ঢাকা: এইতো গত ফেব্রুয়ারির ঘটনা। সচিবালয়ের সামনে একদল আন্দোলনকারীকে ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশের এক সদস্যকে লাঠিপেটার ‘অভিনয়’ করতে দেখা যায়।
সর্বনিম্ন বলপ্রয়োগের মাধ্যমে ভয় সৃষ্টি করে আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করার সেই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে বিভিন্ন মহলে প্রশংসিত হন তিনি।
গত ১৩ ফেব্রুয়ারির বিচ্ছিন্ন ওই ঘটনায় রিয়াদ নামে ওই কনস্টেবল প্রশংসায় ভাসলেও আন্দোলন-বিক্ষোভ দমনে পুলিশের বিরুদ্ধে অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো গুরুতর অভিযোগ নানা সময়েই এসেছে। বিশেষ করে বিরোধী দল-মতের আন্দোলন-বিক্ষোভ দমনে পুলিশের ভূমিকা প্রায়ই বিতর্কের জন্ম দেয়।
সর্বশেষ একটি ঘটনার দিকে নজর দেওয়া যাক। ঈদের আগে বকেয়া পরিশোধের দাবিতে ২৫ মার্চ সচিবালয় অভিমুখে পোশাক শ্রমিকদের মিছিল পুলিশি বাধায় পণ্ড হয়। সেখানে অন্তত ৩০-৩৫ থেকে জন শ্রমিক আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। পুলিশেরও কয়েকজন আহত হয়েছেন। এক্ষেত্রেও পুলিশের বলপ্রয়োগের ধরন আলোচনায় উঠে এসেছে।
২৮ অক্টোবর, ২০২৩। সেদিন সরকার পতনের এক দফা দাবিতে বিএনপির মহাসমাবেশকে ঘিরে পুলিশের সঙ্গে দলটির নেতাকর্মীদের সংঘর্ষ হয়। ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, ইট পাটকেল নিক্ষেপ এবং একের পর এক টিয়ারশেল ও সাউন্ড গ্রেনেডের শব্দে রণক্ষেত্রে রূপ নেয় রাজধানীর নয়াপল্টন ও আশপাশের এলাকা।
সেই সংঘর্ষে পুলিশের এক সদস্য যেমনি নিহত হয়েছিলেন, তেমনি যুবদলেরও এক নেতাও নিহত হন। আহত হন সাংবাদিকসহ দুই পক্ষের আরও অনেকে। ‘শান্তিপূর্ণ’ সেই সমাবেশে পুলিশই হামলা চালিয়েছিল, এমন অভিযোগ বিএনপির। সম্প্রতি আদালতও এক রিমান্ড শুনানিতে সংঘর্ষে পুলিশের সম্পৃক্ততা ছিল বলে মন্তব্য করেছেন। এমন বড় ঘটনা ছাড়াও ছোট ছোট বিভিন্ন আন্দোলন-বিক্ষোভ দমনে পুলিশকে বলপ্রয়োগ করতে দেখা যায়।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সর্বোচ্চ বলপ্রয়োগের চিত্র দেখা যায় জুলাই আন্দোলনে। প্রায় এক মাস ধরে চলা ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে পুলিশ সদস্যদের ভারী অস্ত্রও ব্যবহার করতে দেখা যায়। জাতিসংঘের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, বাংলাদেশে জুলাই–আগস্টে আন্দোলন দমনে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, নির্বিচার গুলি, গণগ্রেপ্তার ও নির্যাতনের মতো মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটে।
পুলিশের অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের টেক্সটবুক উদাহরণ রংপুরে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী আবু সাঈদ হত্যাকাণ্ড। জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয়ের (ওএইচসিএইচআর) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্লেষণ করা তথ্যের ভিত্তিতে এটি বিশ্বাস করার যথেষ্ট যুক্তিসংগত কারণ রয়েছে, আবু সাঈদ পুলিশের ইচ্ছাকৃত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, রংপুরে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী আবু সাঈদের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না। এটি ছিল বাংলাদেশ পুলিশের অপরাধ প্রবণতার প্রতিচিত্র। আন্দোলনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পুলিশ ধারাবাহিকভাবে স্বল্প-ব্যারেলের স্টকবিহীন শটগান ব্যবহার করে। পুলিশ বন্দুক লোড করে বিক্ষোভকারীদের ওপর নির্বিচারে গুলি করেছে।
অনুমান করা হচ্ছে, ১ জুলাই থেকে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত ১ হাজার ৪০০ জন নিহত হন। তাদের বেশির ভাগই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে নিহত হন। এমন বাস্তবতায় প্রশ্ন উঠছে— পুলিশ কি আইন মেনে বলপ্রয়োগ করে? নাকি অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ তাদের নীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে?
