বালুর বাক্স
[নানী মার (১৮৭৬-১৯৫৯) স্মৃতিতে একটি সংক্ষিপ্ত নাটক ]
চরিত্র
তরুণ: ২৫, সুদর্শন, সুস্বাস্থ্যের অধিকারী, সাঁতারের পোশাক পরা
আম্মা: ৫৫, সুসজ্জিত, কতৃত্বপূর্ণ
আব্বা: ৬০, ছোটখাটো মানুষ, বৃদ্ধ, কৃশকায়
নানী মা: ৮৬, খুব ছোটখাটো, রোগা, কিন্তু তার চোখ উজ্জ্বল
বাদক: বিশেষ কোনো বয়সের নয়, তবে তরুণ হলে ভালো
দ্রষ্টব্য: পুরো নাটক জুড়েই আম্মা আর আব্বা নিজেদেরকে আম্মা আব্বা বলেই ডাকে, এই নামের মধ্যে কোনো আঞ্চলিকতা নাই। এই নামে ডাকাটা একেবারেই আবেগশূন্য এবং তাদের চরিত্রের বার্ধক্যজনিত আলস্য ও অসারতাই তুলে ধরে।
[শূন্য মঞ্চ। কেবল সামান্য এইটুকু আয়োজন: পাদপ্রদীপের কাছে মঞ্চের একদম ডানে দুটো সাধারণ চেয়ার পাশাপাশি রাখা, দর্শকদের দিকে মুখ করে রাখা; পাদপ্রদীপের কাছে মঞ্চের একদম বাঁয়ে একটা চেয়ার মঞ্চের ডানদিকে মুখ করে রাখা, এই চেয়ারটার সামনে একটা মিউজিক স্ট্যান্ড রাখা; আরো পিছনে এবং মঞ্চের কেন্দ্রে, একটু হেলানো অবস্থায় শিশুদের একটা বিরাট বালুর বাক্স রাখা, সাথে একটা খেলনা বালতি আর বেলচা রাখা, আসল ব্যাপার হলো নেপথ্যের পর্দা, যেখানে উজ্জ্বলতম দিন আর গভীর রাত ফুটে উঠবে।
একদম শুরুতে, উজ্জ্বলতম দিন; তরুণ লোকটি একা বালুর বাক্সের উল্টোদিকে, একপাশে। সে ব্যায়াম করছে; সে নাটকের শেষ নাগাদ এই ব্যয়াম করতেই থাকবে। তার এই ব্যয়াম মূলত বাহুকেন্দ্রিক, যাতে করে মনে হবে সে ডানা ঝাপটাচ্ছে। তরুণ লোকটি আদতে মৃত্যুদূত। আম্মা আর আব্বা মঞ্চের বাঁ দিক থেকে আসে, প্রথমে আম্মা। ]
আম্মা: বেশ, এই তো এসে গেলাম। এই সেই সৈকত।
আব্বা: (ঘ্যান ঘ্যান করে) আমার ঠাণ্ডা লাগতেছে।
আম্মা: (একটা হাসি দিয়ে তারে অগ্রাহ্য করে) বোকার মতো কথা বলো না, কী গরম! টোস্ট হওয়ার অবস্থা! ওই সুন্দর তরুণ লোকটাকে দ্যাখো: সে তো মনে করছে না, এখন ঠাণ্ডা। (তরুণের দিকে হাত দেখায়) হ্যালো।
তরুণ: (একটি স্নেহমূলক হাসি দিয়ে) হাই!
আম্মা: (তাকিয়ে দেখে) এইটা একদম ঠিকঠাক... তোমার কী মনে হয় আব্বা? ওইখানে বালু আছে... আর দিগন্তজুড়ে জল। তোমার কী মনে হয় আব্বা?
আব্বা: (অস্পষ্টভাবে) তোমার যা খুশি কও আম্মা।
আম্মা: (হালকা হাসি দিয়ে) হুম, তা নিশ্চয়... আমি যা খুশি বলি, তাহলে এটা ঠিক হয়ে গেলো, তাই না?
