ঢাকা, বুধবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

অপ্রকাশিত চিঠি

শামসুর রাহমানকে লেখা বিদেশি লেখকদের চিঠি

সংগ্রহ ও ভূমিকা শেখ মেহেদী হাসান | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৫৯ ঘণ্টা, জুলাই ২৩, ২০২১
শামসুর রাহমানকে লেখা বিদেশি লেখকদের চিঠি শামসুর রাহমান

শামসুর রাহমান (২৩ অক্টোবর ১৯২৯—১৭ আগস্ট ২০০৬) বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি, সাংবাদিক। ঢাকা নগরেই তাঁর বেড়ে ওঠা।

নাগরিক কষ্ট, দুঃখ-সুখ তাঁর কবিতায় বিশেষভাবে উঠে এসেছে। ১৯৫২ সাল। ভাষা আন্দোলনে পূর্ব বাংলার বাঙালি নিজের পথ খুঁজতে শুরু করল। কবি হিসেবে শামসুর রাহমানের সূচনাও সেখান থেকেই। ১৯৬০-এ তাঁর প্রথম কাব্য ‘প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’র প্রকাশ কবিতায় তাঁর অধিকার প্রতিষ্ঠা করে।

কলকাতা থেকে বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত কবিতা পত্রিকায় তাঁর ‘রূপালি স্নান’ প্রকাশের মাধ্যমে কবিতার বৃহত্তর বাংলায় তাঁর আত্মপ্রকাশ ঘটে। ১৯৬০ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত তিনি রেডিওতে কাজ করার পর মর্নিং নিউজ, দৈনিক পাকিস্তান, দৈনিক বাংলা ও সাপ্তাহিক বিচিত্রায় সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। স্বাধীনতার পর শিক্ষিত মধ্যবিত্তের সোচ্চার আন্দোলনে শামসুর রাহমান নিজের কবিতা সমর্পণ করেছিলেন।

বাংলা সাহিত্যের পাঠকদের মধ্যে জনপ্রিয়তা লাভ করে তাঁর কবিতা, গান, গল্প, উপন্যাস ও গদ্য। বাঙালির সব আন্দোলন-সংগ্রামের গৌরবদীপ্ত অধ্যায় উন্মোচিত হয়েছে তাঁর কবিতায়। বাংলা সাহিত্যে অবদানের জন্য তিনি স্বাধীনতা পদক, একুশে পদক, আনন্দ পুরস্কারসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডি.লিট উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন। ব্যক্তিগতভাবে আমার ছাত্রজীবনে কবি শামসুর রাহমান ও তাঁর পরিবারের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সেই সূত্রে কবির বেশ কিছু অপ্রকাশিত রচনা, চিঠিপত্র আমার হস্তগত হয়। পরম যত্নে এত দিন আগলে রেখেছিলাম। কবির স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে কবিকে লেখা ৮টি অপ্রকাশিত চিঠি পত্রস্থ করা হলো। চিঠিগুলো কবিকে লিখেছিলেন ভারতের খ্যাতিমান লেখক ও গবেষকরা। এর মধ্যে অরুণ মিত্র, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষ, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, অন্যতম। এসব চিঠিতে কবির সঙ্গে তাঁদের নিবিড় সম্পর্কের কথা উঠে এসেছে। ব্যক্তিগত হৃদ্যতা, ঘনিষ্ঠতা বা অন্তরঙ্গতা তাঁকে যে সত্য প্রকাশ থেকে বিরত করতে পারেনি, চিঠিগুলোই তার প্রমাণ।

 

বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের চিঠি

নং-২৫০-পি.সি.এম

২৭/১১/২০০০

শ্রদ্ধাস্পদেষু,

আপনার চিঠি পেয়েছি। আমার সম্বন্ধে যে-অনুভব আপনি ব্যক্ত করেছেন, তার জন্য আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। এ ধরনের চিঠি আমাকে অনুপ্রাণিত করে নতুন আলোর পথে যাত্রায়—লক্ষ্য তো তিমির বিনাশের।

