কিন্তু ‘বাংলা উপন্যাস’ প্রবন্ধে দেবেশ রায়ের মতের আমি অনুসারী যে "সত্য এই যে বাংলা ভাষায় কোনদিনই উপন্যাসের এমন আলাদা ধারা তৈরি হয়ে ওঠেনি যেখানে জনপ্রিয় আর বিশিষ্টের মধ্যে কোনো পার্থক্য করা যায়। এই পার্থক্য শিল্পের দিক থেকে অর্থহীন।
এই সমগ্রতার সন্ধান এই সময়কালের কোনো বাংলা উপন্যাসে আমি পাইনি। খণ্ডচিত্রর জায়গায় সমগ্র বলতে আমি গোটা পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে কাহিনীবিস্তারের কথা বলছি না। ১৯৫০-২০০০ কালপর্বের আগের বাংলা সাহিত্যে ধনতন্ত্রের অভিঘাতে সামন্ততান্ত্রিক শৃঙ্খলার ভাঙন তারাশঙ্কর দেখিয়েছিলেন ধাত্রীদেবতায় ‘লাঘাটা বন্দর’-এর পাশে ‘সাত আনির জমিদারি’-তে, ও কালিন্দী-তে কালিন্দীর চরে; সাবেকি ভারতীয় গ্রামীণ সমাজ আর তার নৃতাত্ত্বিক-কার্ষ বৈশিষ্ট্য কেমন করে নতুন শিল্পসমাজের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে তার মনকেমন ইতিবৃত্ত হাঁসুলী বাঁকের উপকথা-য় ‘কোপাই নদীর প্রায় মাঝামাঝি জায়গায় হাঁসুলী বাঁক’-এর পাশে ‘জাঙল’ গ্রামে। গ্রামীণ সমাজের উপর শিল্পায়নের প্রভাব যেহেতু ‘আটচালা’ আর ‘চণ্ডীমণ্ডপ’-এর পতনের মতো বিশেষ স্স্থানিকতায় বিধৃত ফলে তাকে ধরতেই হয়েছিল ‘মহাগ্রাম’, তার ভিতরে ‘শিবকালীপুর’, অথবা ‘পঞ্চগ্রাম’-এর ভাঙাকাঁচে, পশ্চিমবঙ্গের কোনো ‘topos’-এ নয়। একই ভাবে কন্নড় লেখক রাও বাহাদ্দুরের গ্রামায়ণ–এ বিধৃত ‘পাদাল্লি’ নামের একটি গ্রামের রূপান্তরের আখ্যান, কেবল তার ৮৯টি অজস্র চরিত্রের পারস্পরিক সংঘাত-সম্পর্কের ভিত্তিতে। এই গ্রামিক মহাকাব্যে গ্রামই নায়ক, বনের মধ্যে গাছের মতো তার মধ্যেই মিশিয়ে আছে মানুষ। গ্রামজীবনের চালক শক্তিও তারা নয়, চালক বরং বন্যা, দুর্ভিক্ষ, মহামারী, আর সবার উপর মানুষের বোকামি ও অচেতনা। রাম স্বরূপ অনখী কোঠে কড়ক সিং-এ ‘কোটে’ ছাড়াও পাঞ্জাবের মালওয়া অঞ্চলে ‘কোটে’ এবং তার পাশাপাশি কয়েকটি গ্রামে ১৯৪০-৪২ থেকে ১৯৭৭ অবধি একটি জাঠ কৃষক পরিবারের তিন পুরুষের কাহিনীর মধ্যে দেখেছেন প্রাক-স্বাধীনতাকাল থেকে জনতা পার্টির অল্পকালের শাসনের পর ইন্দিরা গান্ধীর প্রত্যাবর্তন পর্যন্ত ৬০টি চরিত্রের আয়নায় পরিবর্তনশীল ভারত। বাংলা সাহিত্যে ১৯৫০ থেকে ২০০০ সালের মধ্যে এরকম কোনো উপন্যাস আছে কি? এই সাহিত্যের আনাড়ি ছাত্রের প্রশ্ন আপনাদের কাছে।
