ঢাকা, বুধবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

কবি নিরুপম চক্রবর্তীর ‘ঈষৎ রঙিন’

দত্তাত্রেয় দত্ত  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৫৭ ঘণ্টা, জুন ১৬, ২০২১
কবি নিরুপম চক্রবর্তীর ‘ঈষৎ রঙিন’

বাংলা কবিতাজগতে নিরুপম চক্রবর্তীর পদপাত বছর পঞ্চাশ আগে, যে-তারুণ্যে তিনি লিখতে পারতেন: 
নদীর নিচে বিপন্ন মাছ অশ্রু মোছে
চাই না আমি তার তীরে কেউ কখনও যাক ।
...   ...
রাজপুত্তুর, সবই নিলে, এইটুকু থাক...
নাই বা নিলে কৌটো ভরা আমার প্রিয় বিষণ্ণতা ।



১৯৭৩ সাল থেকে এ-উদ্ধৃতি শুধু এইটুকু প্রতিষ্ঠার জন্য নয় যে বাংলা কাব্যপ্রেমিকদের কাছে  নিরুপম চক্রবর্তী কোনো নতুন নাম নয়। কিন্তু কোনো কারণে তিনি অতীত পুড়িয়ে ফেলে সে-জগৎ থেকে দীর্ঘদিন স্বেচ্ছানির্বাসন নিয়েছিলেন। ফিরে যখন এলেন, তখন তিনি অনেক পরিণত, জটিল, দীর্ণ এবং আবিশ্ব ভ্রমণের বিস্ময়ে পরিপূর্ণ। নিজস্ব বাতাস বয়ে যায়! (২০১৪), ও বেস্কিড পাহাড়ের ভার্জিন মেরি! (২০১৮) পেরিয়ে এ-বছরে প্রকাশিত ঈষৎ রঙিন! তাঁর তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ। তাঁর সব বইয়ের শিরোনামেই একটি করে বিস্ময়চিহ্ন সংলগ্ন থাকে, কারণ তাঁর মতে তাঁর সব কবিতারই জন্ম বিস্ময়বোধ থেকে। এতে পাঠক হিসেবে বিস্মিত হলেও মালার্মের A Throw of Dice কিম্বা e.e.cummings-এর কাব্যকৃতি পেরিয়ে এসে কবিদের এমনতরো ঝোঁকের অধিকার এ যুগে আমরা মেনেই নেই।  

আসলে উদ্ধৃতিটা এটা দেখানোর জন্য দেওয়া যে নিরুপমের কবিতার যে তিনটা প্রধান জোর— যা তাঁর রচনাকে ‘কবিতা’ হিসেবেই চিহ্নিত করছে— সেগুলো তাঁর লেখাকে গোড়া থেকেই চরিত্রায়িত করেছে ।  

এক: অপ্রত্যাশিত অথচ বাঙ্ময় চিত্রকল্প; দুই: অনুভবের একটা সাধারণ জমিতে পাঠককে ভাগীদার হিসেবে দাঁড় করানোর ক্ষমতা; এবং তিন: রূপদক্ষতা বা ফর্মের ওপর নিয়ন্ত্রণ। বস্তুত, এমন একযোগে কানে-ও-প্রাণে দোলা দেওয়া কবিতা সত্তরের দশকে এক কমল সাহা ছাড়া আর ক’জন লিখেছেন সন্দেহ। অবশ্য বর্তমান বইয়ে কবিতাভেদে এদের মিশ্রণের মাত্রার কমবেশি আছে।  

এ বইয়ের পর্ববিভাজন ইত্যাদি অসার আলোচনা এড়িয়ে, মোটের ওপর এখানে স্বকীয় ও অনূদিত— এই দু’ধরনের কবিতা আছে বলে সেই ভিত্তিতেই কথা এগোনো সমীচীন হবে।  

