ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

‘আন্ধার রাইতে কারে নিয়া নাও বাও মাঝি?’

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২২২ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৪, ২০১৭
‘আন্ধার রাইতে কারে নিয়া নাও বাও মাঝি?’ হাওরের মাঝি। ছবি: বাংলানিউজ

প্রতি বছর সেপ্টেম্বর মাসের শেষ রোববার পালিত হয় বিশ্ব নদী দিবস। নদী ও নদী-মাতৃক প্রকৃতি ও পরিবেশ সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে দিবসটি পালন করা হয়। ১৯৮০ সাল থেকে বিশ্ব নদী দিবস পালন করতে শুরু করে ব্রিটিশ কলম্বিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি। ২০০৫ সাল থেকে জাতিসংঘের বিভিন্ন সহযোগী সংস্থা দিবসটি পালন করছে।

নদীময় বাংলাদেশের জন্য অবশ্য আলাদা করে নদী দিবসের দরকার ছিল না। এদেশের মানুষের কাছে একদা প্রতিটি দিনই ছিল নদী দিবস।

নদী ছিল জীবন-যাপন ও যোগাযোগের উৎস। সংস্কৃতি ও আবেগের সহযোগী হয়ে চিরায়ত বাংলার সঙ্গে মিশে ছিল শত শত নদী।

সেই দিন আর নেই। দেশব্যাপী যেসব নদী ছিল, সেগুলোর প্রত্যেকটি এখন আর জীবন্ত নেই। হয়ে গেছে নদীর কঙ্কাল। দখলে-দুষণে অসংখ্য নদীর মৃত্যু বা অবলুপ্তি ঘটেছে। চারপাশে তাকালে একদার প্রমত্তা বা খরস্রোতে নদীর অপসৃয়মান ছায়া দেখা যাচ্ছে। চোখের সামনে এত বড় হত্যাযজ্ঞ দেখেও আমরা সচেতন হচ্ছি না। অথচ বিশ্বের বহু দেশে নদীকে মানুষের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। নদীকে হত্যা বা ক্ষতি বা দুষিত করাটাকে মানুষের বিরুদ্ধে অপরাধের সমতুল্য বলে ধরা হচ্ছে। যদিও আমরা পাষণ্ডের মতো নদী আর প্রকৃতিকে প্রতিনিয়ত হনন করে চলেছি এবং এভাবেই আমাদের জীবন-যাপনকে বিপদময় করে তুলছি। হয়ত অচীরেই এমন একদিন আসবে, যখন চলচ্চিত্রে নদী দেখে মানুষকে নদী চিনতে হবে! নদী পরিণত হবে স্মৃতির সামগ্রীতে।    

ক’বছর আগে সুযোগ হয়েছিল অনেকগুলো নদীর সঙ্গমস্থল হাওরাঞ্চলে যাওয়ার। কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোণা, সুনামগঞ্জ, সিলেট, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মাঝখানে জলমগ্ন বিস্তৃর্ণ হাওর। সেই হাওর পর্যন্ত ক্রমে ক্রমে অপরিকল্পিত পদক্ষেপে বিরূপ হয়ে যাচ্ছে। প্রাকৃতিক ব্যবস্থাপনা বদলে ফেলার নানা কুপ্রভাব দেখা যাচ্ছে সেখানে। বিশ্ব নদী দিবসে বাংলানিউজের পাঠকদের জন্য তুলে ধরছি নদীময় হাওর ভ্রমণের স্মৃতির অংশ বিশেষ।

হাওরের ওপর দিয়ে যাত্রা করলেই মনে হয়, আমি ভূপৃষ্ঠে নেই; পৃথিবী নামক আদিম গ্রহের অভ্যন্তরে কোনও এক ধমনীর ভেতর দিয়ে রক্তকণিকার মতো ছুটে চলেছি। যেন দুধের বাটির অভ্যন্তরের এক অতল নিঝুমপুরীতে নিমজ্জিত হয়েছি।