পুলিশ কতটা বলপ্রয়োগ করতে পারে
আইনে পুলিশের বলপ্রয়োগের বিষয়ে কী বলা আছে, তা জানতে বাংলানিউজ কথা বলেছে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী খাদেমুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৭ অনুচ্ছেদে অনুযায়ী, প্রত্যেক নাগরিকের সভা-সমাবেশের স্বাধীনতা আছে। জনশৃঙ্খলা বা জনস্বার্থে আইনে আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বিধিনিষেধ-সাপেক্ষে শান্তিপূর্ণভাবে ও নিরস্ত্র অবস্থায় সমবেত হওয়া এবং জনসভা ও শোভাযাত্রায় যোগদানের অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের রয়েছে। তবে কোনো সভা-সমাবেশ যদি জননিরাপত্তার জন্য হুমকি হয় বা জনভোগান্তি সৃষ্টি করে, সেক্ষেত্রে ক্ষমতাপ্রাপ্ত সংস্থা হিসেবে পুলিশ সেই সমাবেশ ছত্রভঙ্গ করার আইনগত কর্তৃত্ব রাখে।
এক্ষেত্রে কতগুলো আইনে পুলিশের কর্তৃত্ব নিয়ন্ত্রিত হয় জানিয়ে তিনি বলেন, ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধি আইনে সমাবেশ কখন বেআইনি হবে, সেই সংজ্ঞা দেওয়া আছে এবং বেআইনি সমাবেশে সম্পৃক্ত হলে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ গণ্য করা হবে। এর বাইরে ফৌজদারি কার্যবিধি আইন, পুলিশ রেগুলেশন অব বেঙ্গল এবং ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ আইনেও বেআইনি সমাবেশ নিয়ন্ত্রণে পুলিশের আইনগত কর্তৃত্ব রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, পুলিশ এ ধরনের সমাবেশ ছত্রভঙ্গ করার পাশাপাশি জনশৃঙ্খলা নিশ্চিতে কতটা বলপ্রয়োগ করবে, তা নির্ভর করে পরিস্থিতির ওপর। কারা সমাবেশ করছে, কী উদ্দেশে বা কী দাবিতে করছে, সমাবেশ কতটা শান্তিপূর্ণ বা শান্তিপূর্ণ থাকতে পারে, কতটা জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করতে পারে ইত্যাদি বিষয় বিবেচনা করা হয়। সমাবেশে অংশগ্রহণকারীরা পুলিশের ওপর হামলা বা আক্রমণ করছে কি না, এসব বিষয়ও দেখা হয়।
সমাবেশ ছত্রভঙ্গ করা, বলপ্রয়োগ নিয়ে আইনে কী বলা আছে
ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮ এর ১২৭ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ম্যাজিস্ট্রেট বা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) যদি মনে করেন, কোনো সমাবেশ জননিরাপত্তার জন্য হুমকি, তাহলে তিনি তা অবৈধ ঘোষণা করে ছত্রভঙ্গ করার নির্দেশ দিতে পারেন।
১২৮ ধারায় বলা হয়েছে, যদি আদেশের পরও জনতা ছত্রভঙ্গ না হয়, তাহলে বলপ্রয়োগ করা যেতে পারে, এবং প্রয়োজনে গ্রেপ্তার করা যাবে। পাশাপাশি সমাবেশে অংশগ্রহণকারীরা যদি হিংস্র ও মারমুখী হন, তাহলে অন্যের জীবন রক্ষায় গুলিও করা যাবে। তবে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার নিচের পদের কেউ দিতে পারেন না।
১২৯ ধারায় বলা হয়েছে, তারপরও যদি সমাবেশ ছত্রভঙ্গ করা না যায় এবং জননিরাপত্তার জন্য যদি সেটি ছত্রভঙ্গ করা প্রয়োজন হয়, তাহলে সামরিক শক্তি ব্যবহার করা যাবে। তবে যথাসম্ভব কম বলপ্রয়োগের কথাও বলা হয়েছে ১৩০ ধারায়। এসব আইনের অধীনে বলপ্রয়োগ করা পুলিশ ও সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সরকারের অনুমতি ছাড়া ফৌজদারি মামলা করা যাবে না বলেও উল্লেখ রয়েছে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৩২ ধারায়।
