বছরের পর বছর রাজধানীর সেগুনবাগিচাকে কর্মমুখর করে রেখেছিল জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। বোর্ডের কর্মকর্তাদের পাশাপাশি ব্যবসায়ীসহ সংশ্লিষ্টদের আগমনে এখানে ছিল প্রাণচাঞ্চল্য।
এনবিআর চলে যাওয়ার পর এই ভবনে একটি কর অঞ্চল শিফট হয়ে এসেছে। নতুন কার্যক্রম শুরু করেছে কাস্টম মূল্যায়ন ও অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা কমিশনারেট-ঢাকার অফিস। ভবনের অন্যপাশে হিসাব মহানিয়ন্ত্রকের অফিস। অফিসটির সাইনবোর্ডে সামনে এখন বড় করে লেখা ‘হিসাব ভবন’। কিন্তু ছাদের ওপরে এখনো ‘জাতীয় রাজস্ব বোর্ড’র আকাশছোঁয়া সাইনবোর্ড। যদিও তাতে অযত্নের ছাপ।
এনবিআর এখানে থাকতে সেগুনবাগিচার পুরাতন ভবনের চারপাশে বিপুল মানুষের যাতায়াত ছিল। সরকারের রাজস্ব আদায়ের প্রধান কার্যালয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ছাড়াও ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা ভিড় করতেন। আসতেন রাজস্ব সংশ্লিষ্ট পেশাজীবীরা। এলাকাটিতে দামি গাড়ির ভিড় থাকতো। শহীদ নজরুল ইসলাম সরণি থেকে কাকরাইলের রাজমনি সিনেমা হয়ে দুদক কার্যালয় পর্যন্ত ফাইল নিয়ে লোকজনের ছোটাছুটি থাকতো। এর আশপাশের দোকানপাট, বাসাবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং ফুটপাতও থাকতো সরগরম।
সরেজমিনে দেখা যায়, সেগুনবাগিচার চারপাশ এখন অনেকটাই নিষ্প্রাণ। ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে এনবিআর আগারগাঁওয়ে নতুন ভবনে চলে যাওয়ার পর সেগুনবাগিচার ভবনের সামনে হোটেল, রেস্টুরেন্ট, স্টেশনারি দোকান থেকে আবাসিক হোটেল আর আগের মত চলছে না। অনেকে টিকতে না পেরে অন্যত্র চলে গেছেন বা যাচ্ছেন।
পুরাতন এনবিআর ভবনের সামনে জহিরুল হকের ফাস্টফুডের দোকান প্রায় ক্রেতাশূন্য। এক কর্মদিবসের দুপুরে দেখা যায়, সকাল থেকে জনাকয়েক ক্রেতা এসেছেন মাত্র। এখন পুরোই ফাঁকা। দোকানটিতে আগের মতো হরেক স্বাদের ফাস্টফুডের পসরাও নেই। আসবাবগুলোয়ও যেন উদাসীনতার ছাপ। কর্মচারীর সংখ্যা কমেছে। অথচ এনবিআর থাকাকালে এই দোকানটিই ছিল এখানকার সবচেয়ে বড় জাঁকজমকপূর্ণ ফাস্টফুডের দোকান।
জহিরুল হক বাংলানিউজকে বলেন, আগে যে পরিমাণ বিক্রি হতো এখন তার এক-তৃতীয়াংশে নেমেছে। আগে এনবিআরের কর্মকর্তারা আসতেন, এনবিআরে আসা লোকজন আসতেন। এখন আর নেই। কিন্তু ভ্যাট ও বাড়িভাড়া আগের মতই বাড়তি গুনতে হচ্ছে।
একই অবস্থা পাশের হোটেল ও রেস্টুরেন্টগুলোর। এনবিআর স্থানান্তর হওয়ার পর বন্ধপ্রায় আশপাশের আবাসিক হোটেলগুলো। সামনের শাহীন হোটেলে আগের এক-তৃতীয়াংশ লোকও আসে না। শুক্র-শনিবার পুরোই ফাঁকা থাকে। কর্মীরা অলস সময় পার করছেন। এক কর্মদিবসে সরেজমিনে দেখা যায়, হোটেলটির কর্মচারীরা বসে স্মার্টফোনে লুডু খেলছেন।
আবাসিক হোটেলের কর্মচারী মাসুক হোসেন বলেন, আগে এনবিআরে কাজ করতে এসে অনেকে হোটেলে থাকতেন। এখন এনবিআর নেই, তেমন লোকও আসে না। একটি কর অঞ্চল এনবিআর ভবনে এসেছে, এখানে ধারেকাছের লোক আসে। ফলে হোটেল ব্যবসা শেষ। লোকসান দিয়ে চালিয়ে নেওয়া হচ্ছে, বেশিদিন আর লোকসান দিয়েও চালু রাখা যাবে না।