আব্বা: (কাঁধ ঝাঁকায়) সে তোমার মা, আমার না।
আম্মা: আমি জানি সে আমার মা। আমাকে তোমার কী মনে হয়? (বিরতি) আচ্ছা বেশ, এখন তবে এটাই হোক। (সে মঞ্চের বাঁয়ে উইংসের দিকে হাঁক দেয়) তুমি! এই যে! তুমি এখন আসতে পারো। (বাদক প্রবেশ করে, চেয়ারে বসে, মঞ্চের বাঁয়ে, মিউজিক স্ট্যান্ডের সামনে স্বরলিপি লেখা কাগজ রাখে, সে বাজানোর জন্য তৈরি। আম্মা সম্মতি জানিয়ে মাথা নাড়ায়। ) খুব ভালো, খুব ভালো, তুমি তৈরি, আব্বা? চলো নানীমা’র কাছে যাই।
আব্বা: তুমি যা বলো আম্মা।
আম্মা: (বাইরের দিকে পথ দেখিয়ে, মঞ্চের বামে) নিশ্চয়ই, আমি যা বলি। (বাদককে) তুমি এখন শুরু করতে পারো।
(বাদক বাজনা শুরু করে; আব্বা, আম্মা বেরিয়ে যায়; বাদক বাজিয়ে চলে আর তরুণের দিকে ঘাড় নাড়ে)
তরুণ: (একই স্নেহমূলক হাসি দিয়ে) হাই!
(একটু পরেই আব্বা আর আম্মা ফিরে আসে, তারা নানীমাকে বহন করে আসে। দুজন তাকে বগলদাবা করে দু’হাতে বয়ে আনে; সে বড় কঠিন হয়ে আছে; তার পা উপরে তোলা, পায়ের পাতা মাটি ছোঁয় না, তার প্রাচীন মুখে ভয় আর বিভ্রান্তির অভিব্যক্তি)
আব্বা: উনারে কই নামাবো?
আম্মা: (হালকা হাসি দিয়ে) যেখানে আমি বলবো, অবশ্যই সেখানে, আমাকে দেখতে দাও... বেশ... আচ্ছা, ওইখানে... বালুর বাক্সে। (বিরতি) আচ্ছা, তুমি কীসের অপেক্ষা করছো আব্বা?... বালুর বাক্সে!
(তারা দুইজন নানীমাকে বালুর বাক্সে নিয়ে আসে এবং একরকম ছুঁড়ে ফেলে দেয়)
নানী মা: (নিজেকে ঠিকমতো বসানোর চেষ্টা করে; তার কণ্ঠ যেন শিশুর হাসি আর কান্নার সংমিশ্রণ) আহহহহ! উউউহহহ!
আব্বা: এখন আমরা কী করবো?
আম্মা: (বাদককে) তুমি এখন থামতে পারো। (বাদক থামে) (আব্বার কাছে ফিরে আসে) কী বলতে চাও, আমরা এখন কী করবো বলতে তুমি কী বোঝাতে চাও? (তরুণকে) এই যে হ্যালো।
তরুণ: (হেসে) হাই!
(আব্বা-আম্মা চেয়ারের দিকে সরে আসে, মঞ্চের ডানপাশে, তারা বসে। )
নানী মা: (আগের মতো) আহ! আহ-হাহা! উউউহ...
আব্বা: তোমার কী মনে হয়... মানে তোমার কী মনে হয়... উনি আরামে আছে?
আম্মা: (অসহিষ্ণুভাবে) আমি কী করে জানবো?
আব্বা: আমরা এখন কী করবো?
আম্মা: আমরা... অপেক্ষা করবো। আমরা... বসবো এখানে... আর আমরা অপেক্ষা করবো... আমরা এই করবো।
আব্বা: আমরা কী একে অপরের সঙ্গে কথা বলবো?
আম্মা: বেশ, তুমি কথা বলতে পারো, যদি তুমি চাও... যদি তুমি কিছু বলার মতো খুঁজে পাও... যদি তুমি নতুন কিছু ভেবে পাও।
আব্বা: (ভাবে) নাহ... আমার মনে হয় না।
আম্মা: (বিজয়ীর হাসি দিয়ে) অবশ্যই না।
নানী মা: (খেলনা বালিতে খেলনা বেলচা দিয়ে ঠোকাঠুকি করছে) হাআআআআ! আহ-হাহাহাহ!