হাওরের বুকে দ্বীপের মতো গ্রাম।  ছবি: বাংলানিউজশরতের কুয়াশার আস্তরণ কখনও পুরো কখনও হাল্কা হতে হতে ভোরের আলো ফুটে ওঠার আগেই রহস্যময় আলোছায়ায় জলের বুকে বিম্বিত হলো একটি অলৌকিক সকাল। জল থেকে সূর্য ওঠে। জলেই অস্তমিত হবে আলোর গোলক। সাগরের মতো চারপাশ ঘেরা অতলান্ত জলের ভূগোলে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দ্বীপ-সদৃশ্য হাওরের গ্রামগুলোর একটিতে আশ্রয় নিয়ে আমি পানির বদলে রক্তের টান পাই। মনে হয়, আমি আর মানব-সত্তায় নেই, একটি উদ্বাস্তু রক্তকণা হয়ে বুদ্বুদের মতো ভাসছি আদিঅন্তহীন জলের শরীরে।
 
হাওরে আসাটা এখন সহজ ও আরামদায়ক হয়েছে। আগে সেখানে যেতে সারাদিনের ধকল পোহাতে হতো। আজকাল কিশোরগঞ্জ শহর থেকে আধা-ঘণ্টার মধ্যে সিএনটি বা বাসে পৌঁছা যায় হাওরের প্রবেশদ্বার নামে পরিচিত করিমগঞ্জ উপজেলার চামড়াঘাটে; অধুনা বন্দরের মর্যাদা পেয়েছে জায়গাটি। ভৈরব বা কুলিয়ারচর দিয়েও হাওরের জলমগ্ন জনপদে প্রবেশ করা আরো সহজ। চোখের সামনেই দেখা যায় রহস্যাবৃত্ত ও অনির্ধারিত জলরাশি। মাইলের পর মাইল নিচু জমি জলে টুইটুম্বুর। মধ্যাকর্ষণের টানও প্রবল। আর আছে জলমগ্ন মানুষগুলোর কণ্ঠে চন্দ্রাবতী, মহুয়া, মলুয়া, আবদুল করিমের হৃদয় মোচড়ানো হাহাকার। জোছনা রাতে এখানে চাঁদের গলিত শরীর জলে ভিজে মায়াবী গলায় ডাকে। মানুষগুলো সেখানে সঙ্কুল ও আক্রান্ত হয়ে জলে জলে ভাসছে। জলমগ্ন হাওরের খোলা প্রান্তরে ‘লিলুয়া বাতাস’ নামের এক মায়াবী উড়ালে মনে হয় জল-কল্লোলিত পুরাণ-রমণীর ছায়াচ্ছন্ন আধুনিক অবয়বের কাছে সব কিছু অবনত হয়েছে।
 
আমি এসেছি কুলিয়ারচর দিয়ে। আসার দিনটির কথা বেশ মনে আছে। ঢাকা থেকে স্বল্প সময়ের আরামপ্রদ ট্রেন জার্নিতে ভৈরব। স্টেশনে নেমে চেপে বসলাম সিএনজি’তে। অলিগলি, এই পাড়া, সেই মহল্লা পেরুতেই বদলে গেল প্রকৃতির চালচিত্র। ফুরফুরে মিষ্টি বাতাস ধেয়ে এলো। কিশোরগঞ্জগামী সরু পাকা রাস্তায় কিছুটা গিয়ে ডান দিকে মোড় নিয়ে কুলিয়ারচর। রাস্তা শেষ হলো বিশাল এক হ্রদ সদৃশ্য নদীর পাড়ে। স্থল পথের সঙ্গে এটাই আমাদের শেষ সাক্ষাৎ। এরপর আমরা কেবলই জলের ভূগোলে বিচরণ করব।

