শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকেই রাষ্ট্র কাঠামো সংস্কারের প্রশ্নটি জাতীয় আলোচনার অন্যতম প্রধান ইস্যু হয়ে দাঁড়ায়। জনগণের প্রত্যাশা ছিল— অতীতের দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার ও অগণতান্ত্রিক প্রথা ভেঙে একটি নতুন গণতান্ত্রিক ও জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে।
তবে এসব কমিশনের পক্ষ থেকে একের পর এক বাস্তবায়নযোগ্য সুপারিশ এলেও, সেগুলো কার্যকর করতে দৃশ্যমান অগ্রগতি পাওয়া যাচ্ছে না। দিন গড়াচ্ছে, কিন্তু প্রস্তাবনাগুলো এখনও ফাইলবন্দি থেকে যাচ্ছে, ফলে প্রশ্ন উঠছে— বাস্তবায়নযোগ্য সুপারিশগুলো কার্যকর করতে এত বিলম্ব কেন?
প্রথম ধাপে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন, সংবিধান সংস্কার কমিশন, পুলিশ সংস্কার কমিশন, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন এবং দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশনসহ ছয়টি কমিশন গঠিত হয়। পরবর্তী সময়ে গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন, স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন, স্বাস্থ্যখাত সংস্কার কমিশন, শ্রম সংস্কার কমিশন নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনসহ আরও পাঁচটি কমিশন যুক্ত হয়ে গঠন করা হয় মোট ১১টি কমিশন। এসব কমিশনের মাধ্যমে ইতোমধ্যেই বিপুল পরিমাণ সুপারিশ উঠে আসে। এর মধ্যে সংবিধান সংস্কার কমিশন বাদে বাকি ১০টি কমিশনের মোট ১২১টি সুপারিশকে আশু বাস্তবায়নযোগ্য হিসেবে চিহ্নিত করেছিল অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ। সর্বশেষ ১৪ আগস্ট আরও ২৪৬টি সুপারিশকে একইভাবে চিহ্নিত করা হয়। ফলে এখন পর্যন্ত মোট ৩৬৭টি সুপারিশকে আশু বাস্তবায়নযোগ্য হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে, যার মধ্যে বিভিন্ন কমিশনের ৩৭টি সুপারিশ ইতোমধ্যেই বাস্তবায়িত হয়েছে।
তবে প্রায় নয় মাস পার হলেও কমিশনগুলোর সুপারিশ বাস্তবায়নের চিত্র আশাব্যঞ্জক নয়। এই ধীরগতি স্বাভাবিকভাবেই জনমনে প্রশ্ন তৈরি করেছে। বিশেষত, যেসব সুপারিশ ‘আশু বাস্তবায়নযোগ্য’ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিল এবং কোনো ধরনের আইনি জটিলতা ছাড়াই নির্বাহী আদেশে কার্যকর করা সম্ভব ছিল, সেগুলোও কেন আটকে আছে, তা নিয়েও প্রশ্ন অনেকের?
সংস্কারের এই মহৎ উদ্যোগ কি তবে আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রতা ও রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবে গতি হারিয়েছে? আগের অভিজ্ঞতায় কোনো রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা এবারও আশার আলো দেখছেন না। তারা বলছেন, এ সরকার জনগণের ভোটে নির্বাচিত নয়। প্রশাসনে বড় পরিবর্তন আনতে হলে তাদেরকে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামতের ওপর নির্ভর করতে হবে। এছাড়া দৃশ্যমান সংস্কারের জন্য যে সময়ের প্রয়োজন সেটাও এ সরকার পাবে বলে মনে করছেন না তারা।
সরকার সংশ্লিষ্টদের পক্ষ থেকে জানা গেছে, সংস্কার একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। অন্তর্বর্তী সরকার আপাতত যেসব সুপারিশ দ্রুত বাস্তবায়ন করা সম্ভব, সেগুলো নিয়েই কাজ করছে। কিছু সুপারিশ নির্বাহী আদেশে বাস্তবায়ন করা হলেও গত ৫ আগস্টের পর থেকে গৃহীত যেকোনো সিদ্ধান্ত চূড়ান্তভাবে আগামী সংসদের অনুমোদন পেতে হবে। রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং অধিকাংশ রাজনৈতিক নেতাদেরও একই মত। তবে জামায়াতে ইসলামী বলছে, সংস্কার ছাড়া আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের পক্ষে নয় তারা। বিএনপির অবস্থান পুরো উল্টো। তারা বলছে, সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ঐকমত্য ছাড়া কোনো সংস্কারই বাস্তবায়নের পক্ষে নয় তারা। বরং আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনক্ষণ ঠিক রেখে আগে যতটুকু সম্ভব, সেটাই করার দাবি তাদের।
