ঢাকা, বুধবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

সাক্ষাৎকার

তৃপ্তি সান্ত্রা'র সঙ্গে একটি বিকেল

সৌমনা দাশগুপ্ত, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১৪৬ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১, ২০২০
তৃপ্তি সান্ত্রা'র সঙ্গে একটি বিকেল লেখক তৃপ্তি সান্ত্রা

বিশিষ্ট লেখক তৃপ্তি সান্ত্রা ২০২০ সালে লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি ও গবেষণাকেন্দ্র (কলকাতা) থেকে ‘ছোটগল্পকার সম্মাননা’র জন্য নির্বাচিত হয়েছেন। তাঁর কাছে আমরা জেনে নেব তাঁর লেখকজীবনের অন্তর্গত বোধ ও দ্বন্দ্বের কাহিনি।

যদিও বাংলা সাহিত্যের জগতে এই লেখকের অবদান নিয়ে নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না, তবুও সংক্ষিপ্ত পরিচিতি দিলে পাঠকের তাঁকে বুঝতে আরও একটু সুবিধে হবে।
 
তৃপ্তি সান্ত্রার জন্ম ২ জানুয়ারি, ১৯৫৬ সালে মালদা জেলাশহরের সদর হসপিটালে। বাবা সুরেশচন্দ্র সান্ত্রা, মা বেলা সান্ত্রা। আদি নিবাস রাজশাহী। পেশা শিক্ষকতা।

গল্পের বই আছে পাঁচটি – অষ্টমীটোলা (২০০৬, অমৃতলোক), দশটি গল্প ২০০৭, পরশপাথর), রাত রোয়াকে বুদবুদ যাপনের ২৫ আখ্যান(২০১৪, গাঙচিল), অষ্টমীটোলা ও ৫০টি গল্প(২০১৯, পুনশ্চ), তৃপ্তি সান্ত্রার গল্পবই (২০২০, শুধু বিঘে দুই, আলপথ সিরিজ)। উপন্যাস লিখেছেন দুটি-- চিরকুট(২০০৭, অমৃতলোক), চুড়েইল (২০১৭, ঐহিক)। কলাম-এর বই দুটি -- ছোপছোপ কাটাকুটি(২০১৮, পুনশ্চ), মেয়েদের চোরাগোপ্তা স্ল্যাং, শরীর এবং অন্যান্য  আলাপ(২০১৯, কারিগর)। দুটি অনুবাদের মধ্যে আছে--- এক যে ছিল রাজকইন্যা (আ প্রিন্সেস রিমেমবারস) (২০১০, সবাই জয়সিঙ্ঘ বেনিভোলেন্ট ট্রাস্ট, জয়পুর), এবং  উত্তরবঙ্গের রাজবংশী (চারুচন্দ্র সান্যালের দ্য রাজবংশীজ অব নর্থবেঙ্গল) (২০১৮, আনন্দ পাবলিশার্স)। কবিতার বই বেরিয়েছে চারটি- কত দীর্ঘ হলে মূল (১৯৮৭, জোয়ার), নিষাদ কলম (২০০৫, কাগজ প্রকাশন, কলকাতা), তৃষার শব্দকোষ(২০০৭, অমৃতলোক), ছোপছোপ কাটাকুটি(২০১১,অমৃত লোক)।
 
কবিতা পাক্ষিকের মঞ্জুষ দাশগুপ্ত নামাঙ্কিত পুরস্কার, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের ইলা চন্দ স্মৃতি পুরস্কার, ২০০৬, গল্পমেলা পুরস্কার,২০১৭, হিতেন নাগ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার, ২০১৭, সান্নিধ্য স্মারক সম্মাননা, ২০১৬, কবি দিলীপ তলোয়ার স্মৃতি সম্মাননা, ২০১৯ এবং সর্বশেষ ঐহিক সম্মাননা, ২০১৯ পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।

