“আওয়ামী লীগের চিহ্নিত দোসররা বিএনপির সদস্য হতে পারবেন না। তবে একজন ভালো লোক, আওয়ামী লীগের চিহ্নিত দোসর নন, হয়তো আওয়ামী লীগকে সমর্থন করতে পারেন, আমরা জানি না।
গত ১৭ মে দুপুরে চট্টগ্রাম বিভাগীয় বিএনপির উদ্যোগে সদস্য নবায়ন কর্মসূচিতে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেছেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী।
কারা বিএনপির সদস্য হতে পারবেন, কারা পারবেন না—সে বিষয়ে নির্দেশনা দিয়ে বিএনপির এই নেতা বলেন, “কারা বিএনপির নতুন সদস্য হতে যাচ্ছেন, এটার একটি ক্রাইটেরিয়া (মানদণ্ড) আছে। এটার একটি দিকনির্দেশনা আছে। এটা মাথায় রাখতে হবে। সমাজে অগ্রহণযোগ্য ব্যক্তি, চাঁদাবাজ ও দুর্নীতিবাজ হিসেবে পরিচিত, যারা সমাজে অসামাজিক কাজে লিপ্ত, যাদের জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্যতা নেই—এসব লোকদের যথাসম্ভব বাইরে রাখার চেষ্টা করবেন। ”
পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে রাজনীতির মাঠ থেকে ছিটকে পড়া ও অস্তিত্বহীন হয়ে পড়া আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের রাজনীতি করতে হলে বিএনপিতে মিশে যাওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই। আওয়ামী লীগের ‘ক্লিন ইমেজের’ নেতাকর্মীরা সেই সুযোগ পাবেন— আওয়ামী লীগ প্রশ্নে বিএনপি নেতার উপরোক্ত বক্তব্যে সেটাই স্পষ্ট হচ্ছে।
গত বছরের ৫ আগস্ট হাসিনার পতন ও পলায়নের পর আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায় থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যায়ের অধিকাংশ নেতারা হয় কারাগারে, না হয় আত্মগোপনে রয়েছেন। মামলা-হামলার ভয়ে ঘরছাড়া কর্মীরা এখনও এলাকায় ফিরতে পারেননি।
এর মধ্যেই সম্প্রতি আওয়ামী লীগের যাবতীয় কার্যক্রম নিষিদ্ধ হয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত আওয়ামী লীগ এবং এর সব অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের যাবতীয় কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। গত ১২ মে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ থেকে এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। এরপর নির্বাচন কমিশন আওয়ামী লীগের নিবন্ধন স্থগিত করে। এর ফলে আওয়ামী লীগ এবং সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের নেতাকর্মীরা আরও কঠিন বিপর্যয়ের মুখে পড়েছেন।
এই প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগের দোসর নন, আওয়ামী লীগকে সমর্থন করা গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের বিএনপির সদস্য করতে বাধা নেই মন্তব্য করে আওয়ামী লীগের ‘গ্রহণযোগ্য’ সদস্যদের জন্য সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছেন আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের এই নেতার এমন বক্তব্যের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের একটা ভরসার জায়গা তৈরি হয়েছে বলে ধারণা করছেন রাজনীতি বিশ্লেষকরা।
বিএনপির কেন্দ্রীয় আদর্শ বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ। বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতাকে ঐতিহাসিক মুক্তি সংগ্রামের সোনার ফসল হিসেবে মনে করে দলটি। বিএনপির লক্ষ্য—অর্থনৈতিক উন্নয়ন, গণতন্ত্রায়ন, বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে জাতীয় ঐক্য এবং জনগণের মধ্যে স্ব-নির্ভরতার উত্থান ঘটানো। এগুলোর ভিত্তিতে দলটির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান তার ১৯ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন। জাতীয়তাবাদ প্রসঙ্গে জিয়াউর রহমান মনে করতেন, বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও ভৌগোলিক ভূখণ্ডের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে ‘বাংলাদেশি’ পরিচয়, যা প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে আলাদা ও নিজের মধ্যে অনন্য।