আম্মা: শান্ত হও, নানীমা... একদম চুপ, আর অপেক্ষা করো। (নানী এক-বেলচা বালু আম্মার দিকে ছুঁড়ে মারে) সে আমার দিকে বালু ছুড়ে মারছে! তুমি! থামো বলছি নানী; আম্মার দিকে বালু ছোড়া বন্ধ করো। (আব্বাকে) সে আমার দিকে বালু ছুড়ে মারছে! (আব্বা নানীর দিকে তাকায়, সে চিৎকার করে ওঠে।
নানী: গররররর!
আম্মা: তার দিকে তাকিও না। ওরফে... বসে থাকো... একদম স্থির হও... আর অপেক্ষা করো। (বাদকের প্রতি) তুমি... উ... তুমি যেতে পারো আর যা খুশি করতে পারো।
(বাদক বাজনা বাজায়। আম্মা আর আব্বা স্থির, দর্শকদের সীমানা পেরিয়ে দূরে তাকিয়ে থাকে। নানী মা তাদের দিকে তাকায়, বাদকের দিকে তাকায়, বালুর বাক্স দেখে, বেলচাটা নামিয়ে রাখে)
নানী মা: আহ-হাহহাহা! গরররর! (প্রতিক্রিয়া প্রত্যাশা করে; কোন প্রতিক্রিয়া পায় না। এখন সে কথা বলে সরাসরি দর্শকদের প্রতি। )
আব্বা: সত্যিই! একজন বৃদ্ধার সাথে এই আচরণ! তাকে টেনে বাড়ির বাইরে নিয়ে আসে... গাড়ির মধ্যে আটকানো... তাকে শহরের বাইরে নিয়ে আসা... তাকে বালুর স্তূপে ফেলে দেয়া... আর তাকে এইভাবে বসিয়ে রেখে চলে যাওয়া... আমার বয়স ৮৬ বছর! যখন আমার সতের বছর বয়স তখন বিয়ে হয়েছিল আমার। এক কৃষকের সাথে। আমার যখন ত্রিশ বছর বয়স তখন সে মারা যায়। (বাদককে) তুমি থামবে দয়া করে? (বাদক থামে) আমি এক কাহিল বুড়া মানুষ... তুমি কী করে আশা করো এই পিপিপিপি’র মধ্যে কেউ আমার কথা শুনতে পারে? পিপিপি! পিপিপিপি! (নিজেকেই) কোনো শ্রদ্ধা সম্মান আর অবশিষ্ট নাই। (তরুণকে) এইখানে কোনো মান-সম্মান নাই।
তরুণ: (হাসে) হাই!
নানী মা: (দর্শকদের উদ্দেশ্যে কথা বলতে থাকে) যখন আমার বয়স তিরিশ বছর তখন আমার স্বামী মারা গেলো আর ওই যে বিরাট গরুটা দেখছেন ওখানে (আম্মাকে দেখিয়ে) একা একা ওটাকে বড় করা লাগলো আমার। আপনি ভাবতে পারেন, বিষয়টা কী রকম ছিল, মাবুদ! (তরুণকে) তোমারে ওরা কই পেলো?
তরুণ: ওহ, আমি এদিকেই আছি বেশ কিছুক্ষণ ধরে।
নানী মা: বাজি ধরে বলা যায়, তুমি ছিলে এদিকেই। আমার দিকে একটু তাকাবে!
তরুণ: (পেশীগুলোকে ভাঁজ করে দেখায়) এইগুলা যথেষ্ট নয়।
নানী মা: খোদা, আহা, আমি বলবো, বেশ ভালোই তো।
তরুণ: (মিষ্টি করে) আমিই বলবো।
নানী মা: তুমি কোত্থেকে এসেছো?
তরুণ: দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়া।
নানী মা: দেহ, দেহ! তোমার নাম কী যাদু?
তরুণ: আমি জানি না...
নানী মা: (দর্শককে) উজ্জ্বল বটে!
তরুণ: মানে... মানে, ওরা আমাকে এখনও কোনো নাম দেয়নি... স্টুডিও... প্রযোজনা সংস্থা...
