ঢাকা, বুধবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

সোভিয়েত ঐতিহ্যকে ভিত্তি করে এগিয়ে চলেছে রাশিয়া (৩)

শামীম খান | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২০৮ ঘণ্টা, জুন ২৬, ২০২১
সোভিয়েত ঐতিহ্যকে ভিত্তি করে এগিয়ে চলেছে রাশিয়া (৩) শামীম খান, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

সম্প্রতি তিনি রাশিয়া ভ্রমণ করেছেন। পাঠকের জন্য তিনি তুলে ধরেছেন সেই ভ্রমণের অভিজ্ঞতা আর রাশিয়ার এগিয়ে চলার খণ্ড খণ্ড চিত্র।

আমরা তা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করছি। আজ থাকছে এর তৃতীয় পর্ব।

যে কথা বলছিলাম, মধ্য ডিসেম্বর থেকেই মস্কোর তাপমাত্রা দ্রুত নামতে থাকবে। এই সময়ে সার্বক্ষণিক আকাশ মেঘে ঢাকা থাকে। কয়েক দিনে আমরা সুর্যের মুখ দেখতে পাইনি। যদিও দিনের বেলায় তুষারপাত হতে দেখিনি, কিন্তু বিভিন্ন জায়গায় বরফের স্তূপ দেখে বোঝা গেলো গভীর রাতে তুষারপাত হয়েছে। সেগুলো কেটে একেক জায়গায় স্তূপ করে রাখা হয়েছে। মস্কোতে তুষারপাত দিনে রাতে যে কোনো সময় হয়। এমনকি অক্টোবর, নভেম্বরেও হঠাৎ হঠাৎ তুষারপাত হয়। তবে মস্কোতে ডিসেম্বরের ওই সময় যে ঠাণ্ডা পেয়েছি অর্থাৎ এই তাপমাত্রা দিয়ে একই সময়ে সারা রাশিয়ার শীতের অবস্থা বোঝার বা ধারণা করার কোনো সুযোগ সেই। আয়তনে রাশিয়া বিশ্বের সর্ববৃহৎ দেশ। ১৫টি প্রজাতন্ত্র নিয়ে গঠিত এক সময় বিশ্বের বৃহত্তম দেশ সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর প্রত্যেক প্রজাতন্ত্র বর্তমানে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। এর পরও রুশ ফেডারেশন আয়তনে বিশ্বের সর্ববৃহৎ রাষ্ট্র।  

রাশিয়ায় সবচেয়ে বেশি শীত পড়ে সাইবেরিয়া অঞ্চলে। এই সাইবেরিয়ার শাখা অঞ্চলের ওইমিয়াকন বিশ্বের শীতলতম শহর। শীতকালে এখানে ২১ ঘণ্টাই অন্ধকার থাকে। সবচেয়ে বেশি ঠাণ্ডার সময় জানুয়ারি। তখন সেখানে গড় তাপমাত্রা থাকে মাইনাস ৪৭ থেকে মাইনাস ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সাম্প্রতিক হিসাব অনুযায়ী, ওই শহরে মাত্র পাঁচ শ’ লোকের বাস।  

মস্কো এবং নভভরোনেস শহরেও সূর্য দেখতে পাইনি। আকাশ মেঘে ঢাকা আর অধিকাংশ সময়ই চারিদিকে ঘন কুয়াশা। এর মধ্যেই চলছে মানুষের স্বাভাবিক কর্মব্যস্ত জীবন। রাস্তার দুই ধারে, পার্কে সর্বত্রই দাঁড়িয়ে আছে পাতাবিহীন গাছের জীবন্ত কাঠামো। হোটেলে ওঠার পর ম্যাক্সিম আমাদের জন্য ভদকা অর্ডার করে। এখানকার আবহাওয়ায় চলাফেরার ক্ষেত্রে এটা কাজে দেবে বলেও সে জানিয়ে দিলো। ভদকার ব্যাপারে আমাদের টিম সদস্যদের কারো কোনো আপত্তি দেখিনি, সবাই সানন্দে স্বাগত জানালো। তবে প্রত্যেকবার খাবার টেবিলে মেনু নির্বাচনে সবার দৃষ্টি সতর্ক ছিলো। খাবারের কোনো আইটেমে পর্ক বা বিফের উপস্থিতি আছে কি না তা যাচাই করে নিতে হতো। আমাদের মধ্যে এক জনের ছিলো বিফে আপত্তি, অন্যদের আপত্তি পর্কে। আমার অবশ্য কোনো কিছুতেই আপত্তি ছিলো না। তাই আমার মেনুর সঙ্গে অনেক সময়ই অন্যদের মেনুর অমিল ঘটে যেতো। প্রথম দিনই খাবার সময় যখন এই বিষয়টি নিয়ে কথা হয় তখন আমি কোনো আইটেমের বিষয়ে আনাপত্তির কথা জানাতেই ম্যাক্সিমকে একটু আশ্চর্য, একটু কৌতুহলী দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাতে দেখলাম।  