উত্তম কবিতার একটা বার্তা থাকে (জ্ঞান নয়), যেটা একটা ভাবনা; এবং যেটা সুচিন্তিত ও সংহত হওয়া প্রয়োজন। বর্তমানে বাংলায় ‘কবিতা’ নামে যা রটছে, তাতে সেই গুণটির অভাব বড়োই পীড়া দেয়: সবই এখন বড় অচিন্তিত। বার্তার আবেদন আমাদের বুদ্ধির কাছে। আবার আধুনিক কবিতায় সেই বার্তা আমাদের বুদ্ধির দরজায় পৌঁছায় প্রধানত চিত্রকল্পের মাধ্যমে, যার আবেদন আমাদের কল্পনাবৃত্তির কাছে। যথার্থ কবি— কোলরিজ যেমন বলেছিলেন— পাঠকের কল্পনাশক্তিকে জাগিয়ে তুলে নিজের ভাবনাটাই পাঠককে দিয়ে ভাবিয়ে নেন। তখন কবিতাটা পাঠকেরই কবিতা হয়ে যায়। চিত্রকল্প হলো সেই কল্পনার বাহন। আর নিরুপমের কবিতা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সেই দায়িত্বটা সম্পন্ন করতে পারে বলেই তাঁর চিত্রায়নশৈলী আমাদের অধ্যয়ন করা প্রয়োজন।  

চিত্রকল্প বা ইমেজের ব্যবহার সব কবিই করেন; এমনকী তা জীবনানন্দের কবিতার হলমার্ক বললেও কোনোই অতিরেক হয় না। কিন্তু মন্দকবিযশোপ্রার্থীদের কবলে পড়ে পরবর্তীকালে সেই চর্চাটাই মুদ্রাদোষে পরিণত হয়েছে— অলস হাওয়ায় পেঁয়াজের খোসার মতো কতক ইমেজ উড়িয়ে দিতে পারলেই এখন কার্যসিদ্ধি হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু একটি প্রধান ইমেজকে অবলম্বন করে একটি পরিণত ভাবনাকে রূপায়িত করা কবিতার মূল লক্ষ্য। নিরুপমের যে কোনো একটি কবিতার কিছু বিচ্ছিন্ন পংক্তির দিকে তাকালেই বিষয়টা বোঝা যায়: 

প্রসাধনহীন পাখি জানে তাকে উড়ে যেতে হবে। ... 
নিষিদ্ধ আকাশে তাকে সারারাত শিস দিয়ে দিয়ে
খুঁজে গেছে স্নাইপার বুলেট ...
নীলাভ চাঁদের আলো ডানায় পড়েছে পাখি
উড়ে যাও কিছুদূর আরও ...

রাত শেষ হয়ে এল, আবার তোমাকে
খুঁজে খুঁজে শিস দেবে সন্ধানী স্নাইপার বুলেট...
উড়ে যাও যতদূর পারো ।  
(—‘যুদ্ধবিরতি’)

এই মূল ছবিটির সঙ্গে পরতে পরতে জড়িয়ে রয়েছে আরও ইমেজ: ডানায় কাঁপা দীর্ঘশ্বাস, সমুদ্রের রক্তাভ ঢেউ, সারিবদ্ধ বিশ্রান্ত কামান, ভৌতিক শিবির থেকে বেরিয়ে আশ্রয়ের খোঁজে কঙ্কালদের দৌড় এবং অগভীর গোরে আলোর আশায় টিকে থাকা শবের সারি ইত্যাদি। অর্থাৎ এখানে সমাবিষ্ট হয়েছে জীবনের স্পৃহা ও উদ্যমের সঙ্গে মরণের আতঙ্ক ও অনিবার্যতার বোধ। ফলে একদিকে যেমন নিরুপমের প্রিয়তম কবির ‘ওরে বিহঙ্গ মোর/এখনই অন্ধ বন্ধ কোরো না পাখা’ এ-কবিতার স্থায়ী ভাবগত পশ্চাৎপট হয়ে থাকে, তেমনই তাঁর কাব্যগুরু জীবনানন্দের ‘দুরন্ত শিশুর হাতে ফড়িঙের ঘন শিহরণ/মরণের সাথে লড়িয়াছে’-এর প্রাণান্ত পরাজয় এক আত্মিক আর্তি হিসেবে আমাদের কাছে পৌঁছোয়। কাজেই বলতে হয়, বাংলা কবিতার সিরিয়াস পাঠক না হলে নিরুপমের কবিতার যথার্থ মর্মগ্রহণ করা যাবে না।  