একটি স্বাভাবিক ও নিয়মতান্ত্রিক জীবন থেকে অচেনা ভিন্নতর প্রতিবেশে চলেছি। মানুষ শেষ যাত্রার আগে যেভাবে চারপাশ দেখে, আমি আমার এতোদিনের চেনা পৃথিবীটাকে দেখার জন্য খানিক থমকে দাঁড়াই। ৩৬০ ডিগ্রির সবটুকু ধীরে ধীরে, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখি। আমার সামনের অর্ধেকটায় জলের হাতছানি আর পেছনে স্থলের আশ্রয়।

আলতো পায়ে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম দীর্ঘতম নদীর পাড়ে সুন্দর সাজানো পার্কটিতে। সামনের আদিঅন্তহীন নদীটি উজানে আরও অনেক নদী আর জলাভূমি হয়ে আদি উৎস গারো পাহাড়ের দিকে চলে গেছে। তার নিম্নগামী পথটি অন্যান্য নদীর সঙ্গে সখ্যের সূত্রে বঙ্গোপসাগরে মিশেছে। নদী-ঘেষাঁ পার্কে নানা রঙিন ফুলের বাহার। সুন্দর নদীর বুকে আধো কুয়াশা জমাট বেঁধেছে। দীর্ঘ এই নদীময়তার বুকে ভেসে বেড়াচ্ছে নানা পরিযায়ীর দল।

একটু পরেই যুক্ত হয়েছি সেই প্রাকৃতিক দলে। রূপবান সিনেমার পোস্টারের মতো রঙ-চঙে শরীর নিয়ে একটি স্টিমার আমাদের তুলে নিল। হয়ত এমনই জলযানে জল-সামন্তরা ঘেঁটুপুত্র কমলাকে নিয়ে ভেসে বেড়ায়। স্টিমারে কিছু কর্মজীবী মানুষের দঙ্গল ছাড়া আমি কোনও পেশাদার সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর লোকজনকে দেখতে পেলাম না। অকাল বন্যা ও প্রাকৃতিক বিরূপতায় মানুষের কঠিন ও সংগ্রামী জীবন থেকে নন্দনকলা বলতে গেলে অবলুপ্ত হয়েছে।

হাওরে সূর্যাস্ত।  ছবি: বাংলানিউজআদিম অন্ধকার জলের ছায়াচ্ছন্ন হু হু বাতাসের বেগ আমাদেরকে অচীরেই টেনে নিল হাওরের গহীন গভীরে। চারপাশে এখন শুধু জলছলছল প্রকৃতির আদিঅন্তহীন কল্লোল।

মধ্যাহ্নের মুখে আমরা এসে ভিড়েছি একটি চরে। বিশাল চরের নাম ডাকি। প্রচুর পাখি দেখছি হাওরের আনাচে-কানাচে ভেসে বেড়াচ্ছে। তাদের দেখতে বছর জুড়েই নানা স্থানের পক্ষিপ্রেমীরা ছুটে আসেন বারে বারে। চরের প্রধান ঘাটের পাড় জুড়ে ছোট ছোট ডিঙি দাঁড়িয়ে আছে। আগে থেকে বলে রাখা ছিল মোজাম্মেলকে; আমার প্রাক্তণ ছাত্র। সে সঙ্গে নিয়ে এসেছে ছমিরদ্দীন মাঝিকে। তিনি সারা বছর মাছ ধরেন আর পর্যটকদের পাখি দেখান। সময় আর চাহিদা জানালে এখনো নিভু নিভু টিকে-থাকা হাওর সংস্কৃতির নানা প্রান্তিক কেন্দ্রে নিয়ে যান আগুন্তকদের; কোনও এক কাঙালিনি সুফিয়ার মতো বেঁচে থাকা লড়াকু-অনামা শিল্পীর সামনে হাজির করেন। মরমী টানে জল আর কথা আর কণ্ঠ তখন খুলে দেয় পৃথিবীর চেয়ে দূরের কোনও রহস্যময় অলৌকিক পথ।