এ প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, ‘সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। এই সরকারের এখতিয়ারে যতটুকু সংস্কার সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের জন্য করা দরকার, সেটা তারা করবে। করছেও। এর বাইরে যা আছে, এর দায়িত্ব তো নির্বাচিত সরকারের। জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে সংসদে গিয়েই বাকি সংস্কার হওয়া উচিত। ’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সাইফুল আলম চৌধুরী এ প্রসঙ্গে বাংলানিউজকে বলেন, ‘সংস্কারের নামে ১১টা কমিশন গঠন করা হয়েছিল। সংস্কারটা কার জন্য? জনগণের জন্যই তো। যেসব সংস্কার অধ্যাদেশ জারি করে অথবা নির্বাহী আদেশেই করে ফেলা সম্ভব ছিল, সেগুলোতে কেন এত বিলম্ব হচ্ছে? এতদিন তো লাগার কথা ছিল না। তারা যেহেতু করতে পারেননি, নির্বাচিত সরকার এসে করবে। এটা তো চলমান প্রক্রিয়া। দেশের প্রয়োজনে সংস্কার চলতে থাকবে। ’
এদিকে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ জানিয়েছেন, সংস্কার কমিশনগুলোর সব সুপারিশ অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেই বাস্তবায়ন করতে হবে, এমন নয়। কিছু সুপারিশ বর্তমান সরকার গ্রহণ করছে, কিছু রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে বাস্তবায়িত হবে, বাকিগুলো ভবিষ্যতের জন্য দিকনির্দেশনা হিসেবে থাকবে।
সরকারের বাস্তবায়িত ৩৭টি সুপারিশের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন: আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন সংশোধন এবং নির্বাচন পর্যবেক্ষণ ও গণমাধ্যম নীতিমালা (স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক) পর্যবেক্ষণ ও সাংবাদিক নীতিমালা (সংশোধন) এবং হলফনামার খসড়া তৈরি করা।
জনপ্রশাসন: পাসপোর্ট প্রদানে পুলিশ ভেরিফিকেশন বাতিল এবং সরকারি দপ্তরে গণশুনানি। পাসপোর্ট প্রদানে পুলিশ ভেরিফিকেশন বাতিলের সিদ্ধান্তটি মূলত নাগরিকদের ভোগান্তি কমানোর জন্য নেওয়া হয়েছে। এখন থেকে পাসপোর্ট করার জন্য আর পুলিশি যাচাই-বাছাইয়ের প্রয়োজন হবে না। এর পরিবর্তে, আবেদনকারীর জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) বা জন্ম নিবন্ধনের (বার্থ সার্টিফিকেট) তথ্যের ভিত্তিতেই পাসপোর্ট ইস্যু করা হবে।
অন্যদিকে, সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে গণশুনানির আয়োজন করার সিদ্ধান্তটিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর মাধ্যমে সরকারি কাজের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা যাবে। জনগণ তাদের সমস্যা ও অভিযোগ সরাসরি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের জানাতে পারবে এবং দ্রুত তার সমাধান পাওয়া যাবে। এটি সরকারি সেবাকে জনগণের আরও কাছে নিয়ে আসবে। জনপ্রশাসনের আশু বাস্তবায়নযোগ্য অন্য সুপারিশগুলোর মধ্যে রয়েছে- মহাসড়কের পেট্রল পাম্পগুলোয় স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট সংক্রান্ত, মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটকে ডায়নামিক করা, কলেজ ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটি গঠন, কমিউনিটি স্বাস্থ্যকেন্দ্র পরিচালনা, তথ্য অধিকার আইন, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো পুনর্গঠন এবং ডিজিটাল রূপান্তর ও ই-সেবা।