বুদ্ধি ও কল্পনার পরে আসে কবিতার ইন্দ্রিয়গত অভিঘাতের প্রশ্ন এবং ফর্মের গুরুত্বের কথা। তবে তার আগে বলা দরকার, নিরুপমের কবিতায় প্রায়শই এমন সব ইমেজ আসে, যা weird বা ভুতুড়ে লাগে। ফলে কেউ তাঁর লেখায় সুররিয়ালিজম খুঁজে পেলে তা আদৌ দোষের হয় না। যেমন সেই ভৌতিক শিবির থেকে বেরোনো কঙ্কালদের দৌড়, অথবা মৃদুতর: 

গ্যাস চেম্বারের পাশে পরিত্যক্ত জুতাগুলি আমাদের মগ্ন স্বপ্নে
পুষ্পের মতন ফুটে আছে।
     (—‘অসউইৎস-বার্কেনাউ-ক্র্যাকাও ২০১৮’) 

কিন্তু এসব ইমেজ বড় নির্মমভাবেই সাম্প্রতিক বাস্তবতায় প্রোথিত। ‘মার্কেট স্কোয়ারে /সকলে আনন্দে হাসে, সাবানের বুদ্বুদ আকাশে উড়ায়’ বটে, কিন্তু এখানেও আঁধার নামলে এক চক্ষুহীনা রমণীর সঙ্গে দেখা হয়ে যায় — 

‘একা দেখি কুলবধূ, কে বট আপনি ?’
...
জানিব না এ রমণী ইহুদিই ছিল কিনা,
ন্যূনপক্ষে কম্যুনিস্ট, জিপসি, অথবা সমকামী;
আসিয়াছে নগ্নপদে ফ্যুয়েরার সম্মুখে তোমার
পাদুকা নিষিদ্ধ, তাই জুতা পায়ে প্রবেশ নিষেধ
ব্যতিক্রম কেহ নও, হও নর, হও নারী, বৃদ্ধ, শিশু, অথবা কিশোর ...
গ্যাস চেম্বারের পাশে পরিত্যক্ত জুতাগুলি আমাদের মগ্ন স্বপ্নে
পুষ্পের মতন ফুটে আছে ।

এইভাবে নিরুপম পোল্যান্ড-সংক্রান্ত কবিতায় অপাঙ্গে উপস্থিত করেন আজকের হিটলার-ধর্ষিতা ভারতমাতাকে; এঁকে দেন ভারতবর্ষের বর্তমানের তথা সম্ভাব্য ভবিতব্যের ছবি: যে-মন্দিরে পাদুকা নিষিদ্ধ, সে-মন্দিরে মাথা না-মুড়োলেই আমরা বিধর্মী, বিদেশি, অথবা দেশদ্রোহী। অসউইৎসের আগুন জ্বলে ২০০২ সালের গুজরাটে; পোল্যান্ডের ইতিহাসের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে এক ‘বাকি ইতিহাস– যার কথা বাদল সরকার বলেছেন। তখন নিরুপমের কাছে ভবিষ্যতে এমন এবং দীর্ঘতর কবিতার প্রত্যাশা তৈরি হয় ।

