ঢাকা, বুধবার, ১১ চৈত্র ১৪৩১, ২৬ মার্চ ২০২৫, ২৫ রমজান ১৪৪৬

বাংলানিউজ স্পেশাল

মাগুরায় শিশু ধর্ষণ

এজাহারের সঙ্গে মিলছে না আসামির জবানবন্দি, গোলক ধাঁধায় পুলিশ

সুব্রত চন্দ ও জয়ন্ত জোয়াদ্দার | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬২৪ ঘণ্টা, মার্চ ২৩, ২০২৫
এজাহারের সঙ্গে মিলছে না আসামির জবানবন্দি, গোলক ধাঁধায় পুলিশ মাগুরায় শিশু ধর্ষণ মামলার আসামি হিটু শেখ

মাগুরা থেকে: ‘মাগুরায় ধর্ষণের শিকার হয়ে মারা যাওয়া ৮ বছরের শিশুটিকে একাই ধর্ষণ করেছেন তার বোনের শ্বশুর। ধর্ষণের সময় শিশুটির বোন ছাড়া অন্য আসামিদের কেউই বাড়িতে ছিলেন না।

’ - ধর্ষণ মামলায় দোষ শিকার করে আদালতে এমন জবানবন্দি দিয়েছেন মামলার প্রধান আসমি হিটু শেখ (৪২)।  

তবে তার এই জবানবন্দির সঙ্গে শিশুটির মায়ের করা মামলার এজাহারের মিল নেই। শিশুটির বোনের ভাষ্যও ভিন্ন। এ নিয়ে গোলকধাঁধায় পড়েছে পুলিশ।

মামলার এজাহার ও তদন্ত সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে হিটু শেখ বলেছেন, ৬ মার্চ সকালে শিশুটিকে তার বোনের কক্ষে একা পেয়ে ধর্ষণ করেন তিনি। এ সময় শিশুটি চিৎকার করলে তার গলা টিপে ধরেন। এতে সে অচেতন হয়ে পড়ে। তবে তাকে মেরে ফেলা তার উদ্দেশ্য ছিল না।

ঘটনার বিস্তারিত সম্পর্কে তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ঘটনার দিন ওই বাড়িতে মোট ৭ জন ব্যক্তি ছিলেন। এর মধ্যে শিশুটির বোনের শাশুড়ি জাহেদা বেগম ভোর ৬টায় বাড়ির পাশে মাঠে মসুরি তুলতে যায়। এরপর শিশুটির বোনের ভাশুর রাতুল শেখ মসুরি বিক্রি করার উদ্দেশ্যে বাড়ির পাশের এক বন্ধুর বাসায় যান। এর কিছুক্ষণ পর শিশুটির বোনের স্বামী সজীব শেখ ডিম দিয়ে ভাত খেয়ে রাজমিস্ত্রির কাজে চলে যায়। এরপর শিশুটির বোনের দাদিশাশুড়ি রোকেয়া বেগম তার ছেলে হিটুকে মসুরি তুলতে যেতে বকাবকি করে বিদ্যুৎ বিল দিতে চলে যায়। তখন বাড়িতে ছিল ভুক্তভোগী শিশুটি, তার বোন ও বোনের শ্বশুর হিটু শেখ।

সকাল ৮টা ২০ মিনিটের দিকে হিটু শেখ তার কক্ষ থেকে বের হয়ে দেখেন শিশুটির বোন রান্নাঘরের কোণে ফোনে কথা বলছেন। এই সুযোগে ভুক্তভোগী শিশুটিকে তার বোনের কক্ষে একা পেয়ে ধর্ষণ করতে যান হিটু শেখ। তখন শিশুটি চিৎকার দিয়ে উঠলে তিনি শিশুটির গলা টিপে ধরেন। এতে শিশুটি অচেতন হয়ে পড়ে। তখন শিশুটিকে ধর্ষণ করতে গেলে যৌনাঙ্গ ছোট হওয়ায় হিটু শেখ ব্লেড দিয়ে কেটে তা বড় করার চেষ্টা করেন। পরবর্তীতে সেখান থেকে বের হয়ে তিনি ভাত খেয়ে কাজে চলে যান। তখনও শিশুটির বোন রান্নাঘরের কোনে ফোনে ব্যস্ত ছিলেন।