মানুষের আশা-আকাংক্ষার কাছাকাছি পৌঁছনোর চেষ্টা করে যাব। আপনাদের প্রীতি ও শুভেচ্ছা সব সময়ে আমার সঙ্গে থাকবে, এ প্রত্যয় রাখি।

শীঘ্র ভালো হয়ে উঠুন। শ্রদ্ধা জানবেন।

 

ইতি,

স্বাক্ষর

(বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য)

 

শঙ্খ ঘোষের চিঠি

এ১/৬ ঈশ্বরচন্দ্র নিবাস

কলকাতা ৭০০০৫৪

৭ নভেম্বর ২০০১

প্রীতিভাজনেষু,

আমার ছোটো মেয়ে টিয়া দিন সাতেকের জন্য ঢাকা যাচ্ছে, তার হাতে এই চিঠিটি পাঠাবার সুযোগ নিচ্ছি।

দুঃসময়ে মুখোমুখি বসবার সময় আবার হলো। গোটা পৃথিবী উন্মাদ হয়ে গেছে মনে হয়। কদিন ধরে আপনার কথা—আপনাদের কথা—খুব ভাবছি। কতটা উদেবগে কতটা মনস্তাপে আছেন তা অনুমান করতে পারি।

এ সময়ে আবার আপনার নতুন কবিতা পড়বার প্রতীক্ষায় আছি।

শরীর মোটের উপর ভালো আছে তো?

আমার শুভেচ্ছা আর ভালোবাসা জানবেন।

 

প্রীতার্থী

স্বাক্ষর

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের চিঠি

৩৭/২ গড়িয়াহাট রোড

কলকাতা-১৯

৩১/১০/৭২

শামসুর রাহমান

প্রিয়বরেষু,

সেই যে আপনার স্ত্রীর গুরুতর অসুখের খবর পেয়ে আপনি হঠাৎ চলে গেলেন, তারপর থেকে আপনার কথা অনেক ভেবেছি। আপনার বাড়ির ঠিকানা জেনে রাখা হয়নি—তবে নানান লোকের মুখে জেনেছি আপনার কুশল ও রুশ ভ্রমণের সংবাদ।

আপনার কবিতার আমি ভক্ত অনেক আগে থেকেই, আপনার সঙ্গে পরিচয় হবার পর বুঝেছি, আপনি একজন সৎ মানুষ। আমার মধ্যে অনেক বৈপরীত্য আছে, কিন্তু সৎ মানুষের সান্নিধ্যে এলে আমার মাঝে একটা স্নিগ্ধ প্রলেপ পড়ে। লেখকদের মধ্যে সে রকম মানুষ খুব বেশী নেই, কিন্তু আপনাকে দেখেই বুঝেছিলাম। আপনার সঙ্গে আমার কোনো দিনই গাঢ় আলাপ হবে না। কারণ আপনি স্বল্পভাষী—আর আমি স্থান ও কাল হিসেবে প্রগলভ হলেও আসলে লাজুক। কিন্তু আপনার সঙ্গে আমার মনে মনে একটা বোঝাপড়া হয়ে রইলো। আমাকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করবেন।

ভালবাসা জানাই

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

 


গৌতম ঘোষের চিঠি

১০/১০/২০০০

ভাটপাড়া

প্রিয়

শামসুরদা,

পত্রবাহক শ্রী আশোক ঘোষ আমার প্রতিবেশী, ওঁর বাপ একটি বক্তৃতা দিতে ঢাকায় যাচ্ছেন; তাঁর সঙ্গেই আশোকদা ঢাকায় যাচ্ছেন; ওঁর হাতে আমি একটি ‘নন্দন’ এবং ‘জিজ্ঞাসা’ পাঠালাম; ‘জিজ্ঞাসা’য় আমার লেখাটা সম্ভব হয়েছে কেবলমাত্র আপনার জন্য। আপনি আমায় নিজে নিয়ে শিবনারায়ণ বাবুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন; লেখাটা সম্পর্কে আপনার মতামত জানবার প্রবল ইচ্ছা রইলো।

