ঢাকা: চলমান রাজনৈতিক সংকটসহ বিভিন্ন সংকট কাটিয়ে উঠতে চলতি বছরের মধ্যেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বলছে বলছে বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো। এর জন্য দ্রুত সময়ের মধ্যে নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা বর্তমান সমস্যা সমাধানের একমাত্র পথ বলে এই দলগুলোর নেতারা মনে করছেন।
চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা জানান, গত বছর ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর গঠিত এই অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান দায়িত্ব ছিল অন্তর্বর্তী কাজগুলো করা। এই অন্তর্বর্তী কাজগুলোর মধ্যে প্রধান কাজ হলো একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচন ও তার জন্য যেগুলো জরুরি সে কাজগুলো করা এবং জুলাই-আগস্টের হত্যাকাণ্ডের বিচার করা। এগুলোকেই শুধু অগ্রাধিকার না দিয়ে এই অন্তর্বর্তী সরকার আরও অনেক কাজে হাত দিয়েছে। এমন কিছু কাজে সরকার হাত দিয়েছে যেটা এই অন্তর্বর্তী সরকারের কাজ বা দায়িত্ব না। এর ফলে দেশের মানুষের মনে বিভিন্ন ধরনের সংশয়, অবিশ্বাস, সন্দেহ তৈরি হয়েছে। এর থেকে দেশের মধ্যে অস্থিরতা ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে। এখন এই সংকট কাটিয়ে উঠতে চলতি বছরের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা এবং তার জন্য দ্রুত একটি রোডম্যাপ ঘোষণা করা একমাত্র সমাধান বলে তারা মনে করেন।
এদিকে কিছু দিন ধরে বিভিন্ন ইস্যুতে সরকারের ওপর বড় ধরনের চাপ তৈরি হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের যে উপদেষ্টারা একটি নতুন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে জড়িত তাদের অব্যাহতি দেওয়ার দাবি জানিয়েছে বিএনপি। একইসঙ্গে সরকারের ভাবমূর্তি রক্ষার্থে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমানকেও অব্যাহতি দেওয়ার দাবি জানিয়েছে দলটি ৷ গত ২২ মে সংবাদ সম্মেলন করে দলটির পক্ষ থেকে এ দাবি জানানো হয়।
আবার যে উপদেষ্টারা বিএনপির মুখপাত্র হিসেবে কাজ করছেন, তাদের পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হবে হলে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) পক্ষ থেকে বলা হয়েছে। গত ২১ মে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) মূল ফটকে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ সমাবেশে এনসিপির মুখ্য সংগঠক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেছেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি গুঁড়িয়ে দিতে পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ ও অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ কাজ করছেন। আইন মন্ত্রণালয় গুঁড়িয়ে দিতে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল কাজ করছেন।
এদিকে বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র পদে শপথ পড়ানোর দাবিতে টানা আট দিন ধরে আন্দোলন চলে। অন্তর্বর্তী সরকারকে ৪৮ ঘণ্টা আল্টিমেটাম দিয়ে ২২ মে অন্দোলন স্থগিত করেন ইশরাক। এদিন ইশরাককে মেয়র ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশনের দেওয়া গেজেটের বৈধতা নিয়ে এবং তাকে শপথ পড়ানো থেকে বিরত থাকার নির্দেশনা চেয়ে করা রিট খারিজ করে দেন হাইকোর্ট।
একই দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং ছাত্রদল নেতা শাহরিয়ার আলম সাম্য হত্যার বিচার ও হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে গত কয়েকদিন ধরে চলে আসা অবস্থান কর্মসূচি স্থগিত করেছে ছাত্রদল। তবে দ্রুত দাবি আদায় না হলে আগামীতে কঠোর কর্মসূচি ঘোষণার হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে। শাহবাগে কর্মসূচি স্থগিত ও এই হুঁশিয়ারি দেন ছাত্রদলের সভাপতি মো. রাকিবুল ইসলাম রাকিব।
এর কয়েকদিন আগে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা টানা আন্দোলনের নামে। এক পর্যায়ে সরকার দাবি মেনে নেওয়ায় তারা আন্দোলন প্রত্যাহার করে। বেশ কয়েকদিন ধরে চলে আসা এসব আন্দোলনকে কেন্দ্র করে রাজধানীতে ব্যাপক জনদুর্ভোগও তৈরি হয়।
গত কয়েক দিনের এইসব ঘটনার প্রেক্ষাপটে ২২ মে রাতে শোনা যায়, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস পদত্যাগ করার কথা ভাবছেন। এদিন সকালে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে তিনি তার এই ভাবনার কথা জানান। পরে রাতে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামও তার সঙ্গে সাক্ষাতের পর গণমাধ্যমকে ড. ইউনূসের পদত্যাগের ভাবনার কথা জানান।
সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, পদত্যাগের কারণ হিসেবে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, রাজনৈতিক দলগুলোর নানামুখী চাপ, অনৈক্য, নানা ইস্যুতে তার বাসভবন ঘিরে আন্দোলন, তার বিরুদ্ধে দেশ বিক্রির অভিযোগ ইত্যাদি কারণে তিনি আর দায়িত্ব পালন করতে চান না। উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে তিনি এ বিষয়গুলো তুলে ধরেছেন।
যদিও শুক্রবার (২৩ মে) প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক মন্ত্রণালয়) ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব ফেসবুকে এক পোস্ট দিয়ে জানান, প্রধান উপদেষ্টা পদত্যাগ করবেন না। পরে অবশ্য ওই পোস্ট নিজের ব্যক্তিগত মত বলে এ বিষয়ে সংবাদ না করার অনুরোধ জানান তিনি।
তবে পরপর এ সমস্ত ঘটনার মধ্য দিয়ে এটা স্পষ্ট হচ্ছে যে সামনের দিনে সংকটগুলো আরও জটিল হবে। এ সমস্যা সমাধানের জন্য দ্রুত নির্বাচনের ব্যবস্থা করা জরুরি বলে বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা মনে করছেন।
দলগুলোর নেতারা বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকার তাদের রুটিন দায়িত্বের বাইরে গিয়ে অনেক বড় কার্যক্রমে হাত দিয়েছে। এ সরকারের পক্ষ থেকে ব্যাপক সংস্কার কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে। সংবিধান নতুন করে লেখার কথা বলছে। এগুলো না করে শুধু নির্বাচনের জন্য যে সংস্কারগুলোর প্রয়োজনীয়তা রয়েছে সেগুলো আগে করা, সেইসাথে নির্বাচন দেওয়ার জন্য সুনির্দিষ্ট তারিখ ও রোডম্যাপ ঘোষণা করা দরকার ছিল।
ওই নেতারা আরও বলেন, রাখাইনে মানবিক করিডোর দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। আবার চট্টগ্রাম বন্দর পরিচালনার জন্য বিদেশিদের নিয়োগ দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। এই ধরনের একটা অনির্বাচিত সরকারের কাজ এগুলো নয়।
বামপন্থী নেতাদের মতে, অন্তর্বর্তী সরকার দ্রুত নির্বাচনের দিকে না গিয়ে অনেক বেশি লোড নিয়ে ফেলেছে। এ সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর যে মব সন্ত্রাসগুলো হয়েছে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি। আইন-শৃঙ্খলা স্বাভাবিক রাখার বিষয় সরকারের প্রাথমিক ও জরুরি কাজের মধ্যে পড়ে। এসব কারণে বিদেশি শক্তিগুলো বিভিন্ন সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করবে। সব ক্ষেত্রে সংস্কার, সংবিধান পুনর্লিখন, বন্দর, করিডোর এসব কাজে না গিয়ে দ্রুত অর্থাৎ চলতি বছরের মধ্যেই নির্বাচন দেওয়ার ব্যবস্থা করাই এখন সরকারের প্রধান কাজ হওয়া উচিত।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বাংলানিউজকে বলেন, গণঅভ্যুত্থানের পর যে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হয়েছে এ সরকারের প্রধান কাজ ছিল অন্তর্বর্তী যে দায়িত্ব সেই দায়িত্ব পালন করা। সেটা হলো হত্যাকাণ্ডের বিচার করা এবং ভালো একটি নির্বাচনের জন্য যে সংস্কারগুলো দরকার সেগুলো করা। সেটা না করে সরকার অনেক কাজে হাত দিয়েছে। সংবিধান পুনর্লিখনের কথা বলছে। বন্দর পরিচালনা বিদেশিদের হাতে দেওয়া, রাখাইনের করিডোর দেওয়ার কথা, বিভিন্ন কথা বলা হচ্ছে। এর ফলে আধিপত্যবাদী, সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো বিভিন্ন সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করবে। পাশাপাশি এসব কারণে মানুষের মনে নানা প্রশ্ন, সংশয়, সন্দেহ, অবিশ্বাসের জন্ম দিচ্ছে। এখন আর দেরি না করে সরকারের উচিত এই বছরের মধ্যেই নির্বাচনের জন্য সুনির্দিষ্ট তারিখ দিয়ে দ্রুত রোডম্যাপ ঘোষণা করা।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ জাসদের সাধারণ সম্পাদক নাজমুল হক প্রধান বাংলানিউজকে বলেন, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার অনেক লোড কাঁধে নিচ্ছে যা তাদের নেওয়ার কথা ছিল না। জুলাই-আগস্টের হত্যাকাণ্ডের বিচার হোক এটা মানুষ চায়। কিন্তু সরকার বিনিয়োগ থেকে শুরু করে সংস্কারসহ সব ধরনের কাজ হাতে নিয়েছে। অথচ এত লোড নেওয়ার কথা ছিল না। আবার এ সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর যে মব সন্ত্রাসগুলো হয়েছে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি। বন্দর ব্যবস্থাপনা বিদেশিদের হাতে দেওয়া, করিডোর দেওয়াসহ বিভিন্ন কাজে হাত দিয়েছে। ক্ষমতায় পাঁচ বছর থাকতে চায় এরকম কথাও শোনা যাচ্ছে। এসব না করে দ্রুত নির্বাচন এবং এ বছর ডিসেম্বরের মধ্যেই সেটা হতে হবে। এটাই বর্তমান সংকট থেকে উত্তরণের একমাত্র উপায়।
এসকে/এইচএ