বাংলানিউজের পক্ষে তাঁর মুখোমুখি হয়েছিলেন কলকাতার কবি-সমালোচক সৌমনা দাশগুপ্ত। যশস্বী এই লেখককে রাখা হয় কিছু প্রশ্ন:
সাক্ষাৎকারগ্রহীতা কবি সৌমনা দাশগুপ্ত’র সঙ্গে তৃপ্তি সান্ত্রা
                                            সাক্ষাৎকারগ্রহীতা কবি সৌমনা দাশগুপ্ত’র সঙ্গে তৃপ্তি সান্ত্রা

১. তোমার প্রথম বই কত দীর্ঘ হলে মূল (১৯৮৭) তো কবিতার। কবিতা থেকে গদ্যে সরে এলে কেন?

--গদ্য দিয়েই আমার লেখকজীবন শুরু। ইস্কুলজীবন থেকেই রম্য রচনা, গল্প লিখেছি। কলেজজীবনে কবিতা লেখার শুরু। প্রথম বই কবিতার, কিন্তু কবিতা থেকে গদ্যে সরে এলাম এটা ঠিক নয়।
 
২. তোমার প্রথম ও দ্বিতীয় বইয়ের প্রকাশকালের মধ্যে এতটা ব্যবধান, সেটা কি এই মাধ্যম পরিবর্তনের কারণে, না কি আরও কিছু কথা সময়ের ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে আছে?
 
--প্রথম কবিতাবই কত দীর্ঘ হলে মূল প্রকাশিত হয় ১৯৮৭ সালে আর প্রথম গল্পবই অষ্টমীটোলা প্রকাশ পায় ২০০৬ সালে। দীর্ঘ উনিশ বছর... এক জন লেখকের মরে যাওয়ার পক্ষে যথেষ্ট সময়। বই প্রকাশ হয়নি মানে যে লিখিনি তা কিন্তু নয়। স্থানীয় পত্রিকায়, কলকাতায়, বাইরে লিখেছি। ছেলেমেয়েদের বড়ো হওয়া, বাড়িঘর, চাকরি.. সব নিয়ে নাকাল ছিলাম বড়ো। কবিতা হচ্ছিল না। সমাজ, রাজনীতি, সংস্কৃতি নিয়ে ভাবনাচিন্তা নিজের মতো করে লিখি। শুধু মাত্র মধ্যবিত্তের ড্রয়িং রুমের গল্প লিখবো না, এর জন্য ফিল্ড ওয়ার্ক দরকার। লোকসংস্কৃতি নিয়ে গবেষণার কথাও ভেবেছি।
 
৯৮ সালে ভয়ংকর ভাঙ্গনে আমার জেলা, আমরা বিধ্বস্ত হই। গল্প লিখছি তখন। মফস্বল শহরে বসে বইয়ের স্বপ্ন দেখার কথা ভাবিনি। আমাদের পরিবারে কেউ লেখক ছিলেন না। লেখক হয়ে ওঠার
সম্বন্ধে আমার কোনো্ ধারণা ছিল না। সময়ের সাথে সাথে কথা জমেছে। ভালো লাগা মন্দ লাগা প্রতিবাদ স্বপ্ন---এ সব নানাভাবে প্রকাশ করেছি। গদ্যে, ফিচারে, অনুবাদে----এসবই যেন মরে যে যাইনি, তা জানান দেওয়ার চেষ্টা! এ দিয়ে কী ভালো কিছু হয়!
 
তবে ওই যে নামডাক, পুরস্কার এসবের তেমন মোহ না থাকায়, দূরে,মহানগরের ঠেকে না গিয়েও ওই নিজের মতো করে গৃহিণীপনা ছাড়াই লেখার চেষ্টা করে গেলাম।

৩. তুমি এবারে কলিকাতা লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি ও গবেষণাকেন্দ্র থেকে ‘ছোটগল্পকার সম্মাননা’ পেলে, কেমন লাগছে?
 