বুদ্ধদেব বাবুকে অভিনন্দন বার্তা কিছু পাঠিয়েছেন? আশোকদার মাধ্যমে পাঠিয়ে দিতে পারেন, আমি বুদ্ধবাবুকে পৌঁছে দেবো।

আপনার শরীর কেমন আছে? কদিন আগে সালাম আজাদ এসেছিল। ওঁর কাছে জানলাম আপনার দিল্লি আসবার কথা আছে, কোলকাতায় কবে আসবেন? ভাবী কেমন আছেন? ওঁকে আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম দেবেন। আপনার কথা সব সময় মনে হয়। ঢাকায় সদ্য প্রকাশিত কবিতাগুলোর জেরক্স কপি যদি পাঠান তাহলে এপার বাংলার পাঠকরা তা পড়তে পারে, তারা কী এতোই অভাগা যে আপনার সাম্প্রতিক কবিতাগুলো পড়বার সুযোগ থেকে তারা বঞ্চিত হবে? আমার আবদার নোতুন কবিতার বই পাঠাবেন। শরীরের দিকে যত্ন নেবেন। ডা. অভিজিৎ তরফদার আপনাকে যে কয়েকটি রক্ত পরীক্ষার কথা বলেছিলেন সেগুলোর কী হলো? ভালো থাকবেন? আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম আর অনেক অনেক ভালোবাসা, শুভ কামনা জানবেন।

ইতি

আপনার স্নেহধন্য

গৌতম

৯, কুমারপাড়া রোড, ভাটপাড়া, ২৪ পরগনা, লেন-৭৪৩২২৩।

ভাকুরা, পশ্চিমবঙ্গ, ফোন : ৫৮১০০৯৮, মোবাইল : ৯৮৩০১৩১৫৩৭

অরুণ মিত্রর চিঠি

এল/এ-২০

কুষ্টিয়া সরকারী আবাসন

কলকাতা-৩৯

শামসুর রাহমান,

ভাই, কতবার ভাবি ওখানে গিয়ে তোমাদের সঙ্গে মিলি, কিন্তু কিছুতেই তা আর হয় না। এবার খুব একটা সুযোগ ছিল। আমার ঘনিষ্ঠ কনিষ্ঠ বন্ধু শান্তি দাসের সঙ্গে যাওয়ার, কিন্তু আমি হঠাৎ এক কঠিন অসুখে পড়লাম, ফলে যেতে পারলাম না। এখনো আমি অসুস্থ। যাই হোক, তোমরা কলকাতায় এলে দেখা করো। দেখি ভবিষ্যতে যেতে পারি কিনা আমি হাল ছাড়িনি।

আশা করি, তোমার শরীর আগের চেয়ে ভালো এবং অন্য বন্ধুদেরও খবর ভালো। প্রীতি ও শুভেচ্ছা।

অরুণদা

১৫.২.৯৪


নিরঞ্জন হালদারের চিঠি

২২/১১/২০০১

কবি শামসুর রাহমান

ঢাকা, বাংলাদেশ

প্রীতিভাজনেষু,

কতকাল আপনার সঙ্গে যোগাযোগ নেই! মাঝে মাঝে শুনি আপনি অসুস্থ। আশা করছি এখন আগের চেয়ে ভাল আছেন। আমি ১৯৯৬ সাল থেকে অসুস্থ। ১৯৯৭ সালে একনাগাড়ে পুরো বছর শয্যাশায়ী ছিলাম। গলার একটা গ্ল্যান্ড বাদ দেওয়ায় বেঁচে থেকেছি। তবে স্পন্ডেলাইসিসের আক্রমণ আমাকে সচল থাকতে দেয়নি। তিন মাস আগের চেয়ে একটু ভাল আছি।