দুর্নীতি দমন: দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশনের তদন্তপূর্ব আবশ্যিক অনুসন্ধান-ব্যবস্থা বিলোপ, দুদক আইনের ধারা ৩২-এর ক বিলোপ, উচ্চমাত্রার দুর্নীতি তদন্তে বিভিন্ন এজেন্সির সমন্বয়ে আলাদা টাস্কফোর্স গঠন, সিএজি ও আইএমইডির সঙ্গে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর।
বিচার বিভাগ: বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের সুপ্রিমকোর্টের বিচারক নিয়োগ সংক্রান্ত সুপারিশ, আদালতে ‘ইনফরমেশন ডেস্ক’ স্থাপন, আদালতে নারী ও শিশুর জন্য স্বতন্ত্র স্থান, অনলাইনে সরকারি সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ, আইনজীবীর বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলায় অন্যপক্ষে অন্য আইনজীবীর নিয়োগে প্রতিবন্ধকতা দূরীকরণের বিষয়ে সুপ্রিমকোর্ট কর্তৃক সার্কুলার জারি, আইনগত সহায়তা কার্যক্রমের সঙ্গে মধ্যস্থতা কার্যক্রমকে সংযুক্তকরণ, দেওয়ানি মামলা নিষ্পত্তি ত্বরান্বিত করার জন্য দেওয়ানি কার্যবিধি সংশোধন এবং ফৌজদারি মামলার নিষ্পত্তি ত্বরান্বিত করার জন্য ফৌজদারি কার্যবিধি সংশোধন।
শ্রম খাত: শ্রম খাত সংস্কার কমিশনের ‘যুবক’ শব্দের একটি একক সংজ্ঞা নির্ধারণ করে তাদের দক্ষতা উন্নয়নের ব্যবস্থা নেওয়া, জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ ও বিভিন্ন পর্যায়ের ক্রীড়া সংস্থায় নারী প্রতিনিধির সংখ্যা বৃদ্ধি নিশ্চিত করতে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ আইন, ২০১৮ সংশোধন করা, প্রবাসী শ্রমিকদের জন্য বাধ্যতামূলক জীবন বীমা প্রচলন, যারা আত্মীয়স্বজনের পাঠানো ভিসায় বিদেশ যান তাদের জন্য নিজে ভিসা প্রক্রিয়াকরণের সুযোগ রাখা ও অবৈধভাবে কোনো এজেন্সির নাম ব্যবহার বন্ধ করা, অভিবাসী নারী শ্রমিকদের নিজ নামে ব্যাংক হিসাব খোলা নিশ্চিত করা, প্রাক-অভিবাসন পর্যায়ে তাদের অধিকার ও সুরক্ষা সম্পর্কিত তথ্য জানানো, ভাষা ও কর্মসংক্রান্ত প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করা।
এছাড়া আরও রয়েছে দুর্ঘটনায় নিহত ও আহত শ্রমিকদের সুচিকিৎসা, হেলথ কার্ড এবং বিনামূল্যে চিকিৎসার সুবিধা, ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করা এবং একটি কেন্দ্রীভূত তথ্যভাণ্ডার তৈরি করা, শিল্পবিরোধ নিষ্পত্তিতে ত্রিপক্ষীয় ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট কমিটি গঠনের ব্যবস্থা, গোপনীয়ভাবে অভিযোগ দায়েরের জন্য কার্যকর অনলাইন ও অফলাইন অভিযোগ নিষ্পত্তি ব্যবস্থা গঠন করা, শ্রম আদালতের সংখ্যা বাড়ানো এবং উপযুক্ত এলাকায় সার্কিট কোর্ট গঠনের ব্যবস্থা নেওয়া, শিশুর বিকাশে ঝুঁকিপূর্ণ কাজের তালিকা নিয়মিত হালনাগাদ করা, প্রাতিষ্ঠানিক-অপ্রাতিষ্ঠানিক ভেদে সব ধরনের শ্রমিক যেন শ্রম কল্যাণ কেন্দ্র থেকে স্বাস্থ্যসেবা পান তা নিশ্চিত করা, কাজ ও ব্যক্তিগত জীবনের ভারসাম্য রক্ষায় যৌক্তিকভাবে ছুটি নির্ধারণ করা, কারখানা পরিদর্শন প্রতিবেদন পরিদর্শনকারী প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে প্রকাশের ব্যবস্থা করা, ঝুঁকিপূর্ণ কাজ চিহ্নিত করে সুরক্ষা ও ঝুঁকি ভাতা নিশ্চিত করা, রোগব্যাধি ও দুর্ঘটনার হালনাগাদ প্রতিবেদন প্রতি তিন বা ছয় মাস অন্তর কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শনের ওয়েবসাইটে প্রকাশ, রাত্রিকালীন কাজের জন্য নারী শ্রমিকদের নিরাপত্তা বিধান ও নিয়োগকারীর পক্ষ থেকে পরিবহণ নিশ্চিত করা এবং ট্যানারি শিল্পে স্বাস্থ্য ও রাসায়নিক ঝুঁকি বিবেচনায় বিশেষ প্রশিক্ষিত শ্রম পরিদর্শক নিয়োগসহ এই খাতে সর্বাধিক সুপারিশ বাস্তবায়িত হয়েছে।
নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন: সাক্ষী সুরক্ষা ও অপরাধের শিকার ব্যক্তির সুরক্ষা নিশ্চিতকল্পে আইনি কাঠামো তৈরি করা এবং পুলিশ, আইনজীবী, বিচারকসহ সংশ্লিষ্ট সব সেবাপ্রদানকারীকে জেন্ডার সংবেদনশীলতা বিষয়ক প্রশিক্ষণের আয়োজন করা। নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের নির্বাচন পর্যবেক্ষণ ও গণমাধ্যম নীতিমালা (স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক) পর্যবেক্ষণ ও সাংবাদিক নীতিমালা (সংশোধন) এবং হলফনামার খসড়া তৈরি করা।
যেখানে পরিবর্তনের চাকা ঘুরছে
অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু সুপারিশ সম্পূর্ণ বাস্তবায়িত না হলেও সেগুলোর বাস্তবায়নের পথে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে- স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠন: পুলিশ সংস্কার কমিশনের সবচেয়ে যুগান্তকারী সুপারিশ ছিল একটি স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠন, যা বছরের পর বছর ধরে রাজনৈতিক কারণে আটকে ছিল। অবশেষে এটি আলোর মুখ দেখতে যাচ্ছে। বিগত সরকারগুলোর আমলে পুলিশের বিরুদ্ধে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহৃত হওয়ার এবং নিয়োগ-বদলিতে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ ছিল। ৫ আগস্টের পট পরিবর্তনের পর পুলিশ বাহিনীর ভেতর ও বাইরে থেকে সংস্কারের জোরালো দাবি ওঠে। গত ২৮ জুলাই জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর সভায় ‘স্বাধীন পুলিশ কমিশন’ গঠনের প্রস্তাবে সর্বদলীয় ঐকমত্য হয়। এই কমিশন একটি সংবিধিবদ্ধ সংস্থা হিসেবে গঠিত হচ্ছে। আপিল বিভাগের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এর চেয়ারম্যান হবেন। সদস্য হিসেবে সংসদ, বিচার বিভাগ, প্রশাসন ও মানবাধিকার ক্ষেত্রের প্রতিনিধিরা থাকবেন, যার মধ্যে ন্যূনতম দুজন নারী সদস্য হবেন।
এই কমিশন পুলিশের নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতির নীতিমালা প্রণয়ন করবে। এছাড়া, পুলিশের বিরুদ্ধে নাগরিকদের অভিযোগ তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত দেবে এবং পুলিশের কাজে বেআইনি রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ থেকে সুরক্ষা প্রদান করবে। বর্তমানে প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরের নির্দেশে আইন মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যে কমিশনের খসড়া আইন তৈরির কাজ শুরু করেছে।
‘না’ ভোটের আংশিক প্রত্যাবর্তন: নির্বাচন কমিশন ইতোমধ্যেই জানিয়েছে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যদি কোনো আসনে মাত্র একজন বৈধ প্রার্থী থাকে, তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হবেন না। সেক্ষেত্রে ব্যালট পেপারে ওই প্রার্থীর প্রতীকের পাশাপাশি ‘না’ ভোটের বিকল্প থাকবে। যদিও এটি কমিশনের সার্বজনীন ‘না’ ভোটের সুপারিশের সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন নয়, তবে এটিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমের স্বায়ত্তশাসন: গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের সুপারিশ মেনে সরকার বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) ও বাংলাদেশ বেতারকে সম্পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য একটি কমিটি গঠনের কথাও জানানো হয়েছে। যদিও এর চূড়ান্ত বাস্তবায়ন সময়সাপেক্ষ, এই সিদ্ধান্তকে একটি বড় অগ্রগতি হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।
