সুনামগঞ্জের বন্যায় ভেসে যাওয়া ঘরবাড়ি, খুলনার লবণাক্ত জমি কিংবা ভোলার নদীভাঙন সব জায়গা থেকে শহরের পথে ছুটে আসছেন হাজারও নারী। বিভিন্ন শহরে গড়ে ওঠা পোশাক কারখানাগুলো এখন যেন তাদের নতুন আশ্রয়।
২০১৭ সালে সাতক্ষীরা থেকে ঢাকার করাইল বস্তিতে ঠাঁই হয় ১৮ বছর বয়সী রূপালীর। ঘূর্ণিঝড় মোরার আঘাতে সব হারিয়ে পরিবারের সঙ্গে ঢাকায় আসেন তিনি। এরপর কিশোরী রূপালী আর তার বোন হালিমা প্রতিবেশীর সহযোগিতায় চাকরি নেন গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিতে। বর্তমানে রূপালী টঙ্গীর একটি গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিতে কর্মরত, সেখানে সেলাই অপারেটর হিসেবে কাজ করছেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড়ে সব ভেসে গিয়েছিল আমাদের। ঘর, জমি, গরু সব হারিয়েছি আমরা। আব্বা সেসময় ক্ষেতে তরমুজ চাষ করেছিল, সবই গেল আমাদের। ঋণে জর্জরিত হয়ে অবশেষে ঢাকার জীবন বেছে নিলাম আমরা। সেলাই অপারেটর হিসেবে দিন শুরু করি সকাল ৯টা থেকে, মাঝে টিফিন খাওয়ারও সময় দেয় না। সোয়েটার ফ্যাক্টরিতে রাত দশটা পর্যন্ত খাটতে হয়, কোনো ওভার টাইম নেই। তবে রাত দশটার পর নাইট শিফ্ট। ’
‘এইখানে কাজ করার সময় বেশি বাথরুমে যেতে দেয় না স্যারেরা, আর কোনো অসুস্থতাতেই ছুটি পাই না আমরা। ’ যুক্ত করেন রূপালী।
বাংলাদেশে ২০০৯ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অভ্যন্তরীণ অভিবাসন ক্রমেই বেড়েছে। বিশেষ করে দক্ষিণ-পশ্চিম ও উপকূলীয় অঞ্চলগুলো সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হয়েছে।
খুলনা বিভাগের খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট, বরিশাল বিভাগের বরগুনা, পটুয়াখালী ও ঝালকাঠি জেলায় নদীভাঙন, ঘূর্ণিঝড় ও বন্যার কারণে ব্যাপক স্থানচ্যুতি ঘটেছে। এছাড়া উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সিলেট ও সুনামগঞ্জে অতিবৃষ্টি ও হঠাৎ বন্যার (Flash flood) প্রভাবে ২০২২ ও ২০২৪ সালের বন্যায় মানুষের ব্যাপক স্থানচ্যুতি হয়েছে।
মাইগ্রেশন পলিসি ইনস্টিটউট আর্টিকেলে (Migration Policy Institute Article) বলা হয়েছে, ২০১৪ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে প্রায় ১৪.৭ মিলিয়ন মানুষ তাদের বাড়ি থেকে স্থানচ্যুত হয়েছে।
আর ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের গ্রাউন্ড সয়েল ২০২১ সালের রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০১৮ সালেই বাংলাদেশে প্রায় ৩.৫ লাখ মানুষ জলবায়ু–সম্পর্কিত কারণে স্থানচ্যুত হয়। এর মধ্যে ৬০ শতাংশ উপকূলীয় জেলা থেকে, যার ৪০ শতাংশ নারী।
ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের ২০২৫ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে ১৩.৩ মিলিয়ন মানুষ অভ্যন্তরীণভাবে স্থানচ্যুত হতে পারে, যা দক্ষিণ এশিয়ার অভ্যন্তরীণ অভিবাসীদের প্রায় ৩৭ শতাংশ, যাদের অর্ধেকের বেশি নারী।
গবেষণায় আরও বলা হয়, এই নারীদের বড় অংশ গার্মেন্টস শিল্পে যুক্ত হচ্ছেন, কিন্তু তাদের ৭৩ শতাংশ পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবা পান না এবং ৬২ শতাংশ নারী কর্মস্থলে বৈষম্য বা হয়রানির মুখে পড়েন।
এই অভিবাসনের ক্ষেত্রে নারীরা পুরুষের তুলনায় অনেক বেশি দুর্বল অবস্থায় আছেন। পুরুষরা বেশিরভাগ সময় বেতনভুক্ত কাজ পান, কিন্তু নারীরা মূলত ‘অবদানকারী পারিবারিক কর্মী’ (contributing family worker) হিসেবে কাজ করেন, যার বেতন অনেক কম ।
গবেষণায় দেখা গেছে, অভিবাসী নারীদের ৯৫ শতাংশ জানান, কাজের জায়গায় শিশু দেখাশোনার সুবিধা নেই। ৮৮ শতাংশ পর্যাপ্ত স্যানিটেশন সুবিধা পান না। ৮৭ শতাংশ নিরাপত্তা বীমা বা সুরক্ষার ব্যবস্থা পান না। ৬৭ শতাংশ জানান, তাদের বেতন পুরুষদের তুলনায় কম।