হাতের তালুর মতো হাওরের প্রতিটি আনাচ-কানাচ ছমিরুদ্দীন মাঝির চেনা। প্রতিটি পাখির বিজ্ঞানসম্মত নাম অজানা থাকলেও তাদের ঠিকানা একেবারে নখদর্পণে এই অক্ষরজ্ঞানহীন লোকটির। কোন পাখি কোন দেশ থেকে এসেছে, সব তার জানা। ‘সাইবেরিয়া থেকে আসা পাখিদের চেনা যায় পায়ের ঘুঙুর দেখে’, জানালেন তিনি, ‘উল্কি আঁকা থাকে তিব্বতের পাখিদের ধূসর পালকে’। চরের ভেতরের দিকে হাঁটতে হাঁটতে তিনি প্রকৃতি-পরিবেশের একটি রানিং কমেন্ট্রি দিতে লাগলেন। মাঝ-চরে কয়েকটি সাজানো ছনের ঘরের একটি দেখিয়ে বললেন, ‘সবচেয়ে ভালোটির ব্যবস্থা করেছি আপনাদের জন্য। ’

আমি মোজাম্মেলের দিকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকাই। এমন পরিস্থিতিতে আমার কিছু বলার নেই। দ্বিতীয় অপশন দেওয়ার রাস্তা বন্ধ। ক্লান্ত ও চরম ক্ষুধার্ত অবস্থায় আশ্রয় আর খাবার নিয়ে দর কষাকষির সুযোগ নেই। ওর দিকে তাকিয়ে আমি হাল্কা মাথা নেড়ে সম্মতি জানালাম। মোজাম্মেল খুশি হলো। ছমিরুদ্দীন মাঝির সঙ্গে মৃদ্যু গলায় পরবর্তী কার্যক্রম নিয়ে কথা বলে আমাকে নিয়ে ঘরে ঢুকল সে।

ঘরের পুরোটা মাটির মেঝে খড় দিয়ে সাজিয়ে নকশী চাদর বিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমি ধপাস করে শোয়ার আগে আগে মোজাম্মেল বলল, চলেন স্যার, কিছুক্ষণ সাঁতার কেটে আসি। তারপর খেয়ে রেস্ট। ’
‘এই বিপজ্জনক জলে কিভাবে সাঁতরাবো?’
‘কিচ্ছু হবে না। চলেন। মেয়েরাও এখানে নির্বিঘ্নে সাঁতরায়। ’     
‘বলো কি?’ আমি বিস্ময়ে হতবাক!
‘হ্যাঁ। গতবার এসে হালিমা নামের একটি মেয়েকে পেয়েছিলাম। স্বামী বাড়ির লাঞ্ছনা সহ্য করতে না পেরে মাঝ রাতে জলে ঝাঁপ দিয়ে তিন হাওর সাঁতরিয়ে ভোরের দিকে চলে এসেছিল নিজের গ্রামে। ’
‘কি বলছো তুমি?’
আমার বিস্মিত অবয়বকে অগ্রাহ্য করে মোজাম্মেল জানায়,
‘এখনও এই গ্রামেই থাকে মেয়েটি। জোছনা রাতে জলের কিনারায় গিয়ে কাঁদে। আপনাকে দেখাবো। ’

হাওরের দেশি পাখী।  ছবি: বাংলানিউজআমি গভীর মমতায় আকাশের দিকে চেয়ে থাকি। মোজাম্মেলও নির্বাক। আমরা অনেক্ষণ কথা বলতে পারি না কেউই।
চট জলদি গোসল করে এসে দেখি খাবার হাজির। ধোঁয়া-ওঠা গরম ভাত। সঙ্গে তাজা মাছের ঝোল। আমিষের গন্ধে মৌ মৌ করছে চারপাশ। ঢাকার ফ্রিজের বিস্বাদ মাছের তুলনায় মনে হলো অমৃত। গোগ্রাসে খেয়ে ভালো করে রেস্ট নেওয়া হলো না মোজাম্মেলের তাড়ায়:
“আমরা মাত্র একটি রাত এখানে থাকবো। ঘুমিয়ে থাকলে চলবে না। ”

