ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় স্মরণে।। ড. মাহফুজ পারভেজ

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৩৭ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৩, ২০১৭
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় স্মরণে।। ড. মাহফুজ পারভেজ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

মৃত্যুর পাঁচ বছর পরেও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের [১৯৩৪-২০১২] প্রাসঙ্গিকতা প্রশ্নাতীত। তাঁর মৃত্যুতে সেতু ভাঙার যে শব্দ শুনতে পেয়েছিলাম, তা এখনো জোড়া লাগে নি। সহসা লাগবে কিনা, কে জানে!

তিনি ছাড়া একদার অখণ্ড এবং আজকের দুই রাজনৈতিক বাংলার সাহিত্য সংযোগ বলতে আর কিছুই নেই; থাকার কথাও নয়; চিন্তায়, দর্শনে, ধর্মে, সংস্কারে, বিশ্বাসে পথ আলাদা হয়ে গেছে ৭০ বছর আগে। সেই পথের একটি চলে গেছে কলকাতা থেকে দিল্লির দিকে।

আরেকটি ঢাকা থেকে সারা বিশ্বের অভিমুখে। ঢাকা ও কলকাতার মধ্যে শেষ সেতুর মতো ছিলেন সাহিত্যাঙ্গনের কয়েকজন লেখক; যারা দুই বাংলাকেই তাদের কাজের ভেতরে ধরতে পেরেছিলেন।   সুনীল তাদের অন্যতম। অন্যতম বলবো না শেষতম বলবো, বুঝতে পারছি না।

সুনীলের পর কলকাতার আর কজনই আছেন, ঢাকা যাদের গ্রাহ্য করবে? হুমায়ূন আহমেদের পর আর কজনই বা আছেন, যাদেরকে কলকাতা কুর্নিশ করবে। দুই বাংলা মিলে যে অখণ্ড বাংলা সাহিত্য সেখানে কেরামতি দেখানোর সাধ্য অনেকেরই নেই। যাদের ছিল, তারা ক্রমেই চলে যাচ্ছেন। প্রবাসে বিরহী প্রলেপে হুমায়ূনের প্রস্থানের পর হেমন্তের নিশীথ রাতে সুনীলও চলে গেলেন। মনে হচ্ছে বাংলা সাহিত্যের ঐতিহ্যবাহী মুঘলেরা চলে যাচ্ছেন।
 
কালে কালে কালোত্তীর্ণ লেখক খুব বেশি আসেন না। একই ভাষার লেখক হলেও সবার দাপট সর্বত্র সমান থাকে না। ঢাকায় হাজার হাজার লেখক আছেন। তাতে কলকাতার বিশেষ কিছু যায় আসে না। কলকাতায় হাজার হাজার লেখক আছেন। তাতে ঢাকায় বিন্দু মাত্র স্পন্দন নেই। সব লেখক সর্বত্র গ্রাহ্য হবেন, এমনও নয়। সব লেখকের সীমানা সমান হয় না। হুমায়ূন বা সুনীল সীমানা ভেঙেছিলেন। নিজের মতো করে তারা সীমানা বানাতে পেরেছিলেন। আকাশের ঔদার্য্য নিয়ে তারা বাংলা সাহিত্যের অসীমান্তিক দিগন্ত গড়েছিলেন।
 
বহুমাত্রিক, সৃষ্টি-প্রবল সুনীল সীমানা ভেঙে নিজের বিশাল সীমান্ত রচনা করেছিলেন। কিংবা দুই সীমানার মধ্যে তিনি সেতুর মতো নিজেকে বিছিয়ে দিয়েছিলেন। এর অবশ্য ঐতিহাসিক কারণও ছিল। সুনীল কলকাতায় লিখলেও তার লেখায় উপজীব্য হয়েছে ভূতপূর্ব পূর্ববঙ্গ বা আজকের বাংলাদেশ। মাদারীপুরের কালকিনির মাইজপাড়ার জন্মের টানেই তিনি সেটা করেছেন। বাকীটা জীবন টেনেছেন কলকাতার স্মৃতি। এই করতে গিয়ে বাংলার দুই পারের মানুষকেই তিনি তার সাধ্য মতো ধরতে চেষ্টা করেছেন। কখনো সফল হয়েছে; কখনো হন নি। তাতে বিশেষ কিছু সমস্যাও হয় নি। সুনীলের প্রচেষ্টা মূল্য পেয়েছে। পাঠককে আগ্রহী করেছে। পশ্চিমবঙ্গের মতো বাংলাদেশেও, এমন কি বিশ্বব্যাপ্ত অভিবাসী বাংলাভাষী সমাজেও। সুনীল ‘আমাদের’, এ কথাটা ঢাকা বা কলকাতা অনায়াসে বলতে পেরেছে। আর কাকে কখন এমনটি বলা যাবে, কে জানে!

