ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

লেখালেখি আমাকে আত্মবিশ্বাসী করে তোলে: মনিকা আলী

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১১৬ ঘণ্টা, নভেম্বর ৮, ২০১৯
লেখালেখি আমাকে আত্মবিশ্বাসী করে তোলে: মনিকা আলী বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ লেখিকা মনিকা আলী। ছবি- ডি এইচ বাদল

১৯৭১ সালে মাত্র সাড়ে ৩ বছর বয়সে বাবা-মা’র সঙ্গে দেশ ত্যাগ করেছিলেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ লেখিকা মনিকা আলী। দীর্ঘ এ সময়ের ভেতর কখনোই জন্মভূমিতে আসা হয়নি তার। অবশেষে ৪৮ বছর পর ঢাকা লিট ফেস্টে’র অতিথি হিসেবে বাংলাদেশে এলেন এ লেখিকা। এ ফিরে আসা, সাহিত্যচর্চা, সাহিত্যভাবনা সব কিছু নিয়ে বৃহস্পতিবার (৭ নভেম্বর) বাংলানিউজের মুখোমুখি হয়েছিলেন ম্যানবুকার পুরস্কার মনোনয়নপ্রাপ্ত, বিশ্বনন্দিত মনিকা আলী। বাংলানিউজের পক্ষে তার সঙ্গে কথা বলেছেন স্টাফ করেসপন্ডেন্ট দীপন নন্দী। ছবি তুলেছেন দেলোয়ার হোসেন বাদল

বাংলানিউজ: আবারও জন্মভূমিতে ফিরে আসা। কেমন লাগছে?

মনিকা আলী: সত্যিই, অসাধারণ! যখন বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যাই, তখন আমার বয়স ছিল মাত্র সাড়ে ৩ বছর।

বহুবার আসার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু হয়নি। সত্যিই দারুণ লাগছে। আমি আমার স্বামী সিমন্স টরেন্সকেও নিয়ে এসেছি।

বাংলানিউজ: বাংলাদেশের কোনো স্মৃতি কি মনে পড়ে আপনার?

মনিকা আলী: আগেই বলেছি, যখন বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যাই, আমার বয়স ছিলো সাড়ে তিন। আসলে দীর্ঘদিন কোনো স্মৃতি মনে রাখার মতো বয়স তখন ছিল না। কিন্তু তারপরও যতদূর মনে পড়ে, আমাদের একটা কালো বিড়াল ছিল। এ রকম কিছু টুকরো স্মৃতি মনে আছে। কিন্তু এর কোনোটাই আসলে পোক্ত স্মৃতি নয়।

বাংলানিউজ: ঢাকা লিট ফেস্টে এসে কেমন লাগছে?

মনিকা আলী: এখানে আসতে পেরে আমি গর্বিত। এতো মানুষ এখানে, সত্যিই খুব ভালো লাগছে!

বাংলানিউজ: বাংলাদেশ ছেড়ে যাওয়ার জন্য কোনো দুঃখবোধ কাজ করে কি?

মনিকা আলী: অবশ্যই। তবে বাংলা ভাষার জন্য বেশি দুঃখ হয়। আমি ঠিক করে বাংলা ভাষাটা বলতে পারি না। এতো সমৃদ্ধ একটা ভাষা, সে ভাষা আমি জেনেও ভুলে গেছি। তবে এ ভাষার প্রতি ভালোবাসাটা কমেনি। এই বাংলা ভাষা আমার বেড়ে ওঠা ও লেখালেখির প্রেরণা হিসেবে কাজ করে। একটি অদৃশ্য শক্তি হয়ে কাজ করে সবসময়।

বাংলানিউজ: আপনার হাতে অনেক কিছু করার সুযোগ ছিল। সেগুলো বাদ দিয়ে লেখালেখিকে কেন বেছে নিলেন?

