ঢাকা, বুধবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

সোভিয়েত ঐতিহ্যকে ভিত্তি করে এগিয়ে চলেছে রাশিয়া (২)

শামীম খান | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯৪১ ঘণ্টা, জুন ১৫, ২০২১
সোভিয়েত ঐতিহ্যকে ভিত্তি করে এগিয়ে চলেছে রাশিয়া (২)

সম্প্রতি তিনি রাশিয়া ভ্রমণ করেছেন। পাঠকের জন্য তিনি তুলে ধরেছেন সেই ভ্রমণের অভিজ্ঞতা আর রাশিয়ার এগিয়ে চলার খণ্ড খণ্ড চিত্র।

আমরা তা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করব। আজ থাকছে এর দ্বিতীয় পর্ব।


আমার রাশিয়া যাওয়ার বিষয়টি যখন ঠিক হয়, তখন নিজের মধ্যে অন্যরকম একটি অনুভূতি কাজ করেছে। আমি আগেই রাশিয়ার প্রতি আকর্ষণের কথা উল্লেখ করেছি। ছোটবেলা থেকে রাশিয়ার প্রতি এই আকর্ষণ তৈরি হওয়ার পেছনে কিছু কারণ রয়েছে। আমার মেজ কাকা দেলোয়ার হোসেন খান (সাংবাদিক) কমিউনিস্ট পার্টি করতেন। সেই সুবাদে ছোটবেলা থেকেই রাশিয়া (তৎকালীন সোভিয়েত ই্উনিয়ন) সংক্রান্ত বই, পত্র-পত্রিকা বিশেষ করে মার্কসবাদ-লেনিনবাদের ওপর মস্কো থেকে আসা প্রগতি প্রকাশনীর বই (অ আ ক খ), উদয়ন ইত্যাদি বইপত্র বাড়িতে দেখতাম। প্রথম দিকে এগুলো উল্টে পাল্টে ছবি দেখার প্রতি আকর্ষণ ছিলো। এছাড়া এই বইপত্রের উন্নত কাগজ যা ওই সময় অন্য বইপত্রে ক্ষেত্রে দেখিনি অর্থাৎ এসব বইয়ের কাগজও ছিলো দেখার মতো। পরবর্তী সময়ে কমিউনিস্ট পার্টির সংস্পর্শ ও ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত হওয়ার সূত্রে রুশ বিপ্লবের ঘটনা সম্পর্কে নেতাদের মুখে শোনা, বইয়ে পড়া এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন সম্পর্কিত বই পত্র, রুশ সাহিত্য পড়ার মধ্য দিয়ে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি এই আর্কষণের জন্ম নেয়। মস্কো থেকে প্রতি মাসে প্রকাশিত ম্যাগাজিন ”উদয়ন” এর আমি বার্ষরিক গ্রাহকও হয়েছিলাম। সোভিয়েত ইউনিয়ন ঘুরে আসা কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) নেতা যিনি বৃহত্তর ফরিদপুর অঞ্চলে চারণ কমিউিনিস্ট হিসেবে পরিচিত ছিলেন, সেই মোকলেছ কাকার (কমরেড অধ্যক্ষ মোকলেছুর রহমান) কাছ থেকে রাশিয়া সম্পর্কে জেনেছি। সোভিয়েত ইউনিয়ন ঘোরা রাজবাড়ির ন্যাপ নেতা (পরে আওয়ামী লীগ নেতা) আব্দুস সাত্তার, রাজপাড়ির সিপিবি নেতা আবুল কালাম, এদের কাছ থেকেও তাদের দেখা সোভিয়েতন ইউনিয়নের অনেক কথা শুনেছি। এর পর বিশ্ব রাজনীতির পট পরিবর্তন ঘটে। ১৯৯১ সালে সোভিয়েতে ইউনিয়নে সমাজতন্ত্রের বিপর্যয় এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যায়।