--আমি মূলত লিটল ম্যাগাজিনের লেখক; তাই এই পুরস্কারে আমি সম্মানিত। হঠাৎ করেই এই পুরস্কারের ঘোষণা... ২৩শে জুন, পত্রিকার জন্মদিনে। সন্দীপদার এই লাইব্রেরি আর গবেষণাগারের
সঙ্গে অনেকদিন ধরেই পরিচিত। পুরস্কার ঘোষণার পর মনে পড়ছিল, আমার প্রথম প্রকাশক, 'অমৃতলোক’-এর সম্পাদক সমীরণ মজুমদারের কথা। আমার শহরের যে ম্যাগাজিনে প্রথম
লিখেছি, সেই ‘অঙ্গন’ আর তার সম্পাদক পিনাকীরঞ্জন চৌধুরীর কথা। আমার একনিষ্ঠ পাঠক, সমালোচক পলুদার কথা। এঁরা কেউ নেই।
 
৪. তোমার অনেক লেখা এবং বই তথাকথিত প্রাতিষ্ঠানিক প্রকাশনীর থেকে ছাপা হয়েছে। কিছু কিছু বহুলপ্রচারিত দৈনিক পত্রিকায় মোটামুটি নিয়মিত লেখালিখি কর। তুমি নিজেকে কোন ঘরানার লেখক বলে মনে করো, মূল ধারার নাকি সমান্তরাল ধারার?
 
--তথাকথিত প্রাতিষ্ঠানিক প্রকাশনী থেকে আমার যে বইটি প্রকাশ পেয়েছে সেটির বিষয় অপ্রাতিষ্ঠানিক.. প্রান্তজনের কথা। মূল ধারা, সমান্তরাল ধারার গোলকধাঁধায় না গিয়ে বলা যায়, আমি নিজের মতোই লিখেছি। মূল ধারার বা সমান্তরাল স্রোতে মিলবার জন্য নিজের লেখা পাল্টে ফেলিনি। তারা পরিবর্তন করতে চাইলে, তা করতে অস্বীকার করেছি।

প্রশ্নটির দ্বিতীয় অংশটির উত্তরে বলি, এই যে নিজের লেখাটা লিখে যাওয়া, কে বা কারা ছাপলেন, সেকথা না ভেবে কাজ করে যাওয়া, এই সময়ে কি এটার অভাব দেখা যাচ্ছে না?  এই সময়ে যোগাযোগ, প্রকাশ, আত্মপ্রকাশের অনেক সুযোগ। সেই জন্যই হয়তো মনে হচ্ছে দায়বদ্ধতার অভাব। চাপটা প্রতিযোগিতার নয়। নিজের কথাটা নিজের মতো করে বলার দক্ষতা অর্জনের।

৫. তোমার লেখায় বারবার প্রান্তিক মানুষ-জনের কথা উঠে আসে, এর জন্য কি তোমাকে আলাদা করে ক্ষেত্রসমীক্ষা করতে হয়, নাকি তোমার যাপনপ্রণালী থেকেই পেয়ে যাও এধরনের লেখার রসদ?

--আমি কলোনিবাসী, শহুরে মানুষ। তবে আমাদের সে-পৃথিবী প্রকৃতিবিচ্ছিন্ন, হেটোমেঠো মানুষবিচ্ছিন্ন নয়। বিমলাদি, হরিদাসী, কুঞ্জলাল, মাংসওয়ালা ইজ্জৎ, গণপতি বাদামওয়ালা, মুদিভূষণদা, কেদারজী-- এদের সান্নিধ্যে খুব আনন্দে দিন কেটেছে আমাদের। গাছ, নদী, খোলা মাঠ, কলেজের পুকুর, বিবির পুকুর, মহানন্দা..সবাই বন্ধু। নদীভাঙন পর্বে ক্ষেত্রসমীক্ষার প্রয়োজনে বারবার গ্রামে গেছি, থাকতেও হয়েছে। স্কুলপাড়ায় বিভিন্ন বৃত্তির মানুষ। ছাত্রীরা আসে বিভিন্ন আর্থসামাজিক অবস্থা থেকে। লোকসংস্কৃতি নিয়ে কাজ করার ইচ্ছে ছিল। বিভিন্ন শিল্পীর সান্নিধ্যে এসেছি। এদের যাপন-প্রণালী, হর্ষবিষাদ উঠে এসেছে লেখায়। মান্য সমাজের প্রেম, ভালোবাসার গল্প লেখার চাইতে, মাটিসংলগ্ন জীবনের কথা লিখতে চেয়েছি।

