জুলাই অভ্যুত্থানের সময় আহত ব্যক্তিদের হাসপাতাল ও চিকিৎসাকেন্দ্র থেকে অথবা জরুরি চিকিৎসার জন্য যাওয়ার পথে নির্বিচারে গ্রেপ্তার করেন পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা।
এমনকি অ্যাম্বুলেন্স থামিয়ে তল্লাশি চালানো হয়েছে এবং চিকিৎসা নেওয়ার পর তাদের খুঁজে বের করে আটক করা হয়েছে।
গত বছরের জুলাই আন্দোলনের নৃশংস ঘটনাগুলোর সঙ্গে এসব ঘটনাও তুলে ধরা হয়েছে শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দেওয়া আনুষ্ঠানিক অভিযোগপত্রে। যে মামলায় আসামি করা হয়েছে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং পুলিশের তৎকালীন মহাপরিদর্শক চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনকে। যদিও চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন ইতোমধ্যে রাজসাক্ষী হয়েছেন।
ফরমাল চার্জ মোট ১৩৫ পৃষ্ঠার। এই ফরমাল চার্জ আদালতে তুলে ধরেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম, প্রসিকিউটর মো. আব্দুস সোবহান তরফদার, মো. মিজানুল ইসলাম। যেটি সরাসরি সম্প্রচার করা হয়।
জাতিসংঘের প্রতিবেদন থেকে তুলে ধরে নথিতে বলা হয়, এসব ঘটনা বিক্ষোভে অংশগ্রহণকারী আন্দোলনকারী ব্যক্তিদের প্রতি নিরাপত্তা বাহিনীর সহিংস দমননীতির শিকার হওয়ার ইঙ্গিত বহন করত। এই নির্যাতন এমন নিষ্ঠুর ছিল যে, জুলাইয়ের শেষের দিকে, এক শ্রমিককে পুলিশ গুলি করার পর চিকিৎসার জন্য তাকে একটি মেডিকেল সেন্টারে নেওয়া হয়। পরে পুলিশ সেই হাসপাতাল থেকে তার ঠিকানা সংগ্রহ করে তাকে গ্রেপ্তার করে। তিনদিন ধরে মিন্টু রোডের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) কার্যালয়ে তাকে আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়। তাকে বৈদ্যুতিক শক দেওয়া হয়, তার পুরনো আঘাতের ওপর মারধর করা হয় এবং তার আঙুল ভেঙে দেওয়া হয়।
জুলাইয়ের মাঝামাঝি সময়ে ঢাকার একটি হাসপাতালে প্রায় এক ডজন ইউনিফর্মধারী ও সাদা পোশাকের নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা তল্লাশি চালান এবং হাসপাতালের কর্মীদের ভয়ভীতি দেখান। জুলাইয়ের শেষের দিকে ডিবি ও অন্যান্য পুলিশ সদস্যরা ঢাকার আরেকটি হাসপাতালে অভিযান চালিয়ে সব রোগীর আঙুলের ছাপ নেন এবং বেশ কয়েকজন রোগী ও হাসপাতালের কর্মীকে গ্রেপ্তার করেন। তারা রোগীদের অকথ্য ভাষায় গালাগাল করেন এবং বলেন যে, আহত বিক্ষোভকারীদের মরাই উচিত। এই বর্ণনাটিও জাতিসংঘের প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে।
আগস্টের প্রথম দিকে বিজিবির একটি ছোট দল ঢাকার একটি হাসপাতালে জোরপূর্বক প্রবেশ করে চিকিৎসকদের জিজ্ঞাসাবাদ করে এবং নিবিড় পরিচর্যা ইউনিটে (আইসিইউ) তল্লাশি চালিয়ে আহত বিক্ষোভকারীদের খুঁজে বের করার চেষ্টা করে। প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্যমতে, গ্রেপ্তার হওয়ার ভয়ে অনেক আহত বিক্ষোভকারীরা প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নিতে ভয় পেতেন অথবা চিকিৎসা শেষ করার আগেই হাসপাতাল ছেড়ে পালাতে বাধ্য হতেন। ফলে তাদের সীমাহীন দুর্ভোগের সম্মুখীন হতে হতো।
এসব ঘটনাসহ জুলাই আন্দোলনের পুরো ঘটনায় যৌথ দায় হিসেবে শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ নিবন্ধন (১২৭ নং) করা হয়। ওই অভিযোগের প্রথম তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন তদন্ত সংস্থার উপপরিচালক মো. জানে আলম খান। পরে তদন্ত করেন উপপরিচালক মো. আলমগীর (পিপিএম)। সার্বিক সহযোগিতা করেছিলেন বিশেষ তদন্তকারী কর্মকর্তা তানভীর হাসান জোহা। এ ঘটনায় তদন্ত কর্মকর্তা মো. আলমগীর ১২ মে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। পরবর্তীতে ৩১ মে সম্পূরক অভিযোগ দেওয়া হয়। ১ জুন আনুষ্ঠানিক অভিযোগ উপস্থাপন করা হয়।
গত ১০ জুলাই শেখ হাসিনার মামলায় অভিযোগ গঠন করা হয়। এ মামলায় আগামী ৩ আগস্ট সূচনা বক্তব্য এবং ৪ আগস্ট প্রথম সাক্ষ্যগ্রহণের তারিখ ধার্য করেছেন ট্রাইব্যুনাল-১।
৫ আগস্টের পর ট্রাইব্যুনালে গত ২৫ জুন পর্যন্ত ২৭টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ২০৬ জনকে আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৭৩ জনকে। কারাগারে মৃত্যু হয়েছে এক আসামির।
ইএস/এমজেএফ