ঢাকা, বুধবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

মোস্তফা কামালের অগ্নিমানুষ: ইতিহাসে প্রাণ প্রতিষ্ঠা

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮০০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১১, ২০১৯
মোস্তফা কামালের অগ্নিমানুষ: ইতিহাসে প্রাণ প্রতিষ্ঠা অগ্নিমানুষ গ্রন্থের প্রচ্ছদ ও লেখক মোস্তফা কামাল

ইতিহাসের চরিত্রগুলোতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে উপন্যাস করে তোলা তুলানামূলক কঠিন একটি কাজ। আর সেই ইতিহাসটা যদি হয় সাম্প্রতিক এবং ইতিহাসের নাম, চরিত্র, ঘটনা অবিকৃত রেখে উপন্যাস সৃষ্টি করাটাকেই দূরূহ বলছি। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের হাত দিয়ে দুর্গেশ নন্দিনী নামে যে উপন্যাসের জন্ম হয়েছিলো তা ছিলো ঐতিহাসিক উপন্যাস। এর কারণ হিসেবে মনে করা হয়, সেসময় সমাজ ও সমাজমানসিকতা ঔপন্যাসিক ভালোভাবে আত্মস্থ করে উঠতে পারেননি।

ফলে উপন্যাস লিখতে গিয়ে ইতিহাসের আশ্রয় নেন বঙ্কিম। প্রথম উপন্যাসটি লেখার বেশ অনেকটা পরে বঙ্কিম বিষবৃক্ষ ও কৃষ্ণকান্তের উইল উপন্যাস লিখে আমাদের সমাজ-মানুষের কাছে ফিরে আসেন।

এখনতো আমাদের সমাজ-মানুষ আমাদের আত্মস্থ, এখন আমরা উপন্যাস লেখা ও পড়ায় কয়েক পুরুষ পার করেছি! তাহলে প্রশ্ন একবিংশ শতকের এই আধুনিক যুগে এতো বছর পরে, যখন উপন্যাসের কাঠামো নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার একটা চূড়ান্ত যুগ অতিক্রম করছে তখন মোস্তফা কামাল ইতিহাসে প্রাণ প্রতিষ্ঠার কাজে হাত দিলেন কেন? আমার মনে হয়েছে খুব সচেতনভাবেই তিনি এ কাজটিতে হাত দিয়েছেন। কোন আঙ্গিক বা গঠনশৈলী নয়, তার আকর্ষণের মূল ছিলো-উপন্যাসের বিষয়। বিষয়কে উপস্থপনের এক দুর্নিবার আর্কষণে তিনি ইতিহাসকে বিনির্মানের কাজে হাত দিয়েছেন। মোস্তফা কামাল সমাজ-ইতিহাসকে খুব ভালোভাবে আত্মস্থ করেই ঐতিহাসিক উপন্যাস লেখেন, তার উদ্দেশ্যই ইতিহাসকে বিনির্মাণ করা।  

মোস্তফা কামাল একজন সাহসী মানুষ। সাহসী এই অর্থে যে বাঙালি জাতির সাম্প্রকিত ইতিহাসকে ব্যক্তি নিরপেক্ষভাবে উপন্যাসে রূপান্তর করার সাহস দেখিয়েছেন। উনিশ সাতচল্লিশ থেকে একাত্তর সময়টা খুব লম্বা না হলেও বাঙালি জাতির জন্য তা প্রচুর ঘটনাবহুল। বাঙালি মুসলমান এদেশে দীর্ঘদিন আত্মপরিচয় সংকটে ছিলো। তারা ছিলো না বাঙালি, না মুসলমান। সাতচল্লিশের ধর্মভিত্তিক দেশবিভাগে বাঙালি মুসলমান আত্মপরিচয় ও আত্মমর্যাদায় নিজের মাটিতে দাঁড়ানোর স্বপ্নে বিভোর ছিলো। কিন্ত খুব অচিরেই তারা তাদের স্বপ্নভঙ্গের বার্তা শুনতে পেল। বিজাতীয় পাকিস্তানিরা ধর্মের ছদ্মাবরণে বাঙালি জাতির মূলে আঘাত হানলো, ফলে বাঙালি ধর্ম পরিচয় ঊর্ধ্বে রেখে জাতিসত্তার পরিচয় নিয়ে রূখে দাঁড়ালো। ঔপন্যাসিক মোস্তফা কামাল উত্তাল এই সময়, তাদের জাগরণ, তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা, নেতৃত্ব ইত্যাদিকে বিষয় করে ট্রিলজি লিখলেন।  