৬. আমি দেখেছি, তুমি খুব সহজে মানুষের সঙ্গে মিশে যেতে পার, মানে ধরো, কোথাও কয়েক ঘন্টার জন্য বেড়াতে গেলে, সেখানকার সাধারণ মানুষের সঙ্গে তুমি দিব্যি ভাব জমিয়ে ফ্যালো, এর রহস্য কী?

---রহস্য ভেদ করার জন্য তো গোয়েন্দা লাগাতে হবে!পাতা বলে একটা কথা আছে জানিস তো, মানে ভালো মাধ্যম। সূক্ষ্ম শরীর কেও ধরতে পারে। তো আমার আটপৌরে চেহারা, খোলামেলা কথাবার্তার জন্যই কী না জানি না, মানুষ খুব তাড়াতাড়ি আমাকে আপন করে নেয়। আলাপের দশ মিনিটের মধ্যে, গোপন কথা বলে হাল্কাও হয়েছেন কত জন। এটা আমার বড়ো পাওয়া।
 
৭. এই যে সহজেই মানুষের সঙ্গে মিশে যাওয়া,  এটা নিশ্চয়ই তোমার লেখার ক্ষেত্রে সহায়ক হয়, তুমি কী বলো?
 
হ্যাঁ। তা হয় বৈকি! খুঁটিনাটি কাছ থেকে দেখাশোনা। আর এক রকম নয়; কত রকম মানুষের রোদ আর ছায়া...অনুরণন আনে। সেটা না হলে লেখা হয় না।

৮. তোমার বইগুলো পড়তে গেলে দেখি, তুমি ঠিক গোল গল্প যাকে বলে, সেটা কোনোদিনই লেখোনি। বাণিজ্যিক গল্প লিখলে তো খুব সহজেই অনেক প্রচারিত হতে পারতে, কেন?
 
প্রচারিত হতে পারার জন্যই কি লেখা। একটা পৃথিবী। দৃশ্যজগত। কালখন্ডে যে ভাবে আসে। আমি যে ভাবে অনুভব করি। সে ভাবেই প্রকাশ। জীবন ঠিক ঠিক রেখে বাক্য গঠন নয়। অনেকেই এই রকম ভাবেন নিশ্চয়ই, তা না হলে আমার সে সব ছাইপাঁশ তাদের ভালো লাগেই বা কেন!

৯. এক স্বতন্ত্র গদ্যভাষায় তুমি লেখ, কীভাবে অর্জন করলে এই ভাষা, তার ইতিহাস কি একটু বলবে?
 
---পঠন প্রিয় ছিলাম। এখনও বই-ই সংগী। গল্প উপন্যাসের পাশাপাশি প্রবন্ধ নিবন্ধ তত্ত্বালোচনা  সিনেমা নাটক বইরিভিউ। কিন্তু এই যে নানা কিসিমের মানুষের সাথে মেলামেশা, কলোনির আমুদে জীবনের গম্ভীরা নাটক যাত্রা পালা সিনেমা সিনেমা সিনেমা এবং আড্ডা আড্ডা আড্ডা আর তাফাল তাফাল তাফাল... এ সবেই বোধহয়...

১০. তোমার গল্প উপন্যাসে বারবার নারীদের কথা এসেছে, আবার একইসঙ্গে পুরুষের যন্ত্রণার কথাও পেয়েছি, সেক্ষেত্রে নারীবাদের সংজ্ঞা তোমার কাছে কীরকম?
 