সোভিয়েত ভেঙে যাওয়ার পর ওই সময় পূর্ব ইউরোপেও একের পর এক সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতে রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হয়ে পুঁজিবাদের পথে যাত্রা শুরু করে। সোভিয়েত ভাঙার ধাক্কা বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটও পরিবর্তন করে দেয়। সোভিয়েতপস্থি বলে পরিচিত বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টিসহ (সিপিবি) বামপন্থি দলগুলোর ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। কোনো কোনো উদারপন্থি বা মধ্যপন্থি বা বাম ঘেঁষা যাই বলা হোক না কেন, সেসব দলেরও ডানের দিকে ঝোঁক বাড়ে। অনেক পরীক্ষিত নেতাকে কমিউনিস্ট মতাদর্শ পরিত্যাগ ও পার্টি পরিবর্তন করতে দেখা যায়। এই পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে অনেকের বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন হারিয়ে গেছে। আবার কোনো কোনো নেতাকে শেষ জীবনে কমিউনিস্ট পার্টিতে ফিরে আসতেও দেখেছি। শুধু তাই নয়, এমন একজন নেতার কথা শুনেছি যিনি কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন, সোভিয়েতের বিপর্যয়ের পর পার্টি ত্যাগ করেছিলেন। কিন্তু মৃত্যুর আগে হাসপতালে শয্যাশায়ী ওই নেতাকে সিপিবির শীর্ষ পর্যায়ের এক নেতা দেখতে যান। তখন তিনি তাকে দেখতে যাওয়া সিপিবির ওই নেতার কাছে ইচ্ছা ব্যক্ত করেছিলেন, মৃত্যুর পর তার ডেড বডিটা যেনো শেষবারের মতো কমিউনিস্ট পার্টি অফিসে নেওয়া হয়। কিন্তু তার মৃত্যুর পর সেটা আর সম্ভব হয়নি। কারণ তিনি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত অন্য একটি দলের পদে ছিলেন।  

সোভিয়েত ভেঙে পড়ার পর বিশ্ব পরিস্থিতি, আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বিরাট পরিবর্তন আসে। যে ১৫টি প্রজাতন্ত্র নিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল, সমাজতন্ত্র থেকে সেগুলো সরে গিয়ে রাশিয়াসহ প্রত্যেকটি আলাদা আলাদা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে। এখন সোভিয়েত ইউনিয়ন নেই কিন্তু সোভিয়েত আমলের ভিত্তিকে ধারণ করেই এগিয়ে চলেছে রাশিয়া। সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের অনুপস্থিতিতেও সোভিয়েত আমলে রাশিয়ার শিক্ষা, শিল্প, সংস্কৃতি, জ্ঞান, বিজ্ঞান, প্রযুক্তিসহ সর্বক্ষেত্রে যে ভিত্তি তৈরি হয়, সেই সময়ের প্রতিষ্ঠিত সকল ভিত্তি আর ঐতিহ্যকে ধারণ করেই এগিয়ে চলেছে আজকের রাশিয়া। কয়েক দিন রাশিয়া ঘুরে যতটুকু দেখেছি এবং মানুষের সাথে কথা বলে যতটুকু জানতে পেরেছি, তাতে সেটাই মনে হয়েছে।  