সকাল ১০টার সময় প্রতিবেশী এক নারী ওই বাড়িতে আসেন। একই সময় বাড়িতে প্রবেশ করে শিশুটির বোনের ভাশুর রাতুল শেখ। তখন রাতুল ঘরে ঢুকে শিশুটিকে কাতরাতে দেখে প্রতিবেশী ওই নারীকে ডেকে কী হয়েছে দেখতে বলেন। ঘরটি অন্ধকার থাকায় তখন কেউই বিষয়টি গুরুত্ব দেননি। এরপর শিশুটির বোন ঘরে ঢুকে তাকে অচেতন অবস্থায় দেখে প্রতিবেশী ওই নারীকে ডাকেন। তখন তারা দুজন মোবাইলফোনের আলো জ্বেলে দেখেন শিশুটির গলায় কালো দাগ। এরপর শিশুটির মাথায় পানি ঢেলে ও চোখে-মুখে পানি দেওয়ার পরও জ্ঞান না ফিরলে তারা চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করেন। মাঠ থেকে শাশুড়িকে ডাকতে লোক পাঠান তারা। খবর শুনে শাশুড়ি বাড়ি ফিরে মনে করেন শিশুটিকে ভূতে ধরেছে। এরপর তারা একটি ভ্যানে করে শিশুটিকে স্থানীয় এক হুজুরের কাছে নিয়ে যান। তখন ওই হুজুর শিশুটিকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে বলেন।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, প্রাথমিক তদন্তে হিটু শেখ ছাড়া ঘটনার সঙ্গে মামলার অন্য আসামিদের কারোরই সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি। এমনকি ধর্ষণের শিকার হয়ে মারা যাওয়া শিশুটি ওইদিন সকালে বারান্দায় এসে ভাত খেয়েছে বলেও জানা গেছে।

এদিকে গত ৮ মার্চ এই ঘটনায় মাগুরা সদর থানায় শিশুটির মা আয়েশা আক্তারের করা মামলার এজাহারে বলা হয়েছে ভিন্ন কথা। এজাহারে বলা হয়, গত ৫ মার্চ রাতে ভুক্তভোগী শিশুটি তার বোন ও বোনের স্বামীর সঙ্গে তাদের কক্ষে ঘুমায়। রাত আড়াইটার দিকে শিশুটির বোন ঘুম থেকে উঠে দেখেন সে মেঝেতে পড়ে আছে। এ সময় শিশুটি তার বোনকে জানায় তার যৌনাঙ্গে জ্বালাপোড়া করছে। পরদিন সকালে আবার শিশুটি তার যৌনাঙ্গে জ্বালাপোড়ার কথা বড় বোনকে জানায়। জ্বালাপোড়ার কারণ জিজ্ঞেস করলে শিশুটি কাঁদতে কাঁদতে তার বোনকে বলে, রাত দেড়টার দিকে তার বোনের স্বামী দরজা খুলে দিলে, শ্বশুর শিশুটিকে মুখ চেপে ধরে তাদের কক্ষে নিয়ে যায় এবং ধর্ষণ করেন। এ সময় চিৎকার করতে গেলে শিশুটির বোনের শ্বশুর তাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা চেষ্টা করে এবং তাকে পুনরায় বোনের কক্ষে রেখে যায়। বিষয়টি জানার পর শিশুটির বড় বোন তার মাকে জানাতে গেলে তার স্বামী মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেন এবং তাকে মারধর করে কাউকে কিছু বলতে নিষেধ করেন। পাশাপাশি বিষয়টি কাউকে জানালে শিশুটিকে মেরে ফেলার হুমকি দেন এবং শিশুটি ও তার বোনকে দুটি আলাদা কক্ষে আটকে রাখে। পরে প্রতিবেশী এক নারী ওই বাড়িতে এলে শিশুটির ভাশুর দরজা খুলে দেন৷ তখন শিশুটি আরো অসুস্থ হয়ে পড়লে তার বোন ও প্রতিবেশী ওই নারী তার মাথায় পানি ঢেলে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করেন। পরে সকাল সাড়ে ১০টার সময় শিশুটির বোনের শাশুড়ি ও অন্যান্য প্রতিবেশীরা তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়।

এজাহারে শিশুটির বোনকে বিয়ের পর থেকে তার শ্বশুর কুপ্রস্তাব দিয়েছে বলেও অভিযোগ করা হয়।