অগ্নিমানুষ-অগ্নিকন্যা-অগ্নিপুরুষ তিনটি উপন্যাস মিলে আসলে একটিই উপন্যাস, আর এর শেষ খণ্ড অগ্নিপুরুষ। এখানে অগ্নি নামটা একটা বিশেষ বার্তা বহন করেছে। সাতচল্লিশের পর থেকে একাত্তর পর্যন্ত সময়টা অগ্নিময়ই ছিলো। প্রায় চব্বিশ বছর এদেশের মানুষ সংগ্রামের মধ্যেই ছিলো। ভাষার দাবিতে আন্দোলন ছিলো আসলে আত্মপ্রতিষ্ঠার আন্দোলন। সেই আন্দোলন শেষ হয় একাত্তরে এসে। একাত্তরের নিকটবর্তী সময়ে বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কীভাবে ধীরে নিজের যোগ্যতা, মেধা ও রাজনৈতিক দূরদর্শিতা দিয়ে বাঙালির স্বপ্নের রাজপুত্র হয়ে উঠলেন সেটা ঘটনা পরম্পরায় যেমন একদিকে চিত্রিত হয়েছে, অপরদিকে পাকিস্তানের তৎকালীন রাষ্টৃপতি আইয়ুব খান অদূরদর্শিতা, মদ-নারীতে আসক্তি এবং জেদ একঘেঁয়েমিতার কারণে পাকিস্তান ভাঙার কারণ হয়ে উঠলো সেটা উপজীব্য হয়েছে। মিলিটারি শাসন তাবৎ পৃথিবীর কোথাও ভালো ফল বয়ে নিয়ে আসেনি। তাদের প্রশিক্ষণই তাদের একচোখা করে গড়ে তোলে। উপন্যাস জুড়েই আইয়ুব খানের অস্থিরতা ও একচোখা দৃষ্টির এবং অগণতান্ত্রিক মনোভাবের বিষয়টা তুলে ধরা হয়েছে যেটা ছিলো বাস্তবতারই প্রতিরূপ। পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো মিলিটারি ছত্রছায়ায় রাজনৈতিক সুবিধা নেওয়া মানসিকতা তাঁর এবং তাঁর স্ত্রীর কথোপকথনে শুধু পরিষ্কার হয় না, তিনি তার পুরো কার্যক্রম দিয়েই সেটা প্রমাণ করেছেন। তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের নেতা হলেও, কোনো বিষয়ে জনমতের ধারের কাছেও যাননি। বরং শঠতা, ষড়যন্ত্র ও মিথ্যাচারে নিজেকে জড়িছেন। অপরদিকে বঙ্গবন্ধু জনগণের পালস বুঝে, সবার মতামত নিয়ে সিন্ধান্ত নিতেন।

উপন্যাসে দেখা যায় এক পর্যায়ে ভু্ট্টোর বৌ তাকে শেখ মুজিবরের মতো জনপ্রিয়তা অর্জনের পরামর্শ দিচ্ছে। উপন্যাসটি পড়তে গিয়ে প্রথম দিকে মনে হয়েছে, লেখক খুব তাড়াহুড়া করে ঘটনার পর ঘটনা সাজিয়েছেন কিন্তু একবার উপন্যাসটিতে ডুব দেওয়ার পর কোনো এক অনিবার্য আকর্ষণে টানতে থাকে। লেখকের এই তাড়াহুড়াটা পাঠকের ভেতর ঢুকে যায়, পাঠকও তাড়াতাড়ি পরের ঘটনা জানার জন্য অস্থির হয়ে উঠে। যেখানে বেশিরভাগ পাঠকই এইসব ইতিহাস জানেন, আর সেই জানা বিষয়টিই মোস্তফা কামালের হাতে অনেকটা জাদু পায়। পাঠককে ধরে রাখার ক্ষেত্রে ঔপন্যাসিক মোস্তফা কামাল এখানে শক্তিমত্তার পরিচয় দিয়েছেন। উপন্যাসের আরেকটা শক্তিশালী দিক হলো কাহিনী পরম্পরা। ইতিহাসের ধারাবাহিক উত্তাল সময়কে কাহিনীতে সিকুয়েন্স ঠিক রেখে উপন্যাস বর্ণনে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন মোস্তকা কামাল।  

উপন্যাসটি সাধারণ পাঠক ও বোদ্ধাদের কাছে আকর্ষণের আরেকটা দিক হলো তৎকালীন এপার ওপারের অত্যন্ত ক্ষমতাশালী রাষ্ট্রপতি, আমলা, গর্ভনর, মিলিটারি প্রশাসক, রাজনৈতিক নেতা ইত্যাদি মানুষদের প্রাত্যহিক কর্মের দিকে আলোকপাত করা হয়েছে, যা সাধারণের জন্য সব সময়ই কৌতূহল উদ্দীপক। রাষ্ট্রের প্রভাশালী আমলা-মিলিটারি অর্থাৎ পলিসিমেকাররা রাষ্ট্রপতির দপ্তরে কি অবস্থায় পরে, জরুরি মিটিংয়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে কীভাবে ভূমিকা রাখে ইত্যাদি ঘটনা বিষয় হিসেবে সব সময়ই আকর্ষণীয়।  