মনিকা আলী: আমার সামনে আসলে আইডল হিসেবে কেউ ছিলেন না। অন্য অনেক কিছুই হয়তো আমি হতে পারতাম। কিন্তু আমি লেখক হয়েছি। কারণ, লেখালেখি আমাকে আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছিল।

বাংলানিউজ: এর কারণ কী?

মনিকা আলী: আসলে আমি যা বলতে চাই, যা করতে চাই, তার সবই আমি লেখালেখি করে করতে পেরেছি। এসব থেকেই আমার লেখক হয়ে ওঠা। আমার নিজেকে সত্যিই ভাগ্যবান মনে হয়। কারণ, যখন আমি প্রকাশক খুঁজছিলাম, সেটাও অল্প সময়ের মধ্যেই পেয়ে গিয়েছিলাম। সত্যিই অনেক সময় এগুলোকে আমার কাছে জাদুকরি ব্যাপার বলে মনে হয়।

বাংলানিউজ: লেখিকা হিসেবে আপনাকে কী ধরনের সংগ্রামের ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে?

মনিকা আলী: আমি কিন্তু জন্মসূত্রে ব্রিটিশ নই। এর ফলে বাংলাভাষী হয়ে ব্রিটিশদের কাছে নিজের লেখা তুলে ধরতে আমাকে প্রচুর সংগ্রাম করতে হয়েছে। গ্রহণযোগ্যতা পেতে কষ্ট হয়েছে। তারপরও সব মিলিয়ে আমি আমার লেখক জীবন নিয়ে তৃপ্ত।

মনিকা আলীর প্রথম বই 'ব্রিকলেন'।

বাংলানিউজ: আপনার প্রথম উপন্যাস ‘ব্রিকলেন’। এটি অসম্ভব জনপ্রিয়তা পায়। এ ব্যাপারে যদি কিছু বলতেন।

মনিকা আলী: ‘ব্রিকলেন’ উপন্যাসটি লিখেছিলাম নাজনীন নামের একটি বাংলাদেশি মেয়েকে কেন্দ্র করে। সে বাংলাদেশের গ্রামীণ পরিবেশে বড় হয়েছে। ময়মনসিংহে, যেখানে আমার পিতৃভূমি। তার বিয়ে হয় দ্বিগুণ বয়সী চানুর সঙ্গে। এরপর নানা ঘাত-প্রতিঘাতে এগিয়ে যায় উপন্যাসটির গল্প। এটি সত্যিই সে সময় ব্রিটেনে জনপ্রিয়তা পায়। আমি বেশ অবাক হয়েছিলাম তাতে। এটা আমার জন্য এক অনন্য অর্জন বলে মনে করি।

বাংলানিউজ: আপনার পরের উপন্যাস ছিল ‘ইন দ্যা কিচেন’। এটা নিয়ে কিছু বলুন।

মনিকা আলী: যুক্তরাজ্যে প্রচুর ভারতীয় রেস্টুরেন্ট আছে। সেগুলোতে খেতে গিয়ে নানা কিছু দেখতাম। সে সব নিয়ে সবসময়ই মাথার মধ্যে গল্প ঘুরতো। ‘ইন দ্য কিচেন’র গল্পটি এগিয়েছে গ্যাব্রিয়েল লাইটফুট নামের এক রাঁধুনীকে কেন্দ্র করে। যিনি হোটেলের নতুন মালিককে সন্তুষ্ট করতে একটি রান্নার দল পরিচালনা করতেন। সবকিছু ঠিকঠাক চলছিল। এরই মাঝে হোটেলের এক কর্মীর মরদেহ পাওয়া যায় রান্নাঘরে। আর তা গ্যাব্রিয়েলের ভারসাম্যময় জীবনকে বাধাগ্রস্ত করে। পরবর্তীতে মৃত কর্মীর সঙ্গে রহস্যময় এক সম্পর্কে যুক্ত লেনার সঙ্গে সাক্ষাত করেন গ্যাব্রিয়েল, এবং একটি বিশেষ সিদ্ধান্ত নেন। আর তা গ্যাব্রিয়েলের জীবন বদলে দেয়।  