মাঝে একটা প্রবন্ধ লিখেছিলাম, ১৯৯০ সালে আপনার বাড়িতে আপনার প্রশ্নটি উল্লেখ করে। ২০৩০ সালে বাঙালী জাতির অবস্থা কেমন হবে? আমি অনেক ভেবেছি, অনেকের নিকট ঐ প্রশ্ন করেছি। পশ্চিমবঙ্গে মধ্যবিত্ত পরিবারে টিভি এমন হাঁকিয়ে বসেছে যে, বই পড়া বন্ধ হয়ে গিয়েছে, এমএ পাশ করা বৌরা কোনো খবরের কাগজ পড়ে না। বাংলাদেশে পুরুষদের মধ্যে ধর্মীয় গোঁড়ামী বাড়ার সঙ্গে তাল রেখে পশ্চিমবঙ্গে ব্যাপকভাবে মেয়েদের মধ্যে পুজো এবং মন্দির ও সাধু বাবাদের কাছে যাওয়া অসম্ভব রকম বেড়ে গিয়েছে। টিভির কর্মসূচি দর্শকদের বিজ্ঞান-চেতনাবিমুখ করছে। একই সঙ্গে অবশ্য রবীন্দ্রসঙ্গীতের চর্চাও বেড়ে চলেছে। মনে হচ্ছে রবীন্দ্রনাথের গান বাঙালীকে বাঁচিয়ে রাখবে। তালিবানদের মতো কোনো হিন্দু বা মুসলমান গোষ্ঠী পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশে চেপে বসতে পারবে বলে মনে হয় না। খালেদা জিয়ার আগের জমানায় মেয়েদের উপর ফতোয়া জারির কথা ভুলিনি। আগেকার পার্লামেন্টের নির্বাচনে সকলে ভোট দিতে পারায় বাংলাদেশের ভোটারেরা রাজনীতিতে পালা বদল ঘটিয়েছিলেন, কিন্তু ২০০১ সালে তারা তো বহু জায়গায় ভোট দিতেই পারেননি। পশ্চিমবঙ্গে সাহিত্য ও শিল্পের উপর বামফ্রন্ট সরকারের খবরদারি সর্বগ্রাসী। সরকার অপছন্দ করেন, এমন কেউ সিনেমা জগতে আর সক্রিয় নেই। তবে সিপিএমের গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সংঘ একচেটিয়া প্রভুত্ব করতে ব্যর্থ হওয়ায় তারা অন্য পথ নিয়েছে। লেখক, গায়ক, গায়িকা ও নাট্যকর্মীদের নানাভাবে প্রলুব্ধ করা হয়। প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগের টাকা নেই সরকারের অথচ তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তরের কোনো ব্যাপারে টাকার অভাব হয় না। গায়ক-গায়িকাদের বিবেচনাবোধ কোথাও বাঁধা থাকতে পারে। কিন্তু গানের কথা তো মানুষের মনে মুক্তির আনন্দ সৃষ্টি করে।

গৌরী আইয়ুবের উপর একটি স্মারকগ্রন্থ বেরিয়েছে। বইটিতে আইয়ুবের বাড়িতে আপনার একটি কথার উল্লেখ করেছি। কাল রাত্রেই কমলেশ চক্রবর্তী ঢাকায় যাওয়ার কথা জানালেন বলে বইটা কিনে পাঠানোর সময় নেই। প্রুফ রিডার রাহমানকে সর্বত্র রহমান করেছেন। এজন্য আপনার কাছে আমাদের সকলের হয়ে ক্ষমা চাওয়া ছাড়া আর কিছু করার নেই।

আপনি তো অসুস্থ। আপনার স্ত্রী কেমন আছেন? আপনাদের সকলকে আমার প্রীতি ও শুভ কামনা।

ইতি

নিরঞ্জন হালদার

সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ 


বাংলাদেশ সময়: ১৩৫৩ ঘণ্টা, জুলাই ২৩, ২০২১
এসআইএস
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।