নানী মা: (দ্রুত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে) তুমি বলো না... তুমি বলো না... বেশ... আহ... আমার কিছু বলার আছে... তুমি দূরে সরে যেও না।
তরুণ: ওহ, নাহ।
নানী মা: (দর্শকের দিকে মনোযোগ আকর্ষণ করে) দারুণ, দারুণ। (আবার তরুণের দিকে ফিরে আসে) তুমি... তুমি একজন অভিনেতা, হ্যাঁ?
তরুণ: (খুশি হয়ে) হুম, আমি তাই।
নানী মা: (আবার দর্শককে) আমি এইভাবেই চৌকস হয়ে উঠি। যা হোক, আমার তো ওকে বড় করতেই হতো... ওই যে ওইখানের ওইটাকে একদম একা; আর ওর পাশে ওইটা কি... ওইটারে ও বিয়ে করছে পয়সালা? আমি বলছি তোমাদের... টাকা, টাকা, টাকা। তারা আমার কাছ থেকে খামারটা নিয়ে নিলো... যেটা ছিল তাদের জন্যে আসলে সমুচিত কাজ... আর তারা আমাকে শহরে বড় বাড়িতে তাদের সঙ্গে সরিয়ে নিলো... চুল্লির নিচে আমার জন্য একটা ভালো জায়গা করে দিলো... আমারে একটা আর্মির কম্বল দিলো... আর আমাকে খেতে দিলো... আমার একান্ত নিজস্ব খাদ্য! তাহলে আমার আর অভিযোগ করার কী ছিল? কিচ্ছু না, অবশ্যই কিচ্ছু না! আমি অভিযোগ করছিও না। (সে আকাশের দিকে তাকায়, মঞ্চের বাইরের কারো দিকে চিৎকার করে কথা বলে) এখন কি অন্ধকার হয়ে যাওয়া উচিত নয়, প্রিয়?
(আলো ম্লান হয়ে আসে; রাত্রি নামে। বাদক বাজাতে শুরু করে; গভীর রাত্রি হয়। সকল অভিনেতার উপর স্পট লাইট, তরুণসহ, তরুণটি যথাবিহিত শারীরিক কসরত করে যাচ্ছে। )
আব্বা: রাত্রি নেমে এলো।
আম্মা: শ্শ্শ্। স্থির হও... অপেক্ষা করো।
আব্বা: (ঘ্যান ঘ্যান করে) আমার খুব গরম লাগছে।
আম্মা: শ্শ্শ্। স্থির হও... অপেক্ষা করো।
নানী মা: (নিজেকেই) এইটা উত্তম। এই রাত। (বাদককে) সোনা, তুমি কি এই পুরো সময়টা ধরে বাজিয়ে গেছ? (বাদক মাথা নাড়ে) বেশ, বিষয়টাকে মধুর আর মৃদু রেখো, এই তো লক্ষ্মীছেলে। এইটা বেশ।
আব্বা: (যেন আরম্ভ করে) এইটা কী ছিল?
আম্মা: (কাঁদতে থাকে) এইটা কিছু ছিল।
আব্বা: ছিল... ছিল... বজ্রপাত... কিংবা একটা ঢেউয়ের ভেঙে পড়া... কিংবা অন্য কিছু।
আম্মা: (কান্নার মাঝখানে ফিসফিস করে) এটা মঞ্চের বাইরের একটা গর্জন ছিল... আর তুমি জানো এর মানে কী।
আব্বা: আমি ভুলে গেছি।
আম্মা: (কথা বলতে পারে না প্রায়) এর মানে হলো সময় চলে এসেছে, বেচারি নানীমা’র... আর আমি এটা সহ্য করতে পারবো না!
আব্বা: আমার... আমার মনে হয় তোমাকে সাহসী হতে হবে।
নানী মা: (ভেঙায়) ঠিক কইছো, খোকা; সাহসী হও। তুমি সইতে পারবে, তুমি এটা অতিক্রম করতে পারবে।
(মঞ্চের বাইরে আবার আরেকটা গর্জন শোনা যায়... এবার আরো জোরে)
আম্মা: ওহ... বেচারি নানী মা... বেচারি নানী মা...
নানী মা: (আম্মাজানকে) আমি ভালো আছি! আমি ঠিকঠাক আছি! এটা এখনও ঘটে নাই!