নারীবাদ মানে ঠিক পুরুষের বিরুদ্ধে আন্দোলন নয়। পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে কথা বলা। পিতৃতন্ত্র একটি সিস্টেম (system)। পিতৃতন্ত্রের নিগড়ে নারী পুরুষ সবাই এক,  একরকম ভাবে নির্মিত। তৃতীয় তরঙ্গের (Third Wave) দার্শনিক জুডিথ বাটলার (Judith Butler) যাকে বলেছেন, ‘Gender as Social Construction’. লিঙ্গ নির্মাণ একটি সামাজিক প্রক্রিয়া, আর সেই মতো নারী বা পুরুষ হিসেবে অভিনয় করে যেতে হয়। নারী যেমন পরিবারের জন্য বলিপ্রদত্ত। পুরুষ রাষ্ট্রের জন্য বলিপ্রদত্ত। সমাজনির্ধারিত পাঠক্রম মেনে, সে যদি পুরুষ হতে না চায় বা না পারে, সে তবে মূল্যহীন। শারীরিকভাবে, উপার্জনকারী হিসেবে, যৌনতায় তার অবস্থান সব সময় নারীর ওপরে হতে হবে। তো পৌরুষের এই নির্মাণই নারীস্বাধীনতার অন্তরায়। ক্রমশ আমরা উপলব্ধি করছি যে,  পুরুষ এবং পৌরুষ সম্বন্ধে দৃষ্টি দেওয়া জরুরি। এটি পুরুষের বিরুদ্ধে আন্দোলন নয়, পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে আন্দোলন। পুরুষদেরও এই আন্দোলনে সামিল হতে হবে, কারণ এই ব্যবস্থায় শুধু নারীরাই ক্ষতিগ্রস্ত হয় না, তা একইভাবে পুরুষদের ক্ষতি করে।
 
এক কথায় নারীবাদের সংজ্ঞা বলা যায় না। সাম্প্রতিক বিভিন্ন আন্দোলন ‘Not in my Name’, ‘me Too’, ‘Black Life Matters’ থেকে এর ‘intersectionality’ বোঝা যায়। শ্রেণী, বর্ণ, জাতি, ধর্ম--- এসব দিয়েই নারীবাদের সংজ্ঞা নির্মিত।
 
কোনো তত্ত্ব না পড়েই… এই সব সত্য অনুভব করার মতো কাণ্ডজ্ঞান আমার ছিল, তাই বোধ হয় আমার লেখায় নারী-পুরুষ, সবার যন্ত্রণার কথা আসে।
 
১১. তোমার লেখায় এক অন্য পৃথিবীর খোঁজ থাকে, পুঁজিবাদ, পণ্যবাদকে হঠিয়ে এক সুন্দর সাম্যের পৃথিবীর কথা থাকে, তুমি কি মনে কর এটা আদৌ সম্ভব? আর কেনই বা তোমার লেখায় ফিরে ফিরে এই স্বপ্নের কথা আসে?
 
---কী যেন বলে.. আয় রে তবে ভুলের ভবে অসম্ভবের ছন্দেতে.. পুঁজিবাদ-পণ্যবাদকে হঠিয়ে এক সুন্দর সাম্যের পৃথিবী আনা--- এ অনেক শতাব্দীর মনীষার কাজ। মানুষের কাজ। কঠিন। তাই কি স্বপ্ন আমরা দেখব না? মূলত কলোনিয়াল শিক্ষিত, উচ্চবর্ণের ভারতীয় বাবুশ্রেণীর হাতে সাহিত্য চলে যাওয়ায়, যে জীবন সাহিত্যে প্রতিফলিত হয়, তা উচ্চবিত্তের ধনীজীবন, উচ্চাকাঙ্ক্ষী মধ্যবিত্তজীবন। নিম্নবর্ণের কণ্ঠ তৈরি হল কই!
 