মৃত্যু লয় এ কারণেই সুনীলকে ম্লান করে না। বরং সুনীলের মৃত্যু একটি সেতু ভাঙার প্রকট শব্দে আমাদের সচকিত করে। তার বিদায় বাংলা সাহিত্য বা কলকাতার সাহিত্যের একটি বহুমুখী যুগের সুস্পষ্ট অবসান ঘটাবে। তার পরের যারা আছেন, তারা সুনীলের মতো কতটুকু দিগন্ত বিস্তারী হতে পারবেন, এখনই সেটা বলা মুশকিল। নিজের স্মৃতি, চঞ্চলতা, সম্পৃক্ততা, স্বজ্জনতা নিয়ে সুনীলের চেয়ে অগ্রসর হতে আর কে পারবেন, জানি না।

সুনীলের আগের সাহিত্য সাধকদের বেলায় অভিযোগ ছিল, বাঙালি-হিন্দু লেখকেরা মুসলিম সমাজকে এড়িয়ে চলেন। এমনও ক্ষোভ ছিল, পশ্চিমবঙ্গের লেখকরা পূর্ববঙ্গের মানুষ ও সমাজকে নিয়ে কাজ করেন না। রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র পর্যন্ত সেসব অভিযোগের তীরে বিদ্ধ হয়েছিলেন। সুনীল বলতে গেলে একাই সেইসব অভিযোগের জবাব দিয়েছেন নিজের রচনাবলীর মধ্য দিয়ে। তার রচনার কতটুকু পশ্চিমবঙ্গ আর কতটুকু পূর্ববঙ্গ দখল করেছে, সেটা নির্ধারণ করা শক্ত।

এক সময় মনে হয়, আহা! এতো ফরিদপুর/মাদারীপুরের বামুনের পোলা। আবার মনে হয়, কঠিন কলকাতায় ছন্নছাড়া এক যুবক তিনি, কবিতার সন্ধানে উদভ্রান্ত। দুপাশেই ‘আমাদের’ হয়ে থাকা; অন্তত শারীরিকভাবে না হলেও লেখকসত্ত্বায়, সেটাই সুনীলের সবচেয়ে বড়ো যাদুকরী প্রতিভা।

সাহিত্যে কেরামতি তিনি আরও দেখিয়েছেন। বিষয়কে ধরতে পারা, ভাষাকে নাচিয়ে দেওয়া সুনীলের এক মহৎ গুণ। এ কারণেই তিনি ঈসা খাঁ বা লালনকেও ছাড়েন নি। রবীন্দ্রনাথ ও প্রিন্সেস রানু মুখার্জিকেও ‘রানু আর ভানু’তে নিয়ে এসেছেন। যদিও ইতিহাসের সত্য আর সাহিত্যের সত্য এক নয়; তথাপি সুনীল সত্য ও সাহিত্যের মাঝখান দিয়ে নিজের কথা বলে গেছেন। কোন কোন পক্ষের প্রতি পক্ষপাত করেছেন বটে; কিন্তু চরমভাবে একপক্ষীয় হয়ে যান নি। চরমভাবে সমালোচিতও হন নি। এখানে এসেই সুনীলকে সাম্প্রদায়িকতা আর আঞ্চলিকতা থেকে বেশ দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়; তাকে মনে হয় সর্বজনীন। নিরপেক্ষতার এই দূরত্ব দিয়েই তিনি সকলের কাছে পৌঁছে যেতে পেরেছেন।    
 
এ কথা বিলক্ষণ বলা যায় যে, ভবিষ্যতে কলকাতাকে ঘিরে যে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস রচিত হবে, তাতে অনেকের নাম থাকবে। আবার ঢাকাকে ঘিরে যে সাহিত্য ও সংস্কৃতির ইতিহাস রচনা করা হবে, সেখানেও বহুজনের নাম আসবে। উভয় পাশেই সমান কৃতিত্বে নিজের নাম রাখতে পারবেন, এমন জন খুব কমই হবেন। সুনীল দুই পাশেই নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন। সাবলীল গতায়াত করেছেন দুপাশেই। এজন্য বলেছি যে, তার মৃত্যুতে সেতু ভাঙার শব্দ শুনছি। স্বজন হারানোর ব্যথা অনুভব করছি। আমার ক্ষেত্রে বিষয়টি বেশ আকস্মিক ও চমকপ্রদ।
   