এনবিআর স্থানান্তর হওয়ার পর সবচেয়ে বেশি খারাপ দশা বিভিন্ন গ্যাজেট, ফরম, ভ্যাট-ট্যাক্সের আইনের বই ও অন্যান্য স্টেশনারি বিক্রেতাদের। আনিস নামে একজন বিক্রেতা বলেন, আগে অনেকেই ছিল, এখন আর নেই। এখন আমি একাই আছি, আরেকজন মাঝে মাঝে আসেন। তারপরও সারামাস বিক্রি করে চালান ওঠে না। এনবিআর চলে যাওয়ায় ব্যবসাও শেষ। অন্য ব্যবসা পারি না, তাই ধরে আছি।
এনবিআর চলে যাওয়ার পর বিক্রি কমার পাশাপাশি ক্রেতার ধরন বদলে গেছে পুরাতন ভবনের সামনের ফুটপাতে ভাত বিক্রেতা রমজান আলীর। আগে এনবিআর থাকাকালে অনেক ব্যবসায়ী ও সরকারি কর্মকর্তা গাড়িতে আসতেন। তখন ভোক্তাদের প্রায় সবাই ছিলেন গাড়ির ড্রাইভার, রিকশাচালক ছিলেন দু-চার জন। এখন ৯০ শতাংশই রিকশাচালক। এসব ক্রেতার উপযোগী কম দামে খাবার রাখতে হয়, ব্যবসা কমেছে এক-তৃতীয়াংশে।
রমজান আলী জানান, স্বাধীনতাযুদ্ধের পর থেকে এই ফুটপাতে ব্যবসা করছি। আগে অন্যের দোকানে চাকরি করতাম, পরে নিজেই মালিক হয়েছি। মাঝে এখানে অনেক ভালো ব্যবসা হয়েছে। নিজের বেশ কয়েকজন কর্মচারী ছিল, এখন আছে মাত্র একজন। এখন নিজের পাশাপাশি একজন কর্মচারী কাজ করি, কোনোমতে চলে।
এনবিআর স্থানান্তরের প্রভাব কাকরাইল সংলগ্ন সৈয়দ নজরুল ইসলাম সরণির মার্কেটগুলোতেও পড়েছে। এসব মার্কেটের বিভিন্ন দোকান ও শোরুমে কথা বলে এমনটা জানা গেছে। সরকারের ৮৫ শতাংশ অর্থের জোগানদাতা প্রতিষ্ঠান এনবিআর। এই প্রতিষ্ঠানের কর্মী, ব্যবসায়ীসহ অন্যান্য অংশীজনরা এসব বাজারের ক্রেতা। এনবিআর স্থানান্তর হওয়ার ফলে সেই গ্রাহকরা নেই এসব মার্কেটে।
সেগুনবাগিচা থেকে এনবিআর স্থানান্তরের পর পুরাতন স্থাপনাটির চেহারার জানান দেয় এর ফটকের পাশে খাঁচার মধ্যে শিকারী ধরার জন্য ওঁৎ পেতে থাকা বাঘের ভাস্কর্য। বলা হয়, এনবিআরের কর্মীদের রাজস্ব আদায়ে বাঘের মত ক্ষিপ্র হতে হবে। কিন্তু সেগুনবাগিচায় সেই বাঘের ভাস্কর্যে জীর্ণতা, জমেছে শ্যাওলা আর গুল্মলতা।
২০২৩ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি সেগুনবাগিচার পুরাতন ভবন থেকে আগারগাঁওয়ে ৬০ ফুট সড়কের মোড়ে ৪১২ কোটি টাকা ব্যয়ে নবনির্মিত ভবনে স্থানান্তর হয় এনবিআর। ভবনটি ১২তলা। ২০তলা হওয়ার কথা থাকলেও নানা জটিলতায় ১২ তলাতেই থেমে যায়। এই ভবনে রাজস্ব বোর্ডের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের কর্মকর্তা ছাড়াও দুটি আপিলাত ট্রাইব্যুনাল, কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেল (সিআইসি), দুটি লার্জ ট্যাক্স পেয়ার ইউনিটের অফিস স্থানান্তর করা হয়। ভবনের সামনে থেকে দেখলে মনে হবে তিনভাগে বিভক্ত।
১৯৭২ সালে রাষ্ট্রপতির ৭৬ নম্বর অধ্যাদেশের মাধ্যমে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) জন্ম। ৫৩ বছরে সংস্থাটির রাজস্ব আহরণ বেড়েছে প্রায় দেড় হাজার গুণ। যে সংস্থাটির মাধ্যমে জাতীয় বাজেটের ৮৫ শতাংশ অর্থ আসে। ২০২৩ সাল পর্যন্ত সেই প্রতিষ্ঠানেরই কোনো নিজস্ব ভবন ছিল না। সেগুনবাগিচায় এনবিআরের পূরণে এই ভবনে অনেক পুরোনো।
পাকিস্তান আমলে এখানে ছিল সচিবালয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও এখানে কিছুদিন কাজ চলে সচিবালয়ের। এরপর সচিবালয় চলে যায় বর্তমান ঠিকানায়। আর সেগুনবাগিচার ওই ভবনে ঠিকানা হয়েছিল এনবিআরের।
জেডএ/এইচএ