ফর্ম আর কন্টেন্টকে আলাদা করে দেখা সম্ভব নয়, এই সরল সত্যটা শুধু একক শিল্পকৃতির ক্ষেত্রেই খাটে। অন্তত, কবিতার ক্ষেত্রে এটা সাধারণ সত্য হয়ে দেখা দেয় না। একই সনেট ফর্মে নানা সময়ে এত বিবিধ ও বিচিত্র বক্তব্য রাখা হয়েছে যে কন্টেন্ট ও ফর্মকে— বিষয় এবং বস্তুকে— আলাদা করে ভাবতেই হয়। এর সবচেয়ে সহজ প্রমাণ রবীন্দ্রনাথের ছন্দ নামক লেখাটি, যেখানে একই কথা তিনি বিবিধ ছন্দে সাজিয়ে হাজির করেছেন: আমরা স্পষ্টই তাদের পরিবর্তমান অভিঘাতগুলি বুঝতে পারি। কাজেই বলে রাখা ভালো, রূপসচেতন নিরুপমের কবিতা কেবলমাত্র বাহ্যতই ‘গদ্যকবিতা’। তার মধ্যে পরিব্যাপ্ত রয়েছে চতুর্মাত্রিক অক্ষরবৃত্ত ছন্দ, (সহজে : ‘পয়ার’) । এ-ছন্দ শুধু সর্বাধিক ভার নিতে পারে তাই নয় (পুনশ্চ রবীন্দ্রনাথ স্মরণ্য), এ-ছন্দ স্বাভাবিক; কারণ আমাদের কথ্য বাংলার চলনের ধাঁচটাই হলো পয়ারধর্মী। ফলে নিরুপম যখন কবিতায় সাধু ক্রিয়াপদ ব্যবহার করেন, তখন সেও তার আড়ষ্টতা ছেড়ে বেরিয়ে এসে কথ্য ও প্রবহমান হয়; কবিতাকে সচল রাখে। (প্রসঙ্গত, এ-পথও জীবনানন্দের। ) তা বলে অবশ্য নিরুপম পয়ারে বাঁধা পড়ে যাননি । এ-বইয়ের প্রথম কবিতাটি (‘রেনেসাঁস) তার প্রদীপ্ত প্রমাণ: 

খুলেছে রাত বিরেতে পক্ষী ঠেকে গানের ধোঁয়ায় গোলাপবাহার
ডেকেছে ও রূপচাঁদ! ও রূপচাঁদ! হেয়ার সাহেব ইস্কুলে তার।

রূপের অনিবার্য আকর্ষণে নিরুপম প্রবৃত্ত হয়েছেন মধ্যযুগীয় ফ্রান্সের গীতিকবিতা ভিলানেলের চর্চায়। (তিনি নিশ্চয় পরিহাসছলেই একে ‘গ্রাম্য কাব্যরীতি’ বলেছেন; কারণ ব্যুৎপত্তি মেনে অর্থ ধরলে ভিলেনকে এবং ক্লাউনকেও শুধু ‘গ্রামবাসী’ বলে ভাবতে হয়। ) ভিলানেল ছিল এক ধরনের সরল ত্রুবাদুর-গীতি, যার বিশেষ দুটি পংক্তি তাদের সুরসহ স্তবকে স্তবকে পুনরাবৃত্ত হতো। নানা ধরনের কোব্লা, চ্যান্সো রেডন্ডা, সেস্টিনা, ইত্যাদির মতো ধাঁধাঁলো গঠন না-থাকার কারণেই তার ‘গ্রামীণ’ পদবি । কিন্তু উত্তর-গুটেনবার্গ জগতে কাব্য সাধারণভাবেই সুরবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল; এবং এসব গীতিরীতি অন্তর্ধান করল। ঊনিশ-বিশ শতকে ভিলানেল আবার দেখা দিলো ওয়াইল্ড, অডেন, এম্পসন, বিশপ, প্রমুখের লেখায়। বাংলায়, নিরুপম যেমন বলেছেন, ভিলানেলের লক্ষণীয় চর্চা হয়নি; আর তিনি যে নিজের যৌবনের রোম্যান্টিক মনটিকে একেবারে ছেড়ে আসতে পারেননি, তার চিহ্ন রয়ে গেছে এ-বইয়ের পাঁচটি ভিলানেলে তাঁর গীতিধর্মী স্বতোৎসারে— যার প্রত্যেকটিই তার নিজস্ব ভঙ্গিমায় অনবদ্য। তবে গীতিধর্মিতা বক্তব্যের সরলতাও দাবি করে, এই সীমিত বিচারে মনে হয় ‘ডিভাইন ভিলানেল’-ই এগুলির মধ্যে সেরা: 

একদিন ভিলানেলে একটি শিশুর সঙ্গে একটি কুকুর
সবুজ ঘাসের মাঠ পার হয়ে যেতে থাকে সমুদ্রের দিকে
সমুদ্র অনেক দূর, তার আগে স্তব্ধ কোনো পুরনো পুকুর
তাদের ছবিটি ধরে রেখেছিল, যেন এক প্রশান্ত মুকুর ...