যেখানে সংস্কার আটকে আছে
সংস্কার কমিশনের দেওয়া আশু বাস্তবায়নযোগ্য সুপারিশগুলোর মধ্যে এমন অনেকগুলোই ছিল যা অন্তর্বর্তী সরকার তুলনামূলকভাবে সহজেই বাস্তবায়ন করতে পারতো, কিন্তু বিভিন্ন কারণে সেগুলো এখনও বাস্তবায়িত হয়নি। এই সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের জন্য বড় ধরনের আইনগত পরিবর্তন বা রাজনৈতিক ঐকমত্যের প্রয়োজন ছিল না, বরং প্রশাসনিক সদিচ্ছা ও একটি নির্বাহী আদেশই যথেষ্ট ছিল।
জনপ্রশাসন সংস্কার
‘সরকারি কর্মচারী আইন, ২০১৮’ এর বিতর্কিত ৪১(১) ধারা: ‘সরকারি কর্মচারী আইন, ২০১৮’ এর বিতর্কিত ৪১(১) ধারাটি এখনো বাতিল করা হয়নি। এই ধারাটি দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত সরকারি কর্মকর্তাদের গ্রেফতারে সুরক্ষা দেয়। শক্তিশালী আমলাতান্ত্রিক প্রতিরোধের কারণেই এই সুপারিশটি বাস্তবায়িত হচ্ছে না বলে মনে করা হয়। ধারাটি অনুযায়ী, সরকারি কর্মচারীকে গ্রেফতারের পূর্বে সরকারের অনুমতি প্রয়োজন, যা দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) বা অন্যান্য সংস্থার দুর্নীতিবিরোধী কার্যক্রমের জন্য একটি বড় বাধা হিসেবে দেখা হচ্ছে।
চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করা: চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের ক্ষেত্রে অনেক সময় মেধার চেয়ে রাজনৈতিক বা ব্যক্তিগত সম্পর্ককে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়, যা বৈষম্য সৃষ্টি করে। একটি সরকারি পরিপত্র বা নির্বাহী আদেশের মাধ্যমেই সকল মন্ত্রণালয় ও বিভাগে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বন্ধ করা সম্ভব ছিল। এর জন্য আইন পাসের প্রয়োজন নেই। তবে প্রশাসনে থাকা প্রভাবশালী কর্মকর্তা বা উপদেষ্টাদের স্বার্থ রক্ষা এবং কিছু ক্ষেত্রে বিশেষায়িত পদে লোক ধরে রাখার অজুহাতে তা কার্যকর করা হয়নি। এই নিয়োগ বন্ধ করার ক্ষেত্রে আমলাতন্ত্রের ভেতর থেকে এক ধরনের প্রতিরোধ থাকতে পারে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টরা।
জ্যেষ্ঠ সচিব পদ বিলোপ করা: জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের এই সুপারিশের মূল কারণ হলো, বর্তমানে বিদ্যমান জ্যেষ্ঠ সচিব পদটি মূলত কিছু কর্মকর্তাকে খুশি করার জন্য সৃষ্টি করা হয়েছিল বলে মনে করা হয়। এই পদটি সৃষ্টি হয়েছিল ২০১২ সালে, এবং এর মাধ্যমে গ্রেড-১ ভুক্ত কর্মকর্তাদের একটি বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়েছিল। এই পদটি একটি প্রশাসনিক পদ যা নির্বাহী আদেশেই তৈরি হয়েছিল। সুতরাং, আরেকটি নির্বাহী আদেশ বা রুলস অব বিজনেস সংশোধন করেই তা বিলুপ্ত করা সম্ভব। তবে এটি আমলাতন্ত্রের সর্বোচ্চ পদগুলোর একটি এবং এর সঙ্গে মর্যাদা ও সুযোগ-সুবিধা জড়িত। ফলে এই পদ বিলোপ করলে প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তাদের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি হতে পারে, এই আশঙ্কায় সরকার হয়তো পদক্ষেপ নিতে পারেনি।
সরকারি কর্মকর্তাদের সম্পদের হিসাব প্রকাশ বাধ্যতামূলক করা: বর্তমানে, সরকারি কর্মচারীদের প্রতি পাঁচ বছর পর পর সম্পদের হিসাব দাখিল করার নিয়ম রয়েছে, তবে এটি সংশোধনের মাধ্যমে সময়সীমা উঠিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে, যাতে সরকার যে কোনো সময় হিসাব তলব করতে পারে। সরকারি কর্মকর্তাদের সম্পদের হিসাব জনগণের জন্য উন্মুক্ত করার বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি, তবে এ নিয়ে আলোচনা চলছে। সরকারি চাকরি আইন অনুযায়ী কর্মকর্তাদের সম্পদের হিসাব দেওয়ার বিধান থাকলেও তা কখনোই কার্যকরভাবে প্রয়োগ করা হয়নি। একটি সুস্পষ্ট সরকারি নির্দেশনার মাধ্যমে সকল কর্মকর্তাকে প্রতি বছর সম্পদের হিসাব জমা দিতে এবং তা ওয়েবসাইটের মাধ্যমে প্রকাশ করতে বাধ্য করা যেত।