(মঞ্চের বাইরে আবার ভয়াবহ গর্জন শোনা যায় ; সব আলো নিভে যায়, তরুণের মুখে কেবল একটি স্পট লাইট দেখা যায়; বাদক বাজানো বন্ধ করে দিয়েছে)
আম্মা: ওহ... ওহহ... (নীরবতা)
নানী মা : এখনই আলো জ্বেলো না... আমি এখনও তৈরি হইনি; আমি পুরোপুরি তৈরি নই। (নীরবতা) ঠিক আছে প্রিয়... আমি প্রায় তৈরি।
(আবার আলো আসে, একদম উজ্জ্বল দিনের আলো; বাদক বাজাতে শুরু করে। নানীমাকে এখনও বালুর বাক্সে দেখা যায়, নিজের দিকে কাত হয়ে আছে, কনুইয়ে ভর দিয়ে, অর্ধেক শরীর ঢাকা, ব্যস্তভাবে বেলচা দিয়ে নিজের উপর বালু ফেলছে। )
নানী মা: (বিড়বিড় করে) আমি জানি কী করে আমি কী করবো এই আলতুফালতু বেলচাটা দিয়ে...
আব্বা: আম্মাজান! এই যে দিনের আলো!
আম্মা: (উজ্জ্বলভাবে) এই তো! বেশ! আমার দীর্ঘ রাত্রির অবসান হলো। আমাদের কান্নাগুলোকে এখন অবশ্যই সরিয়ে রাখতে হবে, আমাদের শোক, গোঙানি... আর ভবিষ্যতের মুখোমুখি হতে হবে। এটাই আমাদের কর্তব্য।
নানী মা: (এখনও বেলচা নিয়ে ব্যস্ত, ভেঙানোর স্বরে)... আমাদের শোককে সরিয়ে রাখতে হবে... ভবিষ্যতের মুখোমুখি হতে হবে... মাবুদ!
(আব্বা আর আম্মা উঠে দাঁড়ায়। হাত-পা ঝাড়া দেয়। তরুণের প্রতি হাত নাড়ে)
তরুণ: (হাসি দিয়ে) হাই!
(নানী মা মরার অভিনয় করে। আম্মা আর আব্বা তার কাছে যায়, সে প্রায় অর্ধেকটাই বালুতে কবরস্থ’ তার হাতের খেলনা বেলচাটা বুকের উপর ক্রুশের মতো রাখা)
আম্মা: (বালুর বাক্সের সামনে; তার মাথা ঝাকাচ্ছে) দারুণ! খুব... খুব কঠিন বিষণ্ন হওয়া... তাকে মনে হচ্ছে... খুব সুখী। (গৌরব আর দৃঢ়ভাবে) ভালোভাবে সব করতে হলে মূল্য দিতে হয়। (বাদকের প্রতি) ঠিকাছে, তুমি এখনও থামতে পারো, যদি তুমি চাও। আমি বলতে চাইছি, আশেপাশে থাকতে পারো, সাঁতার কাটার জন্য কিংবা অন্য কিছুর জন্য; আমাদের দিক থেকে সব ঠিক আছে। (সে গভীর দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে) আচ্ছা, আব্বাজান...চলো আমরা যাই।
আব্বা: সাহসী জননী!
আম্মা: সাহসী পিতা!
(তারা বেরিয়ে যায় মঞ্চের বাঁ দিক দিয়ে)
নানী মা: ভালো কিছু করতে হলে মূল্য দিতে হয়... খোকা, ওহ খোকা! (সে বসার চেষ্টা করে)... বেশ খোকা... আমি... আমি উঠে দাঁড়াতে পারছি না... আমি... আমি নড়তে পারছি না
(তরুণ লোকটি তার শারীরিক কসরত বন্ধ করে, বাদকের দিকে মাথা ঝাঁকিয়ে সম্ভাষণ জানায়, নানী মার কাছে হেঁটে আসে, বালুর বাক্সের দিকে ঝোঁকে)
নানী মা: আমি... নড়তে পারছি না...
তরুণ: শ্শ্শ... একদম স্থির হোন....
নানী মা: আমি... নড়তে পারছি না...
তরুণ: উহ... ম্যাম... এখানে আমার সংলাপ আছে।
নানী মা: ওহ্, আমি দুঃখিত সোনা, তুমি এগিয়ে যাও।
তরুণ: আমি... আমি... এহ...