উত্তর-ঔপনিবেশিক কালখণ্ডের দুটি অনিবার্য জরুরি প্রক্রিয়ার নাম উন্নয়ন ও উচ্ছেদ। উন্নয়নে ক্ষতিগ্রস্ত নিম্নবর্গ। উচ্ছেদে বিপর্যস্ত নিম্নবর্গ। তাঁদের দরকার প্রতিরোধের, প্রত্যাখ্যানের ভাষা। সেই ভাষের খোঁজেই আমি অন্য ভুবনে সামান্য চোখ রেখেছি।
 
কিন্তু সাম্যবাদী পৃথিবী ছাড়া আর অন্য কোন শীততাপনিয়ন্ত্রিত ধনতান্ত্রিক পৃথিবী চাইবো আমরা! নিজেদের বাঁচার তাগিদেই এই স্বপ্ন দেখার প্র্যাক্টিস চালিয়ে যেতে হবে। লড়াইয়ের আঁচটা তো থাক।

১২. মেয়েদের লেখায় সমকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতির কথা কতটা উঠে আসে বলে তুমি মনে কর?
 
‘Personal is political’ বললে, মেয়েদের সব লেখাই রাজনৈতিক। জোকস অ্যাপার্ট, রাজনৈতিক উপন্যাস অনেকেই লিখেছেন। সাবিত্রী রায়, সুলেখা সান্যাল, মহাশ্বেতা দেবী ও জয়া মিত্ররা। সমকালীন রাজনীতি নিয়ে লিখতে গিয়ে নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনীতির সুবিধাবাদ ও অন্তঃসারশূন্যতাকে তীব্র ব্যঙ্গে ক্ষতবিক্ষত করেছেন মহাশ্বেতা দেবী। জয়াদির উপন্যাস ‘মাটির শিকড়বাকড়’, ‘কালো সাদা বাতাস’ মূলতঃ Political Philosophy। অনীতা অগ্নিহোত্রীর ‘কাস্তে’, ‘মহানদী’, ‘মহাকান্তার’ রাষ্ট্রের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক নিয়ে রাজনৈতিক উপন্যাস। সাতের দশকের ‘বসন্তের বজ্রনির্ঘোষ’-এর শব্দ আজ বিলীয়মান। বিশ্বায়নের ধাক্কায় তছনছ পৃথিবী। এই ধাক্কায় গতানুগতিক পদ্ধতি পাল্টে যায়। আধুনিক থেকে উত্তর-আধুনিক! নতুন সময়ে তন্বী হালদার লিখেছেন ‘এই মেয়েটা ভেলভেলেটা’। তৃষ্ণা বসাক লিখেছেন ‘অর্জিত সিং ভার্সেস অজিত সিং’। সমকালীন রাজনীতি নিয়ে লেখা কঠিন। অভিজ্ঞতা, সাহস সর্বোপরি কাণ্ডজ্ঞান প্রয়োজন। ছেলেদের রাজনৈতিক উপন্যাসও তেমন কই?

 ১৩. তুমি তো উত্তরবঙ্গে থাক, কলকাতার লেখকগোষ্ঠির সমস্যা ও তোমার সমস্যা দুটোকে কীভাবে দেখবে?
---লিখতে পারাটাই সমস্যা। লেখাটা লেখা হয়ে ওঠাই সমস্যা।

১৪. প্রতিষ্ঠান বা পুরস্কার একজন লেখকের সৃজনীশক্তিকে উসকে দেয় না ক্ষয় করে দেয়?

--প্রতিষ্ঠানে নেই, বলতে পারব না। পুরস্কার পেলে খারাপ লাগার কথা নয়। লোকজন না পড়লেও বোঝেন, ও তবে কিছু একটু লেখে! তবে সৃজনকর্ম অবিরাম পরিশ্রম। যন্ত্রণা। শেষে আনন্দও।

১৫. এমন কোনো গল্প বা উপন্যাসের নাম বলতে পার, যেটা লেখার পর তোমার মনে হয়েছে তোমার সর্বোচ্চ সীমা ছুঁয়ে ফেলেছ বা এই লেখা তোমার জীবনের ল্যান্ডমার্ক হয়ে থেকে যাবে?
 