ম্যাক্সিম ভারতের মুম্বাইতে রোসটমের দক্ষিণএশিয়ার আঞ্চলিক অফিসে দায়িত্ব পালন করে আসছে। ভারত অনেক আগেই রাশিয়ার সহযোগিতায় পারমাণবিক বিদ্যুতে প্রবেশ করেছে। দেশটির কতগুলো পামাণবিক ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে, আবার কতগুলো নির্মাণাধীন। ২০১০ সালের হিসাব অনুযায়ি ভারতে ১৯টি পারমাণবিক চুল্লি ৪৫৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতো। আর ২০০৯ সালের হিসাব অনুযায়ী কার্যকরী পরমাণু চুল্লির সংখ্যার বিচারে ভারতের স্থান বিশ্বে নবম। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নির্মাণ কাজে ভারতের বিশেষজ্ঞরা পরামর্শক হিসেবে কাজ করছেন।  

যেহেতু এই প্রযুক্তিতে ভারতের অভিজ্ঞতা রয়েছে এবং তারা অনেক এগিয়ে গেছে তাই রূপপুর প্রকল্পে পরামর্শক হিসেবে ভারতের সহযোগিতা নেওয়া হচ্ছে। এ বিষয়ে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের একটি চুক্তিও হয়েছে। ভারতের পরমাণু শক্তির প্রশাসনিক কেন্দ্র মুব্বাই। এখানেই রোসাটমের আঞ্চলিক অফিস। সেখান থেকে মাঝে মধ্যে ম্যাক্সিমকে ঢাকা ও ঈশ্বরদীতে আসতে হয়। ভারতের তামিলনাড়ুতে নির্মাণাধীন কুদানকুলাম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ ভারতের যে সব জায়গায় পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প রয়েছে সে সব স্থানে তাকে যেতে হয়। তাই এই উপমহাদেশের মানুষ সম্পর্কে, কোনো কোনো বিষয়ে তাদের অনুভূতি কতটা স্পর্শকাতর সে সম্পর্কে ম্যাক্সিমের ন্যূনতম ধারণা রয়েছে। সে কারণেই হয়তো আমার বিষয়ে তার এই সামান্য কৌতুহল কাজ করেছিলো। পরবর্তিতে নানা বিষয়ে আলোচনায় তার এই কৌতুহল কেটে যায়।
 
পর দিন সকালে বাইরে বের হতেই চারিদিকে কুয়াশাচ্ছন্ন যেনো এক অন্য রকম শীতের মুখোমুখি হই। ম্যাক্সিম বলছিলো, আবহাওয়ার স্বাভাবিক নিয়মে এই সময় মস্কোতে তাপমাত্রা আরও নীচে অবস্থান করা এবং যে কোনো মুহুর্তে তুষারপাত স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব অনেক ক্ষেত্রেই ব্যতিক্রম ঘটছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে আবহাওয়ার গতি প্রকৃতিরও কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। গোটা ইউরোপেই আবহাওয়ার স্বাভাবিক গতির উপর এর একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।  

রাশিয়া ভ্রমণের প্রথমে আমাদের নিয়ে যাওয়া হয় সে দেশের প্রথম নভভরোনেস পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে। এটি রাশিয়ার সর্ববৃহৎ পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। মূলত এই প্রকল্পকে দেখানোর জন্যই আমাদের এখানে আমন্ত্রণ জানানো হয়। পামাণবিক বিদ্যুৎ প্রযুক্তিকে শিল্প হিসেবে নিয়েছে রাশিয়া। বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতায় এই প্রযুক্তির আন্তর্জাতিক বাজারে নিজের প্রসার ঘটানো ও প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে এই শিল্পের বাজার নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে রাশিয়া বিভিন্ন কৌশল নিয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই প্রযুক্তিকে জনপ্রিয় করে তুলতে এটা সম্পর্কে ধারণা দেওয়ার বিভিন্ন পদ্ধতির অংশ হিসেবে রাশিয়ার নিজস্ব প্রকল্পগুলিকে সরাসরি দেখানো হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিশেষ করে যে সব দেশে রাশিয়ার সহযোগিতায় পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে সেসব দেশের সরকারি বেসরকারি শ্রেণী পেশার মানুষকে আমন্ত্রণ জানাানো হয়। এরই অংশ হিসেবে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের সঙ্গে রিপোটিংয়ে সম্পৃক্ত মিডিয়া কর্মীদেরও বিভিন্ন সময় আমন্ত্রণ জানিয়ে রাশিয়াতে নিয়ে যাওয়া হয়।  