মনিকা আলীর বই 'ইন দ্য কিচেন'।

বাংলানিউজ: আপনার সর্বশেষ উপন্যাস ‘দ্য আনটোল্ড স্টোরি’। এটি প্রিন্সেস ডায়ানার ওপর লেখা। এখনও ব্রিটেনজুড়ে তার মৃত্যু নিয়ে নানান বিতর্ক রয়েছে। আপনি কেন এরকম একটি বিষয় নিয়ে লিখলেন?

মনিকা আলী: এটা একান্তই নিজের ইচ্ছে থেকে। প্রিন্সেস ডায়ানা একটি মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে এসে রাজবধূ হয়েছিলেন। তাকে নিয়ে ব্রিটেনের অন্য মানুষের মতো আমারও আগ্রহ ছিল। সেই আগ্রহ থেকেই মূলত এ উপন্যাস লেখা।

বাংলানিউজ: বিশ্বজুড়ে একটি বিতর্ক চলছে, ই-বুক দিনে দিনে ছাপা বইয়ের জায়গা দখল করে নিচ্ছে। এ বিষয়ে আপনার অভিমত কী?

মনিকা আলী: আমার মতে, বিশ্বের একেক জায়গায় একেক চিত্র। কোথাও ই-বুকের চাহিদা বাড়ছে, কোথাও আবার এর কোনো চাহিদা নেই। ছাপা বইয়ের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা একইরকম। তবে আমার কাছে ছাপার বই এখনও অনেক বেশি আকর্ষণীয়। আমার মতে, এখনও সারা বিশ্বে ছাপার বইয়ের কাটতিই অনেক বেশি।

মোণীকা আলিড় বৈ 'আনটোল্ড স্টোরি'।

বাংলানিউজ: আপনার কাছে ‘গল্প’ মানে কী? 

মনিকা আলী: গল্প আসলে ছোট ছোট জিনিসকে আবেগ ও কাব্যিকতার ছোঁয়ায় বড় পরিসরে ধরা। আমি মনে করি, সাহিত্যিক পরিচর্যার মাধ্যমে যে কোনো ক্ষুদ্র জিনিসকে বড় পরিসরে তুলে ধরতে পারেন।

মনিকা আলী: মনিকা আলী বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ লেখিকা। ১৯৬৭ সালে ঢাকায় বাংলাদেশী বাবা ও ইংরেজ মায়ের ঘরে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। পরবর্তীতে ১৯৭১ সালে বাবা-মা’র সঙ্গে দেশ ছেড়ে ব্রিটেনে পাড়ি জমান। সেখানে তিনি বোল্টন স্কুলে ভর্তি হন ও পরবর্তীতে অক্সফোর্ডের ওয়াডহাম কলেজে দর্শন, রাজনীতি এবং অর্থনীতি বিষয়ে পড়াশোনা করেন।

তার প্রথম উপন্যাস ‘ব্রিকলেন’ এখন পর্যন্ত ২৬টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। এ বইটি মনোনীত হয়েছিল ম্যান বুকার পুরস্কারের জন্যও। একই নাম নিয়ে ২০০৭ সালে একটি চলচ্চিত্রও নির্মাণ করা হয়। মনিকা ২০০৩ সালে আন্তর্জাতিক পুরস্কার ‘গ্রান্টা’র সেরা তরুণ ঔপন্যাসিক হিসেবে নির্বাচিত হন। দীর্ঘ দিন তিনি যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে অধ্যাপনা করেন। বর্তমানে স্বামী ব্যবস্থাপনা পরামর্শক সাইমন টরেন্সের সঙ্গে বসবাস করছেন দক্ষিণ লন্ডনে।

বাংলাদেশ সময়: ২০১০ ঘণ্টা, নভেম্বর ০৭, ২০১৯
ডিএন/এইচজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।