রিসার্স ব্যাগ হাতে বাইরে এসে দেখি আকাশ রঙিন করে দিনের আলো পশ্চিমে লুকানোর তালে আছে। তাড়াতাড়ি কিছু শ্যাওলা, পানি আর মাটির কিছু স্যাম্পল তুলে নিলাম। চরের এক পাশে বিচিত্র ধরনের কিছু ক্যাকটাস প্রজাতির কিছুটা বাকল সংগ্রহ করে রাখলাম। খুঁজে খুঁজে পাখি ও সাপের ডিম-ভাঙা খোসা পাওয়া গেল কিছুটা। চরের যে প্রান্ত দিয়ে আমরা নেমেছি তার উল্টো দিকের শেষ প্রান্তে জলের ধারে পৌঁছুতেই সন্ধ্যা হয় হয় অবস্থা।

তীরঘেঁষা একটি কিশোর হিজল গাছের ছলছলে সবুজের তলে বসে আকাশের দিকে তাকালাম। আবীর-মাখা সুরমা বর্ণা মেঘে মেঘে ছেয়ে আছে গোটা দিগন্ত। জলে তার অদ্ভুত প্রতিবিম্ব। পৃথিবীকে কেউ যেন ক্রমশ একটি কালো চাদরে ঢেকে অন্ধকার করে দিচ্ছে। আমি নিঃসীম জলকল্লোলিত চরাচরে এক গভীর আবেশে চোখ বন্ধ করে প্রকৃতির রহস্যময়তায় তলিয়ে যেতে থাকি।

অল্পক্ষণেই মনোযোগ টুটে গেল। দূরে কোথাও বুক-ছেঁড়া বেদনায় বাঁশিতে টান দিয়েছে কোনও এক অজানা বিরহী। সুরের পিছু পিছু ভেসে আসে এক কিশোরীর উদাত্ত গলা, ‘মনে লয় ছাড়িয়া যাইতাম থুইয়া বাড়িঘর...’। বাতাসে ভেসে ভেসে সেই সুর ও কথার বেদনার্ত ভাসমান ধ্বনি পুঞ্জিভূত মেঘ হয়ে আমাকে ঘিরে রাখে।    
রাতটা কোনও রকমে কাটিয়ে নরম ভোরের আলো গায়ে মেখে আবার ভেসে পড়লাম। এবার কোনও যান্ত্রিক জলযান নয়, ডিঙি ধরনের লোকাল বোটে চলেছি। বিশাল জলাশয়ের বুকে ভেসে পড়তেই তিরতিরে জল কেটে এগিয়ে চলল ডিঙি। হাওরের টলটলে জল কেটে খানিক যেতেই চোখে পড়ল লেসার হুইসলিং ডাকের দল। একটা-আধটা নয়, ঝাঁকে ঝাঁকে। তাদের ডানার কালচে, লাল আর খয়েরি রঙের বাহার দেখতে দেখতে চোখ জুড়িয়ে গেল। মোজাম্মেল বাইনোকুলার চোখে বলল,
‘পাখির চোখ বলে কথা’।
আমার হাতের বাইনোকুলারে তাকে অনুসরণ করে তাকাতেই দেখি, ‘কমন স্নাইম’ তার লম্বা চঞ্চুতে মাছ পুরে ফেললো। আর ছোট ছোট বিদেশি হাঁসের দল। লিটল গ্রিব। জল কেটে  ক্ষণিকের চলন, তারপর আবার দে ডুব। ডুবসাঁতার দিয়ে উঠতেই তাদের শরীরে পিছলে পড়ে জলের আলোকিত কণা।
‘এ সৌন্দর্য না দেখলে অনেক কিছুই অদেখা থেকে যায়। ’
আমাকে এমন অপরূপ নিসর্গের কাছে আনার জন্য মোজাম্মেলের প্রতি কৃতজ্ঞ হয়ে বলি।