এজাহারে উল্লেখ করা প্রতিবেশী সেই নারীর সঙ্গে কথা হয় বাংলানিউজের। তিনি জানান, তিনি যখন ১০টার দিকে ওই বাড়িতে যান, তখন শিশুটি ঘরে শুয়ে ছিল এবং তার বোন রান্না ঘরে কথা বলছিল। তিনি যখন ওই বাড়িতে ঢুকছিলেন, শিশুটির বোনের ভাশুরও বাইরে থেকে এসে বাড়িতে প্রবেশ করেন। সে সময় বাড়িতে আর কাউকে দেখেননি তিনি।

তবে শিশুটির বোন এর আগে একবার রাগ করে তার বাবার বাড়ি চলে গিয়েছিলেন বলেও জানান তিনি। কেন রাগ করে বাবার বাড়ি গিয়েছিলেন সে সম্পর্কে কিছু বলতে পারেননি তিনি। তিনি বলেন, হয়তো ভয়ে, হয়তো লজ্জায় কিছু বলেনি। তবে কখনো ওই বাড়িতে মারধর, ঝগড়াঝাটির কথা শুনিনি। আর যদি রাতের বেলা ঘরের ভেতরে কোনো কাহিনি ঘটে থাকে সেটা তো বলতে পারব না।

যা বলছে নিহত শিশুটির বোন:
ঘটনার পর বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমে দেওয়া বক্তব্যে শিশুটির বোন জানায়, রাতে ঘুম থেকে ওঠার পর শিশুটিকে মেঝেতে পড়ে থাকতে দেখেন তিনি৷ তখন তাকে মেঝে থেকে উঠিয়ে খাটে ওঠান তিনি। তবে তখন তিনি কিছু খেয়াল করেননি। পরে সকালে শিশুটি একবার বাইরে বের হয়েছিল। তারপর বোনকে বলেছে, তার ভালো লাগছে না। এটা বলেই শুয়ে পড়ে। তারপর তার ভালো লাগছে না বলে কান্নাকাটি করছিল। তারপর অচেতন হয়ে যায়।

গণমাধ্যমে তিনি আরও অভিযোগ করেন, আগেও একবার বোন বেড়াতে এলে তাকে জড়িয়ে ধরেছিল তার শ্বশুর। এমনকি তাকেও একবার জড়িয়ে ধরেছিল। বিষয়টি তার মাকে বলার পরও তারা সেটি বিশ্বাস করেনি। বরং ভেবেছিল বাড়িতে যাওয়ার জন্য তিনি মিথ্যা কথা বলছেন।

গোলকধাঁধায় পুলিশ:
মামলার এজাহার ও গ্রেপ্তার প্রধান আসামির জবানবন্দিতে মিল না থাকায় গোলকধাঁধায় পড়েছে পুলিশ।

তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গ্রেপ্তার আসামিরা এক কথা বলছেন। কিন্তু ভুক্তভোগী শিশুটির বোন একেকবার একেক কথা বলছেন। যে কারণে কোনটা সত্য তা এখনো স্পষ্ট নয়। তবে প্রাথমিক তদন্তে হিটু শেখ ছাড়া এখন পর্যন্ত এই ঘটনায় আর কারোর সম্পৃক্ততা পাননি তারা।

যা বলছে পুলিশ:
এই বিষয়ে জানতে চাইলে মাগুরা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপারেশন অ্যান্ড অপস) মো. মিরাজুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, মামলার প্রধান আসামি হিটু শেখ ধর্ষণের দায় স্বীকার করে ইতোমধ্যে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। এ ঘটনায় বাকি আসামিরা জড়িত ছিলেন কি না সেটি ডিএনএ ও ফরেনসিক রিপোর্ট পাওয়ার পর জানা যাবে।

এদিকে এ ঘটনাকে ঘিরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি পোস্ট ভাইরাল হতে দেখা যায়। সেই পোস্টে বলা হয়, ভুক্তভোগী শিশুটির বোন বিয়ের পর থেকেই স্বামী, শ্বশুর ও ভাশুর দ্বারা প্রতিনিয়ত ধর্ষণের শিকার হতেন৷ এমনকি ভুক্তভোগী শিশুটিও বেড়াতে এসে বিষয়টি দেখে ফেলায় তাকে তিনজন মিলে ধর্ষণ ও হত্যা চেষ্টা করে।

যদিও বাংলানিউজের অনুসন্ধানে এমন তথ্যের সত্যতা পাওয়া যায়নি।

বাংলাদেশ সময়: ১৫৫২ ঘণ্টা, মার্চ ২৩, ২০২৫
এসসি/এসএএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।