স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রেও নারীরা পিছিয়ে। অভিবাসী নারীদের মাত্র ২০ শতাংশ গর্ভপরিদর্শন (ANC) চারবার বা তার বেশি গ্রহণ করেন, যেখানে স্থায়ী বা অবিবাসী নারীর জন্য হার প্রায় ৪০ শতাংশ।
বিশ্বব্যাংক রিপোর্টে সুপারিশ করা হয়েছে, নীতি, নগর পরিকল্পনা এবং স্বাস্থ্যসেবায় নারীদের চাহিদা অগ্রাধিকার দেওয়া প্রয়োজন, যাতে তারা নিরাপদ, সুস্থ ও কর্মক্ষম থাকতে পারে।
আরেকটি গবেষণা (IOM, 2024) অনুযায়ী, জলবায়ুজনিত অভিবাসী নারীদের মধ্যে প্রজনন স্বাস্থ্য সমস্যা, মানসিক চাপ এবং কর্মক্ষেত্রে অধিকারহীনতা বেড়ে যাচ্ছে।
খুলনার পাইকগাছা থেকে ২০২০ সালে গাজীপুর অভিবাসী হয়েছেন ১৭ বছরের পূর্নিমা আক্তার। ভুগছেন সার্ভিক্যাল সমস্যায়। লবণাক্ত পানির কারণে তার পরিবারে আয়ের একমাত্র উৎস জমি চাষ করা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় শহরে পাড়ি জমান তিনি।
‘এখন গার্মেন্টসেই ভরসা, কিন্তু এখানে প্রজনন স্বাস্থ্য সেবা খুব খারাপ। ক্লিনিক আছে, কিন্তু কেউ আমাদের সমস্যা শোনে না। আজ এক বছর যাবৎ রোগে ভুগতেছি, ভালো কোনো চিকিৎসা করাতে পারছি না অর্থাভাবে,’ বলেন পূর্নিমা।
নদীভাঙনে ঘর হারানো নাসিমা জানান, ভোলায় ঘর গেছে, এখন গাজীপুরে কাজ করেন। মাসে ১৪ হাজার টাকায় পরিবার চালাতে হয়। সন্তান গ্রামের বাড়িতে দাদির কাছে। এখানে বাথরুমে পরিচ্ছন্নতা নেই, নেই গর্ভকালীন ছুটি। বিরামহীন মেশিনে কাজ করতে হয় তাদের।
‘শরীর চলে না, বাচ্চা হওয়ার পর ২টা মাসও ছুটি পাইনি, এই দুধের বাচ্চা রেখে আবার পেটের তাগিদে কাজে আসছি। আমার তলপেট সারাক্ষণই ব্যথা করে। চিকিৎসা করানোর মতো অর্থও নেই। আবার কারখানায় কোনো চিকিৎসা সুবিধাও আমাদের জন্য নেই। ’
গ্রীন বাংলা গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি সুলতানা বেগম বলেন, ‘অভিবাসি নারীদের সিংহভাগই কল-কারখানাগুলোতে শ্রমিক হিসেবে আসে। ১৮-৪৫ বছর বয়সী নারীদের সংখ্যাই বেশি, যারা ঋতুমতী। তবে মাসিক চলাকালীন তারা কোনো বিশ্রাম তো পায়ই না, উল্টো কাজের চাপে পড়ে। এছাড়া কারখানার নোংরা ঝুট তারা ব্যবহার করে, যা তাদের প্রজনন স্বাস্থ্যকে ঝুঁকিতে ফেলছে। এসব নিয়ে আমরা কথা বলেছি, এখনও বলছি যে অন্তত মাসিকের সময় যাতে গার্মেন্টস থেকে নারীদের ন্যাপকিন সেবাটা নিশ্চিত করা হয়। কিন্তু তা করা হচ্ছে না। ’
তিনি অভিযোগ করেন, দেশে ৬০ শতাংশ গার্মেন্টসই নারীদের মাতৃত্বকালীন ছুটি ও ভাতা দেয় না। বরং তারা নারীদের সন্তান নিতে নিরুৎসাহিত করে বিভিন্নভাবে।
‘জলবায়ুর অভিঘাতে অভিবাসী হয়ে আসা নারীরা শহরের গামেন্টেসের কর্ম পরিবেশের যাঁতাকলে পিষ্ঠ হচ্ছে, যা তাদের মানসিক ও শারিরীক উভয় স্বাস্থ্যকেই ক্ষতিগ্রস্ত করছে। ’ যুক্ত করেন তিনি।
সম্প্রতি আইসিডিআরবির এক গবেষণা বলছে, গার্মেন্টেসে নারীদের ওপর কর্মস্থলে মানসিক সহিংসতার হার দুই বছরে ৪৮ শতাংশ থেকে ৫৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। কর্মস্থলে প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা সীমিত; মাত্র ২২ শতাংশ কারখানায় স্যানিটারি প্যাড সরবরাহ করা হয় এবং মাত্র ১৪ শতাংশ কারখানায় পরিবার পরিকল্পনা সামগ্রী বা তথ্য পাওয়া যায়।
গবেষণার প্রধান গবেষক ড. রুচিরা তাবাসসুম নাভেদ বলেছেন, ‘বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পে কর্মরত নারীদের প্রজনন স্বাস্থ্য পরিস্থিতি অন্যান্য নারীদের তুলনায় খারাপ। ’ তিনি সরকারের, উন্নয়ন সংস্থা ও অংশীদারদের যৌথ উদ্যোগের মাধ্যমে এই পরিস্থিতির উন্নতির আহ্বান জানিয়েছেন।
এনডি