মোজাম্মেল কোনো কথা বলে না। পাখির রাজ্যে সে যেন হারিয়ে গিয়েছে। আমারও নজরে এলো প্রায় ৫-৬ প্রজাতির মাছরাঙার একটি বড় দল। তাদের স্ক্যানারে স্বচ্ছ জলে মাছেদের আনাগোনায় কড়া নজর। নাগালে আসতেই ঝুপ করে ডুব দিয়ে মাছের ঝাঁক থেকে নিজের পছন্দের মাছটি মুখে নিয়ে দে ছুট।

খানিক এগিয়ে জলা-জঙ্গলার মধ্যে আধ ডোবা বাঁশের মাথায় নজরে পড়ল এক শিকারি পাখি। সেও শিকারের সন্ধানে উদগ্রীব। সাদা শরীরে লাল চোখ দেখেই বুঝে নিতে হয় তার ক্ষিপ্রতা। ভাল করে লক্ষ্য করে দেখি তার হলদেটে  ক্ষুরধার নখ বাঁশের খুঁটিতে ধার করতে ব্যস্ত। জলে ভেসে আছে লিটল গ্রীবের দল। খয়েরি রঙে মিশেছে সাদা পোঁচ। ছোট্ট চেহারায় ক্ষিপ্রতা অসাধারণ। রোদ্দুরের তেজ কমে এখন নরম আলোয় বালি হাঁসের দল সূর্যের কুসুম কুসুম তাপ মাখতে মাখতে হাওরের আরও গভীরের দিকে চলেছে। মনে হচ্ছে, আমাদেরই সহযাত্রী।

হাওরের আকাশে মেঘ।  ছবি: বাংলানিউজ“একসময় প্রচুর পাখি মারত গ্রামের লোকজন। ধীরে ধীরে ফিরেছে সচেতনতা, দূর হয়েছে ব্যাধের দল। আজকাল হাওরে প্রচুর পর্যটক আসেন। আনাগোনা হচ্ছে পরিবেশ ও জীব-বৈচিত্র্য সংরক্ষকদেরও। বেড়েছে সচেতনতা। ” অনেকক্ষণ চুপচাপ থেকে সাইফুল মুখ খোলে অবশেষে। হাওরেই বসত করে সে। দেখে হাজারো নৌকা। বিচিত্র পর্যটক। অপরূপ প্রকৃতি। খোঁজ-খবর ভালোই রাখে।

আরও খবর রাখেন মাঝি-মাল্লারা। হাওরে ঘণ্টা পিছু ১৫০ টাকা নৌকা ভাড়া নেন মাঝিরা। এরাও হদিস জানেন পাখিদের। কোন পাখি কখন আসে, কোথায় বসে, কোথায় থাকে। সব জানা নদীতে ভেসে বেড়ানো মানুষের।

এক ফাঁকে আকাশের প্রান্তসীমানায় লালচে গোল সূর্য ঝুপ করে ডুব দিলো। আমরাও ততক্ষণে এলেংজুড়ি নামের নতুন আরেকটি চর-সদৃশ্য গ্রামে এসে পৌঁছেছি। লালচে আভাময় কালচে-নীল আকাশের বুক জুড়ে পাখিদের ঘরে ফেরার গান শুনতে শুনতে সন্ধ্যে ঘনিয়ে এলো। এখানে আমাদেরও নতুন আরেকটি ঘর খোঁজার পালা। মানুষ কত-শত মজবুত ও বাহারি ঘরে-ঘরে থাকে; তবু তার ঘর খোঁজার শেষ হয় না কোনদিনও!