---ল্যান্ডই থাকবে না পৃথিবীর! তো মার্ক! ওসব কিছু হয়নি। লেখা শেষে তৃপ্তি – সে আসলে না পাওয়ার মতোই দুরূহ!!
 
১৬. সবশেষে তোমার লেখা, তোমার গল্পলেখা নিয়ে কিছু বলো, যাতে করে পাঠক ও তোমার মধ্যে কিছুটা হলেও পারস্পরিক বোঝাপড়া তৈরি হয়।

---মনে হয় পাঠকও খানিকটা লেখক তাই খুব গোল করে কিছু বলতে চাই না। নাকি পারি না! কম্পাস ছাড়া খালি হাতে খুব চমৎকার গোল করতেন GD...লোম লোম পুরুষালী হাত। স্টিল ব্যান্ডের ঘড়ি। চক ঘুরিয়ে বৃত্ত একেঁ ফেলছেন...সেই বৃত্তে দলবেঁধে ঢুকে যাচ্ছে দীপক, রজো, মৃণাল...মেয়েরা আবেগ জড়িয়ে ভিজিয়ে ফেলছে রাত...গোল তো হলই না, ঝলসানো চাঁদও না। রুটি! তা কী গোল!গোল। গোলতর। গোলতমর জন্য। উফ!সে-কী-কী-কী-প্র‍্যাকটিস...!
 
দূর অত খাটে কে! এসো একটা খেলা খেলি। গোল খেলা নয়। বিন্দু একটা...সে গোল হবে না চৌকো। সরলরেখা। না বক্ররেখা। না কিছু হবে না...এই সব ভাবতে ভাবতেই দলবেঁধে নদীরা চলে এলো। রাঙাতি ফুলহার থেকে কর্ণাবতী সবাই। যামিনী সুলোচনা বিমলা চায়না থেকে বিবি শিখা ইরাবতী। ও বাব্বাঃ! সবই যে পরমা প্রকৃতি...ব্যাটাছেলে নেই বুঝি! না-না-আছে তো! নাম শুনে ভাবছো বুঝি ওরা মেয়ে! শুধু মেয়ে শুধু ছেলে হয় নাকি! এও খানিকটা ও। ও-ও খানিকটা এ। আছে কিন্তু বেশি নেই। আসলে সবাই এতো গোলে ঢুকে পড়ছি। এক ছাঁদ। এক প্রাণ। ওসব আর কী লেখার! দু'এক পিস দিব্য। দীপন। ডাক্তার। আছে। ঝড়-ঝঞ্‌ঝা আবেগ-প্রতিবাদ-বিপ্লব-কান্নাকাটি-পলিটিক্যালি-কারেক্ট-কিসস্যা পেরিয়ে জমি নিড়ানি দেবার অধ্যাবসায়। সব্জি কাটার দক্ষতা। কী চমৎকার কাপড় মেলে অদ্বৈত। আর অত নারী পুরুষ কী! সব নিয়েই ভুবনেশ্বরী। ভুবন ভাবলে ভুবন। ঈশ্বরী ভাবলে ঈশ্বরী। আছি তো সেই ভিটেমাটি চাটির থাবার নিচে। পাঠক্রমে একবার পুব থেকে পশ্চিম আর একবার পশ্চিম থেকে পুবে খালি পা ফোস্কা সয়ে হাঁটার ভুবনায়ন।
 
মানুষ সর্বশ্রেষ্ঠ এই ফ্লুক থেকে বেরিয়ে একটা বটগাছ। একটা রাজগোখরো। একটা নিশিকাওন মাঠ। একটা মেয়েলি ঋতুস্রাবের কানি। কোটিকোটি স্মার্ট জীবাণুমুক্ত এসেনশিয়াল প্রোডাক্টের চিৎকারের
নিচে কাঁথাকানি ন্যাকড়া অপরের বাতিল কথাগুলির হোলটাইম ওয়ার্কার...এই তো গল্প। লেখা। আমি। আমাদের। একাকী। সমবেত। যাপন প্রয়াস...!

বাংলাদেশ সময়: ২১৩০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০১, ২০২০

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।