৯ ডিসেম্বর স্থানীয় সময় দুপুরে মস্কো পৌঁছানোর পর এয়ারপোর্ট থেকে বের হতেই প্রথম ধাক্কা হিমাঙ্কের নিচে (মাইনাস ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস) তাপমাত্রা। আমাদের দেশে আমরা শীতে যে ধরনের পোশাক ব্যবহার করি সেই সাধারণ শীতের পোশাকে ওখানে ৩/৪ মিনিটের বেশি অবস্থান করা সম্ভব ছিলো না। এয়ারপোর্টে আমাদের রিসিভ করতে এসেছিলো রোসাটমের দক্ষিণ এশিয়ার পাবলিক রিলেশন (জনসংযোগ) ম্যানেজার ম্যাক্সিম সিসভ। রাশিয়ায় যে কদিন অবস্থান করেছি ম্যাক্সিম সার্বক্ষণিক আমাদের সঙ্গে থেকেছেন এবং সহযোগিতা দিয়েছেন। এ সময় ম্যক্সিমও আমাদের বার বার শীতের ভারী পোশাক পরার তাগিদ দিচ্ছিলেন। বলতে গেলে মাত্র একটি ছবি তোলার পরই আমরা প্রত্যেকে মোটা জ্যাকেট বের করে দ্রুত গায়ে চাপাতে বাধ্য হই। আমাদের হ্যান্ড সেটে তখন ইন্টারনেট সংযোগ সম্ভব ছিলো না। তাই ম্যক্সিমের কাছে তাপমাত্রা জানতে চাইলে সে তার  হ্যান্ডসেট দেখে জানালো মাইনাস ৫ ডিগ্রি, ফিল লাইক মাইনাস ৮ ডিগ্রি। যদিও রাশিয়ায় সারা বছরই শীত থাকে। ডিসেম্বরের এই সময় মাইনাস ৫ তাপমাত্রা সে দেশের মানুষের জন্য খুব একটা অস্বাভাবিক বিষয় নয়। কিন্তু আমাদের জন্য অস্বাভাবিক, তবে নিশ্চয়ই সেটা উপভোগ্য ছিলো। অভিজ্ঞতা নেওয়ার একটা অনুভূতিও তখন কাজ করছিলো। পরে এই তাপমাত্রা আরও নিচে নেমেছে। যদিও এতো বেশি ঠাণ্ডার মধ্যে যাওয়ার পূর্ব অভিজ্ঞতা আমার ছিলো না। এর আগে ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে গিয়েছিলাম দার্জিলিংয়ে, ওই সময় সেখানে একদিন সন্ধ্যা থেকে সকাল ৮/৯টা পর্যন্ত মাইনাস ১ ডিগ্রি তাপমাত্রা পেয়েছিলাম।  

আমরা তিন সাংবাদিক; আমি, আলী আসিফ শাওন ও শয়িত খান সেখানে গিয়ে এতো শীতের মধ্যে পড়বো ভাবতে পারিনি। যেদিন সেখানে গেলাম সেদিন ছিলো ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবস, সরকারি ছুটি। শুধু তাই নয়, দোকানপাট সব কিছুই বন্ধ। এমনকি ওয়াইন শপও বন্ধ। যদিও ঘুরতে ঘুরতে এক মুদি দোকান খোলা পেয়েছিলাম, সেখান থেকে নির্ধারিত দামের চেয়ে একটু বেশি দিয়েই এক বোতল কিনতে হয়েছিলো। সেখানে মুদি দোকানেও ওয়াইন বিক্রি হয়, এমনকি পর্যটন স্পটগুলোতে যে সব খাবারের দোকান (রেস্টুরেন্টের মতো) রয়েছে সেখানেও পাওয়া যায়।  