পুলিশের বলপ্রয়োগের বিষয়টি পুলিশ রেগুলেশনস বেঙ্গলেও (পিআরবি) উল্লেখ হয়েছে। পিআরবি প্রবিধান ১৪৩-এ বলা হয়েছে, যদি কোনো সমাবেশকে আইন অনুযায়ী ছত্রভঙ্গ করা সম্ভব না হয়, তবে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে তা করা যেতে পারে। প্রবিধান ১৪৫-এ বলা হয়েছে, যদি কোনো থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মনে করেন যেকোনো মারাত্মক দাঙ্গা বা অপরাধ সংঘটিত হতে চলেছে, তবে তিনি হেড কনস্টেবল বা উচ্চপদস্থ কাউকে তা দমন করার নির্দেশ দিতে পারবেন।
প্রবিধান ১৪৬-এ বলা হয়েছে, দাঙ্গা বা গোলযোগের পরিস্থিতিতে বিশেষ সশস্ত্র বাহিনী নিয়োগ করা যেতে পারে, তবে সুপারিনটেনডেন্টের জন্য দায়ী থাকবেন এবং জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে পরামর্শ করবেন। পাশাপাশি সশস্ত্র বাহিনীকে জনগণের শোভাযাত্রা পাহারা দেওয়ার কাজে ব্যবহার করা যাবে না।
এ ছাড়া জনসমাবেশে অংশগ্রহণকারীরা যদি কোনো আপত্তিকর অস্ত্রশস্ত্র বহন না করেন, তাহলে বেত্রসজ্জিত পুলিশের মাধ্যমে তাদের পাহারা দেওয়া এবং বিশেষ পরিস্থিতিতে সশস্ত্র পুলিশ ব্যবহার করার কথা ১৪৭ নম্বরে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে প্রবিধান ১৫০-এ বলা হয়েছে, সশস্ত্র পুলিশের কাছে শুধুমাত্র গোলাকার ধরনের গুলি থাকবে, কোনো পুলিশ কর্মকর্তা দাঙ্গা দমনে ব্যবহারের জন্য ব্যক্তিগত বন্দুক বহন করতে পারবেন না।
প্রবিধান ১৫১-এ বলা হয়েছে, দাঙ্গা দমনে গুলি চালানোর জন্য উপস্থিত ম্যাজিস্ট্রেটকে নির্দেশ দিতে হবে এবং সেটির প্রতিবেদন তিনিই দেবেন। তবে তিনি নির্দেশ পালনের বিষয়ে পুলিশের কাজে হস্তক্ষেপ করতে পারবেন না। পাশাপাশি পুলিশ কর্মকর্তারা গুলি চালানোর আগে সতর্কতা অবলম্বন করবেন, যেন অতিরিক্ত ক্ষয়ক্ষতি না হয়।
১৫৪ নম্বরে বলা হয়েছে, গুলি চালানোর আগে সতর্কবাণী উচ্চারণ করতে হবে। তবে, আত্মরক্ষার পরিস্থিতিতে তা সবসময় সম্ভব নাও হতে পারে। প্রবিধান ১৫৫ অনুযায়ী, সাধারণত ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি ছাড়া পুলিশ গুলি চালাতে পারে না। তবে ম্যাজিস্ট্রেট অনুপস্থিত থাকলে, পরিস্থিতি বিবেচনায় পুলিশ কর্মকর্তা গুলি চালানোর নির্দেশ দিতে পারেন, তবে তা ন্যূনতম ক্ষয়ক্ষতির শর্তে হতে হবে।
জনমত জরিপ কী বলছে
বিক্ষোভ মিছিল মোকাবিলা ও বিরোধী মত দমনে মাত্রাতিরিক্ত বলপ্রয়োগসহ পুলিশের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের গুরুতর অভিযোগের বিষয়ে জনমত জরিপ করেছে পুলিশ সংস্কার কমিশন। সেই জনমত জরিপে অংশ নেওয়া ৭১ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ এই মানবাধিকার লঙ্ঘনকে ফৌজদারি অপরাধ বিবেচনা করে সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্যের শাস্তি চেয়েছেন।
অন্যদিকে ৬৮ দশমিক ৮ শতাংশ উত্তরদাতা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার নির্দেশনা অন্তর্ভুক্ত করে প্রতিস্থাপিত প্রমিত পদ্ধতি (এসওপি) অনুসরণকে প্রবিধানভুক্ত করার পক্ষে মত দিয়েছেন। তা ছাড়া মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও অনুগত পুলিশ সদস্যকে উৎসাহিত করতে বার্ষিক কর্মমূল্যায়নে পুরস্কার ও তিরস্কারের ব্যবস্থা রাখার পক্ষে মতামত দিয়েছেন ৬৮ দশমিক ২৭ শতাংশ উত্তরদাতা।
পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে যা উঠে এসেছে
পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বলপ্রয়োগ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের একটি গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু অনাকাঙ্ক্ষিত কাজ। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখা এবং নিজেদের ও জনগণের জানমাল ও সম্পত্তি রক্ষার্থে আইনের বিধান মেনে শক্তি প্রয়োগ করতে হবে। এই ক্ষমতা প্রয়োগ করার সময় শক্তি প্রয়োগের ধাপগুলো যথাযথভাবে অনুসরণ করা আবশ্যক। কিন্তু এই শক্তি প্রয়োগের ধাপসমূহ সম্পর্কে সম্যক ধারণা না থাকলে অনেক সময়ই আইনের ব্যত্যয় পরিলক্ষিত হয় যা অনাকাঙ্ক্ষিত ও অনভিপ্রেত পরিস্থিতির সৃষ্টি করে।
এক্ষেত্রে ১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধি আইন, ১৮৬১ সালের পুলিশ আইন, ১৯৪৩ সালের বেঙ্গল পুলিশ রেগুলেশনস (পিআরবি) যথাযথ অনুসরণ করে এবং সেই সঙ্গে সময়ের বিস্তর ব্যবধানে আধুনিক বিশ্বে উচ্ছৃঙ্খল জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে যেসব প্রযুক্তিগত কৌশল ব্যবহার করা হয়, তা বিবেচনায় নিয়ে পাঁচ ধাপে বলপ্রয়োগের একটি পরিকল্পনার সুপারিশ করেছে কমিশন। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা বাহিনীর বলপ্রয়োগের জন্য নির্ধারিত নীতিমালা অনুসরণ করে এই সুপারিশ সুবিন্যস্ত করা হয়েছে।
ভারতে পুলিশের বলপ্রয়োগের ক্ষমতা কেমন
পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে ফৌজদারি কার্যবিধি (সিআরপিসি), ১৯৭৩ এর ৪৬ ধারা অনুযায়ী, পুলিশ যখন কাউকে গ্রেপ্তার করবে, তখন যথাসম্ভব কম বলপ্রয়োগ করতে হবে। যদি অভিযুক্ত ব্যক্তি পালানোর চেষ্টা করে বা গ্রেপ্তার এড়াতে চায়, তবে পুলিশ প্রয়োজনীয় বলপ্রয়োগ করতে পারে, তবে তার প্রাণনাশ করা যাবে না, যদি না তিনি মৃত্যুদণ্ডযোগ্য বা যাবজ্জীবন শাস্তিযোগ্য অপরাধে অভিযুক্ত হন।
১২৯ থেকে ১৩২ ধারার মধ্যে বলা হয়েছে, দাঙ্গা বা বেআইনি সমাবেশ ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ বলপ্রয়োগের আশ্রয় নিতে পারে, তবে তা হতে হবে ন্যূনতম এবং যুক্তিসঙ্গত। শুধুমাত্র নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে সরকার বা ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি সাপেক্ষে অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ করা যেতে পারে।
ভারতীয় দণ্ডবিধি (আইপিসি), ১৮৬০ এর ৯৬ থেকে ১০৬ নম্বর ধারায় আত্মরক্ষার অধিকার সংরক্ষণের কথা বলা হয়েছে। আর ৩০০ ও ৩০৪ নম্বর ধারা অনুযায়ী, পুলিশের অযৌক্তিক বলপ্রয়োগের ফলে মৃত্যু ঘটলে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। ধারা ১৬৬এ অনুযায়ী পুলিশের বেআইনি বলপ্রয়োগ বা নির্যাতনের বিরুদ্ধে শাস্তির বিধান রয়েছে।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশন এবং বিভিন্ন রাজ্যের মানবাধিকার কমিশন পুলিশের অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের বিরুদ্ধে তদন্ত পরিচালনা করতে পারে। ১৯৯৭ সালে সুপ্রিম কোর্ট ও হাইকোর্টের এক রায়ে (ডিকে বসু বনাম পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য) পুলিশ হেফাজতে বলপ্রয়োগ ও নির্যাতন রোধে নির্দেশনা দেওয়া হয়। ২০০৬ সালে সুপ্রিম কোর্টের আরেক রায়ে পুলিশ সংস্কারের জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল।