পুলিশ প্রশাসন সংস্কার কমিশন
পুলিশের জন্য একটি স্বাধীন ‘পুলিশ অভিযোগ কমিশন’ গঠন: পুলিশের কাজের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার জন্য এই ধরনের একটি কমিশন গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছিল। পুলিশের কার্যক্রমের উপর নজরদারি বাড়ানো এবং জনগণের অধিকার সুরক্ষার ওপর জোর দেওয়ার জন্যই এমন সুপারিশ ছিল কমিশনের। একটি অধ্যাদেশের মাধ্যমে বা প্রাথমিকভাবে একটি নির্বাহী আদেশে এই কমিশন গঠন করা যেত। এর ফলে পুলিশের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ তদন্তে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা যেত। তবে এখনো তা সম্ভব হয়নি। পুলিশ বাহিনীর ভেতর থেকে সম্ভাব্য বিরোধিতা একটি বড় কারণ। একটি স্বাধীন কমিশন পুলিশকে সরাসরি জবাবদিহিতার আওতায় আনবে, যা বাহিনীর অনেকেই মেনে নিতে চাইবেন না।
পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ না দেওয়া: কমিশনের সুপারিশে প্রস্তাব করা হয়েছিল- পুলিশের মহাপরিদর্শক পদে চুক্তিভিত্তিক কোনো নিয়োগ দেওয়া যাবে না। এতে পুলিশের শীর্ষমহলে জট বাঁধে এবং অসন্তোষ দেখা দেয়। জনপ্রশাসনের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বন্ধ করার মতোই এটা একটি নীতিগত সিদ্ধান্ত যা সহজেই বাস্তবায়নযোগ্য ছিল। তবে এখনো তা আশার আলো দেখেনি।
স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন
উপজেলা পরিষদে নির্বাচিত চেয়ারম্যানদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা: এই সুপারিশে বলা হয়েছিল- উপজেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী হিসেবে চেয়ারম্যানের ক্ষমতা আরও সুনির্দিষ্ট ও শক্তিশালী করা উচিত, যাতে তিনি পরিষদের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেন। সুপ্রিম কোর্টের রায় অনুযায়ী, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ (ইউএনও) অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তাদের উপজেলার নির্বাচিত চেয়ারম্যানের অধীনে কাজ করার কথা। একটি সরকারি প্রজ্ঞাপন জারি করে এই কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা যেত। এটা বাস্তবায়নের প্রধান বাধা হলো প্রশাসন ক্যাডারের তীব্র বিরোধিতা। আমলারা কোনোভাবেই নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের অধীনে কাজ করতে চান না। এই আমলাতান্ত্রিক প্রতিরোধের কারণেই সরকার এই সিদ্ধান্ত নিতে বিলম্ব করছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন
গণমাধ্যম সংস্কার: রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমের স্বায়ত্তশাসনের সিদ্ধান্ত হলেও, স্বাধীন সাংবাদিকতার পথে সবচেয়ে বড় বাধা হিসেবে বিবেচিত সাইবার নিরাপত্তা আইনের নিপীড়নমূলক ধারাগুলো বাতিল বা মৌলিকভাবে সংশোধন করার সুপারিশে কোনো অগ্রগতি নেই। মত প্রকাশের স্বাধীনতা সংক্রান্ত আইনগুলো সংশোধন একটি সংবেদনশীল বিষয় এবং এর জন্য গভীর আইনি পর্যালোচনার প্রয়োজন বলে সরকার সময় নিচ্ছে। অন্যদিকে, রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমের ওপর থেকে নিয়ন্ত্রণ ছাড়তে কোনো সরকারই সহজে রাজি হয় না, যা এখানেও একটি বড় বাধা হিসেবে কাজ করছে।
বাস্তবায়নযোগ্য সুপারিশগুলো বাস্তবায়িত হলো না কেন?