এরপর একবার শিলংয়ে ঘুরতে গিয়ে কলকাতার একজনের সাথে কথা হচ্ছিলো। সেও শিলংয়ে ঘুরতে এসেছে। আমরা ঢাকা থেকে এসেছি জানতে পেরে হাসতে হাসতে আমাদের জানালো, সে ঢাকায় বেড়াতে গিয়ে দুই ঘণ্টা ঘুরেও কোনো বার খুঁজে পায়নি। দার্জিলিংয়ে পরদিন ভোরে আমরা গিয়েছিলাম টাইগার হিলে, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এটি প্রায় ৯ হাজার ফুট উঁচু। মাইনাস ১ ডিগ্রি তাপমাত্রার মধ্যে সেখানে গিয়ে আমরা গাছের দুই একটি পাতার ওপর লবণের মতো বরফ পড়ে থাকা দেখতে পেয়েছিলাম। যদিও সেদিন আকাশ মেঘাচ্ছন্ন আর ঘন কুয়াশা থাকায় আমাদের সুর্যোদয় দেখা হয়নি। দুই বছর পর আমি দ্বিতীয়বার সেখানে গিয়ে সূর্যোদয় এবং কাঞ্চনজঙ্গা পর্বত দেখেছি। তখন ছিলো সেপ্টেম্বর মাস। আর একবার কঠিন শীত পেয়েছি শিলংয়ে। যদিও ওই সময় সেখানকার তাপমাত্রা শূন্যের নিচে ছিলো না। আমরা কয়েকজন সাংবাদিক ডিসেম্বরের শুরুতে শিলং এবং গৌয়াহাটি ঘুরতে গিয়েছিলাম। সারা দিন বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে রাতে শিলংয়ে এসে থাকতাম। যে কদিন সেখানে থেকেছি, কখনও কখনও তাপমাত্রা ৪/৩ ডিগ্রি পর্যন্ত নামতে দেখেছি। একদিন রাতে গৌয়াহাটি থেকে শিলং ফেরার সময় রাস্তায় আমাদের বেশ সমস্যায় পড়তে হয়। গৌয়াহাটি ও শিলংয়ের মাঝামাঝি থেকে শিলংয়ের দিকে কিছু এগিয়ে পাহাড়ি হাইওয়েতে আমাদের গাড়ি বিকল হয়ে যায়। তখন রাত সাড়ে ১১টার মতো। গৌয়াহাটি-শিলং হাইওয়ে সমতল থেকে পাহাড়ের ওপর উঠে এসেছে। এই মহাসড়কের অর্ধেকের বেশিটা পহাড়েরর ওপর দিয়ে শিলং এসে পৌঁছেছে। এই রাতে জনশূন্য তো বটেই যানবাহনও তখন প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে এ মহাসড়কে। মাঝে মধ্যে দুই একটি ট্রাক বা লরি ছাড়া আর কোনো যানবাহনই নেই সড়কে।  

গাড়ি থেকে নামতেই প্রচণ্ড শীতের তীব্রতা আঘাত করতে থাকে। ধারণা করি, তাপমাত্রা হয়তো ৩ ডিগ্রির নিচেও নামতে পারে। শীতের তীব্রতা বুঝতে পেরে অন্যরা গাড়ি থেকে নামেনি। ড্রাইভারের সঙ্গে আমি আর দীপন (দীপন নন্দী) নেমেছিলাম। ড্রাইভার মাসুক আধাঘণ্টা চেষ্টা করে গাড়ি সচল করতে সক্ষম হয়। গাড়ি থেকে নামতেই আমার মনে পড়লো, সেভেন সিস্টারে এক সময় বিচ্ছিন্নতাবাদী বিভিন্ন সংগঠনের তৎপরতা ছিলো। এক সময় ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সাতটি রাজ্য বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ভয়ে তটস্থ ছিলো। যদিও এখন সেই অবস্থাটা আর নেই। তারপরও এই মধ্য রাতে পাহাড়ি রাস্তায় যে কোনো কারণেই হোক না কেন ভেতরে ভেতরে কিছুটা হলেও আতঙ্কিত হওয়াটা অস্বাভাবিক কোনো বিষয় ছিলো না।  

