ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

স্বর্গদূতের আনা বড়দিন | তানিয়া চক্রবর্তী

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১১৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৪, ২০১৭
স্বর্গদূতের আনা বড়দিন | তানিয়া চক্রবর্তী স্বর্গদূতের আনা বড়দিন | তানিয়া চক্রবর্তী

এই ডিসেম্বর মাস, কমলালেবু, পিকনিক আর মিহিন রোদ— এর মধ্যে বাঙালি যে রসে মেতে ওঠে তা ক্রিসমাস ও তার কেক মহিমা। আসলে খ্রিস্টান ধর্মকে ঘিরে নয়, এর যিনি সাংকেতিক প্রবর্তক তিনি আসলেই মানবিকতার রূপ। আসলে যে ধর্ম তার উৎসবকে ভালোবাসার মিলনমেলায় পরিণত করে সেই ধর্মই প্রকৃত ধর্ম; সে যে ধর্মই হোক।

“যীশুচরিত” নামক একটি বইতে লেখক তপনমোহন চট্টোপাধ্যায় যথাযথ বলেছেন, মহাপুরুষের জীবন আসলেই মহাকাব্য। বাইবেল বলে, যিশু পাপের কারণে সৃষ্টি হয়েছিলেন।

পাপ আসলে কী সেটা বোঝাই সবার পক্ষে সহজ নয়। তবে যা ভারসাম্যকে হানিকর দিকে নিয়ে যাওয়ায় অগ্রসর হয় তা তো ন্যায় হতে পারে না! শুধু যিশু কেন জীবন মধ্যস্থ এই দেহের নিয়ম একেবারেই সেইরকম। যখন এই দেহে রোগের সঞ্চার হয় তখনই দেহের অনাক্রমতা সৃষ্টি হয়। আসলে একথা তো অনুভবের বচন— বহু বাধা ও বিপত্তিকে অতিক্রম করে জীবন যখন সুস্থ উপত্যকায় বয়ে যাওয়ার প্রয়াস করে সেখানেই কাহিনী রচিত হয়। এর থেকে বড় সাহিত্য আর কী বা হতে পারে!

লর্ড টেনিসন এই শীতবেষ্ঠিত তুষারের ২৫ ডিসেম্বরের পবিত্র সময়কে এক নিদারুণ কাব্যিক মহিমায় তুলে ধরেছেন, “The time draws near the birth of Christ: The moon is hid; the night is still; The Christmas bells from hill to hill Answer each other in the mist”।

ফিদেল কাস্ত্রো তাই বলেছিলেন, গরীবকে প্রতারণা করার সমার্থক হলো যিশুকে প্রতারণা করা। ব্রিটিশ দার্শনিক ও কবি কোলারিজ বলেছিলেন, আমি যেমন প্লেটো-সক্রেটিসকে বিশ্বাস করি, আমি তেমন যিশুকেও বিশ্বাস করি। রাশিয়ার ঔপন্যাসিক দস্তয়োভস্কি বলেছিলেন, “THEY THINK TO ORDER ALL THINGS WISELY;BUT HAVING REJECTED CHRIST THEY WILL END BY DRENCHING THE WORLD WITH BLOOD”।