এ এক গতিময় চিত্রকল্প। তবে এই সারল্য সাম্প্রতিক নিরুপমের চারিত্রিক নয়: এ যেন আদ্যন্ত আমাদের টানে শৈশবের সেই বাস্তবনিরপেক্ষ জগতে, যেখানে ছড়ায়-ছবিতে এক মায়াময় জগতে ভাসতো আমাদের কল্পনাযান: 

হাঁসের পিঠেতে চড়ে পাঁচটি ইঁদুর
চাঁদপুর হয়ে তারা যাবে বহুদূর ... 

অন্য ভিলানেলগুলির কোনোটিই এমন যন্ত্রণারিক্ত বা দুর্ভোগরিক্ত নয়; তাদের মধ্যে সরলতম পদ্যটিতেও দেখি:

বাবুদের বাগানেতে শিস দিয়ে বয়ে যায় হাওয়া 
আমাদের ভিলানেলে হঠাৎ এসেছে এক পরী
ডানায় ঝরেছে রক্ত; আজ তার স্বর্গে ফিরে যাওয়া।

তবু এদের গীতিময়তা যে রূপসিদ্ধির কারণেই অস্তিত্বশীল, তা নিশ্চয় বলার অপেক্ষা রাখে না। সেই সূত্রেই আসে নিরুপমের অনুবাদের প্রসঙ্গ। ক্রিস্টিনা জর্জিনা রসেটির কবিতা তাঁকে মুগ্ধ করেছিল বাল্যের Silver Bells নামক পদ্য-সংকলন থেকেই। সেই প্রেরণায় তিনি রসেটির ‘A Better Resurrection’ কবিতাটির অনুবাদ করেছেন। অবশ্য ওই বইয়ে উত্তম কবিতা আরও ছিল: প্রাচীন ইংরেজি ব্যালাড থেকে ব্লিস কারম্যানের ‘A Vagabond Song’ হয়ে এলিয়টের ‘Preludes’ পর্যন্ত যার রূপগত প্রসর। ছিল মেসফিল্ডের ‘Twilight’ নামে কবিতাটি, যার অনুবাদ করেছিলেন সুধীন্দ্রনাথ ‘প্রদোষ’ নামে । সেখানে দেখি মেসফিল্ডের মিশ্র dactyl-এর দোলা সুধীন্দ্রনাথ যথাসাধ্য অক্ষুণ্ণ রেখেছেন; অনুবাদে পংক্তির দৈর্ঘ্য মূলানুসারী এবং মিলের ছক হুবহু অনুসৃত। বিশিষ্ট বা একক শিল্পকর্মের বিচারের ক্ষেত্রে বিষয় ও রূপের অদ্বৈতের যে-কথাটা একটু আগেই এলো, সেটা যদি ঠিক হয়, তবে অনুবাদের ক্ষেত্রেও রূপ বা ফর্মকে যথাযথ প্রতিফলিত করতে না পারলে বিষয় বা কন্টেন্টকে কখনোই উপস্থিত করা যাবে না; এবং পাঠক প্রতারিত হবেন। তাতে করে কিছু দুরূহ শব্দ বা অচেনা অভিব্যক্তি এসে যেতে পারে, কদাচিৎ বাক্যবন্ধও দুম্ড়ে যেতে পারে; কিন্তু সে-সমস্ত তো ইতোমধ্যেই নিরুপমের নিজস্ব কাব্যভাষায় আত্তীকৃত হয়ে আছে: 