নানী মা: তাড়াহুড়া করো না প্রিয়, সময় নাও।
তরুণ: আমি মৃত্যুর দেবদূত। আমি... আমি... আমি আপনার জন্য এসেছি।
নানী মা: ককককি... ককক (তারপর সমর্পণ করে) ওহহহ.... ওহহহহ, আমি বুঝেছি। (তরুণটি ঝুঁকে আসে, নানীমার কপালে চুমু খায়। নানী মার চোখ বন্ধ, তার হাত বুকের ওপর ভাঁজ করা, বেলচাটা দুহাতের মাঝখানে, তার মুখে একটা মধুর হাসি। ) বেশ... এটা খুব সুন্দর ছিল, প্রিয়...
তরুণ: (এখনও ঝুঁকে আছে) শ্শ্শ... একদম স্থির হোন....
নানী মা: আমি যেটা বোঝাতে চেয়েছি... তুমি খুব ভালোভাবে এটা করেছো প্রিয়...
তরুণ: (লজ্জায় রক্তিম হয়) ওহ...
নানী মা: না। আমি এটাই বোঝাতে চেয়েছি... তোমার আছে... তোমার যোগ্যতা আছে...
তরুণ: (প্রীতিকর হাসি দিয়ে) ওহ... ধন্যবাদ আপনাকে; আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ ম্যাম।
নানী মা: (ধীরে, নরম স্বরে কথা বলে আর তরুণটি তার হাত রাখে নানী মার হাতের ওপর) তোমাকে... তোমাকে স্বাগতম... প্রিয়।
বাদক তার বাজনা বাজাতে থাকে আর পর্দা নামতে শুরু করে।
টীকা
১. স্যান্ডবক্স (sandbox) বস্তুটি সম্পর্কে আমাদের সে-অর্থে ধারণা নেই। এটা আসলে বাচ্চাদের খেলার জিনিস। একটা মাঝারি আকারের ঘেরের মধ্যে বালু দেয়া হয়, সাথে বেলচা, বালতি ইত্যাদি। বাচ্চারা এটাকে সমুদ্রের সৈকত মনে করে খেলা করে। আমার মনে হয়েছে এলবি এ নাটকে স্যান্ডবক্স-এর মাধ্যমে বালুর গৃহ কিংবা বালু নিয়ে খেলার প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। হয়তো আমাদের জীবন বালুর গৃহের মতোই কিংবা বালু নিয়ে খেলার মতোই।
২. মূল নাটকে তরুণ চরিত্রটিকে দেখানো হয় বারবার ক্যালিসথেনিকস করতে। ক্যালিসথেনিকস হলো দুটো সমান্তরাল বারের উপর জিমন্যাস্টিকস করা। এটা মূলত হাতের পেশীকে দৃঢ় করতে করা হয়। আমি বোঝার সুবিধার জন্য এখানে শারীরিক কসরত শব্দটি ব্যবহার করেছি ক্যালিসথেনিকসের বদলে।
লেখক পরিচিতি
আধুনিক আমেরিকান থিয়েটারের অন্যতম স্থপতি এডওয়ার্ড এলবি’র জন্ম ১৯২৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়া অঙ্গরাজ্যে। জন্মের দু’সপ্তাহ পরই এডওয়ার্ড এলবিকে পালক নেন রিড এলবি। রিডের দ্বিতীয় স্ত্রী তাকে পুত্র হিসাবে কোলে তুলে নেন। কিন্তু এই মা’র সঙ্গে কোনোদিনই বনিবনা হয়নি এলবি’র। এলবির আসল বাবা এডওয়ার্ড ফ্রাঙ্কলিন এলবি ছিলেন একাধিক ভদ্যুভাইলের মালিক। ভদ্যুভাইল হলো মঞ্চের বিচিত্র অনুষ্ঠান। নাটক, নাচ, কৌতুক সবকিছুই হতো সেখানে। বাবার জিনের সূত্র ধরেই হয়তোবা পরবর্তী সময়ে এডওয়ার্ড এলবি হয়ে ওঠেন আধুনিক আমেরিকান থিয়েটারের অন্যতম স্থপতি। সৎ মা বারবার চেয়েছেন ছেলেকে নাটক, থিয়েটার থেকে দূরে রাখতে, অভিজাত পরিবারের লক্ষ্মী সন্তান বানাতে। কিন্তু