বিখ্যাত ফরাসি ঐতিহাসিক আর্নেস্ট রেনান বলেছেন, “ALL  HISTORY IS INCOMPREHENSIBLE WITHOUT CHRIST”। সান্টাক্লজউত্তর প্যালেস্টাইনের গ্যালিলি প্রদেশে ন্যাজারেথে শহরে যিশুর জন্ম হয়। বাবার নাম জোসেফ মার নাম মিরিয়ম বা মেরি। হেরড রাজার সময়ে তার আগমন হয়। বহু জায়গায় অবশ্য বলা হয়েছে, কুমারী মা মেরির গর্ভেই যিশুর আগমন, যাইহোক সে প্রসঙ্গে যাব না। বিভিন্ন গসপেল থেকে এটুকু সাধারণ তথ্য অবশ্য মেলে যে, যিশু জন্মানোর পূর্বে একদল দৈবজ্ঞ বুঝেছিলেন, এমন কোনো শিশুর জন্ম হবে যে ইহুদিদের রাজা হতে পারে। তারা বিভিন্ন গণনা করে তারার মাধ্যমে পথ দেখে যিশুর জন্মানোর স্থানে উপস্থিত। এবং সেই রাতেই যিশুর পিতা স্বপ্ন  দেখেন, এক দেবদূত তাকে ওই শিশু নিয়ে মিশর দেশে পালিয়ে যেতে বলছেন। এইভাবে বহু মিথে মিশে আছে যিশুর জন্মকাহিনী। তবে তেত্রিশ বছর বয়সে তার ঘটনাবহুল মৃত্যু হওয়ায় যিশুর মৃত্যুই বোধহয় তার জীবনের সাক্ষ্য বহনের বড় ভিত্তি। বাস্তবিক মহাপুরুষের ঈশ্বরীয় মহান গল্পকে বাদ দিলেও আদতেই যিশু চূড়ান্ত অমায়িক কেউ ছিলেন ফলে যতো না তার জাদুবলে, তার চেয়ে বেশী তার ইতিবাচক সংস্পর্শে মানুষ জীবনের দিশা পেয়েছিলেন। যিশুর ভয়াবহ ক্রুশবিদ্ধ মৃত্যুর কথা জানে না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। শোনা যায়, মৃত্যুর পর তিনি তার শিষ্যদের নাকি দর্শন দিতেন। যিশুর শেষ উক্তি একটি শিশুর মা থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার মতো ছিলো, সম্ভবত তীব্র আর্তনাদে বলেছিলেন, ঈশ্বর কেন তাকে ছেড়ে যাচ্ছেন! আসলে এই সেই যিশুর রক্তক্ষয় বা যুদ্ধ যা মানুষের সামাজিক ভালো-মন্দ বোধকে কোথায় নিয়ে গিয়ে স্থাপিত করল! যে তিনি এক বিশাল সংখ্যার মানুষের কাছে ঈশ্বর। আর তা এতো মাত্রায় ইতিবাচক যে ভারসাম্যকেই সে পথে আনে। আসলে যিশু প্রকৃতি থেকে সমাজ অবধি ভালোবাসার স্রোত বইয়ে দিয়েছিলেন। বলা হয়, ২৫ ডিসেম্বর তার জন্ম হয়েছিল। স্বর্গদূতের আনা বড়দিনএকটা সিদ্ধান্ত, একটা শক্তির প্রতিষ্ঠা এতো সহজ নিশ্চয় নয় তাই যিশুর মৃত্যুর পরেও তার জন্মদিন পালন হতো না, তার শিষ্যরাও তা মানতেন না। ২০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে মিশরে প্রথম বড়দিন পালিত হয়। মধ্যযুগে বড়দিনের উৎসব আরও তীব্র ভাবে পালিত হতে শুরু করে। ১৬৬৮ সাল থেকে কলকাতায় বড়দিন পালন শুরু হয়। শোনা যায়, জব চার্ণক এই বিষয়ে আগ্রহী হন। ক্রিসমাসের সময় কিছু বিষয় এই অংশকে মাহাত্ম্যপূর্ণ করে তোলে তা হলো- ক্রিসমাস ট্রি, সান্তা ক্লজ, কেক আরও কতো কী! মানুষকে স্বাভাবিক সুখের পথ দেখাতে পারলেই বোধ হয় তাকে কিছু হলেও অন্যায় কর্ম থেকে বিরত করা যায়! ২৪ ডিসেম্বর রাতে সাধারণত ক্রিসমাস ট্রি সাজানো হয় আর তা ধর্মীয় বিশ্বাস অনু্যায়ী ১২তম রাতে সরিয়ে ফেলা হয়! ব্রিটিশ রাজপরিবারের উইন্ডসর ক্যাসেলে নকশা করে এই ক্রিসমাসের গাছ লাগানো হতো। তৃতীয় জর্জের সময় এর প্রাধান্য বাড়তে থাকে। বলা হয়, জার্মানির এক সাধু তার ওক গাছের কাছে ফার জাতীয় একটি জন্মানো গাছকে দেখে তার মধ্যে ধর্মীয় সাংকেতিক বোধকে নিজস্ব ভালো লাগা থেকে নিক্ষেপ করেন। তার থেকেই এর প্রাথমিক প্রচলন শুরু হয়। তুষারপাত হওয়া ফার গাছ যেনো শ্বেতশুভ্র আনন্দের সূচনা! ডিসেম্বরের বড়দিনের ছুটি, রাতে মোজা ঝুলিয়ে রাখা আর ঘুম থেকে উঠে উপহার পাওয়া— এই অদৃশ্য অথচ সুখকর জাদু কল্পনার পেছনে যতোই নিজের লোকেদের হাত থাকুক কল্পনায় কিন্তু সেই সাদা দাড়িওলা বুড়ো দাদুগোছের আদুরে কেউ! এই মুহূর্তগুলোই বোধহয় সুস্থ শৈশব তৈরির উপাদান; যা যিশুর মহৎ বিশ্বাসের সঙ্গে জড়িয়ে। আসলে ১৮৬০ যুক্তরাষ্ট্রে এই সান্তার জন্ম। বিষয়টা অনেকটা এরকম সেন্ট নিকোলাস ছিলেন একজন বিশপ। তিনি খ্রিস্টধর্মের প্রতি মানুষকে আগ্রহী করাতে এই প্রথা নিয়ে আসেন। পরবর্তীতে ডাচ ভাষায় তাকেই ডাকা হতো সিন্টার ক্লস সেটাই বিবর্তিত হয়ে সান্টা ক্লস ওরফে সান্তা ক্লজ। পশ্চিমী সংস্কৃতিতে এর প্রাধান্য বিশাল। তার জন্য অপেক্ষমান শিশুরা ঘরের বাইরে জুতো-মোজা ঝুলিয়ে রাখে যাতে উপহার আসে। আর তারা কেউ কেউ দুধ, বিস্কুট, কোথাও বিয়ারের সঙ্গে কেক, পুডিং এসব সান্তার জন্য সাজিয়ে তাকে যেনো ডাকে। সান্তা আবার হরিণে টানা স্লেজ গাড়ি করে বরফের দেশ ঘুরে ভালো বাচ্চাদের জন্য জাদুবলে উপহার নিয়ে আসেন। সে তিনি সান্তা হন বা না হন! ভালো হলে উপহার পাওয়া যায় এই রূপকথার বোধ এই ধর্মের সাহচর্যেই বিস্তৃত হয়েছে, তাইতো অদ্ভুত আনন্দের বিষয়! খারাপ থাকার প্রলোভন যদি পৃথিবীতে থাকতে পারে, ভালো থাকার প্রলোভনও তো থাকা উচিত।