তথাপি এমত স্বপ্নে সবাই পরিতৃপ্ত, আনন্দে অটুট
অট্ট অট্ট হাসিতেছে নরনারী নির্বিশেষে 
...
রুধিরের স্রোত বহে নদীবক্ষে; সভ্যতার সুচারু প্লাবন
সেই নদী পার হয়ে কে আছ হে সন্তরণপটু
চলো যাই জ্যামিতির কারুকাজহীন ওই আধোচেনা মুখশ্রীর কাছে ...
(—‘পরাবাস্তব দিবাস্বপ্ন)

কিন্তু এমন নমনীয় ও সর্বাধার ভাষা ব্যবহারের স্বাধীনতা নিলেও সখেদে দেখি তিনি রসেটির আট লাইনের তিনটি স্তবকের দু’টিকেই ন’ লাইনের স্তবকে পরিণত করেছেন; মূলের ababcdcd স্তবকছক আদৌ বজায় রাখেননি; এবং এই কবিতার প্রত্যেক tetrametric স্তবকের অন্তে প্রযুক্ত trimetre-এর ধ্বনিগত তাৎপর্যকে অগ্রাহ্য করেছেন।  

তাছাড়া, ইংরেজি ভাষায় সাধু/চলিত ক্রিয়াপদের পার্থক্য নেই। অর্থাৎ রসেটি ‘সাধারণ’ বা চালু ইংরেজি ভাষাতেই অনাড়ম্বর ভক্তি নিবেদন করেছিলেন। অথচ নিরুপম এক অচলিত বাকভঙ্গিমা ব্যবহার করেছেন তাঁর অনুবাদে, যা পাঠককে রসেটির কবিতার সারল্য ও সমাচার সম্বন্ধে ভুল ধারণা দেবে। যেমন, মূলের ১১-১২ পংক্তি, যার বক্তব্য : 

সত্যিই আমার বাঁচা শূন্য ও সীমিত, 
বড়ো ক্লান্তিকর এই বন্ধ্যা গোধূলিতে 

— সেটি এই অনুবাদে হয়েছে :
অতীব সত্য কথা এ জীবন সংক্ষিপ্ত ও শূন্য, তদুপরি
বৈচিত্র্যবিহীন দিন মিশে যায় ধূসর সন্ধ্যায়।  
(—‘প্রার্থিত পুনর্জন্ম)

এবং কবিতার অষ্টম লাইনের ‘O Jesus, quicken me’ (হে যিশু, বাঁচিয়ে তোলো মোরে)  হয়েছে : ‘প্রভু যিশু, তুমি আজ ত্বরা করো অভাগীর তরেৎ। এসব কথা বলা আরও এজন্য যে ফর্মের প্রতি সম্পূর্ণ বিশ্বস্ত থেকে কবিতার বক্তব্যের সঠিক বাংলা অনুবাদ সুধীন্দ্রনাথের সঙ্গে সঙ্গে শেষ হয়ে যায়নি: শ্রী প্রশান্ত সামন্তর ওয়র্ডসওয়ার্থ ও কিটসের কবিতার অনুবাদগ্রন্থগুলির সন্ধান যে বাঙালি পাঠকেরা রাখেন না, সে শুধু তাঁর ঢাকি নেই বলে। ‘The Eve of St. Agnes’  যে বাংলায় অনুবাদ করা সম্ভব— তার Spenserian stanza অবিকৃত রেখে— তা তিনি স্বাচ্ছন্দ্যে দেখিয়েছেন। সে-নিদর্শনগুলি আমাদের প্রণিধানযোগ্য, কারণ শিক্ষণীয়। মোট কথা, নিরুপম যদি ‘প্রার্থিত পুনর্জন্ম’-কে ‘বঙ্গানুবাদ’ না-বলে রসেটি-অনুপ্রাণিত স্বকীয় কবিতা বলতেন, তবে তা সঙ্গততর হতো।  

এছাড়া এই গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে সির্ক্কা সেল্যা-র ‘তমার গানগুলি’— ইংরেজি অনুবাদ থেকে যা বঙ্গীকৃত। যেহেতু ফিনিশ ভাষায় আমি অজ্ঞ, অতএব অনুবাদের যথার্থতা নিয়ে আমার মন্তব্য করা অনুচিত। প্রশ্ন জাগে যে নিরুপমের— 