কয়েক বছর আগে আগরতলায় আমি সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে আগরতলা প্রেস ক্লাবে যাওয়ার পর কবি রাতুল দেব বর্মণ আমাকে বলেছিলেন, এতো রাতে এখানে বাইরে ঘোরাঘুরি করো না। জানই তো সেভেন সিস্টারের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কথা। তবে এখন আর আগে মতো অবস্থা নেই, আগের অবস্থা থাকলে তোমার এই সময়টায় বের হওয়া ঠিক হতো না। ওই সময় কয়েক দিন আগরতলায় ছিলাম। ত্রিপুরার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকারসহ বিভিন্ন মানুষের সাথে কথা বলার সময় বোঝা গেলো এই সেভেন সিস্টারের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ব্যাপারে ভারতের কঠোর অবস্থানের পাশাপাশি বাংলাদেশের কঠোর অবস্থানও পরিস্থিতিকে পাল্টে দেওয়ার ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। বাংলাদেশের এই অবস্থান ইতিবাচক বলেও তারা মনে করেন। ভারতের দিক থেকে অভিযোগ ছিলো, বিচ্ছিন্নতাবাদীরা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়ে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোয় সন্ত্রাসী তৎপরতা চালায়। কিন্তু শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর স্পষ্ট ঘোষণা দেন, বাংলাদেশের মাটি ব্যবহার করে কেউ কোথাও সন্ত্রাসী তৎপরতা চালাতে পারবে না, এটা হতে দেবো না। মানিক সরকারের সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময় ভরতের অভিযোগের বিষয়টি নিয়ে আমি তার কাছে প্রশ্ন করেছিলাম। উত্তরে তিনি বলেছিলেন, এতো দিন বাংলাদেশ এটাকে স্বীকারই করতো না। এখন তো অন্তত স্বীকার করা হচ্ছে। এতে এই সমস্যা (বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎপরতা) সমাধানের পথে অনেক দূর এগিয়েছে। যাই হোক, শিলং-গৌয়াহাটির মাঝ পথে এই গভীর রাতের পাহাড়ের অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখা ছাড়া ওই সময় আমাদের আর আর কিই বা করার ছিলো।  