সিলভিয়া প্লাথের “বেলুন”, জন মিলটনের “অন দ্য মর্নিং অফ ক্রাইস্ট’স নেটিভিটি”, লর্ড টেনিসনের “রিং আউট, ওয়াইল্ড বেলস”... এমন আরও কতো কবিতা রচিত হয়েছে এই মুহূর্তকে ঘিরে। বসন্তের কাছাকাছি শীতের আমেজ তার মধ্যে রেড ওয়াইন বা বিয়ার, কেক আর মানুষের উপহার আদান-প্রদানের এক দয়ালু মমতাময় পরিবেশ! এই সব ঝুলিতে ভরিয়ে ভালোবাসার কবিতা নিয়ে জীবনের নতুন মুহূর্ত, নতুন বছরের কাছাকাছি পৌঁছে দিতে চেয়ে পৃথিবী নিজেই যেনো সান্টা হতে চায়। ধর্ম তো আসলে উপলক্ষ, আসল কথা হলো মানবিকতায় ভরপুর থেকে এই মানবজীবনকে উপভোগ করা; কারণ, কথাতেই আছে দুঃখ ভাগ না করলেও চলে আনন্দ ভাগ না করলে আনন্দেরই কোনো তৃপ্তি আসে না। আসছে ২০১৮ সাল। পুরোনো ভালো-মন্দকে পরিস্রুত করে আমরা যিশুকে শুধু ধর্মপ্রবর্তক না ভেবে এক মহান মানুষ ভেবে এগিয়ে চলি।

বাংলাদেশ সময়: ১৭১২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৪, ২০১৭
এসএনএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।