ইতোমধ্যে বাংলাদেশের মিডিয়া কর্মীসহ সরকারের উচ্চপদস্থ অনেক কর্মকর্তাদেরকেও আমন্ত্রণ করে নিয়ে পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প ঘুরিয়ে দেখানো হয়েছে। বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের সংশ্লিষ্ট বিষয়ের শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষা ও প্রশিক্ষণের জন্য প্রতিনিয়ত বৃত্তি দেওয়া হচ্ছে। ২০১৪ সাল থেকে এই প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে। পারমাণু বিষয়ে শিক্ষার ক্ষেত্রে সেরা বিশ্ববিদ্যালয় ন্যাশনাল রিসার্চ নিউক্লিয়ার ইউনির্ভাসিটি-মস্কো ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড ফিজিক্স ইনস্টিটিউট (মেফি)তে ইতোমধ্যে ৫শ’ ছাত্রছাত্রীকে পড়াশোনার জন্য পাঠানো হয়েছে। এদের অনেকে একাডেমিক কোর্স শেষ করে নভভরোনেসসহ রাশিয়ার বিভিন্ন পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। তাদেরকে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র পরিচালনার প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। অনেকে পড়াশোনা শেষ করে প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে ফিরেছেন। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া এবং এ বিষয়ে দুই দেশের সরকারের মধ্যে(জি টু জি) চুক্তি রয়েছে। এই নভভরোনেস প্রকল্প প্রত্যক্ষ করে রাশিয়া বিজ্ঞান, প্রযুক্তির, শিক্ষা, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক জীবন মানের উচ্চতা স্পষ্ট হয়ে উঠে।  

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ”রাশিয়ার চিঠি”তে লিখেছেন, ..... ”আপাতত রাশিয়ায় এসেছি-না এলে এ জন্মের তীর্থদর্শন অন্তত অসমাপ্ত থাকত। ” রবীন্দ্রনাথ যখন রাশিয়া ভ্রমণ করেছিলেন সেই ১৯৩০ সাল তখন ছিলো বিপ্লব পরবর্তী রাশিয়ার সমাজের উত্থানপর্ব। মাত্র ১৩ বছর আগে ১৯১৭ অক্টোবর বিপ্লবের (রুশ বিপ্লব) মধ্য দিয়ে সেখানে সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠা হয়। এই নতুন ব্যবস্থায় শিক্ষার প্রসার, বিজ্ঞানভিত্তিক চিন্তা-চেতনা এবং তার ওপর ভিত্তি করে আর্থসামাজিক উন্নয়নের ধারা দেখে মুগ্ধ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ”রাশিয়ার চিঠি”তে আরও উল্লেখ করেছিলেন, ”......এতকাল সমাজের অধিকাংশ লোক শিক্ষার পূর্ণ সুযোগ থেকে বঞ্চিত-ভারতবর্ষ তো প্রায় সম্পূর্ণই বঞ্চিত। এখানে সেই শিক্ষা যে কী আশ্চর্য উদ্যমে সমাজের সর্বত্র ব্যাপ্ত হচ্ছে তা দেখলে বিস্মিত হতে হয়। শিক্ষার পরিমাণ শুধু সংখ্যয় নয়, তার সম্পূর্ণতায়, তার প্রবলতায়। কোনো মানুষই যাতে নিঃসহায় ও নিষ্কর্মা হয়ে না থাকে এজন্যে কী প্রচুর আয়োজন ও কী বিপুল উদ্যম। শুধু শ্বেত-রাশিয়ার জন্যে নয়-মধ্য-এশিয়ার অর্ধসভ্য জাতের মধ্যেও এরা বন্যার মতো বেগে শিক্ষা বিস্তার করে চলেছে; সায়েন্সের শেষ-ফসল পর্যন্ত যাতে তারা পায় এই জন্যে প্রয়াসের অন্ত নেই। ” রবীন্দ্রনাথ তার দূরদৃষ্টি দিয়ে দেখতে পেয়েছিলেন অর্থাৎ সায়েন্সের (বিজ্ঞান) শেষ ফসলের যে কথা তিনি বলেছিলেন সোভিয়েত আমলের প্রথমভাগেই রশিয়া (সোভিয়েত ইউনিয়ন) মানুষের কল্যাণে বিজ্ঞানের শেষ ফসল পাওয়ার অবস্থানে পৌছে যায়। শিক্ষা, চিকিৎসা থেকে শুরু করে পারমাণবিক শক্তির ব্যবহারসহ সর্ব ক্ষেত্রেই বিজ্ঞানের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে যায় রাশিয়া যা আজও অব্যাহত আছে।  

বিপ্লবের পর মানুষের জীবন মান উন্নত করতে রাশিয়ার প্রথম অগ্রাধিকার ছিলো শিক্ষা এবং সারা দেশে বিদ্যুৎতায়ন। বিদ্যুতেও বিপ্লব ঘটনানোর পাশাপাশি বিদ্যুৎ উৎপাদনের সর্বাধুনিক প্রযুক্তিরও উদ্ভাবন করতে থাকে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৫৪ সালে বিশ্বে প্রথম পরমাণবিক শক্তিকেন্দ্র থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ গ্রীডে সঞ্চালন করে। যদিও এর আগে ১৯৪৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম পারমাণবিক শক্তিকেন্দ্র থেকে উৎপন্ন বিদ্যুৎ দিয়ে একটি আলোর বাল্ব জ্বালানো হয়। কিন্তু পারমাণবিক বিদ্যুতের সার্বজনিন ব্যবহার শুরু হয় সোভিয়েত ইউনিয়নেই। চলবে...


 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।