নাচিছে কিরীটী রায়, নাচিতেছে স্বপনকুমার
মুণ্ডমালা হস্তে ধৃত, নাচিতেছে কৈশোর তোমার।
নৃত্যকালী, নাচিতেছে ব্যোমকেশ চিড়িয়াখানায়
ভোট্টীমা টিম বলি গণতন্ত্র নেচে নেচে যায় ।
(—‘নাচ’)

—এই লাইন চারটির কোনো ইংরেজি তর্জমা থেকে যদি ফিনিশ ভাষায় অনুবাদ করা হয়, তবে মূলের স্বাদ-গন্ধ-ঝাঁঝ ও তাৎপর্য (হাট্টিমা টিম্‌ টিম্‌-এর মাঠে-পাড়া ডিম, ঘোড়ার ডিম, ও ভারতীয় রাজনীতির অনুষঙ্গসমেত) ফিনিশ পাঠকের কাছে কতোটা পৌঁছোয়? প্রাচীন গ্রিক সাহিত্যের অনুবাদ যাঁরা করেন, তাঁরা নিতান্তই একমত যে সে-ভাষার ব্যঞ্জনাসমূহ অনুবাদে প্রতিফলিত করা আধুনিক কোনো ভাষায় অসম্ভব: আমরা আজ মতলববাজকে দাঁড়িমাঝি (সফোক্লেস) কিম্বা মহাযোদ্ধাকে গাধা (হোমার) বলে ভাবতে পারি না। উপরন্তু আছে তার বিচিত্র ছন্দসম্ভার। কাজেই একটি উরালিক ভাষার কবিতার জার্মানিক তর্জমাতে মূলের স্বাদ কতটুকু বজায় ছিল, তা তর্কাতীত নয়। সেইটি আবার অনূদিত হয়েছে প্রাকৃত-ভাঙা বাংলায়। সম্ভবত সেসব কারণেই ‘তমার গানগুলি’ আদৌ কবিতা কিনা, সেই সন্দেহ মনে জাগে। সেল্যা নিশ্চয় ফিনল্যান্ডে অতি সমাদৃতা; কিন্তু শুধু সেই সমাদরের প্রতিধ্বনিতে বঙ্গদেশেও তাঁর সমাদর হওয়ার যথেষ্ট কারণ এখনও নেই।  

তবে, কবিতা নিঃসন্দেহে বিচিত্রধর্মী; অতএব সেই সুবাদে সবকিছুকেই ‘কবিতা বলা সম্ভব। সেগুলি কেন কবিতা, সে-প্রশ্ন তুললে প্রশ্নকর্তাকে অবোধ বা অদীক্ষিত বলাটাই প্রথা। সে-প্রথার সম্মানার্থে সেল্যার কবিতাকে চৌকি দেওয়াই যায়। কিন্তু নিরুপমের পরিশ্রমী, জটিল ও তীব্র কবিতার পাশে এগুলিকে বড়োই ক্ষীণপ্রাণ, রক্তহীন ও নিরর্থক ঠেকে: শুধু যেন কতকগুলো নিস্তেজ দ্বিমাত্রিক গদ্যসত্ত্ব উক্তিমাত্র। আসলে এসব ক্ষেত্রে পাঠককে মানসিক প্রস্তুতির সময় মঞ্জুর করতে হয়: কারণ বিষ্ণু দে-র কবিতা পড়ার মনোগঠন নিয়ে বৈষ্ণব পদাবলী পড়া যায় না। কাজেই মনে হয় বেস্কিড পাহাড়-এ মুদ্রিত অন্য সেল্যা-কাব্যের সঙ্গে ‘তমার গানগুলি’ যদি পৃথক্ একটি গ্রন্থে সঙ্কলিত হতো, তবে পাঠক নিরুপমের বহুস্তরিত কাব্যের অভিঘাত মন থেকে পুরো মুছে ফেলে বিপরীত এক মানসিকতা নিয়ে সেগুলি দেখতে পারতেন।  

বাংলাদেশ সময়: ১৬৫০ ঘণ্টা, জুন ১৬, ২০২১
এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।