। হেডস্যার কাঁদতে কাঁদতে বলছেন, আমার মেজো চাচা—বহু আগে হারিয়ে গিয়েছিলেন, আমরা তখন ছোট। এভাবে রাস্তায় তাকে পেয়ে যাব ভাবিনি। রুবির এখনও মনে আছে সব, পরিষ্কার।    
সেই বৃষ্টির দিনটা মনে পড়ে তোমার?
রুবিকে কেউ প্রশ্নটা করে। মুহূর্তে চারদিকের নৈঃশব্দ ভেঙে গেলে সে বুঝতে পারে, ওই ফোটোফ্রেমটা তাকে প্রশ্ন করেছে। আজ তো প্রথম না, এর আগেও বহুবার এমন চমকে দিয়েছে তাকে চারকোণা মাঝারি আকৃতির ওই চিত্রধারক কাঠের ফ্রেম। দেয়ালে ওই ফ্রেমটায় বন্দি ছবিতে ঠিক ডানপাশে দাঁড়িয়ে আছে লুতফা, বামপাশে নিপা, শোভনা, দিলু। এদের মাঝে তার সবচেয়ে কাছের বান্ধবী নিপা। ঠিক তার মতোই একটা নীলচে ফ্রক পরনে, মাথায় সাদা হেয়ারব্যান্ড। রাঙামাটি যাওয়ার আগের দিন ওরা দু’জন একই সঙ্গে নিউমার্কেট গিয়েছিল যার যার মা-কে নিয়ে। একই রকম পোশাক পছন্দ করেছিল। নিপার আম্মা হাসতে হাসতে বলেছিলেন, এমন হলে কিন্তু বিপদ, যখন তোরা বড় হবি—দেখা যাবে একটাই বর পছন্দ করেছিস দু’জন মিলে। হরিহর আত্মা হওয়ার এই বিপদ।
ফোটোফ্রেমটা তার ঘোর ভাঙায়। আর কী মনে আছে বলতো? নিপা এখন কোথায়? কিরকম আছে জানো?
স্মরণ হয় অনেক কিছুই।
কাপ্তাই লেকের নীলচে জল চিরে ট্রলারগুলো ফিরছে শুভলং থেকে, পাশাপাশি অনেকগুলো নৌযান—সবগুলো দেখতে একই রকম, ওগুলোয় দাঁড়িয়ে কিংবা বসে থাকা যাত্রীরাও প্রায় অভিন্ন, হই-হল্লারত শিক্ষার্থী না হয় শিক্ষক—চারদিকে পিকনিকের ঘ্রাণ। আকাশ হঠাৎ কালো মেঘে ঢেকে গেলো। বিকেল তখন, অথচ মুহূর্তে সন্ধ্যা নামতে শুরু করল যেনো, আকাশ থেকে চুঁয়ে চুঁয়ে নামা সন্ধ্যা। বাতাসে লেকের শান্ত পানিতেও ঢেউয়ের নৃত্য উঠছে, খানিক আগের নীল জল এখন দেখাচ্ছে কালচে মতন। বহু দূরের সমাগত উঁচু পাহাড়ের গা হয়ে উঠেছে ঠিক ডায়নোসরের পিঠ, সেখানে লালাভ আলো—সূর্য ওদিকটায় নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে। ট্রলারের গলুইয়ে দাঁড়িয়ে রুবি আর নিপার চপল মগজে তখন খেলা করছে অন্য কিছু, বৃষ্টিতে ভিজলে কেমন হয়? এমন ভিজবার স্মৃতি সারাজীবন মনে রাখবে তারা। ওপাশ থেকে কে যেনো তাদের চেঁচিয়ে ডাকছে, “এই তোমরা ভিজে যাবে তো, ছাউনির নিচে এসো”!