যদিও ব্যক্তিগত, তবু উল্লেখ করি, ঠিক যে রাতে (২৩ অক্টোবর) সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় যখন মারা যাচ্ছেন, আমি তখন সে বছরের (২০১২) শারদীয় দেশ-এ প্রকাশিত তার উপন্যাস ‘স্বরস্বতীর পায়ের কাছে’ পড়ছি। সকালে মৃত্যু সংবাদ পড়ে আমি বিমূঢ়। আবার চোখ বুলালাম তার সর্বশেষ উপন্যাসটিতে। ঔপনিবেশিক আমলের প্রেক্ষাপটে মাদারীপুর অঞ্চলের আবহে এক ব্রাক্ষণ পরিবারের বিদ্যার্থীর অভিবাসী-জীবন-সংগ্রামের ভয়াবহ চিত্র ফুটে ওঠেছে উপন্যাসটিতে। আগেও তিনি মাদারীপুর-ফরিদপুর অঞ্চল এবং প্রাচীন ব্রাক্ষণ সমাজের নানা দিক নিয়ে লিখেছেন। এ উপন্যাসে তিনি বিদ্যার্জন ও জ্ঞানের প্রতি আগ্রহের যে প্রকাশ ঘটিয়েছেন, সেটা অনন্য। একটি বাড়ি পালানো নব্য-যুবক মেট্রিক পাস করার জন্য পৃষ্ঠপোষকতা ও সাহায্য চায়। গ্রামে গ্রামে ঘুরে অবশেষে সেই সাহায্য মিললো কলকাতার বেশ্যাপল্লীর একটি প্রায়-বন্দি জীবনে। অধ্যবসায় শেষে ছেলেটি তার গ্রামের প্রথম মেট্রিক পাস হিসাবে গণ্য হলো। শিক্ষার সংগ্রামে সে হারালো পুরনো প্রেমিকা, যৌবনের দাবি এবং ভোগের উপাচার। তবু সে সার্থক, তৃপ্ত। উপন্যাসের এক পর্যায়ে পালানোর পথে স্টিমারের অন্ধকার এক প্রকোষ্ঠে একটি ভাঙা মূর্তির পা চেপে ধরেছিল ছেলেটি। সে তখন বুঝতে পারেনি, সেটি লক্ষ্মী না স্বরস্বতী। কিন্তু না বললেও বোঝা যায়, পুরো উপন্যাস জুড়েই সুনীল স্বরস্বতীরই আরাধনা করেছেন।

ব্যক্তি জীবনে সুনীল নিজেও তাই। দেশভাগের ক্ষত ও  ক্ষতি নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় নেওয়া বাঙাল বা রিফিউজি সুনীল এবং আরো অনেকেই, যেমন শীর্ষেন্দু, তারাপদ, প্রবল বিরূপ পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে জীবনের সাফল্য অর্জন করেছেন। সাইকেলে চেপে টিউশনি, লজিং, কেরানি, শিক্ষকতা ইত্যাদি হেন পেশা নেই যে, তারা বেছে নেন নি। সুনীলের ‘আত্মপ্রকাশ’ বা ‘একা এবং কয়েক জন’ নামের শুরুর দিকের লেখাগুলো যারা পড়েছেন, জানেন কী প্রচণ্ড সংগ্রাম ও কষ্টসহিষ্ণুতার মধ্য দিয়ে জীবন তাদেরকে চালিত করেছে। এমন পরিশ্রমে সবাই টিকতে পারে না। ছিটকে পড়ে। আটপৌরে জীবনে মিশে যায়। সাধারণের একজন হয়ে যায়।

সুনীল সেটা করেন নি। লড়াই চালিয়ে গেছেন। সেটা বিত্তমুখী লক্ষী পথে নয়; বিদ্যামুখী স্বরস্বতীর পথে। বাংলা ভাষার একজন প্রধান লেখক হয়েছেন তিনি। সমকালীন সাহিত্যে বিশেষ জায়গাও করে নিয়েছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে কবিতার জন্য বৃত্তি পেয়ে পড়তে গেছেন। সখ্য গড়েছেন অ্যালেন গিন্সবার্গ প্রমুখ প্রথাবিরুদ্ধ কবিকুলের সঙ্গে। শিল্পের রাজধানী প্যারিসসহ তাবৎ বিশ্ব চষেছেন শুধু সাহিত্যের জন্য। এমনটি আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে বিরল।

একটি সময় সুনীল পরিণত হন জনপ্রিয়তম সাহিত্যিক চরিত্রে। কলকাতার শেরিফের পদও লাভ করেন। একজন অভিবাসী ও উদ্বাস্তু লেখকের জীবন-সংগ্রামের এমন অনবদ্য, হৃদয়গ্রাহী, সংগ্রামী সাফল্যের উপাখ্যান দেশান্তরী কমিউনিস্ট, আক্রান্ত ইহুদি বা ফিলিস্তিনি লেখক ছাড়া বিশ্বসাহিত্যে সচরাচর দেখা যায় না। তিনি যে আগাগোড়াই জ্ঞানের দেবি স্বরস্বতীর আনুকুল্য নিয়েই থাকতে চেয়েছিলেন, অর্থ-বিত্ত নয়, বিদ্যা ও সুকুমার কলাই ছিল তার উপাস্য,  শেষ উপন্যাসে বিধাতা তাকে দিয়ে সেই জীবনসত্যটিই ব্যক্ত করালেন। বিদ্যাদেবি ভক্ত সুনীলকে মরণেও পায়ের কাছেই ঠাঁই দিলেন।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মৃত্যুর পাঁচ বছর পরেও তিনি প্রাসঙ্গিকতা হারান নি; বরং ক্রমশই উজ্জ্বল হচ্ছেন।

ড. মাহফুজ পারভেজ: কবি-কথাশিল্পী-গবেষক। অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

বাংলাদেশ সময়: ২১২৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৩, ২০১৭
জেডএম/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।