১০টি কমিশনের দেওয়া আশু বাস্তবায়নযোগ্য সুপারিশগুলো এখনো বাস্তবায়িত না হওয়ার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ঐকমত্য ও ম্যান্ডেটের সীমাবদ্ধতাকে মূল বাধা হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। অন্তর্বর্তী সরকার একটি অনির্বাচিত সরকার। সংবিধান সংশোধন, ক্ষমতার ভারসাম্য পরিবর্তন বা প্রশাসনের কাঠামোগত সংস্কারের মতো সুদূরপ্রসারী ও স্থায়ী সিদ্ধান্ত নেওয়ার রাজনৈতিক ম্যান্ডেট তাদের আছে কি না, তা নিয়ে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ব্যাপক বিতর্ক রয়েছে। তারা মনে করে, এই ধরনের স্থায়ী সংস্কারের দায়িত্ব একটি নির্বাচিত সংসদের।
আমলাতান্ত্রিক প্রতিরোধ ও প্রাতিষ্ঠানিক জড়তাও আরেকটি কারণ। যেকোনো ব্যবস্থার সুবিধাভোগীরা পরিবর্তনকে সহজে গ্রহণ করে না। জনপ্রশাসন, পুলিশ বা মাঠ প্রশাসনের সংস্কারের অনেক প্রস্তাবই বিদ্যমান কর্মকর্তাদের ক্ষমতা, সুযোগ-সুবিধা ও কর্তৃত্ব হ্রাস করবে। ফলে ভেতর থেকেই এক ধরনের নীরব কিন্তু শক্তিশালী প্রতিরোধ তৈরি হয়েছে, যা সংস্কারের গতিকে ধীর করে দিয়েছে। এর মধ্যে অনেক আইনি ও পদ্ধতিগত জটিলতাও রয়েছে। অনেক গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ বাস্তবায়নের জন্য বিদ্যমান আইন সংশোধন বা নতুন আইন প্রণয়ন করতে হবে। আইন প্রণয়নের প্রক্রিয়াটি খসড়া তৈরি, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মতামত গ্রহণ, জনমত যাচাই এবং অধ্যাদেশ জারির মতো কয়েকটি ধাপে বিভক্ত, যা অত্যন্ত সময়সাপেক্ষ এবং জটিল।
বিশ্লেষকরা বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকারকে একসঙ্গে একাধিক জরুরি সংকট মোকাবিলা করতে হচ্ছে। নিত্যপণ্যের লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ, ভঙ্গুর অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখা এবং সর্বোপরি একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের আয়োজন করা তাদের প্রধান কাজ। এই জরুরি সংকট মোকাবিলার চাপে দীর্ঘমেয়াদী ও কাঠামোগত সংস্কারের বিষয়টি স্বাভাবিকভাবেই অগ্রাধিকারের তালিকায় পেছনে পড়ে গেছে। তাছাড়া ৩৬৭টি সুপারিশ বাস্তবায়নের জন্য একটি সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা বা রোডম্যাপের অভাবও পরিলক্ষিত হয়েছে। কোন মন্ত্রণালয় কোন সুপারিশ কীভাবে এবং কত সময়ের মধ্যে বাস্তবায়ন করবে, তার একটি স্পষ্ট নির্দেশনা না থাকায় পুরো প্রক্রিয়াটিই ধীর ও কিছুটা অগোছালো হয়ে পড়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
তারা এও বলেন, সংস্কার কমিশনগুলোর সুপারিশ ছিল একটি আধুনিক, গণতান্ত্রিক ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশের পথে যাত্রার এক বিস্তারিত নীলনকশা। এটি কোনো কল্পনাবিলাস ছিল না, বরং দেশের সেরা কিছু বিশেষজ্ঞের বাস্তবসম্মত এক রূপরেখা। ৩৭টি সুপারিশের বাস্তবায়ন নিঃসন্দেহে প্রশংসার যোগ্য, কিন্তু বিশাল প্রত্যাশার তুলনায় তা সিন্ধুতে বিন্দুর মতোই।
এসবিডব্লিউ/এমজে