অন্যদিকে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক আদর্শের মূল পুঁজি মুক্তিযুদ্ধ ও বাঙালি জাতীয়তাবাদ। তাই অস্তিত্বের হুমকির মুখে পড়া প্রাচীন দলটির নেতাকর্মীরা নিজেদের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার বাঁচাতে যা কিছু যোগসূত্র খুঁজে পেতে পারেন, তা কেবল বিএনপির রাজনৈতিক আদর্শের মধ্যেই বিদ্যমান। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিএনপি ব্যতীত তাদের অন্য কোনো আশ্রয় অবশিষ্ট নেই। ধর্মীয় রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামী, যাদের রাজনৈতিক অবস্থান একাত্তরের বিপরীতে, সেখানে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ঠাঁই স্বভাবতই হবে না। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা জামায়াতে আশ্রয় নিয়ে স্বস্তি বোধও করবেন না।
এর বাইরে আছে অভ্যুত্থান পরবর্তী ছাত্রনেতাদের দ্বারা গঠিত রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি, যাদের অবস্থান সরাসরি আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে। মূলত এনসিপির নেতাকর্মীদের নেতৃত্বে জুলাই অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন সংগঠন ও রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের আন্দোলনের মুখে পড়েই আওয়ামী লীগের যাবতীয় কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে অন্তর্বর্তী সরকার। তাই রাজনীতিতে এনসিপি সরাসরি আওয়ামী লীগের শত্রুপক্ষ বলা চলে। প্রতিকূল পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ ছেড়ে দলটির নেতাকর্মীরা যদি ভিন্ন কোনো দলে ভেড়ার চিন্তা করেন, তবে তাদের জন্য বিএনপি ছাড়া বড় কোনো গন্তব্য নেই।
যদিও আওয়ামী লীগের জন্য সহজ আরেকটি গন্তব্য হতে পারতো তাদের ১৫ বছরের স্বৈরাচারী শাসনের সহযোগী দল জাতীয় পার্টি। কিন্তু সে পার্টি আছে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে, তাদের অস্তিত্বও রয়েছে হুমকির মুখে। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের শরিক জোট ১৪ দলের অন্তর্ভুক্ত দলগুলোর দশাও নাজুক। ১৪ দলীয় জোটভুক্ত ছোট ছোট দলগুলোতে আওয়ামী লীগের মতো ‘পাপের ঘড়া’ পূর্ণ হওয়া দৈত্যাকার দলের নেতাকর্মীরা আশ্রয় নিয়ে কোনো সুবিধাই করতে পারবেন না।
ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর গত প্রায় দশ মাস ধরে কার্যত নিষিদ্ধই ছিল আওয়ামী লীগ। এরমধ্যে কয়েকবার রাজনীতির মাঠে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছে দলটি। গত বছরের ১০ নভেম্বর শহীদ নূর হোসেন দিবসে কর্মসূচি দিয়ে মাঠে নামার চেষ্টা করেছিল, পারেনি। আবার ফেব্রুয়ারিতে হরতাল-অবরোধসহ বিভিন্ন কর্মসূচি ঘোষণা করে। তবে তাদের সেই চেষ্টাও মুখ থুবড়ে পড়ে।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকেই রাজনৈতিক অঙ্গনের বিভিন্ন দিক থেকে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার দাবি ওঠে। কিন্তু বিএনপি কখনো সরাসরি জোরালোভাবে সেই দাবি করেনি। বরং দলটি প্রকাশ্যে বলেছে, আওয়ামী লীগ রাজনীতি করতে পারবে কি পারবে না, সেটা দেশের জনগণের ওপর নির্ভর করবে।