ঢাকা: বিচারিক আদালত দিলেন খালাস। আর সেই রায় দেওয়ার পর বিচারক দেশত্যাগে বাধ্য হলেন।
বৃহস্পতিবার আপিল বিভাগ অর্থ পাচারের সেই মামলায় তারেক রহমান ও ব্যবসায়ী গিয়াস উদ্দিন আল মামুনকে খালাস দিয়েছেন। কারণ হিসেবে দুদকের আইনজীবী বলছেন, পাচারের কোনো অভিযোগই তারেক রহমানের বিরুদ্ধে নেই। এই যুক্তিতে আদালত খালাস দিয়েছেন।
আর মামুনের আইনজীবীরা বলছেন, এখানে দুদকের মামলা করার কোনো এখতিয়ারই নেই। আইনগতভাবে এটা অচল।
যেভাবে মামলার শুরু
টঙ্গীতে প্রস্তাবিত ৮০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের কাজ পাইয়ে দেওয়ার জন্য নির্মাণ কন্সট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেডের চেয়ারম্যান খাদিজা ইসলামের কাছ থেকে গিয়াস উদ্দিন আল মামুন ২০ কোটি ৪১ লাখ ২৫ হাজার ৮৪৩ টাকা নেন। সিঙ্গাপুরে এ টাকা লেনদেন হয়।
এরপর মামুন ওই অর্থ সিঙ্গাপুরের ক্যাপিটাল স্ট্রিটের সিটি ব্যাংক এনএতে তার নামে ব্যাংক হিসাবে জমা করেন। এ টাকার মধ্যে তারেক রহমান তিন কোটি ৭৮ লাখ টাকা খরচ করেন বলে অভিযোগ এনে ২০০৯ সালের ২৬ অক্টোবর রাজধানীর ক্যান্টনমেন্ট থানায় এ মামলাটি করে দুদক। এরপর ২০১০ সালের ৬ জুলাই তারেক রহমান ও গিয়াস উদ্দিন আল মামুনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দাখিল করা হয়।
২০১১ সালের ৮ আগস্ট এ মামলায় তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ (চার্জ) গঠন করেন আদালত।
মামলাটিতে ১৩ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়, যাদের মধ্যে চার্জশিটের বাইরের সাক্ষী হিসেবে ছিলেন মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (এফবিআই) এজেন্ট ডেবরা লেপরোভেট।
এ মামলায় ২০১৩ সালের ১৭ নভেম্বর তারেক রহমানকে বেকসুর খালাস দিয়ে গিয়াস উদ্দিন আল মামুনকে অর্থপাচার মামলায় সাত বছরের কারাদণ্ড দেন ঢাকার তৃতীয় বিশেষ জজ আদালত।
রায়ে কারাদণ্ডের পাশাপাশি মামুনকে ৪০ কোটি টাকা জরিমানাও করা হয়। পাচার করা ২০ কোটি ৪১ লাখ ২৫ হাজার ৬১৩ টাকা রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করারও নির্দেশ দেন আদালত।
কিন্তু সেই রায় কাল হয়ে দাঁড়ালো বিচারক মোতাহার হোসেনের জীবনে। এক পর্যায়ে দেশত্যাগে বাধ্য হলেন তিনি। বিভিন্ন সময়ে তিনি মালয়েশিয়া ও ফিনল্যান্ডে অবস্থান করেছেন। এর মধ্যে তার বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুদক। এমনকি তার গাড়িচালক ও দেহরক্ষীকেও জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করেছিলো দুদক। যদিও ৫ আগস্ট পট পরিবর্তনের সেই মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন। এর মধ্যে তিনি স্ত্রীকে হারিয়েছেন। তবে সেই রায়ে থেমে থাকেনি দুদক। বিচারককে হয়রানির পাশাপাশি তারেক রহমানের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে দুদক আপিল করে।
দুদক ও মামুন হাইকোর্টে
২০১৩ সালের ৫ ডিসেম্বর আপিল করে দুদক। ২০১৪ সালের ১৯ জানুয়ারি এ আপিল শুনানির জন্য গ্রহণ করেন। পাশাপাশি গিয়াস উদ্দিন মামুনও আপিল করেন। দুই আপিলের শুনানি শেষে ২০১৬ সালের ২১ জুলাই তারেক রহমানকে সাত বছরের কারাদণ্ড দেন হাইকোর্ট। একইসঙ্গে ২০ কোটি টাকা জরিমানা করা হয়।
একই মামলায় গিয়াস উদ্দিন আল মামুনের সাত বছরের কারাদণ্ডের সাজা বহাল রাখেন হাইকোর্ট।
বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম (আপিল বিভাগের বিচারপতি থাকা অবস্থায় পদত্যাগ করেন) ও বিচারপতি আমির হোসেনের (২০২১ সালে প্রয়াত) হাইকোর্ট বেঞ্চ ওই রায় দেন।
আপিল বিভাগে মামুনের আপিল
হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে গিয়াস উদ্দিন মামুন আপিল বিভাগে লিভ টু আপিল (আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন) করেন। গত ১০ ডিসেম্বর আপিল বিভাগ আপিলের অনুমতি দিয়ে হাইকোর্টের রায় স্থগিত করেন। এরপর মামুন আপিল করেন। সেই আপিলের শুনানি শেষে বৃহস্পতিবার রায় দেন আপিল বিভাগ।
আদালতে আবেদনের পক্ষে ছিলেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এস এম শাহজাহান ও শেখ মোহাম্মদ জাকির হোসেন এবং আইনজীবী সাব্বির হামজা চৌধুরী। দুদকের পক্ষে ছিলেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আসিফ হাসান।
আইনজীবীদের বক্তব্য
জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এস এম শাহজাহান বলেন, এই মামলায় গিয়াসউদ্দিন আল মামুনের সাত বছরের সাজা ছিলো। তারেক রহমানকে বিচারিক আদালত খালাস দিয়েছিলো। ওই খালাসের বিরুদ্ধে দুদক আবার হাইকোর্ট বিভাগে আপিল করলো। শুনানির পর গিয়াস উদ্দিন আল মামুনের সাজা বহাল থাকে। আর দুদকের আপিল মঞ্জুর করে তারেক রহমানকে সাত বছর সাজা দেওয়া হয়। তার বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আপিল করা হয়। আজকে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে আপিল বিভাগ নির্দোষ সাব্যস্তে গিয়াস উদ্দিন আল মামুনকে খালাস দিয়েছেন। আর তারেক রহমান যদিও এ মামলায় আপিল করতে পারেননি, আমরা আমাদের সুপ্রিম কোর্ট, ইন্ডিয়ান ও পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের বিভিন্ন রায় থেকে দেখিয়েছি যে, যদি মামলা মুখ্য অভিযুক্তের বিরুদ্ধে প্রমাণ না হয়, যদি মামলা দেখা যায় যে এটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে করা হয়েছে, হয়রানি করার জন্য করা হয়েছে, এ মামলা সাজা দেওয়ার মতো কিছু নেই, সে ক্ষেত্রে কেউ যদি আপিল নাও করে কোর্ট ইচ্ছা করলে তাকেও খালাসের বেনিফিট দিতে পারে। এভাবে আমাদের আবেদন ছিলো এবং বিভিন্ন উদ্ধৃতি আমরা দেখিয়েছি। প্রধান বিচারপতিসহ আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ আমাদের এই বক্তব্য (কনটেনশন) গ্রহণ করেছেন। তারেক রহমানও এই রায়ের বেনিফিট পাবেন। অর্থাৎ আমরা বলতে পারি এ মামলায় উনিও নির্দোষ সাব্যস্তে খালাস পেয়েছেন।
অপর আইনজীবী শেখ জাকির হোসেন বলেন, আমেরিকা থেকে এফবিআই এক্সপার্ট ডেভরাকে নিয়ে আসা হয় সাক্ষী দেওয়ার জন্য। উনি কোথাও বলেন নাই তারেক রহমান বা গিয়াসউদ্দিন আল মামুন অর্থ পাচারের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। বিচারিক আদালত সব কিছু দেখে শুনে তারেক রহমানকে খালাস দেন। কিন্তু রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে তৎকালীন দুদক এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে। আপিলে ১৩০ পৃষ্ঠার রায় দেওয়া হয় হাইকোর্টে। তারেক রহমানকে ৭ বছরের সাজা ও ২০ কোটি টাকা জরিমানা করা হয়। পরে গিয়াস উদ্দিন আল মামুন আপিল করেন। শুনানিতে আপিল বিভাগ দেখতে পান এই মামলায় কোনো সারবত্তা নেই। দুদকের মামলা করার কোনো অথরিটি নেই। আইনগতভাবে এটা অচল। আপিল বিভাগ বিচার বিশ্লেষণ করে তারেক রহমান ও গিয়াসউদ্দিন আল মামুনকে খালাস দিয়েছেন। তাদের যে মানহানি হয়েছে সেটাকে ফেরত দেওয়া হয়েছে।
দুদক আইনজীবীর বক্তব্য
দুদক আইনজীবী আসিফ হাসান বলেন, টোটাল কেসে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে পাচারের বিষয়ে কিছু নেই। সেখানে আছে শুধু একটা হিসাব থেকে কয় লাখ টাকা খরচ করেছে। খরচ তো আসলে পাচার না। খরচ আর পাচার জিনিসটা আলাদা। পাচারের কোনো অভিযোগ তারেক রহমানের বিরুদ্ধে নেই। এই যুক্তিতে আদালত খালাস দিয়েছেন।
বাংলাদেশ সময়: ২১১০ ঘণ্টা, মার্চ ০৬, ২০২৫
ইএস/এজে