ঢাকা, রবিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

তোমার জন্য থামি | অমল আকাশ

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১৫২ ঘণ্টা, মে ৩০, ২০১৯
তোমার জন্য থামি | অমল আকাশ ...

এক.
গানের দল ‘শহুরে গায়েন’। যাত্রা শুরু করে দুই হাজার দশ সালে। যাত্রা শুরুর পর থেকেই নারায়ণগঞ্জের এই দলটি শ্রোতাদের কাছে বিশেষ সমাদৃত হয়ে আসছে তাদের সামাজিক-রাজনৈতিক দায়বোধ সম্পন্ন গানের জন্য। অনেকগুলো বছরের প্রচেষ্টায়, অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে এ বছর তাদের প্রথম অ্যালবাম প্রকাশ হলো ‘তোমার জন্য থামি’ শিরোনামে। 

অ্যালবামের দশটা গানের লিরিকই আহমেদ বাবলুর লেখা। দশটা গানের মধ্যে বেশ কয়টা গানই আমার ভালো লেগেছে।

বিশেষ করে ব্যবধান, একটাই জীবন, মা, মানুষ, নদীর গল্প শিরোনামে গানগুলো বেশ ভালো লেগেছে। ভালো লেগেছে প্রথমত দুটো কারণে। এক. লিরিক বেশ ভালো, দুই. সাউন্ডও বেশ ভালো হয়েছে। গিটারটা দারুণ বাজিয়েছে রণক। মিউজিক কম্পোজিশন মোটের উপর ভালো হয়েছে বলার পরও বলতে হয় কিছু ক্ষেত্রে আমার একটু মনোটোনাস লেগেছে। কিছু ক্ষেত্রে মিউজিকে বিরতি অপ্রয়োজনীয় মনে হয়েছে। কিছু জায়গায় ভোকালের নিচে কিঞ্চিৎ ফাঁকা লেগেছে, মনে হচ্ছিলো কিছু একটা ফিলার দরকার। কিন্তু আমার শহরের উদীয়মান কম্পোজার রণক ইব্রাহীমকে আমি জানি, তার মিউজিকের নিবেদন গভীর। এটা তার প্রথম অ্যালবামের কাজ। ভবিষ্যতে অনেক ভালো ভালো কাজ পাবো তার কাছ থেকে নিশ্চয়ই। শাহীন মাহমুদের ভোকাল নতুন মাত্রা পেয়েছে। ‘মানুষ’ গানটাতো ঠিক শাহীনের ভোকাল স্ট্রেন্থ মাথায় রেখেই যেন তৈরি করা হয়েছে।

দশটা গানের মাঝে হঠাৎ ভিন্ন স্বাদ পেয়েছি আহমেদ বাবলুর ভোকালে। ‘মা’ গানটা খুব দরদে গেয়েছেন ঠাণ্ডা লাগা কন্ঠে। তবে ‘মা’ গানের টেম্পোটা একটু কম হওয়াতে একটা সময় মনে হচ্ছিলো ভোকালের গতিকে যেন পেছন থেকে টেনে ধরে রেখেছে মিউজিক। তারপরেও বলতে হয় ‘মা’ গানের মিউজিক কিন্তু হৃদয় স্পর্শ করে গেছে। যেমনি স্পর্শ করেছে ‘ব্যবধান’। এ গানে খুব সুন্দর সুরারোপের জন্য বিশেষ ভালোবাসা জানাই তারিক মাহমুদকে। তবে অ্যালবাম শিরোনামের গান ‘তোমার জন্য থামি’ একই কম্পোজিশনে কেন দুইবার দেওয়া হলো এটা আমার কাছে বোধগম্য হয়নি। যদি দুইটাতে দুই রকমের মিউজিক এক্সপেরিমেন্ট করা হতো তবে একটা কথা ছিলো! শাহেনশাহ অর্ণবের ড্রামস বাদন আশাপ্রদ।