এরপর আর কিছু মনে করতে ইচ্ছে করে না রুবির। ফোটোফ্রেমটি তখন কর্কশ কণ্ঠে প্রশ্ন করে, কেন ইচ্ছে হয় না? ইচ্ছে না হলেও তোমাকে ওই দিনটি বুকে নিয়েই বাকি জীবন কাটাতে হবে। তুমি কি আর তোমার জীবন বাঁচো? তোমার জীবন খেয়ে যায় অন্য কেউ। রুবির মনে হয়, বড় বেশি আজেবাজে বকছে ফোটোফ্রেম। মন চায়, ওটাকে দেয়াল থেকে টেনে ছুড়ে ফেলতে।     
না চাইলেও দৃশ্যটি কেউ সিনেমার মতো তার চোখের সামনে ছেড়ে দেয়, ফোটোফ্রেমটি হয়ে ওঠে এক দূরদর্শনের পর্দা। ওই তো ট্রলার এগিয়ে চলেছে বৃষ্টির মধ্যে। গলুইয়ে দাঁড়িয়ে ভিজছে তারা দু’জন। ঢেউয়ের দুলুনিতে মুহূর্তেই টুপ করে পানিতে পড়ে গেলো নিপা। সবার মাঝে একটা হুড়োহুড়ি শুরু হলো। কতজন একের পর এক লাফিয়ে নামল কাপ্তাইয়ের জলে। সেও ঝাঁপ মারতে যাবে, তখন পিছন থেকে হেডস্যার তাকে ধরে ফেললেন। এভাবে কেটে গেলো অনেকক্ষণ। এরপর দৃশ্য বদল হয়। বৃষ্টি ধরে এসেছে, চারদিকে শেষ বিকেলের মরা আলো—আকাশে গোধুলি। পাহাড়ের গায়ে লেগে থাকা জল ছুঁই ছুঁই এক গাছের শেকড়ে আঁটকে আছে কার যেনো নীল ফ্রকের পাড়। খুব দ্রুতই ফোটোফ্রেমটায় তৃতীয় দৃশ্য চলে আসে। নিপা মারা গেছে। ট্রলারের ডেকে একটা বেতের পাটিতে শোয়ানো তার মরদেহটি ফুলতোলা চাদরে ঢাকা। হেডস্যারের সেই হারিয়ে যাওয়া চাচার সন্ধানও মিলছে না, অনেকের সঙ্গে তিনিও জলে ঝাঁপ মেরেছিলেন, বাঁচাতে চেয়েছিলেন নিপাকে।
কেন এমন হয়েছিল নিপা, কেন?
রুবি কয়েকবার প্রশ্নটা করে, বুকে ক্ষীণ আশা, বুঝিবা তার মৃত বান্ধবী এসে উত্তর দিয়ে যাবে। তখন ফোটোফ্রেমটা খানিক আগের কর্কশ স্বর বদলে নরম কণ্ঠে রুবিকে সান্ত্বনা দেয়। “শোন, এমন হয়ে কিন্তু ভালো হয়েছে। তুমি তোমার শেকল পেয়ে গেছ। সারা জীবন নিপার অমন মৃত্যু তোমাকে হানা দেবে—এরচেয়ে সহজ শেকল কি আর পাবে? নাকি কেউ পায়?”
কিসের একটা শব্দে রুবির মনে পড়ে দাদি গোসল করতে ঢুকেছিল। এখনও কেন বেরুলো না? ফোটোফ্রেম বলে, তোমাদের সেই হেডস্যারের শেকলটার কথা ভাবো তো একবার। তোমার চেয়ে তারটা কতো কঠিন। তার চেয়েও কঠিন.. আরে কোথায় চললে?
 

নুরুন্নাহার গোসল সেরে বেরুলেন গামছা দিয়ে চুল ঝাড়তে ঝাড়তে।
এ বয়সেও তার মাথাভরা চুল, পেকে পুরোপুরি সাদা হয়নি। জুলাইয়ের শেষ বিকেলের নরম বাতাসে বড় আরাম। টাইলস বসানো খয়েরি মেঝে পিচ্ছিল হয়ে যাচ্ছিল তার চুল বেয়ে ঝরে পড়া জলে, লম্বা ড্রয়িংরুমে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটির পর সেই পিছল মেঝেতে আছাড় খেয়ে পড়লেন। খুবই ছোটখাট আর রোগাপাতলা একজন মানুষ তিনি, আকস্মিক পতনে বুকের ভিতরে কেমন একটু ধক করে উঠল এই যা। উঠে বসতে চেষ্টা করে যখন পারলেন না, বুঝলেন কোমরে কোনো সাড় নেই।
চিতিয়ে পড়ে থেকে কিছুক্ষণ তিনি চুপচাপ কাটিয়ে দিলেন। এরপর সিলিংয়ের দিকে চেয়ে যেনো সিলিংকেই প্রশ্ন করলেন কিংবা ওই যে মাটির ছোট ছোট ঘণ্টা ঝুলছে নায়লনের দড়িতে বাঁধা, একটা ঝাড়বাতির মতো—তাদেরকে। “আমার চেহারায় এতো এতো দাগ, মনেও এতো এতো দাগ, তাহলে এমন একলা কেন লাগে? এই দাগগুলো আমার সঙ্গী কেন হয় না, আমাকে সাহস কেন দেয় না?”  