কার নির্দেশে অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং অপরাধ বিশেষজ্ঞ তৌহিদুল হক বাংলানিউজকে বলেন, দুই পক্ষই নির্দেশনার ব্যত্যয় ঘটায়। বাধ্য করে দাবি আদায় করা অথবা ভাঙচুর করে দেশের বা রাষ্ট্রীয় সম্পদ নষ্ট করা— এই জায়গায় অনেক আন্দোলনকারী শৃঙ্খলার বিষয়ে প্রশ্নবিদ্ধ। আবার এ ধরনের পরিস্থিতিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গাইডলাইন বা নির্দেশনা বা আইন অনুসরণ করছে না।
তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আইন বা গাইডলাইন অনুসরণ না করার কারণগুলো হলো, পুলিশ সদস্যরা আইনের চেয়ে বেশি তাদের উপরের পদে থাকা কর্মকর্তা বা সরকারের নির্দেশনাকে বেশি গুরুত্ব দেন। পুলিশের এই পেশাদারত্ব তৈরি না হওয়ার দায় এককভাবে পুলিশকে দেওয়া যায় না। পুলিশকে অনেক সময় সরকারের নির্দেশনার কারণে তাদের নির্দেশিকা বহির্ভূত আচরণ করতে হয়। তাই সরকারে যারা থাকেন, তাদের চাইতে হবে, পুলিশ যেন নির্দিষ্ট আইনের মধ্যে থেকে কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে।
পুলিশ কীভাবে বলপ্রয়োগ করবে, আইনে সেই নির্দেশনা আছে জানিয়ে তিনি আরও বলেন, অধিকাংশ জায়গায় দেখা যায়, নির্দেশনা না মেনে মাত্রাতিরিক্ত বলপ্রয়োগ করা হয়। আবার অতীতে বিভিন্ন সময়ে দেখা গেছে, নির্দেশনা মেনে বলপ্রয়োগ করে পুলিশ সফল হয় না, বরং আক্রমণের শিকার হয়। তখন পুলিশকে বাধ্য হয়ে মাত্রাতিরিক্ত বলপ্রয়োগ করে উচ্ছৃঙ্খল জনতাকে ছত্রভঙ্গ করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে হয়।
তিনি বলেন, আন্দোলনকারীরা যদি শিষ্টাচার মেনে আন্দোলন করেন, তখন পুলিশ বলপ্রয়োগ করলে আমরা নানাভাবে সমালোচনা করতে পারি বা তাদের ভুল-ত্রুটিগুলো নিয়ে পর্যালোচনা করা যায়। কিন্তু সেটি সবসময় হয় না। উভয়পক্ষ যখন নিজেদের শিষ্টাচারের ব্যত্যয় ঘটায়, তখন প্রশ্নগুলো আসে।
এই বিশেষজ্ঞ বলেন, জনসাধারণকে এমনভাবে প্রস্তুত করতে হবে, যেখানে তাদের মধ্যে আইন মানার সংস্কৃতি ও মানসিকতা থাকবে। তারা অন্যের অধিকার বা নিরাপত্তার বিঘ্ন ঘটে এমন কোনো আচরণ বা আন্দোলন সংগ্রাম করবেন না। জনগণকে এভাবে প্রস্তুত না করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলপ্রয়োগ করবে না— এমন প্রত্যাশা করলে হবে না।
‘আবার আমাদের এখানে শৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে আন্দোলন করে দাবি আদায় হয়েছে, সেই উদাহরণও আমাদের এখানে একেবারে কম। ফলে যারা আন্দোলন করেন, তারা অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে আন্দোলনের কাঠামো বা কৌশলগুলো নির্ধারণ করে থাকেন। পুলিশ এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তাদের কৌশল নির্ধারণ করে। উভয়পক্ষকেই দায়িত্বশীল হতে হবে, নির্দেশনা-নিয়ম মেনে চলতে হবে। তা না হলে এই অভিযোগ চলতে থাকবে, উভয়পক্ষই নানাভাবে বলপ্রয়োগের চেষ্টা করবে। যেটা আমরা এখন দেখতে পাই। ’