ছোটখাটো দু’একটা ত্রুটির কথা বাদ দিলে ‘তোমার জন্য থামি’ নিঃসন্দেহে বাংলা ব্যান্ড সংগীতের ধারাবাহিকতায় একটি ভালো কাজ হিসেবে যুক্ত হলো। আমাদের শহর থেকে এমন সময়োপয়োগী গানের সংকলন প্রকাশ করার জন্য অ্যালবামের কাজে যুক্ত সবাইকে প্রাণে প্রাণ ভালোবাসা। তবে কথায় আছে, গেঁও যোগী ভিক্ষা পায় না, তেমনি আমাদের পরিমণ্ডলে কতজন আপনাদের গান শুনে কদর করবে, তার কোনো নিশ্চয়তা আমরা কেউ আজো দিতে পারি না। কোনো সাংস্কৃতিক বন্ধু হয়তো অনেক দিন পর বলতে পারে ‘ও এগুলো তোমাদের গান’! কিংবা অনেকে শুনেও দেখবে না। হতেই পারে এমন। অভিজ্ঞতার আলোকে বলছি এসব। তাতে কী? তরুণদের কাছে আপনাদের গান পৌঁছাতে শুরু করেছে। আপনাদের সংগীত সংগ্রাম অব্যাহত থাকলে আরো আরো তরুণদের মাঝে আপনাদের গান ছড়িয়ে পড়বেই, এটা আমার বিশ্বাস। শুভকামনা আপনাদের অগ্রযাত্রায়।

দুই.
আমার তবু শেষ হলো তোমার ও পথ খোঁজা...
‘শহুরে গায়েন’ যেহেতু সামাজিক দায়বোধ সম্পন্ন একটি গানের দল, ফলে তাদের সবগুলো গানই যেন আমাদের সময়ের প্রতিচ্ছবি। সমসাময়িক সামাজিক, রাজনৈতিক অবক্ষয়, ব্যক্তি মানুষের মনোবেদনা, জ্বালা-যন্ত্রণা-ভালোবাসা কিংবা প্রকৃতিকে ধ্বংসের রাষ্ট্রীয় আয়োজনের ডকুমেন্টেশন। সর্বোপরি এসকল কিছু থেকে বেরিয়ে আসার আকুতি ফিরে ফিরে আসে প্রতিটি গানের বাঁকে বাঁকে। যে সময় তরুণদের নতুন অসংখ্য গানের দল ছুটছে বিক্রয় উপযোগিতার পিছে, তখন শহুরে গায়েন হাঁটছে উল্টো পথে। একদলীয় শাসনের কালে প্রায় সকল লেখক, কবি, শিল্পী, আর্টিস্ট, বুদ্ধিজীবীরা মাথা বিক্রির প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত তখন সেই রাষ্ট্রীয় শোষণ-শাসনকে হিম্মতের সাথে ‘শহুরে গায়েন’ চিৎকার করে বলে দিতে পারে, মাননীয় সরকার, আপনাকে চাই না। রাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়ার এই হিম্মত যেমন আছে, তেমনি আছে ব্যাক্তি মানুষের অবক্ষয়ের আহাজারি, ‘লোভে লালসার বৃষ্টিতে ভিজে কে, বেচে দেবে না আর এভাবেই নিজেকে’। ‘একটাই জীবন’ শিরোনামের এই গানটার আরেকটা লাইন, ‘তুমি অবিরাম বেচে দাও নিজেকে’ শুনতে শুনতে একটা ভিন্ন জিনিস আবার আমার মনে হচ্ছিলো যে, আমরা যখন অপরের সমালোচনা করি তখন অপর কিন্তু আমার দিকেও তাকিয়ে তাকে যে, আমার আত্মসমালোচনাটা আমি করতে পারছি কতটা অকপটে। নইলে অপরকে মন্দ ছেড়ে ভালো হয়ে যাওযার হিতোপদেশ সমাজে কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য হয় না। এই গানটা আমার কিছুটা হিতোপদেশমূলক গান মনে হয়েছে। বরং আমার কাছে ‘প্রতিদিন জন্ম নিই’ গানে ‘আমি প্রতিদিন বেঁচে মরে যেতে থাকি ক্ষুদ্র স্বার্থ লোভে’-এই লাইনটা যথার্থ ফুটে উঠেছে ব্যক্তি মানুষের অবক্ষয়ের কিংবা জয়-পরাজয়ের হাহাকার।  