ঔপন্যাসিক মোস্তফা কামালের উপন্যাস উপস্থাপনের ঢঙে তা আরো আকর্ষণীয় হয়েছে। উপন্যাস বর্ণনার ক্ষেত্রে তিনি যথেষ্ট রুচিবোধেরও পরিচয় দিয়েছেন। ইয়াহিয়া খানের নারী লোলপতা, অনাচার একটা ঐতিহাসিক সত্য। এই সত্যটাকে নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণের মতো যথেষ্ট রুচির সাথে তুলে ধরেছেন মোস্তফা। তবে অনেক ক্ষেত্রে এই তাড়াহুড়াটাই উপন্যাসের দুর্বলতা হিসেবেও প্রকাশ পেয়েছে। উপন্যাসটি পাঠ করতে গিয়ে উপন্যাসজুড়ে ডিটেইলসের অভাব অনুভব হয়। লেখকের প্রধান ঝোঁক ঘটনা উপস্থাপনে, কালের রাজনৈতিক ঘটনাকে দ্রুত ধারণ করাই যেন লক্ষ্য। ফলে এটা একটা রাজনৈতিক উপন্যাস হিসেবে বিবেচিত হতে পারে সহজেই। ঘটনাক্রমে পারিবারিক পরিমণ্ডল উঠে এসেছে উপন্যাসে। যেমন সাংবাদিক দম্পতির পরিবার, বঙ্গবন্ধুর পরিবার এমনকি জুলফিকার আলী ভুট্টোর পরিবারও। পরিবারগুলোতে রাজনৈতিক ঘটনা বা রাজনৈতিক কথোপকথনের পাশাপাশি ব্যক্তিগত বিষয় আশয় উঠে এসেছে। যেমন ভুট্টোর স্ত্রী পারিবারিক পারিমণ্ডলে ভুট্টোকে তার বান্ধবীর কথা জিজ্ঞেস করে। কিংবা বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার স্বামী ওয়াজেদ মিঞার বিদেশ যাত্রা বা যুদ্ধের ভয়াবহতার ভেতর প্রসববেদনাক্রান্ত শেখ হাসিনার জন্য ডাক্তার খোঁজা ইত্যাদি ঘটনা অন্যমাত্রা দিলেও পাঠক হিসেবে আরো ডিটেইলসের আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়। এছাড়া যুদ্ধে প্রবাসীদের ভূমিকা, মুক্তিযোদ্ধাদের আবেগ ইত্যাদি বিষয়ের বিস্তারিত উপস্থাপন উপন্যাসটিকে মহাকাব্যিক মাত্রা দিতো। ঘটনার প্রতি অবাধ বিচরণ দেখে মনে হয়েছে ঔপন্যাসিক হয়তো ইচ্ছাকৃতভাবেই এসব এড়িছেন, হয়তো তাঁর এসব ঘটনা নিয়ে অন্যকোনো পরিকল্পনা আছে।

রাজনৈতিক ঘটনাআশ্রিত অনেক লেখার কথা বলা যায়। রবার্ট পেন ওয়ারেনের অল দ্য কিংস মেন পৃথিবী খ্যাত রাজনৈতিক উপন্যাস। সেখানে দেখা যায়, প্রান্তিক পর্যায় থেকে রাজনীতির নানা পাঠ গ্রহণ  করতে করতে আলো-অন্ধকার পেরিয়ে মার্কিনযুক্ত রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পর্যন্ত হয়ে যাচ্ছে। এই উপন্যাসেও রাজনৈতিক ঘটনা ও চরিত্রকে তুলে আনা হয়েছে। বাংলাদেশে বেশ কিছু গল্প-উপন্যাস লেখা হয়েছে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছোট বকুলপুরের যাত্রী কিংবা সৈয়দ ওয়ালীউল্লার কদর্য এশীয় ইত্যাদি লেখা কখনো রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রচার আবার কখনোবা রাজনীতির পেছনের কার্যকারণকে উপজীব্য করে লেখা। কাজেই এই ধারায় মোস্তফা কামালে উপন্যাস নতুন নয়। তবে বাংলাদেশে এরকম পূর্ণাঙ্গ রাজনৈতিক ঘটনা নিয়ে লেখা যেখানে ইতিহাস থেকে উঠে এসে চরিত্রগুলো সরাসরি কথা বলছে এটা খুব সুলভ নয়। মুক্তিযুদ্ধের এই স্বল্প সময়ের ইতিহাসে তা নিয়ে বির্তক শুরু হয়েছে, হচ্ছে ইতিহাস বিকৃতি! আর সাহসী মোস্তফা কামাল ইতিহাসের চরিত্রগুলোকে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে সামাজিকভাবে তাঁর দায়বদ্ধতার কাজটাই শুধু শেষ করেননি, তিনি অতীতকে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য চির অম্লান করে রাখলেন তাদের ভবিষ্যতের পথকে বিভ্রান্তমুক্ত রাখার জন্য।
 
অগ্নিমানুষ: মোস্তফা কামাল। প্রচ্ছদ: ধ্রুব এষ। প্রকাশক: পার্ল পাবলিকেশন্স। মূল্য: ৫০০ টাকা।

বাংলাদেশ সময়: ১২৫২ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১১, ২০১৯
এএ
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।