দার্জিলিক থেকে শুরু করে ভারতের উত্তর-পূর্বাঅঞ্চল সর্বত্রই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ছড়িয়ে রয়েছে। এই সব পহাড়ী অঞ্চলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে অনেকে ভূ-স্বর্গ বলে বর্ণনা করে থাকে। যদিও স্বর্গের সৌন্দর্য সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা নেই। মানব সভ্যতার ইতিহাসে পৃথিবীর কোনো প্রান্তের কোনো মানুষের স্বর্গ বা বেহেস্ত প্রত্যক্ষ করে আসার প্রমাণ আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। ভারতীয় উপমহাদেশ শাসনের সময় ব্রিটিশরা ভারতের এই অঞ্চলে বসবাসের জন্য যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলে। গরমের সময় তারা এই শীতল অঞ্চলে এসে অবকাশ যাপন করতো। আবহাওয়া আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত শিলংকে ব্রিটিশরা প্রাচ্যের স্কটল্যান্ড বলতো। শিলংয়ে রবীন্দ্রনাথের একটি বাড়ি রয়েছে। হয় তো এখানকার আবহাওয়া, পরিবেশ, প্রকৃতি, সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে তার এই অবকাশ যাপনের নীড় গড়ে তুলেছিলেন। পাহাড়ের আঁকাবাঁকা কখনও উঁচু কখনও নিচু রাস্তা ধরে চলতে চলতে পাঠক মাত্রই মনে পড়বে রবি ঠাকুরের রোমান্টিক উপন্যাস ’শেষের কবিতা’র কথা। এই শিংলয়ের প্রকৃতির মাঝে কবি তার শেষের কবিতার চিত্রপট এঁকেছিলেন। অমিত আর লাবন্যর আকস্মিক পরিচয়ের মুহূর্ত তিনি বর্ণনা করেছেন- ”আাঁকাবাকা সরু রাস্তা, ডান দিকে জঙ্গলে-ঢাকা খাদ। এর রাস্তার শেষ লক্ষ্য অমিতের বাসা। সেখানে যাত্রী-সম্ভাবনা নেই, তাই সে আওয়াজ না করে অসতর্কভাবে গাড়ি হাঁকিয়ে চলেছে। ... এমন সময় হঠাৎ একটা বাঁকের মুখে এসেই দেখলে, আর একটা গাড়ি ওপরে উঠে আসছে। পাশ কাটাবার জায়গা নেই। ব্রেক করতে করতে গিয়ে পড়ল তার উপরে, পরস্পর সংঘাত লাগল, কিন্তু অপঘাত ঘটল না। অন্য গাড়িটা খানিকটা গড়িয়ে পাহাড়ের গায়ে আটকে থেমে গেল। ” চার-পাঁচ হাজার ফুট ওপরে পাহাড়ের গা ঘেঁষে আঁকাবাঁকা, উঁচুনিচু রাস্তা, কখনও ডানে, কখনও বামে জঙ্গলে ঠাসা গভীর খাদ। কখনও ঘন কালো মেঘ এসে ঢেকে দিয়ে যায় রাস্তা, কখনও অঝরে বৃষ্টি নামে, দিনের বেলায় নেমে আসে রাতের অন্ধকার। দ্রুত গতিতে চলা গাড়ির বিপরীত দিক থেকে আসা অপর গাড়ির হেড লাইট ধরা পড়ে মাত্র কয়েক গজ কাছে থেকে। আবার পরক্ষণেই সব মিলিয়ে যায়, সূর্যের আলোতে ঝকঝকে চারিদিক। কোথাও কোথাও পাহাড়ের গায়ে অবিরাম বয়ে চলা ঝরনা ধারা। চোখ ধাঁধানো প্রকৃতির এই অপূর্ব সৌন্দর্য ভেদ করে এগিয়ে চলা সেই রাস্তা দিয়ে ঘণ্টায় ৮০, ৯০ কখনও ১০০ কিলোমিটার গতিতে গাড়ি ছুটে চলে। বিপরীত দিক আসা দুই গাড়ি যেনো মুখোমুখি সংঘর্ষের কাছাকাছি এসে সাইড কেটে বেরিয়ে যায়। এখানে অসতর্কতার কোনো সুযোগ নেই। গরমের মাসগুলোতে ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হাজার হাজার মানুষ ছুটে আসে এ অঞ্চলে। একবার আমি মে মাসে একা শিলংয়ে ঘুরতে গিয়েছিলাম। দুই ঘণ্টার বেশি সময় লেগেছিলো থাকার জন্য হোটেলের রুম পেতে। অনেক হোটেলে ঘুরেছি, যেখানেই যাই রুম ফাঁকা নেই। হোটেলের জন্য ঘুরতে ঘুরতে অধৈর্য্য হয়ে হাঁপিয়ে উঠি। শিলংয়ের কেন্দ্র স্থল পুলিশ বাজারে এক মানি এক্সচেঞ্জ থেকে ডলার ভাঙিয়ে ছিলাম। ওই মানি এক্সচেক্সেঞ্জের বয়স্ক লোকটির কাছে গিয়ে তার জানার মধ্যে কোনো হোটেলের খোঁজ পাওয়া যায় কি না যেখানে একটি রুম পাওয়া যাবে বলে জানতে চেয়েছিলাম। লোকটি পশ্চিমবঙ্গের মানুষ। তিনি হেসে বললেন, বাবু এখন যে অবস্থা হোটেল পাওয়া খুব কঠিন ব্যাপার। সারা দেশের গরম এলাকা থেকে ওরা সবাই আসছে, থাকছে, ঘুরছে। লোকটি আমাকে পুলিশ বাজারের উত্তর-পূর্ব দিকে পাহাড় থেকে একটু নিচের দিকে নেমে দেখতে বললেন। বললেন, ওদিকে দেখো পেলেও পেতে পারো। সেদিকে কয়েকটা হোটেল ঘুরে একটি রুম পাওয়ার পর আমার বড় কিছু পাওয়ার স্বস্তি ফিরে আসে। চলবে...

পর্ব ১: সোভিয়েত ঐতিহ্যকে ভিত্তি করে এগিয়ে চলেছে রাশিয়া

বাংলাদেশ সময়: ১৯৩৫ ঘণ্টা, জুন ১৫, ২০২১
নিউজ ডেস্ক

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।