গীতিকার আহমেদ বাবলু কিন্তু সেই হাহাকারের হারেমখানায় বেদনা বিলাসে বুঁদ হয়ে থাকেন না, তিনি লোকালয়ে হাঁটতে হাঁটতে সেই মানুষের কাছেই এসে উপনীত-নত হন, ‘ভাব বুঝি না, বুঝি না তত্ত্ব / সত্য বুঝি, মানুষ সত্য ... সেই মানুষে খুঁজি মুক্তি / মানুষ - না থাকলে নাই আল্লা হরি / সব মানুষে গুজরান / তাই-মানুষ আমার গান হে প্রিয় / মানুষ আমার গান। ’ না, শুধু মানুষই সত্য নয়, সত্য এই সর্বপ্রাণ-প্রকৃতি। যার অস্তিত্ব ছাড়া মানব জীবন মূল্যহীন। পুঁজিবাদী দর্শনে সকল কিছুই সম্পদ, মানবসম্পদ, পানিসম্পদ, তেল-গ্যাস, পাহাড়, নদী, বন সব সবকিছুই কেবলই সম্পদ। সুতরাং সম্পদ লুণ্ঠনের লড়াই চলছে দুনিয়াব্যাপী। আর আমাদের দেশে তো চলছে হরিলুট। এর পাশাপাশি রাক্ষুসে পুঁজিপতিরা আরো আরো মুনাফার লোভে নির্বিচারে ধ্বংস করে চলেছে আমাদের নদী-বন-পাহাড়, সকল প্রাণ-প্রকৃতি। এইসব প্রকৃতি বিধ্বংসী কোম্পানির টাকায় বেঁচে বর্তে আছে যেহেতু সরকার, রাস্ট্র, তখন কোনো আইনকানুন, জবাবদিহিতা কিছুই কার্যকর হয় না, প্রকৃতির পক্ষে সর্বোপরি মানুষের পক্ষে। তবু নদীটার গল্প আমাদের গেয়ে যেতেই হবে, কেননা আমরা যে নদীর সন্তান। মাকে বাঁচাবে কে, তার সন্তানরা ছাড়া! যদিবা আজ, ‘তীরে জমা গল্পেরা উঠে এসে এ শহরে / কালো ধোঁয়া কোলাহলে ধুঁকে ধুঁকে কেঁদে মরে’। তবু গেয়ে যাবো নদীদের গান, কেননা ‘এই শহরে ঘুমাই আমি এই শহরে খাই / লক্ষ্যা নদীর হাওয়া মেখে ঘুরিয়া বেড়াই ‘। ‘মানি না কত কি মানি না তবু কেন মাথা নত? / প্রশ্ন গুলো ঘুরে ঘুরে খাচ্ছে থতম ‘আর তখন শহুরে গায়েন আমাদের আরো একবার মনে করিয়ে দেয়, ‘...মানুষের ইতিহাস ঢেউয়ে ঢেউয়ে করে কানাকানি’। মানুষের সেই ইতিহাস যখন আমরা কানপেতে শুনতে শিখি, পড়তে জানি তার অন্তরগত ভাষা তখনি এসে আমরা কোরাসে সুর মেলাই বদলে যাওয়া গানে। আর এ সকলই তো আমাদের মা জানে! আমরা কেবল বিস্মৃত হই মাতৃপ্রদত্ত জ্ঞান থেকে। বারবার ভুলে যাই পৃথিবীর ইতিহাস শেষতক পরিবর্তনেরই ইতিহাস।