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যে কারো রাজনৈতিক দল করা গণতান্ত্রিক অধিকার। কারো সেই অধিকার খর্ব করতে চায় না বিএনপি। পাশাপাশি আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যাতে অংশ নিতে না পারে, সে দাবি উঠেছিল। এ ক্ষেত্রেও বিএনপির দিক থেকে বলা হয়েছিল, আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে কি পারবে না, সেটাও জনগণের ওপর নির্ভর করবে। বিএনপির এই অবস্থান দল হিসেবে আওয়ামী লীগের টিকে থাকার জন্য সহায়ক হিসেবে দেখা দিয়েছিল। বিএনপির এই বক্তব্যে আওয়ামী লীগের জন্য ভরসার জায়গা তৈরি হয়েছিল। বিএনপি নির্বাচনের দাবিতে কর্মসূচি দিয়ে মাঠে নামলে ভবিষ্যতে আওয়ামী লীগ রাজনৈতিকভাবে মাঠে নামার সুযোগ পেতে পারে, এমন আশা করেছিলেন দলটির নেতাকর্মীরা। বিএনপির ওপর ভর করে হলেও আওয়ামী লীগ বাঁচার একটা কৌশল নিতে পারতো, বিশেষ করে মাঠের রাজনীতিতে ফিরে আসতে বিএনপি কতটুকু ছাড় দেবে, তার ওপর নির্ভর করছিলেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। কিন্তু ‘সে আশার গুড়ে বালি’—আওয়ামী লীগের যাবতীয় কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার, দলটির নিবন্ধন স্থগিত করে দিয়েছে নির্বাচন কমিশন।
সরকার পতনের পর দলের সভাপতি শেখ হাসিনা থেকে শুরু করে জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন, ওয়ার্ড পর্যায় পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনগুলোর হাজার হাজার নেতাকর্মীর নামে মামলা হয়েছে। শীর্ষ পর্যায় থেকে শুরু করে জেলা উপজেলা, ইউনিয়ন পর্যায়ের অনেক নেতা, সাবেক মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, এমপি গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন। শেখ হাসিনার নামে এখন পর্যন্ত প্রায় আড়াইশ’ মামলা হয়েছে। শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের অনেকের নামে শতাধিক, অর্ধশতাধিক মামলা রয়েছে। অন্য যেসব নেতাকর্মীর নামে মামলা হয়েছে, তাদের অর্ধিকাংশের নামে একাধিক, কারো কারো নামে চার-পাঁচটি করে মামলা হয়েছে। এখনো অনেকের নামে মামলা দেওয়া হচ্ছে। যেকোনো সময় মামলা হতে পারে, অনেকে এমন আতঙ্কেও রয়েছেন। শুধু মামলা নয়, হামলার আতঙ্কও আছে তাদের মধ্যে। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন স্থানে অনেকেই হামলা ও আক্রমণের শিকার হয়েছেন।
এ পরিস্থিতিতে অনেকেই টিকে থাকার জন্য এবং নিজেকে রক্ষা করার জন্য বিএনপির দিকে ঝোঁকার চেষ্টা করবেন। আর বিএনপি সেই সুযোগ দিলে আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মী বিএনপিতে ঢুকে পড়বেন। এভাবে বিএনপিতে বিলীন হয়ে যেতে পারে আওয়ামী লীগ।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ সম্প্রতি বলেছেন, আওয়ামী লীগের যেসব নেতাকর্মীরা স্বৈরাচারী আচরণ করেননি। সাধারণ মানুষের ওপর জুলুম-নির্যাতনের স্টিমরোলার চালাননি, তারা চাইলে বিএনপি করতে পারবেন। কারণ বিএনপি বিশ্বাস করে জনগণের রাজনীতি করার অধিকার সবার রয়েছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান দিলারা চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, আওয়ামী লীগ তার কৃতকর্মের জন্য এ নিয়ে তিনবার নিষিদ্ধ হয়েছে। এই দল টানা ১৭ বছর দেশ পরিচালনা করে এক ধরনের অন্যায়ের রাজত্ব কায়েম করেছিল। আওয়ামী লীগের বাইরে ভিন্ন মতাদর্শের জনগণকে চরম নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। যেহেতু আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার, সুতরাং যারা এখনো দেশে গা ঢাকা দিয়ে আছে, তারা যদি দেশের জন্য কাজ করতে চায়, তাহলে সুযোগ দেওয়া উচিত। অন্তত যারা ফ্যাসিস্ট আচরণকে সমর্থন করেনি।
ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির সভাপতি আমিনুল হক বাংলানিউজকে বলেন, আওয়ামী লীগ দেশের প্রাচীনতম দল হলেও তারা যখনই ক্ষমতায় গিয়েছে, মানুষের অধিকার হরণ করেছে। অন্যায় নির্যাতন নিষ্পেষণের সর্বোচ্চ পর্যায়ে সীমালঙ্ঘন করেছে। আর সে কারণেই শেখ হাসিনাসহ দলটির শীর্ষ নেতা থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যন্ত নেতাকর্মীরা পালিয়েছেন। তবে আওয়ামী লীগের সাধারণ জনসমর্থন রয়েছে। তাদের মধ্যে যারা নির্যাতনের সঙ্গে সম্পৃক্ত নন, তাদের রাজনীতিতে ফেরার সুযোগ রয়েছে।
টিএ/এমজেএফ