এলবি ছোটবেলা থেকে স্কুল পালাতেন। স্কুল থেকে বরখাস্ত হয়েছেন, এমনকি আর্মি একাডেমি থেকেও তাকে বিদায় করে দেয়া হয়েছে। যা হোক, কোনোভাবে গ্র্যাজুয়েশন করেন তিনি। আর নিয়ম-বন্ধন না-মানা এলবি প্রথম যেখানে থিতু হলেন সেটি হলো মঞ্চনাটক। ১৯৫৮ সালে প্রথম মঞ্চনাটক ‘দ্য জু স্টোরি’ দিয়েই তিনি শুধু আমেরিকা না, সারাবিশ্বের নাট্যপ্রেমীদের মন জয় করে নেন। তারপর একে একে ‘দ্য স্যান্ডবক্স (১৯৫৯), ‘হু’জ অ্যাফ্রেইড অব ভার্জিনিয়া উলফ (১৯৬২), আ ডেলিকেট ব্যালেন্স (১৯৬৬), ‘থ্রি টল উইমেন’ (১৯৯৪)-এর মতো কিংবদন্তির সব নাটক রচনা করেছেন।
ইউজিন ও’নীল, আর্থার মিলার, টেনিসি উইলিয়ামের মতো মহৎ মার্কিন নাট্যকারদের যথার্থ উত্তরসূরী হিসাবে এডওয়ার্ড এলবি’র নাম উল্লেখ করা হয়। আধুনিক আমেরিকান থিয়েটারকে গতিশীল করেছেন তিনি একাই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তীকালের ‘অ্যাবসার্ড’ ঘরানার নাটক লিখেছেন তিনি। আমেরিকায় তিনিই প্রথম অ্যাবসার্ড নাটকের বিস্তার করেছেন।
উল্লেখ্য, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ ভাঙন স্যামুয়েল বেকেট, ইউজিন আয়ানেস্কো, জঁ জেনের মতো নাট্যকারদের প্রবলভাবে তাড়িত করেছিল। সেই বিপর্যয়ের মুখে দাঁড়িয়ে বেঁচে থাকার একঘেয়েমি আর অস্থিরতা তাদেরকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। এই পৃথিবী, প্রচলিত জীবন, সমাজ সবকিছুই তাদের কাছে উদ্ভট আর অবাস্তব মনে হয়েছে। মানুষের বহু পরিকল্পনা, সাজানো ঘর, ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স সবই মুহূর্তে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে একটা বোমার আঘাতে। জীবনের অনিশ্চয়তা, ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা তাদের নাটককে করে তুলেছে অদ্ভূত, কখনোবা উদ্ভট। ইউরোপীয় অ্যাবসার্ড ঘরানার হলেও এডওয়ার্ড এলবি’র নাটক পুরোটাই আমেরিকান। আমেরিকান সমাজের অস্থিরতা, পাগলামি, অর্থহীনতা তার নাটকে প্রকট। আমেরিকার সমাজের সাজানো, আলগা সৌন্দর্যকে আঘাত করেছেন তিনি বারবার। আধুনিক আমেরিকাকে খোলাখুলি দৃষ্টিতে সমালোচনা করেছেন তিনি। এবসার্ড নাট্যকার হিসাবে অধিক সমাদৃত হলেও তার শেষের দিকের নাটকে বৈবাহিক সম্পর্ক, নর-নারীর মনস্তত্ত্ব, যৌনতা ইত্যাদি প্রাধান্য পেয়েছে।
ভ্লাদিমির নবোকভের বিতর্কিত উপন্যাস ‘লোলিতা’র মঞ্চরূপ দিয়ে তিনি তীব্রভাবে সমালোচিত হয়েছিলেন। আজও এডওয়ার্ড এলবিকে বাদ দিয়ে আমেরিকার নাটকের তথা অ্যাবসার্ড নাটকের কোনো আলোচনা, সমালোচনা করা সম্ভব নয়।
লেখক: মুম রহমান, কবি, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক
বাংলাদেশ সময়: ১৩০০ ঘণ্টা, মার্চ ১২, ২০২০
এইচজে