পরিবর্তন আসবেই, সে আমি আপনি চাই বা না চাই। কিন্তু যখন সমাজ রাষ্ট্র পরিচালনা করে দানবীয় পুঁজি, যে মুনাফা, মুনাফা আর মুনাফা ছাড়া আর কিছু বোঝে না, যখন টাকাই দুনিয়ার ঈশ্বরে রূপান্তরিত হয়। তখন সে পারিবর্তন আমাদের নিয়ে চলে নরকের রাস্তায়। সেই অপ্রাকৃতিক, অমানবিক পরিবর্তন মানুষের সাথে প্রকৃতির, মানুষের সাথে মানুষের, প্রজন্মের সাথে প্রজন্মের বাড়িয়ে তোলে বিরাট ‘ব্যবধান’। বাণিজ্যের পেটে চলে যায়, যেতে থাকে মাঠ-ঘাট, বন-বাদার সব। এমনকি চুরি হয়ে যায় প্রজন্মের সবুজ শৈশব। তখনই শহুরে গায়েন আকুল আকুতি নিয়ে গেয়ে ওঠে, ‘নাগরিক সময়ের ঘেড়াটোপে এসে / তোমার আমার সাথে এই ব্যবধান / বন্ধু তোমাকে তবু ভালোবেসে আমি / তোমার জন্য গাই সবুজের গান’। যতদিন পর্যন্ত আমরা শিশুর অধিকার, তার খেলার মাঠ ফিরিয়ে দিতে না পারছি, ততদিন পর্যন্ত ওকে তো ফিরিয়ে আনতে পারবো না সাইবার গেম থেকে ফিজিক্যাল গেমে! সেই বঞ্চিত শৈশবের জন্যই আমাদের গেয়ে যেতে হবে সবুজের গান। জানি, ‘সময়গুলো যাচ্ছে পুড়ে পুড়ছি সাথে আমি’ আর এটাও জানি, একদিন ‘চলতে চলতে বদলে যাবে চলতি পথের মানে’। আর সেই বদলে যাওয়া গান তো তোমাকে আমাকে পেছনে ফেলে রেখে একা গাওয়া যায় না! ‘তুমি আমি মিলে আমরা হলে’ইতো (সমগীতের গান থেকে) ঘুচানো যায় সকল দূরত্ব-ব্যবধান। হাঁটা যায় কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনের রাস্তায়। শহুরে গায়েন চলতি পথে অসংখবার আমাদের জন্য, তোমার জন্য থামে, এক সাথে আরো বহুদূর হাঁটবার তাগিদে। সেই পথ চলা থেমে থেমে শেষ হয় না যেন, বরং আবার চলা শুরু করে একটা নতুন পথের সন্ধানে। এমন অনুসন্ধিৎসা, উপলব্ধির জার্নি এক গানের শরীরর বেয়ে চলতে থাকে আরেক গানে বহতা নদীর মতো, পুরোটা অ্যালবাম জুড়ে। আর সংগীতের এই ঢেউয়ে ঢেউয়ে শহুরে গায়েনের ‘তোমার জন্য থামি’ অ্যালবামটি শ্রোতাকে নিয়ে চলে বোধের মহাসমুদ্রে। যেখানে শ্রোতা অসংখ্য জিজ্ঞসা, অমীমাংসিত অংক, আর প্রশ্ন নিয়ে হাজির হন নিজের মুখোমুখি-কোন পথে জাবেন? উত্তর এখনি হয়তো আসবে না, কিন্তু শহুরে গায়েন চলতি পথে থামছে আমার জন্য-তোমার জন্য। চলেন তাদের সাথে বাতচিতে লিপ্ত হই।
ভালোবাসা শহুরে গায়েনের সকল বন্ধুদের।

বাংলাদেশ সময়: ১৭৪৮ ঘণ্টা, মে ৩০, ২০১৯
এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।