মাটির ঘণ্টাগুলো বাতাসে নড়তে শুরু করে। যেনো প্রশ্নের উত্তর দিতে তারা প্রস্তুতি নিচ্ছে।
প্রথম ঘণ্টা, যার রঙ সবুজ, কালচে কালচে ফুল সারা গায়ে। সে জবাব দেয়- তুমি তো খুব বুদ্ধিমান ছিলে চিরকাল। যে মানুষ নিজের একাকিত্ব টের পেয়ে যায়, সেকি কখনও আর তা কাটিয়ে ওঠে? একজন একাকী মানুষের বড় সঙ্গী হলো তার একাকিত্ব।
নুরুন্নাহার কী জবাব দেবেন ভেবে পান না।
দ্বিতীয় ঘণ্টার রঙ কমলা, এর গায়ে কোনো ফুল নেই কিন্তু মাঝামাঝি সবুজ রঙের একটা ড্রাগনচিত্র একে পেঁচিয়ে রেখেছে। ঘণ্টাটি জানায়, তুমি তো এদেশের আর দশটা নারীর চেয়ে আলাদা জীবন পেয়েছ। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছো। শিক্ষকতা করেছ। এতো এতো ছাত্রছাত্রী তোমার। অথচ বিয়ে করলে এক লোহা ব্যবসায়ীকে, সে চাইল তুমি শিক্ষকতা ছেড়ে দাও। তুমি ছাড়লে না, নিজেকে স্বাধীন মনে করতে। সেই ব্যবসায়ী আর তোমার সংসারে যাদের জন্ম হলো, তাদের রক্ত হয়ে গেলো দূষিত। না কেউ জ্ঞান পেল, না কেউ বিষয়। দু’টো সন্তানের জন্মের পরেই ব্যাপারটি আগেভাগে টের পেয়েছিলে তুমি, আর একে একে নিজের সম্ভাব্য সন্তানদের নষ্ট করতে শুরু করলে?
নুরুন্নাহার বিড়বিড় করতে থাকেন। কী বলছেন নিজেই শুনতে পান না, অথচ ঘণ্টাগুলোর কণ্ঠ এমন ধাক্কা মেরে যাচ্ছে হৃদয়ে! কীভাবে? তার ভাবনায় ছেদ ফেলে কথা বলতে শুরু করে তৃতীয় ঘণ্টাটি।
এর গাত্রবর্ণ কালো, সাদা সাদা অজস্র ফোঁটা দেহজুড়ে—যেনো অন্ধ আকাশের বুকে অজস্র নক্ষত্রের ফুল। সে বলে- স্বাধীনতা বিষয়ে তোমার ধারণায় ভ্রান্তি ছিলো। ওই ব্যবসায়ী লোকটি যখন তোমার উপর প্রভাব খাটাতে লাগল, আর তুমি সে প্রভাব থেকে বের হতে নিজের ইচ্ছেমতো সবই করলে, শুধু তাকে ছেড়ে গেলে না। একি প্রেম ছিলো? এমন প্রেমে একাকিত্বই আসে। কখনও কখনও তা শেকল হয়ে যায়, এতো বুদ্ধি তোমার, এটাও বুঝে গেলে। তবু দেখ প্রেমের শক্তি কিরকম প্রবল, তুমি বুঝবার পরেও মুক্ত হতে পারলে না।
তার ভাবনাকে কোনো রকম বিরতি না দিয়ে চতুর্থ ঘণ্টাটি তার বক্তব্য শুরু করে, শোন.. ঠিক এমন সময় রুবি ড্রয়িংরুমে এসে দেখে তার দাদি মেঝেতে চিত হয়ে পড়ে আছেন।
ও আল্লা, কী হলো তোমার? দাদি!
নুরুন্নাহার হাসেন। রুবি এসেছে সে খেয়াল যেনো তার নেই। বিড়বিড় করে তিনি বলেন, মুক্ত কেইবা হতে পারে? সব মানুষ যার যার নিজস্ব শেকলে বন্দি।
 
এ দুই বয়সের দু'জন নারীকে উপর থেকে দেখতে দেখতে মাটির ঘণ্টাগুলো নিজেদের মাঝে আলাপ করে।
কয় হাজার বছরের চক্র বলতো?

পাশের ঘর থেকে ফোটোফ্রেমটা উঁচুস্বরে প্রস্তাব করে, এসো আমরা গুনতে থাকি।
ওরা সমস্বরে গুনতে শুরু করে, এক দুই তিন চার পাঁচ ছয় সাত...
 
বাংলাদেশ সময়: ১৩২৩ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৯, ২০১৭
এসএনএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।