তৌহিদুল হক বলেন, আইনের চেয়েও পুলিশের পেশাদারত্ব বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সেই জায়গা আমরা এখনো তৈরি করতে পারিনি। পুলিশের পদক্ষেপগুলোকে বিতর্কমুক্ত রাখতে গেলে রাজনৈতিক দলের প্রতিশ্রুতি বা অঙ্গীকার বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাদের প্রতিশ্রুতি থাকতে হবে, ক্ষমতায় গেলে তারা পুলিশকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করবে না। এই দুই বিষয় সমন্বয় করা না গেলে পরিস্থিতির পরিবর্তন হবে না।
আনুপাতিক হারে বলপ্রয়োগ, কিন্তু মাপনযন্ত্র তো নেই
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মোহাম্মদ নুরুল হুদা বলেন, কতখানি বলপ্রয়োগ করতে হবে, তা তো আইনে বলা নেই। রেগুলেশনে বলা আছে, আনুপাতিক হারে বলপ্রয়োগ করতে হবে। কিন্তু এই আনুপাতিক হার মাপার তো কোনো যন্ত্র নেই। আমরা কোন কালচারে বাস করি, সেটাও বুঝতে হবে।
তিনি বলেন, আমরা প্রতিক্রিয়াশীল একটি সমাজে বসবাস করি। যেখানে মানুষ চট করে রেগে যায়। তো এই ধরনের মানুষ থেকেই তো পুলিশ বাহিনীতে আসে। আবার তীব্র গরমের মধ্যে তাদের দায়িত্ব পালন করতে হয়। তখন স্বাভাবিকভাবেই তাদের আচরণে প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। আবার আত্মরক্ষার জন্যও আইনে তাদের বলপ্রয়োগের অধিকার দেওয়া আছে।
মোহাম্মদ নুরুল হুদা বলেন, কোনো রাজনৈতিক সরকার যদি চায়, বিরোধীদলের মানুষদের দাঁড়াতেই দেওয়া যাবে না, তখন সরকারি চাকরি করে তো পুলিশ বলতে পারবে না সেটি মানবে না। এখানে অনেক বিষয় দেখার আছে। তাদের নির্দেশনা কে দেয়, প্রশিক্ষণ কেমন, রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ কী চায়, এসব দেখতে হবে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের মতো শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, ভারতেও একই আইন। তবে সেসব দেশের মানুষ আমাদের মতো পুলিশকে আক্রমণ করে না। তারা একটি মাত্রার মধ্যে থাকে। আপনি যে কালচারের মানুষ, সেই কালচারের পুলিশই পাবেন। পুলিশ যেমন মাত্রাতিরিক্ত বলপ্রয়োগ করে তার নৈতিক শক্তি হারিয়ে ফেলেছে, তেমনি পুলিশের ভয় কেটে যাওয়ায় এখন মব তৈরি হচ্ছে, আসামি ছাড়িয়ে নিয়ে চলে যাচ্ছে। সেই জায়গা থেকে ফিরে আসতে সময় লাগবে।
সাবেক এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, গত ১৫ থেকে ২০ বছর ধরে রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে ব্যক্তিগত লাঠিয়াল বাহিনী হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। বিএনপির সময় যেমন পুলিশ ব্যবহার করে আওয়ামী লীগের লোকজনকে তাদের অফিসের বাইরে বের হতে দেওয়া হয়নি, তেমনি আওয়ামী লীগের সময় বিএনপির লোকজনকে তাদের নয়াপল্টনের অফিস থেকে বের হতে দেওয়া হয়নি।
মানুষের আন্দোলন করার অধিকার আছে। কিন্তু সেটি করতে গিয়ে যদি কেউ উচ্ছৃঙ্খল হন, তাহলে তো নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এখন কোন পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করা যাবে, সেটি কীভাবে ঠিক করা হবে— এমন প্রশ্ন রাখলেন সাবেক এই আইজিপি।
বাংলাদেশ সময়: ০১০৮ ঘণ্টা, মার্চ ২৬, ২০২৫
এসসি/আরএইচ/এজে