ঢাকা, বুধবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

নারীর অস্তিত্ব রক্ষার আখ্যান ।। ড. মাহফুজ পারভেজ

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৬৫৮ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৫, ২০১৭
নারীর অস্তিত্ব রক্ষার আখ্যান ।। ড. মাহফুজ পারভেজ সায়ন্তনী।

ভীষণ অন্য রকম তার লেখা। খুবই আলাদা। প্রান্তিক জনজাতি আর প্রকৃতিকে নিটোল অবয়বে তুলে ধরেন তিনি। এভাবেই সমকালীন বাংলা কথাসাহিত্যের বিশিষ্টজন সায়ন্তনী পূততণ্ডু ভাষা, বর্ণনা ও বিষয়ে সকলের মনোযোগ কাড়েন।

'কৃষ্ণবেণী' নামে তার নতুন উপন্যাসের কাহিনী ও আবহটি অসাধারণ:
তখন অনেক রাত। চতুর্দিক নিস্তব্ধ।

নিকটবর্তী ছোট্ট জনপদ ঘুমিয়ে পড়েছে। বেশির ভাগটাই অন্ধকার। আকাশ গাঢ় নীলের পরতে ঢাকা। আকাশে তারারা মিটমিট করে জ্বলছে। সেই সঙ্গেই জ্বলছে জোনাকি। গুঁড়ো গুঁড়ো সবুজাভ আলো ইতস্ততঃ ঘুরে বেড়াচ্ছে চারিদিকে। যেন নক্ষত্রের আলো ধার করে মর্ত্যে নেমে এসেছে তারা। এখন তাদের মিলনের সময়। পুরুষ জোনাকিরা অপেক্ষাকৃত উজ্জ্বল ও তীব্র আলো জ্বেলে খুঁজে বেড়াচ্ছে সঙ্গিনীকে। নারীদের আলো মৃদু ও স্নিগ্ধ। নরম আলোর সঙ্কেতে সম্মতি জানাচ্ছে তারা। নক্ষত্র নক্ষত্রের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে।

সারি সারি নারকেল গাছ অন্ধকারে চুপ করে দাঁড়িয়েছিল। যেন এখনই কিছু ঘটতে চলেছে। হাওয়ায় মাঝে মাঝে শিরশির করে কেঁপে উঠছে পাতা। ঘন নারকেল বাগানের পাতার ফাঁক দিয়ে নিটোল চাঁদ স্পষ্ট। আকাশ মেঘমুক্ত হওয়ায় চাঁদের রূপোলি আলো ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। সেই আলোয় আরও যেন মোহময়ী হয়ে উঠেছে রাত্রি। এর মধ্যেই দূর থেকে ভেসে আসছে বিখ্যাত কন্নড় লোকসঙ্গীত।

এমনই পটভূমিতে রচিত 'কৃষ্ণবেণী'। দুই নারীর আপ্রাণ লড়াই-এর কাহিনি। ময়দানে নেমেছে দুই মা। একজনের লড়াই হৃত সম্মান পুনরুদ্ধারের জন্য। ধর্মের জন্য, নিজের সম্মান, আত্মগর্বের জন্য যিনি নিজের সন্তানকেও যূপকাষ্ঠে চড়াতে পিছ পা নন। অন্যজন নিজের সন্তানের জন্য হাঁড়িকাঠে চড়তেও রাজি। দুই পক্ষের আপ্রাণ লড়াইয়ের মধ্যে রয়েছে এক ছোট্ট শিশু, এবং তার ভবিষ্যত।

শিশুটির ভাগ্যের কাঁটা  চিরাচরিত অন্ধকূপ আর সংস্কারমুক্ত আলোকিত বিশ্বের দ্বৈরথে আবর্তিত হয়। সূচিত হয় এক একা নারীর লড়াই, যার প্রতিপক্ষ তারই নিজের মা, পুরো সমাজ এবং তার পরিচিত দুনিয়া। এক অভিশপ্ত আধুনিক দেবদাসীর কথা কৃষ্ণবেণী। ইতিহাস নয়, এই ২০১৭ সালের কাহিনীই সায়ন্তনীর উপন্যাসের উপজীব্য।

আধুনিক জীবনের অনেক অঙ্গনেই আঘাত হেনেছে সায়ন্তনী তার উপন্যাসের বাতাবরণে। যেমন, প্রতিবাদ কাকে বলে?

ফেসবুকে দু লাইন লিখে রাতে নিশ্চিন্তে ঘুমোতে যাওয়া এবং পরের দিন দেখে নেওয়া ক'টা লাইক আর ক'টা শেয়ার হল! এটাই কি প্রতিবাদ?

হোয়াটস আপে বড় বড় প্যারাগ্রাফে লেখা আর বক্তব্যকে ফরোয়ার্ড করা প্রতিবাদ?

ম্যাগাজিনে প্রচুর তথ্য সম্বলিত অগ্নিগর্ভ ফিচার লেখা, প্রতিবাদ?

রাজপথে মোমবাতি হাতে মিছিলে হেঁটে,  তার সেলফি তুলে, বিরিয়ানি খেয়ে বাড়িতে ফিরে আসা, প্রতিবাদ?

ফেসবুক, হোয়াটস আপ তো দূর, যারা টিভি জিনিসটাকেও হয়তো চোখে দেখেনি, যাদের গ্রামে ইলেকট্রিসিটি নেই, তারা কেমন করে প্রতিবাদ করবে?

তবু প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়েছে। সমাজের নামে, ধর্ম ও অধর্মের নামে, প্রথা ও সংস্কারের নামে প্রান্তিক সমাজের একজন নারী অন্তত তার আদি ও অকৃত্রিম মানবসত্তায় প্রতিবাদ করেছেন। দক্ষিণ ভারতের বিদ্যমান আর্থ-সামাজিক-ধর্মীয় কুসংস্কার ও ধর্মের নামে অধর্মের দানবীয় চিত্রটি বড়ই মানবিক অক্ষরে রচনা করেছেন সায়ন্তনী। নারীর প্রতি বহুমাত্রিক নিগ্রহ ও নিপীড়নের কালো অধ্যায়গুলোকে প্রতিবাদের লাল কালিতে মুছে দিতে চেয়েছেন তিনি। তার কৃতিত্ব এখানেই যে, নারীর আত্মসমর্পনের ইমেজ ভেঙে তিনি গড়েছেন দ্রোহের প্রতিমূর্তি। এখানেই কৃষ্ণবেণী'র স্বকীয় বৈশিষ্ট।

ফেসবুক, টুইটার, ফিচার, মোমবাতি মিছিলের কথা সে হতভাগী জানত না। ধর্মের বিপরীতে যাওয়ার জন্য কোপার্নিকাস, গ্যালিলিও, ব্রুনোর পরিণতি তার জানার কথা নয়! নাবীবাদীরা তার অচেনা। নারীধর্মের পালন না করায় জীবন্ত পুড়ে যাওয়া জোন অব আর্কের কথা সে জানত না।

তবু চিৎকার করে কোন অসীম সাহসে বলল সে--"আমি  মানি না"। নারীর অস্তিত্ব রক্ষার চিরায়ত প্রতিবাদের ছবি সায়ন্তনীর 'কৃষ্ণবেণী'।

বাংলাদেশ সময়: ১২৫১ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৫, ২০১৭
জেডএম/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।