একথা বলছি আমি রাঢ় বঙ্গের দুশোবছরের বিবর্তনকে ফ্রেমবন্দী করা ভগীরথ মিশ্রর ১৯৯৬-এ প্রথম খণ্ড থেকে ২০০০ সালে পঞ্চম খণ্ডের মৃগয়া (২০০৮) উপন্যাসের কথা মনে রেখেও বলছি। সেখানে 'দহনপর্ব'-এর প্রস্তুতি পরিচ্ছেদে ‘উনিশশো ঊনপঞ্চাশের চোদ্দই আগস্ট’ মধ্যরাত্রে কৃষকরা রাষ্ট্রকে বলছে "এই স্বাধীনতা থেকে আমরা কী পেলাম? কেন আমাদের ভাগচাষের জমিন কেড়ে নেয়? কেন ভাগচাষীদের কাছ থিক্যে আধা ফসল লয়া সত্ত্বেও বাবুদের খাস-দখলের জমিন বেগার খাইট্যে চাষ কইর্যে দিতে হয়?" কিম্বা 'তস্কর' (১৯৯২) উপন্যাসে জোতদারদের মাথা বাণেশ্বর ঘোষ জানাচ্ছে, "পর পর দুটো যুক্তফ্রন্টই দেশ গাঁয়ের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। সেই যে হরেকিষ্টো কোঙার মেদুনপুর শহরে মিটিং করে সব্বাইকে লাঠি-সড়কি ধরে বেনাম জমির দখল নিতে বললো, দেশ গাঁয়ের অধঃপতন শুরু হলো তখন থেকেই। ... (কম) জ্বালিয়েছে সাতষট্টি থেকে একাত্তর? শালা, নিজের ঘরে চোরটি সেজে বসে থাকা ... আর বিচার আচার? ... নামেই বিচার আসলে চলে মানী লোকের মান হরণের ব্যবস্থা। সুদ খাটাও ক্যানে? বন্ধক রাখো ক্যানে? দেশের ধান চড়া দামে বাইরে বিক ক্যানে? আরে, দেশ গাঁয়ের চিরকালের ধারাই যে ঐ ... ভাগ্যে বাহাত্তরে জিতলো দল, ভাগ্যে জরুরী অবস্থাটা জারী হইল দেশে। ... জরুরী অবস্থাটা জারী হতেই, পুলিশ দু-চারবার ভিড়কা ভিড়কি করতেই যে যার মুষার মতন গর্তে সেঁধিয়ালঅ। "
কী ক’রে মেলাই ভগীরথ মিশ্রের তস্কর–এ বামশাসন ও ইমার্জেন্সির চিত্রায়নের সঙ্গে জরুরী অবস্থার প্রতিবাদী গৌরকিশোর ঘোষের পশ্চিমবঙ্গ এক 'প্রমোদ তরণী, হা হা' গল্পগ্রন্থটিতে ১৯৬৭-৭১ কালে বামশাসনে কলকাতার চিত্রায়নকে? কিম্বা 'তস্কর'–এ বামশাসনের চিত্রায়নের সঙ্গে সমরেশ বসুর 'তিন পুরুষ' (১৯৮৬) ও 'শেকল ছেঁড়া হাতের খোঁজে' (১৯৮৪)উপন্যাসের প্রথমটিতে গান্ধীবাদী প্রথম পুরুষের পরে মার্কসবাদী দ্বিতীয় পুরুষের হাতে তাঁর এককালের অনুগামী মার্কসবাদী হয়েও তৃতীয় পুরুষের নিগ্রহের কথা, অথবা দ্বিতীয় উপন্যাসটিতে শ্রমিকের ঘরের থেকে আসা শ্রমিকনেতা নওয়াল আগারিয়ার পার্টি সম্পর্কে মোহভঙ্গের কথাকে। 'শেকল ছেঁড়া হাতের খোঁজে' উপন্যাসের সঙ্গে সমরেশ বসুর প্রিয়বন্ধু গৌরকিশোর ঘোষের ‘সাগিনা মাহাতো’ গল্পের বড় যে মিল! পার্টিজান সাহিত্যের দ্বিমেরুকরণে পুরসমাজের স্থান কোথায়? সমাজ/রাষ্ট্রে, পুরসমাজে, খণ্ডে-সমগ্রে, মেলানোর মশলার সন্ধান দেওয়ার চেষ্টা করতেন দেবেশ! চলে গেলেন!
অমর্ত্য মুখোপাধ্যায়, প্রাক্তন অধ্যাপক ও ডিন (আর্টস); কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা
বাংলাদেশ সময়: ১৪১২ ঘণ্টা, মে ১৬, ২০২০
টিএ