এলেংজুড়িতে ভোর ভোর আমেজে যখন বাইরে বেরুলাম, তখনও ঝাঁ-চকচকে জলের আয়নায় বিম্বিত আদিম চরের ঘুম ভাঙেনি। হু হু করে বাতাস বইছে জলের সমান্তরালে। চারপাশ এ সময় অনেকটাই ফাঁকা। চরের ঢালি পেরুনোর কিছুটা পর একটা খালের কাছে এসেছি। প্রকৃতি এখানে একেবারেই ভার্জিন। তকতকে সবুজের আস্তরণে চোখের আরাম নিমেষেই মনের প্রশান্তির স্থরে চলে এলো।  

এখানে দুটো রাত কাটিয়ে ঠিক করেছি আরও গভীরে চলে যাবো। মোজাম্মেলের সঙ্গে আমারও বেশ জমেছে জার্নিটা। আমি আর এখন তাকে কেবলই অনুসরণ করছি না। সহযাত্রীর মতো আলাপ-আলোচনা করে পরিকল্পনাও করছি। কুড়ি বছর ধরে ওকে চিনি। ক্যাম্পাসে থেকেছে কয়েক বছর। পড়াশোনার কাজও করছি একই সাথে। অথচ এবারের মতো এতো কাছে আসা হয় নি, জানাও আগে। জলের ভূগোল জানে কাকে কখন কার সঙ্গে মিশিয়ে দিতে হয়।

হাওরগুলো পেরিয়ে জলের উৎসমুখে চলে যাওয়ার বাসনা আমাদেরকে বার বার রোমাঞ্চিত করছে। জলরাশি আমাদেরকে করছে আপ্লূত। সবচেয়ে ভালো হয় অখণ্ড জলের কাছে মিশে থাকতে পারলে। হাওরের অসীমান্তিক জলের, মাছের, পাখিদের সমানাধিকারের জায়গাটায় হয়ত কিছু স্বাধীনতা ফিরে পাওয়া যাবে। অবিভাজ্য জলে সমানে সমানে ভেসে থাকা যাবে কারো বাধা বা চাপ ছাড়াই। হয়ত একটি নিরীহ কোণে পড়ে থাকা যাবে জলের অংশ হয়ে। শামুকের, শ্যাওলার, পতঙ্গের মতো সার্বভৌম দিনগুলো কাটিয়ে দেওয়া যাবে সেখানে উদার আকাশের নিচে আন্তরিক জলের শরীরে। ’  

হাওরের আদিঅন্ত জলজ ভূগোলে এসে মনে হচ্ছে, আমি এক জলজ বুদ্বুদ্ব। মনে হয়, আমি আর মানব-সত্তায় নেই, একটি উদ্বাস্তু রক্তকণা হয়ে বুদ্বুদের মতো ভাসছি আদিঅন্তহীন জলের শরীরে। ভেসে চলেছি হাজার হাজার জল-বুদ্বুদ্বের সঙ্গে। হাওর থেকে ফিরে আসার রাতে অন্ধকার জলের শরীর বেয়ে আমাদের পাশ দিয়ে চলে গিয়েছিল একটি নৌকা। ছলাৎ ছলাৎ শব্দ ছাপিয়ে নৌকার ভেতর থেকে কে যেন গাইছিল, “আন্ধার রাইতে কারে নিয়া নাও বাও মাঝি? সে কি তোমার পরাণের খোঁজ জানে?”

আমি কোনও কথাই বলতে পারি না। অন্ধকারে অপলক চেয়ে বিড়বিড় করে সেই গানটিই গাইতে থাকি: “আন্ধার রাইতে কারে নিয়া নাও বাও মাঝি? সে কি তোমার পরাণের খোঁজ জানে?”

ড. মাহফুজ পারভেজ: কবি-গল্পকার-লেখক। অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।  

বাংলাদেশ সময়: ১৮০০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৪, ২০১৭
জেডএম/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।